ক্যাম্পে গর্ভবতী ৫৬৩ নারী

(পর্ব ২৭)

জুন মাসে বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য ঢাকা উন্মুক্ত করার পর ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতা ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউন প্রতিবেদনটি পাঠান, যা ছাপা হয় ১০ অক্টোবরের পত্রিকায়। এখানে উল্লেখ করা যায়, সাংবাদিকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিধিনিষেধ উঠিয়ে নিলেও নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা সিডনি সেনবার্গকে ঢাকা আসার পরপরই আবার বহিষ্কার করা হয়। বিশেষ সংবাদদাতা ব্রাউন ঢাকা থেকে যে প্রতিবেদনটি পাঠান, তাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য স্থান পেয়েছে। যেমন, পাকিস্তান সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে বিদেশিদের সহায়তায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা ছিল লোক দেখান এবং যা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়।

এ ছাড়া এই প্রতিবেদনে খুব বেদনাদায়ক একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে কেমন করে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে যার ফলে শত শত মা-বোন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আতঙ্কাবস্থা, আশা থেকে নিরাশায় পরিণত’ [Horrors of East Pakistan turning hope into despair]

সংক্ষেপে প্রতিবেদনটি এমন
পর্ব পাকিস্তানে আতঙ্কিত অবস্থার সব লক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এটি এখানকার জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে। বেশির ভাগ বিদেশি যারা সাহায্য করতে এসেছিল তারা হতাশার সীমান্তে অবস্থান করছে। তারা দেখলেন, শরণার্থীদের ভারতমুখী স্রোতকে উল্টোমুখী করা সুদূরপরাহত। বেশির ভাগ বিদেশি সরকার মনে করে, শরণার্থী সমস্যাই উপমহাদেশে যুদ্ধাবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। নয়াদিল্লি সরকার আভাষ দিয়েছে, শরণার্থী সমস্যা সমাধানে অবশেষে তারা চাপ প্রয়োগ করবে। পাকিস্তানও তড়িঘড়ি করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে, কয়েক সপ্তাহ যাবৎ সীমন্ত এলাকায় সৈন্য সমাবেশের খবর ভারত পেয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে এই জাতি বিবাদে জড়িত। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন জরুরিভাবে এই দুর্দশার অবসান এবং যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কাজ করছে। ডজন খানিক দেশের কারিগরি ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ দল পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করছে। জাতিসংঘের ত্রাণ দলে ৭৫ জন কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে আছে। কীভাবে শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে—এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ আছে, তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, পরিবেশ তৈরি করতে হলে ভীতিকর অবস্থার নিরসন করতে হবে এবং মানুষের দুর্দশার অবসান করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানকে তাদের নীতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছে, যার মধ্যে আছে—

l লাখ লাখ রাজনৈতিক ও অমুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি পুলিশ ও মিলিটারির ভীতিকর আচরণ বন্ধ করা।
l পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিশ্বস্ত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
l পূর্ব পাকিস্তানের বন্য, সাইক্লোন ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সহানুভূতিশীল এবং বিশ্বস্ত আচরণ।

সবাই এ বিষয়ে একমত যে, এর কোনটিতেই কোনো বাস্তব অগ্রগতি হয়নি।

একটি গল্প ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় এবং নানা সূত্র থেকেও এটি শোনা গেছে, ৫৬৩ জন নারী যাদের গত মার্চ ও এপ্রিলে সেনারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে, যারা আর্মি ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় আছে তাদের ছাড়া হচ্ছে না। কারণ তারা এখন গর্ভবতী এবং তাদের গর্ভপাত করান সম্ভব হচ্ছে না। একজন সরকারি মুখপাত্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে জানা গেছে, একাধিক বাঙালি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে সেনা ক্যাম্পে গর্ভপাতের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

একজন বাঙালি কৃষক গোপনে এই সাংবাদিককে বলেন, ‘১১ এপ্রিল আমাকে সেনারা উঠিয়ে নেয়, পরে ছেড়ে দেয়, আমি বাড়ি ফিরে দেখি আমার বোন বাড়ি নেই। আমার প্রতিবেশীর কন্যাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং একটি হিন্দু পরিবারের কন্যাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পরে মে মাসে তারা আমার বোন ও প্রতিবেশীর কন্যাকে মুক্তি দেয়। তবে হিন্দু মেয়েটির এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা এখন অন্তঃসত্ত্বা। তারা যেখানে ছিল সেখানে আরও ২০০–৩০০ মেয়ে আছে। তাদের একই কাজ ছিল, সেনাদের মনোরঞ্জন করা। সেই কৃষক আরও বলেন, ‘আমার বোন জানে না, কোথায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।’

গত মাসে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, বিদেশি কূটনীতিকরা যার প্রশংসা করেন। তারা এখন বলছেন, সেটি ছিল লোক দেখানো। সরকার এখনো রাজনীতিক, আইনজ্ঞ, শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করছে। অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ কূটনীতিক মনে করেন, শেখ মুজিবই বাংলাদেশের একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। তাঁকে মুক্তি দিয়েই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু তিনি বর্তমানে কারাগারে বন্দী আছেন এবং সম্ভবত গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ড পেতে যাচ্ছেন। তার পরিবার বিনা অপরাধে সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী।

কেন্দ্রগুলোতে কেউ যাচ্ছে না
একজন ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মী সরকারের সাধারণ ক্ষমা সম্পর্কে বলেন, ‘সরকারের প্রতিষ্ঠিত ৬০টি শরণার্থীশিবিরে তারা আর পরিদর্শনে যাচ্ছেন না, কারণ এখন পর্যন্ত সেই সব কেন্দ্রে কেউ আসেনি এবং ভবিষ্যতেও আসবেন বলে মনে করেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক জায়গায় সরকারের কিছু লোক নিজেরাই শরণার্থীর ভূমিকায় ছিল, যাতে দেখে মনে হয় সেখানে কিছু একটি হচ্ছে।’

আরেকজন ত্রাণ কর্মী বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমাদের খবর দিল, একটি ক্যাম্পে ২০০০ শরণার্থী এসেছে। আমরা সেখানে গেলাম এবং বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে আসল, হয়তো ২০০ মত লোক ফিরে এসেছে।’ (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]