স্বপ্নজাল

সুধা ও নবীন, ভিন্ন ধরনের মানুষ দুজন, অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে দুজনার। বিয়ে হওয়ার চার মাসের মাথায় স্বামী চলে এল আমেরিকায়। বিয়ের পর স্বামীর সান্নিধ্য পায়নি খুব একটা। এখানে আসার আগে কত কী-ই না কল্পনার জাল বুনেছে সুধা। স্বামীর কাছে যাবে ভালোবাসবে। হাতে হাত, চোখে চোখ রেখে ভালোবাসায় ডুবে যাবে।
ম্যানহাটনের রাস্তায় কপোত-কপোতী হয়ে ঘুরে বেড়াবে। সুধার কাছে ভালোবাসার অর্থ ছিল বিশাল। ভাবনার জাল ছিল আকাশ সমান। কত কী যে করবে, এ যেন সুধাকে মগ্ন করে রেখেছে এক ভালো লাগার মায়াজালে। সুধার দেশের নদীর পার, এখানে রিভারসাইড। কত তফাত! তবু সুধার এখানে আসার আগে আমেরিকা মানে অন্য ধারণা ছিল। বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা বোঝার আগেই দুজন আলাদা হয়ে আমেরিকা চলে আসতে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে হয়নি। মা-বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছে। স্বামী আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। খুব অল্প সময়ে সুধাকে দেখে বিয়ে করেছে। একবার কি দুবার দেখা হওয়ার পরই বিয়ে। খুব একটা ভালো লাগা বা ভালোবাসার সুযোগ হয়নি সুধার।
সুধা ছিল প্রেমের বিয়েতে বিশ্বাসী। মা-বাবার পীড়াপীড়িতে তা আর হলো না। সুধার বিয়ে হয়ে গেল এক অজানা মানুষের সঙ্গে। আজ সুধার ভিসা হয়েছে আমেরিকা আসার। বিয়ের পর প্রথম স্বামীর কাছে আসছে। হুটহাট করে বিয়ে হওয়ায় সুধা যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে স্বামীকে চাইতে পারেনি। আজ যেন সে সুযোগ আসছে স্বামীকে মনের মাধুরী দিয়ে ভালোবাসার। আমেরিকায় একসঙ্গে পথচলার অঙ্গীকার সুধার। মধুময় কল্পনার জাল প্রতি দিন সুধার মনে উঁকি দেয়। এসব কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সময় চলে এসেছে।
আমেরিকা থেকে স্বামী টিকিট পাঠিয়েছে। সুধা স্বামীর কাছে যাবে। শত জনমের স্বপ্ন সুধার পূর্ণ হতে চলেছে। মায়াময় স্বপ্ন যেন সুধাকে ঘিরে রেখেছিল। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে দুটো চোখ লেগে গিয়েছিল। স্বপ্নে তার স্বামী আসে। সুধা ভাবে, ‘তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছ? আমার স্বপ্ন ভুবনে আমার আঙিনায়। আর দূরে থেকো না।’ সুধার আহ্বানে নবীনের উত্তর, ‘হ্যাঁ গো তুমিই তো আমার সকল ভাবনা।’ সুধার কপালে নবীন এঁকে দেয় আলতো করে চুমু। সুধা ভাবে, এ কোন আলোতে আমায় চমকে দিলে।
প্লেনে পাশের সিটে ছিল এক যুবক। তাঁর সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টা প্লেনে একসঙ্গে বসা। আলাপচারিতা করতে গিয়ে বললাম প্রথম যাচ্ছি স্বামীর কাছে। সে যুবক কথাটা শুনে বলতে দ্বিধা করেনি। তাহলে তো আপনার আনন্দের শেষ নেই। সুধার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাচ্ছিল যুবকটি। স্বপ্নাবিষ্ট সুধার দিকে সে তাকিয়েছিল অপলক। হঠাৎ যুবকটি দাঁড়িয়ে তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করতে গিয়ে সুধাকে জাগিয়ে দিল। হঠাৎ সজাগ হয়ে সুধা কিছুক্ষণ বুঝতেই পারছিল না সে কোথায়। ধাতস্থ হতে সময় লাগল কিছুটা।
উড়োজাহাজ বেলজিয়াম বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করে তেল নিচ্ছিল, তখন যুবকটি এসে সুধাকে বলল, ‘চলুন বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।’ সুধা যুবকটির সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে টের পেল যুবকটি দেখতে যেমন, তেমনি কথায়ও বেশ। উড়োজাহাজে চড়েও আলাপ চলল তাদের। যুবকের প্রশ্ন, ‘আচ্ছা কত দিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে?’
-বিয়ে হয়েছে এক বছর। আমার স্বামী আমার সঙ্গে দেশে চার মাস ছিল। বুঝে ওঠার আগেই চলে এল। তাই এখনো ভয়-সংশয় সবই কাজ করছে।
আলাপের পর যুবকটি কোনো কিছুই না ভেবে সুধাকে টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলল, ‘কোনো অসুবিধা হলে আমাকে কল করবেন।’
সুধা অবাক হলো, ‘কেন সুধার বিপদ হবে!’ সুধা তো তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর কাছে যাচ্ছে তাহলে কিসের বিপদ হবে। সুধা কিছু উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের কাগজটা হ্যান্ড ব্যাগে রেখে দিল। প্লেন ল্যান্ড করলে বের হওয়ার সময় সেই যুবক সুধাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। কোথায় গেল সুধা, তা সে জানে না বা জানতেও চায়নি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পাশাপাশি বসে আলাপ, একসঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি—সব মিলিয়ে যুবকটি চলে যাওয়ার পর সুধা কিসের যেন শূন্যতা অনুভব করছিল।
বিমানবন্দরে সুধার স্বামী ফুল হাতে অপেক্ষায় ছিল। সুধাকে দেখে মানুষের ভিড় পেরিয়ে এগিয়ে এল তারপর দুজন রওনা হলো গাড়ি করে গন্তব্যের উদ্দেশে। সুধা চুপ করে তার স্বামীর কথা শুনছিল। কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার। বাসায় এসে সুধা ঘরে ঢুকল। এভাবে বেশ কিছু মাস পার হলো। সুধা আর কল করেনি ওই যুবককে। এদিকে সুধা ও নবীনের মধ্যে খুট খুট লেগেই থাকে। সুধা যেন কিছুতেই বুঝতে পারছিল না নবীনকে।
নবীন সুধার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিল। তাদের মতে মিলছিল না কিছুতেই। নবীনের ইগো সমস্যা সুধাকে কষ্ট দিত। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে প্রথম ঘুরতে যায় ম্যানহাটন হাডসন নদীর পারে। খুব ভালো লাগে সুধার। নদীর পারে বসে সে ভাবে, এই কী সেই স্বপ্নের দেশ? সুধা চেয়েছিল হাতে হাত রেখে হেঁটে যাবে নদীর পার ধরে। নদীর পারে দাঁড়িয়ে সুধা ভাবছিল, সত্যিই কি সে স্বপ্ন তার আজ পূর্ণ হলো। কই না তো। স্বপ্ন তো স্বপ্নই আছে। নবীনের তো এসব করার সময় নেই। ব্যস্ত জীবন। দিনে কাজে যায় রাতে বাড়ি ফেরে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সুধা ধরতেই সেই যুবকের কণ্ঠ শুনল, ‘হ্যালো আপনি কেমন আছেন? ফোন নম্বর দিলাম একবার ফোন করলেন না? সবাই ভালো আছেন?’
সুধা চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। যে জীবন সুধা পার করছে, তা তো তো সে চায়নি। জীবনের কী মানে হলো, যদি মোমবাতির আলোয় একদিন ডিনার করা না হয়। শাড়ি পরলে একদিনও নবীন বলেনি, ‘তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। তুমি শুধু আমায় ভালোবাসবে।’ যাক এসব ভাবনা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। যুবকটি বলে, ‘বরাবরের মতো আমিই তো কথা বলছি। আপনার কথা তো শোনা হলো না। চুপ কেন? প্লিজ কিছু বলেন।’
সুধা বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারছে না যে, ‘আমি স্বামীর ঘরে একদমই ভালো নেই। যে হাত দিয়ে আদর করবে, সে হাত দিয়েই মারধর করে। যে স্বপ্ন মনের গহিনে, তার হদিস কেউ রাখে না।’ স্বামীর কাছে সুধা একজন শুধু চাকর। তার মতের বা ভালোবাসার কোনো দাম নেই তার কাছে। সব সহ্য করে সুধা জীবনকে চালিয়ে নিচ্ছে। যুবকটা ফোনে বলতে লাগল, ‘কেন জানি আমার মন বলছে আপনি খুব একটা ভালো নেই। তাই ফোন দিলাম। যদি মনে করেন আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমাকে ফোন করবেন। ফোনটা রাখার আগে একটা সত্য কথা বলি আপনি দেখতে অনেক মিষ্টি।’
সুধা অবাক হয়ে যায় কথাটা শুনে। এমন কথাই তো সুধা তার স্বামীর কাছে শুনতে চায়। ফোনটা রেখে সুধা আবারও কল্পনায় স্বামীকে বসিয়ে কত কথা আর ভাবনার জাল বুনে গেল। এভাবেই হয়তো সুধা একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কেউ জানবে না সুধার কষ্টের আহাজারি।