'বুয়েটে আড়িপেতে শোনা'

‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ বলে একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে। বর্তমান ও সাবেক বুয়েট শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশাল এক গ্রুপ, যার সদস্য সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। বন্ধুদের কাছে মজার মজার স্ট্যাটাসের কথা শুনে আমি খুবই আগ্রহী হলাম। তখন জানা গেল, এই গ্রুপে ঢুকতে গেলে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। লম্বা লাইন। বুয়েটের নাম দিয়ে অনেক অ-বুয়েট ঢুকে পড়ছে বলে যাচাই করার প্রক্রিয়াটাও দীর্ঘ। একজন অ্যাডমিনকে খুঁজে বের করলাম। তিনি আমার তথ্যাদি নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রাক্তন অ্যাডমিন, বর্তমান অ্যাডমিনদের কাউকে জানাচ্ছি। সময় লাগবে।’ আমি কয়েক মাস অপেক্ষা করতে করতে হাল ছেড়ে দিলাম। সপ্তাহ তিনেক আগে এক বড় ভাই আমাকে সেই গ্রুপে শেষে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর আমিও ‘বুয়েটে’ আড়ি পেতে শোনা শুরু করলাম।

মাত্র কয়েকটি দিন। এখন ভাবছি, কী কুক্ষণে এই গ্রুপে জয়েন করেছিলাম? বাইরে যা শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, এই গ্রুপে তারচেয়ে অনেক বেশি, অনেক সরাসরি সব দেখা যাচ্ছে। যে ছেলেটি নামের মিলে ফেঁসে গেছে, সে নিজেই সেখানে এসে করজোড়ে সংশোধনের আবেদন জানাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, তার নাম এসেছে ভুলে, সেদিন সে বুয়েটে ছিল না। তার সাক্ষীসাবুদ দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করছে। যে ছাত্রটি নির্মম ঘটনা কিছু দেখেছে, সে বলছে, ‘আমার হয়তো জীবনের সংশয় রয়েছে; কিন্তু না বলেই পারছি না...।’ তারপর একজন তার নিজের শরীরে দাগ দেখিয়ে বলছে, ‘এই হলো ‘র‌্যাগিং’-এর দাগ। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় বুয়েটের এই র‌্যাগিং সম্পর্কে কিছু জানতাম না। কিন্তু যেভাবে জানলাম, তাতে আমার খাওয়ার রুচি বিদায় নিল। সব যে সঠিক তা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এর এক-দশমাংশও যদি সঠিক হয়, তা হলেই ব্যাপার ভয়াবহ।

অনেকে নাও জেনে থাকতে পারেন, বুয়েটে নেভি ও আর্মির অফিসাররা পড়তেন। তাঁরা তাঁদের ফোর্সের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য নিজ নিজ ফোর্স এবং বুয়েট থেকে মনোনীত হয়েই আসতেন। নেভির প্রায় সবাই হলে আবাসিক থেকে পড়াশোনা করেন। না থাকলেও প্রিপারেটরি লিভে (ফাইনাল পরীক্ষার আগে পড়াশোনার জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি দেওয়া হয়) কয়েক দিনের জন্য বুয়েটের হলে এসে পড়াশোনা করেন। বুয়েটে তাঁরা ছাত্র, বাইরে তারা অফিসার।

এমনই এক নেভি কর্মকর্তা আহসানউল্লাহ হলে আমার রুমমেট ছিলেন। সমবয়সী হওয়ায় আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বও হয়ে যায়। একসঙ্গে কমন রুমে টেবিল টেনিস, ক্যারাম ও দাবা খেলতাম। মাঝেমধ্যে ‘কন্টাক্ট ব্রিজ’ নামের তাসের কঠিন ও বনেদি খেলাটাও খেলতাম। সেই রিংকু হঠাৎ একদিন চোখ-মুখ লাল করে এসে বলল, হেড কোয়ার্টার থেকে তাঁদের সবাইকে জরুরি তলব করেছে। সে খুবই নার্ভাস। সত্তর যেতে হবে। আমি তাঁকে ‘হয়তো কিছুই না’ বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে তার নিজের ফোর্সের প্রটোকল ভালো জানে। সান্ত্বনায় কাজ হলো না। সে ড্রেস পরে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। তখন সেলফোন ছিল না। আমি বেশ কিছুটা শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একজনকে নয়, বুয়েটপড়ুয়া সব নেভি অফিসারকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কেন?

সে বেশ তাড়াতাড়িই ফিরে এল। তার মুখে অনাবিল হাসি। সেদিন চট্টগ্রামে কোথাও গ্রামবাসীর সঙ্গে কিছু নেভি সদস্যের সমস্যা হয়। সেটা পেপারে ফলাও করে এসেছে। এখন হেডকোয়ার্টার থেকে ভাবছে, সাধারণ ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে তাঁদের কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করতে পারে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কেউ হলে থাকতে পারবে না। তারা কোয়ার্টারে থাকবে। নেভির গাড়ি সকালে তাদের নিয়ে যাবে, বিকেলে ক্লাস শেষে নিয়ে আসবে।

তারা সবাই একযোগে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। তারা বোঝাতে পেরেছিল যে, বুয়েটে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। যাই ঘটুক না কেন, বাইরে যাই হোক না কেন, বুয়েটের হলে তাদের ‘সিভিলিয়ান’ বন্ধুরা তাদেরকে বরং জান দিয়ে বাঁচাবে। সাক্ষী মানল সিনিয়র কর্মকর্তাদের, যারা এর আগে বুয়েটে পড়েছেন। সেই অফিসাররাও জোর গলায় একই কথা বললেন। বুয়েটের শৃঙ্খলা অদ্বিতীয়। সেখানে সবাই বন্ধু, সবাই ভাই-বোন। অন্ততপক্ষে, কারও ভয় পাওয়ার এতটুকু কিছু নেই।

আমার বুয়েট জীবনে কয়েকটি ক্ষুদ্র ঘটনাই ঘটেছে। সেগুলোর জন্য বড় বড় তদন্ত কমিটি, কত কত জেরা, আর কত কত গুরুদণ্ড হতে দেখেছি। একবার দণ্ড হলে কিছুতেই তাকে ফেরানো যেত না। যেমন, পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়ায় ছাত্রনেতা মাহফুজ ভাইকে এক বছরের জন্য বরখাস্ত করা হলো। রাতের ঘটনা, অন্ধকার ছিল। কিন্তু দারোয়ান দেখেছে, সেই দারোয়ান সাক্ষী দিয়েছিল। আহ্সানউল্লা হলের দ্বিতীয় গেট দিয়ে ঢোকার পরই ক্যানটিনের আগে বাঁ দিকে ছিল মজিদ মিয়ার মুদির দোকান। সেখান থেকে নকল স্যাভলন আটক করল কয়েকজন ছাত্র। সেই অপরাধে ছাত্রনেতা অসীতদাসহ কয়েকজন দুই বছরের জন্য বহিষ্কার হলেন। শুনেছি কোর্টে গিয়েও ফল হয়নি। বুয়েটে নকল হয় না। ভুলে একটি ছেলে পড়তে পড়তে কোনো একটি সমীকরণের পাতা বুক পকেটে ঢুকিয়েছিল, সে এক্সপেলড হয়ে গেল। ইলেকট্রিক্যালের ছাত্র, পরীক্ষা ছিল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয়ে। পাল্টাপাল্টি কেমিক্যালের এক ছাত্রের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সময় এক্সপেলড হওয়া। কোনো নকলই না, ভুলে কিছু একটা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। এগুলোই ছিল ঘটনা।

সময়টা এরশাদের কাল। স্বৈরাচারবিরোধী তুমুল আন্দোলন করেছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। তারপর ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়েছে। সামান্য ধাক্কা ধাক্কির বাইরে কোনো মারামারি হয়নি। ডান দলের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় বাম দলের লস্কর ভাই বন্ধ ফটক টপকাতে গিয়ে ওপর থেকে পড়ে যান। তাঁর কিছু হতে পারত, সেটাও একটা শীর্ষ খবর।

সেই বুয়েটে যখন একজন মেধাবী ছাত্রকে তার বন্ধুরাই রুম থেকে ডেকে জেরা করতে নিয়ে গেল, তারপর সে লাশ হয়ে গেল, সেই কথা বলার কেউ সাহস পাচ্ছিল না, তখন কিছুতেই এটাকে মেলানো যায় না! কোথায় সেই নিরাপদ বুয়েট? কোথায় সেই প্রভোস্ট, সেই ডিএসডাব্লিও, সেই উপাচার্য? বাঘা বাঘা শিক্ষকদের তদন্ত কমিটি? কে দরজায় তালা লাগিয়েছিল সেই ভীষণ ‘অপরাধের’ চুলচেরা বিচার?

এই গ্রুপে ঢুকে, র‌্যাগিংয়ের নিষ্ঠুরতা শুনে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি, সেই বিল্ডিং আছে, পলাশী থেকে মেডিকেল হোস্টেল পর্যন্ত একের পর এক সেই সোহরাওয়ার্দী হল, শেরে বাংলা হল, তিতুমীর হল ও আহসানউল্লাহ হল আছে; কিন্তু সেই নিরাপদ, মেধাবী ছাত্রদের মায়ের বাড়ির মতো যত্নে রাখা বুয়েট আর নাই। কে জানত, ‘বুয়েটে আড়িপেতে’ এমন সব ভয়ানক গল্প শুনতে হবে!

লেখক: প্রকৌশলী, হার্নডন, ভার্জিনিয়া