ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু

(পর্ব ২৯)

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়, যা চলে ১৩ দিন। এই যুদ্ধ শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ভারত ও বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
যুদ্ধ শুরু হয় যখন পাকিস্তান বাহিনী ভারতে ১১টি বিমান ঘাঁটিতে একযোগে বিমান আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রেডিওতে একটি ভাষণ দেন, যা নিউইয়র্ক টাইমস–এ ‘মিসেস গান্ধীর বিবৃতি’ [Mrs. Gandhi’s statement] শিরোনামে ছাপে ৪ ডিসেম্বর।
সংক্ষেপে বিবৃতিটি ছিল—
দেশের ও মানুষের এক গভীর সংকটের মুহূর্তে আপনাদের সামনে বলছি। কয়েক ঘণ্টা আগে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটের কিছু পরে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে।
পাকিস্তানের বিমানবাহিনী আমাদের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অভান্তিপুর, উত্তেরলাই, যোধপুর, আমবালা এবং আগ্রা বিমানঘাঁটিতে সহসা আক্রমণ চালিয়েছে। তাদের স্থল বাহিনী সুলেমনাখি, খেমখেরান, পুন্‌চ এবং অন্যান্য স্থানে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে গোলা নিক্ষেপ করেছে।
গত মার্চ থেকে আমরা সবচেয়ে ভারী বোঝা বহন করছি, শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বিশ্বকে অনুরোধ করার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়েছি, যাতে তারা একটি জাতিকে শুধু গণতন্ত্রের জন্য ভোট দেওয়ার অপরাধে ধ্বংস করতে না পারে। কিন্তু বিশ্ব মূল কারণকে অস্বীকার করেছে। আজ বাংলা দেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, দায়িত্ব বর্তেছে আমার ওপর, আমার সরকারের ওপর এবং ভারতের জনগণের ওপর। যুদ্ধে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর বিকল্প নেই। সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং সম্ভাব্য সব ঘটনার জন্য আমরা প্রস্তুত।
যুদ্ধের শুরুতেই ঢাকায় বিমান আক্রমণের দৃশ্য নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি রিপোর্ট করে, যা কিছুটা বিলম্বে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ ছাপা হয়। সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা যুদ্ধ দেখছে এবং অপেক্ষা করছে’ [Dacca watching the war and waiting]

সংক্ষেপে সংবাদটি এমন
রাত সাড়ে ৮টায় শহর বাতি শূন্য। কিছুই চলছে না। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হওয়া কারফিউয়ের ফলে রাস্তা জনশূন্য, পর্দা টানা। জানালা আড়াল করে মোমবাতি জ্বলছে। চারিদিক একেবারে শব্দহীন। কোথাও থেমে থেমে একটি কুকুর ডাকছে। আলো ঢেকে একটা জিপ বা ট্রাক চলছে। মেঘ চন্দ্রপ্রভাকে আড়াল করেছে, তারাগুলিও ঔজ্জ্বল্যহীন। কাকেরা সারা দিন মাথার ওপর পাকিস্তান আর ভারতের বিমানের গর্জন শুনে এখন ক্লান্ত। রাত ৮টা ৩২ মিনিটে ঢাকার অদূরে তিনটি বোমার শব্দ, সাইরেন বাজল, তবে কোন বিমানের শব্দ পাওয়া গেল না। রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে অনেক দূরে জেটের শব্দ শোনা গেল, কোন গোলা বর্ষণ হয়নি। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের পরিবার, ঠিকাদার, ত্রাণ দলের লোকজন, আমেরিকান, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান ও অন্যান্য দেশের লোকজনে ঠাসা, যারা তাড়াতাড়ি স্যুটকেস গুছিয়ে এনেছে। তাদের বলা হয়েছে, জাতিসংঘের একটি বিমান আমেরিকান সি-১৩০ হারকিউলিকস, যা সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ব্যাংকক থেকে আসছে।
প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক মোমের আলোতে টাইপরাইটারে টাইপ করে চলেছেন। সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের সংবাদ পাঠাতে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। অনেকেই রেডিও নব ঘুরিয়ে নতুন সংবাদ জানার চেষ্টার চালাচ্ছেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারের কর্মকর্তাদের হোটেলে এনে রাখা হয়েছে, ৩ বা ৪ জন প্রতিটি কক্ষে রাখা হয়েছে। এদের নয়জন সহকর্মী ভারতীয় বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। তারা বলেন, রাত ৩টায় বিমান আক্রমণ শুরু হয় এবং মধ্যদুপুর পর্যন্ত চলেছে।
সরকারি তথ্য বিভাগ দাবি করেছে, ৩১টি ভারতীয় বিমানকে গুলি করে নামান হয়েছে, যদিও কেউ সেটা বিশ্বাস করে না। এর মধ্যে ১৩টি পূর্ব পাকিস্তানে। সাংবাদিকেরা ৪টি বিমানকে ভূপতিত হতে দেখেছেন আর তিনটিতে ধুয়া বের হতে দেখেছেন। পাকিস্তান বিমান সূত্র একজন উইং কমান্ডারসহ নয়জন পাইলটকে আটকের দাবি করছেন। পাকিস্তান তাদের দুইটি এফ-৮৬ হারানোর কথা স্বীকার করেছে, এর মধ্য একটি নিজেদের গুলির আঘাতেই ভূপাতিত হয়েছে।
বিমান যুদ্ধ হাজার হাজার ঢাকাবাসীর জন্য দর্শনীয় প্রদর্শনীর আমেজ এনে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ও ছেলেমেয়েরা ছাদে উঠে বিমান যুদ্ধ দেখছেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় সাংবাদিকদের একটি ভূপাতিত ভারতীয় বিমান দেখাতে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সাংবাদিকদের জানান হয়, ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামে ভারতীয় বিমান আক্রমণ হয়েছে। এদের লক্ষ্য ছিল জ্বালানি মজুতে আঘাত হানা। ঢাকার আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল—একজন কর্মকর্তা জানালেন, নারায়ণগঞ্জে গেরিলারা একটি পাট প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র আগুন দিয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই নিউইয়র্ক টাইম ‘ভারত বনাম পাকিস্তান: যুদ্ধ! তিক্ত প্রতিবেশীরা আবার অস্ত্র তুলে নিল” [India vs Pakistan: War! The bitter neighbours take up arms again] শিরোনামে উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতা এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

সংক্ষেপে সেটি ছিল এমন—
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক রেডিও ঘোষণায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য ভারতকে দায়ী করেন এবং দেশবাসীকে তার জবাব দিতে আহ্বান জানান। একইভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও রেডিওতে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন। ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধের জেরে যুদ্ধ হয়। তবে এবারের যুদ্ধের পরিধি ও ব্যাপ্তি অন্যরকম। ভারতীয় বিবৃতিতে মনে হয়, এবার পূর্ব পাকিস্তান জয় করে স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইল দূরে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তার পরিষদের জরুরি সভা ডাকার অনুরোধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজাস যুদ্ধবিরতির আশা ব্যক্ত করেন। এখন পর্যন্ত রাশিয়া ভারতকে এবং চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করবে বলে মনে হয়। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]