স্পেশালাইজড স্কুল ও কোচিং

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত সংখ্যার প্রথম পাতায় মনজুরুল হকের স্পেশালাইজড বা বিশেষায়িত স্কুল ঘিরে কোচিং বাণিজ্য প্রতিবেদনটি আমার কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। এই জটিল বিষয়টি বুঝতে হলে আরও অনেক গভীরে যেতে হবে। নিউইয়র্কের এলিট স্কুলগুলোতে সন্তানদের ভর্তি করতে আমরা অভিভাবকেরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই সত্য। তার মানে এই নয়, এই স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে সন্তানেরা গোল্লায় যাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সিদ্ধান্তের ওপর সন্তানের সাফল্য নির্ভর করে। প্রথম শর্তই হল, শিক্ষার্থীদের ভালো পরিবেশে রাখা, ভালো স্কুল ডিস্ট্রিক্টে থাকা।

নিউইয়র্ক সিটির প্রত্যেক স্কুলে বিশেষ করে জুনিয়র হাইস্কুলে কয়েকটি অনার্স সেকশন থাকে এবং এদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। ক্লাসে যারা ভালো করে, তারাই এই এলিট গ্রুপে থাকার সুযোগ পায়। তারপর ক্লাসের ফার্স্ট ও সেকেন্ড পজিশনে যারা থাকে, তাদের যথাক্রমে বেল-ই-ডিক-টরিয়ান ও সে-লি-ডেক-টরিয়ান নামে ডাকা হয়। এদের ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে স্টুডিয়াস ও স্মার্ট বলা যায়। এই শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে স্পেশালাইজড ও ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুযোগ পায়। আমরা প্রত্যেকেই চাই, আমাদের সন্তান ভালো স্কুলে যাক। কিন্তু পিতা-মাতা চাইলে কি সেটা সম্ভব? পৃথিবীটাই হলো প্রতিযোগিতার জায়গা। ত্যাগ স্বীকার করে সফল নাও হতে পারেন।

আসলে আমাদের প্রায়োরিটি কী, তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। অনেকের হয়তো টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাসাবাড়ির মালিক হওয়া ইত্যাদি প্রধান প্রায়োরিটি। নিউইয়র্ক নগরের পাবলিক স্কুলগুলোতে টুয়েলভথ গ্রেড পর্যন্ত ফ্রি পড়াশোনা হয়। সেই জায়গায় প্রাইভেট স্কুলে কল্পনাতীত ব্যয় হয়ে থাকে, যা আমাদের সাধ্যের বাইরে। ম্যানহাটনের প্রাইভেট স্কুলগুলোতে নার্সারি থেকে শুরু করে টুয়েলভথ গ্রেড পর্যন্ত প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে বার্ষিক ৪৫/৫০ হাজার ডলার পিতা–মাতাকে গুনতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই অনুপাতে পড়াশোনায় পার্থক্য হয়ে থাকে। হোয়াইট আমেরিকানদের সঙ্গে কদাচিৎ দু-একজন ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীদের এসব প্রাইভেট স্কুলে দেখা মিলে। বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের কথা কখনো শুনিনি যে সেখানে গেছে বরং আমাদের কাছে এটা অকল্পনীয়। যারা এসব প্রাইভেট স্কুলে যায়, তাদের অভিভাবকেরা কল্পনাতীত বিত্তশালী। ভবিষ্যতে এই শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ আইভি লীগ কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ পায়।

তবে কিছু বাঙালি অসাধারণ প্রতিভাবান কিশোর–কিশোরী ম্যানহাটনের ডব্লিউ ৯১ স্ট্রিট প্রিপারেটরি প্রাইভেট স্কুল ট্রিনিটিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, যার বার্ষিক টিউশন ফি ৫৫ হাজার ডলার। তাঁরা খুব ভাগ্যবান ও মেধাবী। প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীদের পাঁচটি বোরো থেকে মেধার ভিত্তিতে তিন স্টেজে পরীক্ষা নিয়ে সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা হয় ট্রিনিটি স্কুলের জন্য। ম্যানহাটনে হান্টারের মতো প্রেস্টিজিয়াস হাইস্কুলেও বাঙালি ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতায় টিকে গেছে। আমার ছেলেরাও একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেও ট্রিনিটি ও হান্টার হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। সেজন্য আমার আর কষ্ট থাকেনি, যখন তাদের জন্য সর্বশেষ যে সুযোগ, সেটি ছিল নগরের স্পেশালাইজ হাইস্কুল।

নিউইয়র্ক নগরের পাবলিক স্পেশালাইজড হাইস্কুলগুলো প্রাইভেট হাইস্কুলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম। ক্ষেত্র বিশেষে পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের থেকেও স্মার্ট হয়ে থাকে। অনেক সময় প্রাইভেট হাইস্কুল থেকে বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েদের স্টাইভ্যাসেন্ট হাইস্কুলে আসতে দেখেছি। হয়তো বার্ষিক ব্যয়ের কারণ হতে পারে। স্টাইভ্যাসেন্ট হাইস্কুলটি সারা আমেরিকার মধ্যে অন্যতম একটি প্রেস্টিজিয়াস হাইস্কুলে স্কুল। অবশ্য স্পেশালাইজড ছাড়াও অনেক ভালো পাবলিক স্কুল ফাইভ বোরোতে আছে। নগরের সীমানার বাইরে নাসাউ, সাফক্স কাউন্টি, ওয়েস্টচেষ্টার, আপ স্টেট, নিউজার্সি এবং কানেকটিকাটের বেশির ভাগ স্কুল ডিস্ট্রিক্টগুলো তুলনামূলক অনেক ভালো এবং প্রেস্টিজিয়াস। তার জন্য সেখানকার অধিবাসীদের অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়। সেই তুলনায় নিউইয়র্ক নগরের ট্যাক্স খুব কম।

যতটুকু জানি তাতে নিশ্চিত, নিউইয়র্ক নগরের স্পেশালাইজড স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা খুব ফেয়ার হয়ে থাকে। জুনিয়র হাইস্কুলে আগেই সপ্তম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রায় স্কুলে কয়েক সপ্তাহের জন্য খুব অল্প খরচে কোর্সের ব্যবস্থা থাকে। যেসব অভিভাবক বেশি সচেতন, তারা আগে থেকেই সন্তানের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। এতে তো দোষের কিছু দেখি না। আবার কোচিং সেন্টারে কেনই বা যেতে হবে। আমার বড় ছেলে মাত্র দু-তিন দিনের জন্য খান টিউটোরিয়ালে গিয়েছিল। তারপর জোর করেও আমি তাকে সেখানে পাঠাতে পারিনি। কারণ তাদের পড়ার সিস্টেম তার ভালো লাগেনি অথবা সে যা জানত, তাই হয়তো তাঁরা আবার পড়াতেন।

সেই সময় সম্ভবত ক্লাস প্রতি এক ঘণ্টার জন্য তাদের ৪০ ডলার দিতে হয়েছে। সর্বমোট খান টিউটোরিয়ালকে হয়তো ১২০ ডলার দিয়েছি। কিন্তু নাঈমা খানের কাছ থেকে আমি খুব ভালো পরামর্শ পেয়েছিলাম, যেটা আমার ছেলের জন্য খুব কাজে লেগেছে। সেই জন্য তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। পরে, কাপলানে তাকে মাত্র নয়টি ক্লাস করাই। কাপলানের পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ছেলেরও তাদের পদ্ধতি ভালো লেগেছিল। সে স্টাইভ্যাসেন্ট হাইস্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়। ছোট ছেলেও শুধু কাপলানে ৯/১০টি ক্লাস করেছিল। সেও স্টাইভ্যাসেন্টে গিয়েছে। আমরা যারা প্রথম এ দেশে আসি, এই শিক্ষা পদ্ধতি সম্বন্ধে তখন খুব কম ধারণা থাকে। এই কোচিং সেন্টারগুলো সেই গ্যাপ দূর করে দেয়। কোচিং সেন্টারের বদৌলতে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন নিঃসন্দেহে। এটাতো আমাদের জন্য অনেক ভালো।

আমি আমার মতামতটুকু শুধু বললাম। সবাই প্রচুর ব্যয় করলেই সাফল্য পাবেন, এমন নয় তা মনজুরুল হকের প্রতিবেদনই প্রকাশ পেয়েছে। পিতা-মাতাকেও প্রথম থেকেই মনযোগ দিতে হবে। ভালো হাইস্কুলে যেতে পারলে ভালো ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সময়মতো কিছু ত্যাগ স্বীকার করে যদি ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০/৭০ হাজার বার্ষিক স্কলারশিপ বা গ্র্যান্টস পাওয়া যায়, তবে আমরা কেন আমাদের সন্তানদের জন্য চেষ্টা করব না। তার প্রমাণ বাংলাদেশি প্রচুর শিক্ষার্থী স্পেশালাইজড স্কুলে গিয়ে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছে বা পারছি, যা আমাদের জন্য গর্বের। এসব পড়ুয়ার পিতা-মাতা খুব কমসংখ্যকই বিত্তশালী। আমার মতো অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

স্পেশালাইজ স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে অনেক স্বল্প আয়ের পিতা-মাতার জন্য অশনিসংকেত। বিত্তশালীরা তো প্রচুর ডলার দিয়ে সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াতে পারবেন, স্কলারশিপের প্রয়োজন হবে না। ড্রামসহ অন্যান্য অর্গানাইজেশন যদি মনে করে, স্পেশালাইজড হাইস্কুলগুলো বন্ধ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আমি বলি কখনোই না। তাহলে আমার নেইবারহুডের পিএস ১২২ স্কুলের একাডেমিক সেকশনগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কুইন্স কাউন্টি থেকে স্টুডেন্ট বাছাই করে এখানে একাডেমিক সেকশনে নেওয়া হয়। এই স্কুল থেকে প্রায় সবাই স্পেশালাইজড স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায়।

যতটুকু দেখেছি, নিউইয়র্ক নগরের হিসপানিক ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ আমাদের এশিয়ানদের মতো সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে ততটা সিরিয়াস না। তারা সবকিছুতেই স্কুলকে দায়ী করে। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল শেষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বা ম্যাকডোনাল্ডসে আড্ডা দিতে পছন্দ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের শিক্ষার মান নিচে নেমে যায়। পিতা-মাতাও এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেন না। অথচ তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে স্পেশালাইজড স্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে হবে? হাইস্কুলগুলোর মান তো আরও নিচে নেমে আসবে। তখন প্রতিযোগিতায় প্রাইভেট হাইস্কুলের সঙ্গে পাবলিক স্কুলগুলো পেরে উঠবে না। কোচিং সেন্টারের মালিকদের বলা যায়, তারা যে হাজার হাজার ডলারের প্যাকেজ ডিল চালু করেছে, সেটি বন্ধ করতে। সপ্তাহ ভিত্তিতে কোর্স চালু করা যায়। যার যতটুকু প্রয়োজন, সেই পরিমাণ কোর্স চালু করা, যেটি কাপলান করে থাকে।

অভিভাবকদের কিন্ডারগার্টেন থেকেই শিশুদের পড়াশোনার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। হঠাৎ করে সিক্স/সেভেন গ্রেডে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে প্রেস্টিজিয়াস স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন সফল নাও হতে পারে। পরিশেষে বলতে চাই, স্পেশালাইজড হাইস্কুলগুলো কোনো অবস্থাতেই শুধু বিত্তশালীদের জন্য নয়। এই এলিট হাইস্কুলগুলো প্রতিভাবানদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক অপূর্ব সুযোগ। এগুলো বন্ধ করার আন্দোলনে নামা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। স্পেশালাইজড হাইস্কুল কিছুটা হলেও প্রাইভেট হাইস্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে আছে, যেখানে আমাদের সন্তানদের ভর্তি হওয়ার সুযোগও থাকছে।