যুদ্ধের ষষ্ঠ দিনে পতনের মুখে ঢাকা

(পর্ব ৩২)

যুদ্ধ শুরুর মাত্র ছয় দিনের মাথায় পূর্ব পাকিস্তান প্রায় পতনের মুখে, যদিও পাকিস্তানিরা তা অস্বীকার করছিল। যুদ্ধের অগ্রগতি ও পাকিস্তানের অস্বীকৃতির সংবাদ দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি সেনবার্গ কলকাতা থেকে যে প্রতিবেদন পাঠান তার শিরোনাম ছিল, ‘ভারত জানাচ্ছে ঢাকা পতনের মুখে, শত্রুদের ঘেরাও, পাকিস্তানের উত্তর: সৈন্যবাহিনী পূর্বে দখল রেখেছে বলে জোর প্রচার এবং বড় শহরগুলোর পতন অস্বীকার’ [ India reports foe in rout in East as encirclement of Dhaka gains; Pakistan replies: Insists forces holds on in East and denies loss of big cities]

সংবাদটি সংক্ষেপে এমন—
ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ শিং অরোরা আজ রাতে বলেন, ভারতীয় বাহিনী শত্রুদের কোণঠাসা করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার দিকে নিয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টার বিমানবাহিনীর জন্য ছিল ‘মাঠ দিবস’, তারা পালাতে চেষ্টা করা পাকিস্তানি সেনা বোঝাই কয়েকটি নৌকা গুলি করে ডুবিয়ে দিয়েছে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে রয়টার খবর দিচ্ছে, পাকিস্তান দাবি করছে, পূর্বাঞ্চলে তাদের দখল অব্যাহত আছে, তারা ভারতীয় বাহিনীর জয়ের খবর অস্বীকার করছে।

কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ
আজ সহসা ভারতের কলকাতা বিমানবন্দর সব বাণিজ্যিক উড্ডয়নের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ধারনা করা হচ্ছে, পূর্বাঞ্চলে জয় নিশ্চিত জেনে ভারত তার বাহিনীকে পশ্চিমাঞ্চলে সরিয়ে নিচ্ছে, যা পূর্বাঞ্চল থেকে এক হাজার মাইল দূরে। সরকার তা অস্বীকার করেছে। তবে কেন কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ করা হল, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকা দখলের জন্য এখনো দুটি নদী পার হতে হবে যেগুলো প্রস্থে প্রায় এক মাইল। ঢাকা বিমানবন্দর ভারতীয় আক্রমণে ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত হয়েছে। দুইটি নদীর একটি হলো পদ্মা, যা পশ্চিমে অবস্থিত যেদিকে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। অন্যটি হলো মেঘনা যা পূর্বে অবস্থিত, যেখানে তারা আজ পৌঁছেছে। নদী দুটি ঢাকার দক্ষিণে মিলিত হয়েছে। নদীগুলো ফেরি দিয়ে পার হতে হয়। কোন কোন সরু স্থানে সেতু থাকলেও তা পাকিস্তানি সৈন্যরা উড়িয়ে দিয়েছে।
‘আমরা একটা পরিকল্পনা তৈরি করছি’
জেনারেল অরোরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বললেন, তিনি নদী পার হতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে চান না। বললেন, ‘আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি।’ জানালেন, পশ্চিম দিক থেকে তার বাহিনী মাগুরা দখল করে একটু সামনে এগিয়ে ছোট্ট নদী মধুমতীর কাছে অবস্থান করছে, এই নদীতে চলাচল করা ফেরি পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংস করেছে। ভারতের অগ্রগামী বাহিনী গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ২২ মাইল দূরে মেঘনা নদীর পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সেখান থেকে ঢাকা ৩৫ মাইলের মতো দূরে। ভারত মেঘনা নদীর পাশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আশুগঞ্জ, চাঁদপুর এবং দাউদকান্দি দখল করেছে। এসব শহর ঢাকা থেকে ২৫ মাইলেরও কম দূরত্বে।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ইন চিফ গতকাল কয়েকটি দখল করা শহর ঘুরে দেখেন। তিনি কুমিল্লার কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘যখন আমার হেলিকপ্টার এয়ারফিল্ডে নামল, এক বিরাট জনতা প্রায় ২০০০ মানুষ সেখানে জড় হয়। তারা আমাকে ছিনিয়ে নেয়, হাত মেলাতে থাকে, কোলাকুলি করতে থাকে, জড়িয়ে ধরে, আনন্দে কাঁদতে থাকে। এটা চলছে তো চলছেই। একপর্যায়ে তারা আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে থাকে, এটা আমার জন্য অস্বস্তিকর, কিন্তু খুবই স্পর্শকাতর বিষয়।’

সেনানিবাস পরিবেষ্টিত
সেনারা কুমিল্লা শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে সেনানিবাস ঘেরাও করে রাখে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই তারা সেখানে ঘেরাও অবস্থায় থাকুক—অন্তত কিছু সময়ের জন্য, সেখানে সম্ভবত এক ব্রিগেড বা এক ডিভিশন সৈন্য আছে।’ তিনি আরও বলেন, এসব পাকিস্তানি সৈন্যদের এখনো ধরা সম্ভব হয়নি, তারা ছোট ছোট পকেটে এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এদের আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এখনো খুব বেশি পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বন্দরে এবং নদীর সংযোগ স্থলে ডানক্রিকের (সার্বিক পরাজয় এড়াতে পশ্চাদপসরণ/দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের উপকূল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সৈন্যদের উদ্ধারের ঘটনাকেও বোঝায়) মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে জেনারেল অরোরা আশঙ্কা করছেন। অরোরা আরও বলেন, তাই বিমান ও নৌবাহিনী গোয়ালন্দ ঘাট, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, খুলনা, বরিশাল ও অন্যান্য নদী বন্দরে নজর রাখছে। তিনি উল্লেখ করেন, চাঁদপুরে ৪০০ থেকে ৫০০ সেনাকে বহনকারী স্টিমারকে ট্যাংক ও বিমান আঘাত করে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, পাকিস্তানি বাহিনী পেছনে যাওয়ার সময় বাঙালি সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করছে। বাঙালিরাও পাকিস্তানকে সহযোগিতাকারীদের হত্যা করছে। যশোরের ঝিকরগাছার কাছে এক ব্রিটিশ ফটোগ্রাফারকে রাস্তার পাশে প্রায় ৪০টি বাঙালি সাধারণ নাগরিকের মৃতদেহ দেখান হয়, যাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময় হত্যা করেছে। যশোরে একজন শিখ গোলন্দাজ ক্যাপ্টেন বলেছেন, সেখানে বাঙালিরা কম পক্ষে ছয়জন পাকিস্তানি সৈন্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। জেনারেল অরোরা সৈন্যদের স্পষ্ট বলেছেন, ভারতের দখলকৃত এলাকায় কোন সংক্ষিপ্ত বিচার হবে না এবং কোন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা যাবে না।
যুদ্ধে আটকে পড়া বিদেশিদের সরিয়ে নিতে আগামীকাল সকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত করাচি বিমানবন্দরে যুদ্ধবিরতি এবং ঢাকা বিমানবন্দরে আগামীকাল সন্ধ্যা থেকে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ঢাকায় ২০ জন শিশুসহ ৫৪০ জন বিদেশি নাগরিক আটকা পড়েছেন। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]