স্মৃতিতে টেপরেকর্ডার

একটি শাখা শব্দ সংরক্ষণ। সে আবিষ্কারের সঙ্গে যে নামটি পৃথিবীজুড়ে আজও বেশি বেশি উচ্চারিত হয় সেটি হলো ওবারলিন স্মিথ। আমেরিকান এই প্রকৌশলী ১৮৭৭ সালে টেপরেকর্ডারের মূল নকশা তৈরি করেন। পরে ১৮৯৮ সালে প্রখ্যাত ডেনিস প্রকৌশলী ভ্লাদিমার পলসন যুগান্তকারী নতুন এই আবিষ্কারের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন অনেক সময় নিয়ে। তবে এই শব্দ সংরক্ষণ শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণ ও অধিক ব্যবহার ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে ১৯৩০ সালে বিএএসএফ (BASF) নামের জার্মান কোম্পানির মাধ্যমে। ১৯৩৫ সালে বার্লিন রেডিও শোতে পূর্ণাঙ্গ টেপ রেকর্ডার প্রথম প্রদর্শনী হওয়ায় পর আবিষ্কারের জগতে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়।

উনিশ শতকের বিস্ময়কর আবিষ্কার টেপ রেকর্ডার নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণ। অদ্ভুত এই শব্দ যন্ত্রের সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৬৮ সালে, যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমাদের ছোট চাচা এ কে এম ফজলুল বারী আমেরিকা থেকে দেশে এলেন। তখন সঙ্গে আনলেন অনেক বিলাসী আইটেম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দামি স্টিল ক্যামেরা, বাইনোকুলার, মুভি ক্যামেরা ও বিখ্যাত জার্মান কোম্পানি গ্রুন্ডি (Grundy) ব্রান্ডের বাদামি রঙের নতুন টেপরেকর্ডার। ওজনে ভারী থাকায় যেখানে-সেখানে হাতে নিয়ে চলা ছিল কষ্টকর। এর ওপর আটটি নতুন ড্রাইসেল ব্যাটারি লাগত বিধায় চাচার সঙ্গে আনা ব্যাটারি দিয়ে বেশ কয় দিন চালানো সম্ভব হয়। পরে এর ব্যবহার বেশ সীমিত হয়ে আসে। ব্যাটারির ব্যয় ছিল অন্যতম কারণ।

চাচা আসবার পর আমরা ভাই–বোনেরা সবাই গ্রামের বাড়ি গিয়ে সেখানে এই বিস্ময়কর যন্ত্রের একেবারে মুখোমুখি হলাম। প্রায়ই শুনতাম, ছোটবেলায় বাসায় নিজস্ব একটি গ্রামোফোন ছিল। শুধু কি তাই? সেই গ্রামোফোনের সঙ্গে আমার দুই বছর বয়সের একটি ছবিও নাকি ছিল। সে ছবিটির কথা শুনেছি অনেক। তবে নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। টেপরেকর্ডার দর্শনের আয়োজন ছিল রাজসিক। মাটিতে শীতল পাটি বিছিয়ে একেবারে মাঝে রাখা টেপ রেকর্ডার ঘিরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসে আছি। নীরব ও নিঃশব্দে।

জটলার এক পাশে মোড়ায় ছোট চাচা বসে টেপরেকর্ডারের ওপরে বসানো নানা বোতাম টিপছেন আর আমরা বিস্ময়ে এবং মুগ্ধ নয়নে দেখছি আর ভাবছি, এও কি সম্ভব? মোটা মোটা দুইটি চাকতির ন্যায় গোল প্লাস্টিকে প্যাঁচানো হালকা বাদামি রংয়ের ফিতায় সুন্দর গান, কবিতা কীভাবে আটকে থাকে। এরপর এল ছোট চাচার কলজে কাঁপানো ঘোষণা।

ছোট–বড় সব স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের বললেন, তোমরা যে যা জান, তা মুখস্থ করে আসবে। আগামীকাল তা রেকর্ড হবে। সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ–মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল নিমেষে। আওয়াজও বেশ নিচু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। পরদিন সবাই উপস্থিত চাচার সামনে যার যার জানা এক–আধটা কবিতা নিয়ে। কমপক্ষে ১০–১২ জন চাচাতো ভাই–বোনদের মাঝে মাত্র দুই/তিনজন রেকর্ডিং পর্যন্ত আসতে পেরেছিলেন। অনেক কসরত করে একটি কবিতার অর্ধেক আবৃত্তি করতে পেরেছিলাম বলে আমার স্মরণে আজও আসে। কবিতা কোনটি, তা মনে নাই। তবে বারবার ভুল করায় চাচার কড়া ধমক আজও স্মরণে আছে। বাজিমাত করেছিলেন খসরু ভাই। তিনি একটি সুরা তিলাওয়াত করেছিলেন। ওনার ভরাট ও সুর মিশ্রিত কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শুনে ভয়েস অব আমেরিকার তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রধান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত প্রযোজক ও সংবাদপাঠক ইকবাল বাহার চৌধুরী বড় ভাইয়ের কণ্ঠের দারুণ প্রশংসা করছিলেন। আজ এ পড়ন্ত বয়সে গ্রুন্ডি কোম্পানির রাজসিক চেহারার টেপরেকর্ডারের ছবি এখনো মনের কোণে ভেসে উঠে।

১৯৭১ সালের পর টেপরেকর্ডার হোটেল রেস্তোরাঁয় গ্রাহকদের মনোরঞ্জনের জন্য উচ্চ স্বরে গান বাজানোর কাজে ব্যাপক ব্যবহৃত হতো। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের মালিকের ক্যাশ টেবিলের পাশের দেয়ালের তাকে বড় বড় ঢাউস আকারের টেপ রেকর্ডার ছিল অপরিহার্য। ১৯৭৪ সালে নানি গেলেন লন্ডনে ওনার একমাত্র ছেলে মানে ফারুক মামাকে দেখতে। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসার পর দেখি নানির কাছে কালো রংয়ের ছোট একটি টেপরেকর্ডার। জানা গেল, ওনার দুই নাতি (দিপু ও টিপু) আমাদের মামাতো ভাইদের টুকরা টুকরা আধো আধো বোল আর হাসি মামি রেকর্ড করে দিয়েছেন নানি অবসরে শুনবেন বলে। কৌশলে নিজ দখলে নিয়ে এনে শুনতাম সেই সময়কার হিন্দি ও জনপ্রিয় বাংলা গান। ক্যাসেট সংগ্রহ করতে হতো সিলেটে থেকে। যেখানে ভালো ভালো শিল্পীর গানের ক্যাসেট পাওয়া যেতো সে সময়।

১৯৭৬–৭৭ সালে মধ্যপ্রাচ্য হতে দেশে আসা প্রবাসীরা ঢাউস আকারের টু–ইন–ওয়ান বা কেউ থ্রি–ইন–ওয়ান নামের টেপ রেকর্ডার নিয়ে দেশে ফিরতেন। এয়ারপোর্টে গেলে দেখা যেত, বাক্স–প্যাটরার ওপর বিরাট আকারের টেপ রেকর্ডার। সাইজ দেখে প্রবাসীর রিয়াল অথবা দিরহাম সঞ্চয়ের পরিমাণ আন্দাজ করা যেত।

গ্রামে দু-চারজন মধ্যপ্রাচ্য ফেরত প্রবাসীদের দেখতাম, টেপরেকর্ডার নিয়ে গ্রামের এক প্রান্তে ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে মাঠে বসে গান শুনতেন। গানগুলোর গায়ক কিন্তু বিদেশি বা বিদেশি হিন্দি ভাষার গান নয় একেবারে স্থানীয় গায়ক ক্বারি আমির উদ্দীন, শফিক উন নূরসহ নাম না জানা গায়কদের। শহরের দামি ইলেকট্রনিকস দোকানে নানা সাইজ ও রকমারি ডিজাইনের টেপরেকর্ডার দেখা যেত। বর্তমানে বিদেশিদের কাছে ফরমাশ আসে আই ফোনের সর্বশেষ ভার্সনের জন্য, তখন আসত টু–ইন–ওয়ান বলে খ্যাত ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের টেপরেকর্ডারের। তখন বিয়ের ‘যৌতুক’ হিসেবেও টু–ইন–ওয়ান ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। নানির কাছ থেকে পাওয়া ছোট টেইপরেকর্ডারই ছিল ভরসা। বেশির ভাগ সময় গান শুনি মান্না দের আধুনিক গান, নামকরা ভারতীয় শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত বা কিশোর কুমার, লতার গাওয়া চুটুল হিন্দি গান। মাঝে মধ্যে বেসুরো গলায় গান গেয়ে নিজে নিজে রেকর্ড করে শুনতাম। ভ্রাম্যমাণ ও ফুটপাতে নানা ধরনের বনজ ওষুধ, স্বপ্নে পাওয়া নানা তেলেসমাতির তেল, তাবিজ বিক্রেতাদের মধ্যে টেপরেকর্ডারের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। হয়তো ঠেলা গাড়িতে অথবা লোক সমাগম হয় এমন স্থানে টেপরেকর্ডারে পূর্বে ধারণকৃত লেকচার ক্রমাগত চালিয়ে যেতে লাগল। এখনো সেটি দেশে দেখা যায়।

পাশে একজন লোক ওষুধ, তাবিজ ক্রেতার হাতে তুলে দিয়ে টাকা পকেটে ঢোকাতে থাকল। টেপ রেকর্ডার থাকায় মুখে ফেনা তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে আর ওষুধ বা তাবিজ বিক্রি করতে হল না। একে বারে বৈজ্ঞানিক সমাধান। আশির দশকে আমার বড় ভাই কাতারপ্রবাসী হলেন, ১৯৮৩ সালে বড় ভাই দেশে প্রথমবারের মতো আসেন শার্প (SHARP) ব্র্যান্ডের লাল রঙের টু–ইন–ওয়ান টেপরেকর্ডার নিয়ে।

লম্বাটে আকারের টেপ রেকর্ডারটির সাউন্ড সিস্টেম ছিল একেবারে অত্যাধুনিক। দেশে আসার আগে গতানুগতিক প্রবাসীদের মতো বড় ভাই নিয়ে আসেন আব্বার ফরমাশ মতো বিখ্যাত মিসরীয় গায়িকা উম্মে কুলসুমের আরবি গানের ক্যাসেট আর তখনকার সময়ে দারুণ জনপ্রিয় গজল গায়ক জগজিৎ সিংয়ের প্রচুর গজলের ক্যাসেট। উম্মে কুলসুমের আরবি গানের মর্মার্থ না বুঝলেও গানের মধ্যে আল্লাহর নাম শুনে ধরে নিতাম, গানের সুরে সৃষ্টিকর্তার বন্দনাই ছিল গানের বিষয়। গানের সুরে গায়কি আবেদন ও কম্বিনেশন চমৎকার, তাই এই গায়িকা বিশ্বের কোটি কোটি আরবি ভাষার মানুষের নয়নমণি হয়ে ছিলেন বলে আমার ধারণা। ভাই দেশে আসার পর ওনার বন্ধুরা বাসায় আসতেন নিয়মিত। বসতো ম্যারাথন আড্ডা। ছিলেন প্রয়াত কবি মউজদীন ভাই, জিয়ন কুমার দাশ মিন্টু, ইতু ভাই, কবি মুতাসিম ভাইসহ অনেকই। উত্তর দিকের পাকা বিল্ডিংয়ের লম্বা ড্রয়িং রুমে সবাই একত্রে বসতেন। আম্মার হাতে তৈরি করা মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি বাজতে থাকত কিংবদন্তি গজল গায়ক জগজিৎ সিংয়ের বিখ্যাত সব প্রেমের গজল। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত শহরের সেরা প্রেমিকদের প্রেম বিষয়ক আড্ডা।

যাদের অনেক আজ শহর ছেড়ে কেউবা না ফেরার দেশে, কেউবা সাত সমুদ্রের ওপারে। তবে স্মৃতিতে আজও সবাই ভাস্বর।

জীবনের সব ঘটনাবলি শুধু যান্ত্রিক মাধ্যমে রেকর্ড না করতে পারলেও অধিকাংশ স্মৃতি মনের টেপে রেকর্ড হয়ে থাকে। মানব জীবনের সেই স্মৃতিময় টেপের জট কেউ খুলতে পারে, কেউ বা পারে না। তবুও বিজ্ঞান তার বিরল উদ্ভাবন নিয়ে যেমন এগিয়ে চলে, তেমনি মানব সভ্যতা না থেমে আরও বেশি গতিময় হয়ে এগিয়ে যায় হাজার শতকের পানে।