দেশকে মেধাশূন্য করছে কারা?

আবরার
আবরার

আবরার ফাহাদের হত্যায় দেশবাসী একসঙ্গে কেঁদেছে, ঠিক যেমন কেঁদেছিল হলি আর্টিজানের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতায় এবং সম্ভাবনাময় ছেলেগুলোর হঠাৎ বদলে গিয়ে খুনির তালিকায় নাম লেখানোয়। আবরারের হত্যাকারীদের আমরা ঘৃণা করব—এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমি পারছি না। আমার দৃষ্টিতে ওদের এখনো বয়ঃসন্ধিকাল; ওদের ব্রেইনের পরিপক্বতা এখনো আসেনি; ওরা এখনো বোঝে না, কোন কাজের পরিণাম কী। মূলত ২৫ বছরের আগ অবধি মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সুগঠিত হয় না, যা একজন মানুষের ভালো-মন্দের সিদ্বান্ত নিতে এবং কোনো কাজের পরিণতি চিন্তা করতে সাহায্য করে। এই বয়সী ছেলেদের এমন দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই কেউ ওদের দ্বারা ঘটিয়েছে হলি আর্টিজানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পড়াশোনার পরিবর্তে গড়ে উঠেছে টর্চার সেল। কিশোরেরা এসব সামাজিক অন্যায় নির্বিঘ্নেই করে যাচ্ছে। কারণ ওদেরকে বোঝানো হচ্ছে, কাউকে পিটিয়ে মারার নামই হচ্ছে দেশপ্রেম, খুন করার নামই হলো জিহাদ। আর তারা এটাও জানে, তাদের মাথার ওপর আছে রাজনৈতিক অথবা প্রভাবশালী কোনো প্রশ্রয়। খুনি হয়ে ওঠা এসব ছেলেকে ঘৃণা করার সঙ্গে সঙ্গে আজ এটাও খুব জানা জরুরি, এদের খুনি বানানোর নেপথ্যে কারা?

সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই, রাজনীতিকেরা তাদের ক্ষমতার মসনদ পোক্ত রাখতেই এসব মেধাবী ছেলেকে দুর্ধর্ষ ক্যাডার হিসেবে গড়ে তুলছে নিজেদের স্বার্থেই। এ ছাড়া দেশের মধ্যে নানা রকম সংগঠন রয়েছে, যারা এসব অন্যায় কাজের উসকানি দিচ্ছে। এমন অনেক গুপ্ত সংগঠনও আছে, যাদের নাম সরকার জানে কিনা সন্দেহ। বেশ কয়েক বছর আগে আমার আগের কর্মক্ষেত্রে এক নারীকে প্রতিদিন ভোরে দেখতাম সামান্য কিছু কেনাকাটা করতে। তাঁর কালো ত্বকে অফ-হোয়াইট কালারের ফাউন্ডেশন, যা পুরোটাই তাকিয়ে থাকত, মাথা পুরো বেল, তাতে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখত, স্লিম শরীর, আর তার হিম-শীতল, হাসিবিহীন চেহারা দেখলে শ্যামলা এলিয়েন বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। তাকে দেখলেই আমার ভেতরে কেমন যেন ভয় ছড়িয়ে যেত। কৌতূহলবশে তার সঙ্গে একদিন কথা বলে জানলাম, তিনি বাঙালি। দেশে তাঁর শ্বশুর বাড়ি মিরপুর। স্বামীর সঙ্গে তাঁর ডিভোর্স হয়ে গেছে এবং এখানে ছেলেকে নিয়ে তিনি আলাদা থাকেন।

ওই নারী স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের কারণ হিসেবে যা বললেন, তা শুনে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে গেছে। তাঁর স্বামীরা বিহারি। প্রতি রাতে তাদের মিরপুর ক্যাম্পে অনেক মানুষ মিলে বিশাল খাবার-দাবারের আয়োজন করে। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা করে, কাকে কোথায় খুন-জবাই করবে, কোথায় কোথায় গন্ডগোল লাগাবে অথবা গন্ডগোলের মাঝে গিয়ে উসকে দেবে। তাঁর শ্বশুরবাড়ির সবাই নাকি এই কাজে নিয়োজিত, এটিই তাদের পেশা।

আবরারের পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্তদের বাবা-মা, পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে মানুষ যখন গালি দিচ্ছে, আমার দৃষ্টি তখন লজ্জায়, অনুশোচনায় অবদমিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমিও দুইটি সন্তানের মা, সন্তানেরা বড় হওয়া অবধি আমি আমার নিজের জীবনের জৌলুশ বাদ দিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাদের সার্বক্ষণিক খেয়াল করেছি, আমার শৌখিন স্বামী নিজের সব শখ জলাঞ্জলি দিয়ে সার্বক্ষণিক ছেলে-মেয়েদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে, যেমনটা ঠিক করেছে আমার বাবা-মা এবং প্রতিটি বাঙালি পরিবার। আবরারের হত্যায় অভিযুক্তদের একজনের বাবা ভ্যানচালক।

তিনি কতটা অমানুষিক পরিশ্রম করে তাঁর ছেলেকে এই পর্যন্ত এনেছেন, সেটি বলাই বাহুল্য। আমি সেই ভ্যানচালক পিতাকে অসম্মান নয়, স্যালুট দেব, আর তাঁর আর্তচিৎকারে আমিও কাঁদব। প্যাডেল চালিয়ে তিনি যে ছেলেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পাঠালেন, কারা তার ছেলেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে সন্ত্রাসী বানাল? আবরার হত্যায় অভিযুক্তি অনিকের বাবা জানালেন, তাঁর এলাকায় অনিককে সবাই ভালো ছেলে হিসেবেই চেনে; একটা ভালো ছেলেকে তারা বুয়েটে পাঠিয়েছেন পড়াশোনা করতে, বুয়েট তাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে!

আবরারের মৃত্যু, এতগুলো মেধাবী ছেলের খুনি বলে আজ সমাজে আবির্ভূত হওয়া, এ কষ্ট শুধু তাদের বাবা-মায়ের নয়, এ কষ্ট পুরো জাতির। এত দিন জানতাম, সন্ত্রাসী হতো স্কুল-কলেজে না–যাওয়া বখাটে ছেলেরা। কিন্তু এখন রাষ্ট্রযন্ত্র হোক অথবা গোপন শত্রু, তারা মেধাবীদের বেছে নিয়েছে সন্ত্রাসী বানাতে, কারণ মেধাবীরা সহজেই হিটলারের মতো দুর্ধর্ষ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে দ্বিধাবোধ করবে না। বাহ্যিক সুশিক্ষার আলোকে তারপর একদিন এসব মেধাবী সন্ত্রাসী রাজনীতির মঞ্চেও অধিষ্ঠিত হবে, আর দেশকে নিয়ে যাবে দুর্নীতির শিখরে।

অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হতে পারি, কিন্তু অগ্রগতি নয়। ব্যক্তিজীবনে হোক, অথবা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অতীত কচলিয়ে কোনো ফায়দা তো হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। তাই রাজনীতিবিদদের উচিত, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হিংসাত্মক মনোবৃত্তিতে উজ্জীবিত না করে, পড়াশোনা করার সময় দিয়ে প্রযুক্তির উদ্ভাবনে উদ্ভাসিত করা। সঙ্গে বাবা-মায়েদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার যেন এ কাঁদা ছোড়াছুড়ির নষ্ট রাজনীতিতে সন্তানেরা পতিত না হয়। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে এমন বিবাদে লিপ্ত যে, আমাদের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে অশুভ শক্তি যারা খুব ধীরে ধীরে পরিকল্পনা মাফিক আমাদের মেধাবীদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।