ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিভক্তি

‘দশের লাঠি একের বোঝা’। এই সত্য জানে বলেই মানুষ সংঘবদ্ধ হয়। একজনের জন্য যা বোঝা, তা দশজনের সংঘবদ্ধতায় সহজ হয়ে ওঠে। তাই সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে মানুষ প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে জয়ের পথে এগিয়ে যেতে চায়। সেই আদিম শ্বাপদসংকুল সময়েও মানুষ তার সংঘবদ্ধতার জোরেই জয়ী হয়েছে। মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধতা, সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের মূলেও কাজ করেছে এই বোধ।

যেকোনো অচেনা-অজানা পরিবেশে মানুষের সন্ধানী চোখ সদা খোঁজে তুলনামূলক পরিচিত পরিসর। আর এই প্রবণতা থেকেই জন্ম নেয় বিবিধ সংঘের; সে দেশই হোক, কিংবা প্রবাস। প্রবাসে এই সংঘবদ্ধতার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রবাসের অচেনা পরিবেশে অনেকেই এগিয়ে যাওয়ার রসদটি পান এসব সংঘ থেকে। অনেকের সহযোগিতায়, পরামর্শে সেখানে তাঁরা নিজের ভাগ্য গড়ে নেন।

প্রবাসে যাঁরা ব্যবসা করেন বা করতে চান, তাঁদের জন্য এ সম্পর্কিত সংঘের গুরুত্ব অনেক। আর এ গুরুত্ব অনুধাবন করেই নিউইয়র্কের মতো শহরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন। ‘হয়েছিলেন’ বলতে হচ্ছে কারণ, এখন সেই সংঘেই ধরেছে বিভাজনের ঘুণ।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রথম আমেরিকান বাংলাদেশি বিজনেস অ্যালায়েন্সের (এবিবিএ) ব্যানারে সংগঠিত হন। উদ্দেশ্য, এই বিদেশবিভুঁইয়ে বাংলাদেশি আমেরিকান ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। কিন্তু সংঘ থাকলে তো তার নেতৃত্বও থাকবে, আর নেতৃত্ব থাকলে থাকবে তার দ্বন্দ্বও। এই দ্বন্দ্ব কখনো কখনো পুরো সংগঠনকেই ভেঙে দেয়, ডেকে আনে বিভাজন। এবিবিএর ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। ২০১৮ সালে সংগঠনটি ভেঙে বাংলাদেশি আমেরিকান বিজনেস অ্যালায়েন্স (বিএবিএ) নামের আরেকটি সংগঠন জন্ম নেয়। সেই সময় থেকেই তারা পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এবার প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফরকালে তাঁর সঙ্গে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে পৃথক অনুষ্ঠান আয়োজন করে এ দ্বন্দ্ব নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিব্রত হয়েছেন স্বয়ং অতিথিরাই।

আয়োজনের দিক থেকে দুটি অনুষ্ঠানকে পৃথক বলার তেমন কোনো সুযোগ নেই। যতটুকু পার্থক্য, তা ছিল শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায়। তাহলে দুটি অনুষ্ঠান আয়োজনের অর্থ কী? এ প্রশ্নের উত্তর নিউইয়র্কের সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছেও নেই। তাঁরা নিজেরাও বিব্রত।

সংগঠনমাত্রই সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে। একটি কার্যকর সংগঠনের জন্য এটি জরুরিও। কারণ, সংগঠনের ভেতর থেকে বিদ্যমান নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর বিষয় না থাকলে সেই সংগঠন স্থবির হয়ে পড়ে। এই ইতিবাচক দ্বন্দ্ব আত্মঘাতী হয়ে উঠলেই বিপদ। বিশেষত, যখন সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে নেতৃত্বের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থ হাসিল, তখন সেখানে কোনো নীতি আর কাজ করে না। সবার মধ্যে তখন এই বোধের জন্ম হয় যে, ‘নেতা হতে পারলে আমারও জুটবে।’ ফলে নেতৃত্বের অর্থ ‘দায়িত্ব’ না হয়ে দাঁড়ায় ‘স্বার্থ হাসিলের উপায়’। এই মনে হওয়ার মধ্যেই রয়েছে বিভাজনের মৌল সূত্রটি।

যখন একটি সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায় এমন স্বার্থকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে জড়ায়, তখন তা সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর কোনো উপকারেই আসে না। বরং এ ধরনের চর্চা বৃহত্তর পরিসরে ক্ষতির কারণ হয়। এবিবিএ ও বিএবিএ—দুই পক্ষই মুখে ব্যবসায়ীদের কথা বললে বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরে এদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা তেমন কিছু পাচ্ছেন না। অর্থাৎ যে ব্যবসায়ীদের উপলক্ষ করে সংঘের জন্ম হলো, তা বড় হয়ে ব্রাত্য করে দিল ব্যবসায়ীদেরই, যা অগ্রহণযোগ্য। উভয় পক্ষের নেতারাই যেহেতু ব্যবসায়ীদের মঙ্গলের কথা বলছেন, সেহেতু তাঁদের এটি অনুধাবন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ, ঐক্যই একমাত্র সুফলদায়ী। এ ঐক্য স্থাপনে সাধারণ ব্যবসায়ীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন।