নির্বাচনে বাংলাদেশিরা

কেউ চাক বা না চাক রাজনীতি তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রভাবকে সাদা চোখে শনাক্ত করা যায় না বলে, অনেকে এক ধরনের রাজনীতিবিমুখ মনোভাব পোষণ করেন। তাঁরা ভাবেন, ব্যক্তিক উন্নয়নই সবকিছু। কিন্তু এই ব্যক্তিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত নানা বিষয় সরাসরি নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতিকদের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের দ্বারা। আর এখানেই রয়েছে নেতৃত্ব পর্যায়ে নিজেদের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তাটি, যা প্রবাস জীবনে আরও জরুরি হয়ে পড়ে।
নতুন দেশ ও সংস্কৃতিতে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব অনেক। একই সঙ্গে যে স্থান ও সংস্কৃতি ব্যক্তিকে সাফল্যের সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছে, তারও একটা দাবি জন্মে ব্যক্তির ওপর। ব্যক্তি একা পারে না বলেই প্রয়োজন হয় যূথবদ্ধতার। প্রয়োজন সংঘ-সমিতির। আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিরা এমন বহু সংঘ-সমিতি গড়ে তুলেছেন। তবে নানা ধরনের বিভাজনে তা সাফল্যের দুয়ার খুললেও যথেষ্ট নয়। আবার মার্কিন সরকারি নীতিতে নিজেদের দাবির প্রতিফলনও এসব সংঘ-সমিতি দ্বারা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এগুলো সব বিবেচনাতেই আঞ্চলিক, যার সঙ্গে আমেরিকার কোনো সম্পর্ক নেই। এখানেই আসে মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি।
দেরিতে হলেও এ প্রয়োজনটি শনাক্ত করেছেন আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিরা। একটু একটু করে আমেরিকার মূলধারার নির্বাচনে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন তাঁরা। শুরুতে বিভিন্ন শহরের কাউন্সিল সদস্য হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন তাঁরা। সেই সূত্র ধরে অনেক সাফল্যও ধরা দিয়েছে। নিউজার্সির তাহসিনা আহমেদ, ড. নূরন্নবি, শাহিন খালিক, মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, মিশিগানের আবু মুসা, আনাম মিয়া, পেনসিলভানিয়ার নীনা আহমেদ, নিউইয়র্কের হেলাল এ শেখ, তৈয়বুর রহমানরা এ পথ দেখিয়েছেন। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির বাস নিউইয়র্কে। কিন্তু পেনসিলভানিয়া, নিউজার্সি, জর্জিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশি প্রতিনিধিত্ব থাকলেও নিউইয়র্কে নেই। নিউইয়র্ক থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে অনেক বাংলাদেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এখনো সাফল্য ধরা দেয়নি। তবে চেষ্টা অব্যাহত। এবারই যেমন জাহাঙ্গীর আলম, মেরী জোবাইদা ও বদরুন নাহার আগামী কংগ্রেস নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। অ্যাসেম্বলিম্যান প্রার্থী হয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন জয় চৌধুরী।
এই প্রার্থীরা এখন তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। করছেন জনসংযোগ। তাঁরা কতটা সফল হবেন তা সময়ই বলে দেবে। এ ক্ষেত্রে আগের প্রার্থীদের সফল না হওয়ার কারণগুলো দিকনির্দেশনা দিতে পারে। মোটাদাগে অনৈক্যই ব্যর্থতার মুখ্য কারণ হিসেবে উপস্থিত। নিউইয়র্কে প্রচুর বাংলাদেশি বাস করায় সেখানে আঞ্চলিক সংগঠনের সংখ্যাও বেশি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মার্কিন শাখার মূল কেন্দ্রও নিউইয়র্কেই। ফলে অঞ্চলভিত্তিক কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যা-ই হোক না কেন, তার মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক বিভাজন বেশ স্পষ্ট। এমনকি এমন বিভাজনের কারণে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ফোবানাও কয়েক বছর ধরে পৃথক সম্মেলন করছে। এটিই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। সঙ্গে রয়েছে অন্য কমিউনিটিগুলোকে সঙ্গে না নিতে পারার বিষয়টি।
প্রবাসে নিজেদের কমিউনিটিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেমন কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠনের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি মূলধারায় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজন সব কমিউনিটির অভাব-অভিযোগ ও চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। সবাইকে সঙ্গে নিতে না পারলে নেতৃত্বে যাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ান বোনাপার্টের কথা স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘নেতা মানে যে অন্যদের মনে আশা জাগিয়ে রাখতে পারে।’ মনে রাখা দরকার যে, নেতাকে পাহাড়সম উঁচুতে দেখা গেলেও, তিনি নেতা হন সমতল থেকেই। আর এই সমতল থেকে সেই পাহাড়সম উচ্চতায় ওঠার সিঁড়িটি শুধু রাজনীতির ময়দানে খুঁজলে হবে না। এ জন্য চাই নিত্যকার জীবনে সবার প্রয়োজনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করা। এ পথ অনুসরণ করে আরও অনেক বাংলাদেশি আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন—এটাই প্রত্যাশা।