বাঁশি

বাঁশি। প্রতীকী ছবি
বাঁশি। প্রতীকী ছবি

বাঁশিতো আগের মতো বাজে না। লিখেছেন ফেসবুক বন্ধু সুমাইয়া ইসলাম। তরুণী কর্মী। হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ। দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটছেন। শ্রমজীবী মানুষের হয়ে কথা বলছেন। পাচ্ছেন তাদের ভালোবাসা। বাঁশি নিয়ে তার যে উদ্বেগ তা আলোচনার দাবি রাখে।
ঈদ মানে খুশি। বৃহৎ এ পার্বণে সবাই নতুন জামা-কাপড় পরবে, ঘুরবে এটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে আনন্দে কেউ বাঁশি বাজাবে, সে ইচ্ছে থাকতেই পাবে। বাঁশিতে আবহমানকাল থেকেই ভালো সুর শোনা যায়। সেখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে মনটা একটু খারাপ হওয়ারই কথা। এ ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।
অন্য এক বন্ধু সন্ধ্যা রায়। তার বিচরণ পাঠদানে। একটি কলেজে পড়াচ্ছেন। তিনি এমন আয়োজন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই। নাম ও পেশার সঙ্গে এমন ধারণাটি বেশ যায়। আমারও মূল্যায়ন অনেকটা তাই। অনেকের মনে বাজে সে কথাটি—সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি, যোগ করি আমি। শচীন দেব বর্মণ বোধ হয় খুশিই হন। ঈদের সঙ্গে মিলে গেল এক প্রেক্ষাপট। দীর্ঘ বিরহের পর কৃষ্ণ যাচ্ছেন বৃন্দাবন। রথে উঠেছেন। রথ ঠেলে নেওয়া হচ্ছে। বিপুল মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত। সেটা এক আনন্দ। সে রথযাত্রার দিনটিও আজ।

ঈদের দিন আবুধাবিতে নারীদের মিলনমেলা
ঈদের দিন আবুধাবিতে নারীদের মিলনমেলা

রাধার কাছে কৃষ্ণের বাঁশিটি বড়ই ডাকাতিয়া। মন কাড়া তার সুর। কদমগাছে উঠে কৃষ্ণ বাঁশি বাজালে রাধা আর ঘরে থাকতে পারেন না। রাতে কিংবা দিনে কেবলই তাকে টানে। উতলা করে মন। সে কারণে বাঁশির প্রসঙ্গ কোনোভাবেই বাদ পড়ে না, এড়ানো যায় না এর প্রভাব।
ঈদের আনন্দে আবুধাবি মাতোয়ারা। পরবাসীরা এখানে একজন আরেক জনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। একদল যুবক। বাংলাদেশের এই দুরন্তরা মিলেছে এক জায়গায়। তারা একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছে। ঘুরেছে দলবেঁধে। কয়েক দিন আগে তারা কেনাকাটা সেরেছে। বোনের জন্য সোনার নয়, পুঁতির মালা কিনেছে। আধুনিক গড়ন। শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর নামকরা মার্কেটগুলোতে এসবের সমাহার এখন। কে এম ট্রেডিং কিংবা লুলু সেন্টার থেকে তাদের এ সংগ্রহ। ভাইয়ের জন্য মানানসই জুতা কিনেছে। শৌখিন এ পণ্য পেয়ে তারা খুশি হবে। এখান থেকে সেই কথা মনে করে তাদের মনে আলাদা তৃপ্তি। তারা ফোনে আজ খবর নিচ্ছে কেমন লাগল তাদের এসব জিনিসপত্র। নতুন দলের সঙ্গে দেখা হয় তাদের। তারা কোলাকুলি করে।

ঈদি হাতে কিশোর–কিশোরীরা
ঈদি হাতে কিশোর–কিশোরীরা

মাথায় সাদা নেটের টুপি, পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা। মোহাম্মদ ইউসুফ, তিনি আওয়ামী লীগের আরব আমিরাত শাখার প্রতিষ্ঠাতা। নামাজ পড়ে এলেন সদস্যরা। তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা জাতির পিতার সেই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন।
নারীরা রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তারা এসেছেন বাইরে। বিকেলের সময়টা কাটিয়েছেন একাধিক পরিবারের সঙ্গে। তারা তাদের সন্তানদের জন্য কল্যাণ কামনা করেছেন। শিশুদের প্রতি দোয়া করতে অন্যদের অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রকৌশলী ইজাজ কলিম আজ মুক্ত। অঢেল ছুটি তার। নাজনীন ইজাজ, তারও ফুর্তিতে মন ভাসে। সঙ্গে দম্পতির প্রিয় কন্যা ইমশাদ নাজ। তারা সুহৃদদের কাছ থেকে পেলেন উষ্ণ ভালোবাসা।
বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন তার বাসভবনে বাঙালি পাড়ার মানুষদের আহ্বান করেছেন। তাঁরা তাঁর প্রাণের অতিথি। তাঁদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। নাশেতা নাহরির তানিয়া আবুধাবির প্রিয়মুখ। তিনি মোয়াজ্জেম–শারমিন জুটিকে আতিথেয়তায় ঈদের সেরা ঘোষণা করলেন। ঈদে আশীর্বাদ পেয়েছেন ছোটরা। খালি ছালায় গিড়ে আটে না। টাকা দিতে হয়। সেও এক উদ্‌যাপন। এরই নাম বোধ হয় ‘ঈদি’।
এখানে এই রাজধানীতে দীর্ঘদিন অবস্থান করেছেন এ টি এম আব্দুর রহিম। ঢাকা থেকে তিনি এই নগরীকে অনুভব করেন বুকের গভীরে। তাইতো তিনি সেই খেজুরতলা, মদিনা যায়েদ, কর্ণিশের মুক্তাঙ্গন তুলে আনেন তাঁর বয়ানে। ফেসবুকের পাতায় প্রকাশ পায় তার সোনালি স্মৃতি। তাঁর সহধর্মিণী তানজিয়া দীপাও জানান তাদের ফুলের শুভেচ্ছা। এ পাশ থেকেও প্রাণঢালা ভালোবাসা জানানো হয়। স্নেহসিক্ত হয় তাঁর দুই সন্তান অর্ক–অরিগা।

কোলাকুলির দৃশ্য
কোলাকুলির দৃশ্য

গ্র্যান্ড মস্কসহ বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়েন মুসল্লিরা। শঙ্কাহীন জীবন এখানে। তাইতো এ জন্য নিরাপত্তা চাদরে ঢাকবারও প্রশ্ন ওঠে না। আবার অন্য জায়গায়ও নামাজ আদায় করেছেন অনেকে। নিজ নিজ এলাকার মসজিদকে ধরে জায়নামাজ নিয়ে বসে পড়েছেন তারা। তারপর সারা দিন ঘোরাঘুরি-বেড়ানো।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ তাবৎ মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। সংগঠনের সভাপতি আজিম ফজলুল কাদের জানান, সৌহার্দ্য আর জীবনবোধের বাংলাদেশ ভাসে আমাদের সামনে। একই সংগঠনের মোহাম্মদ খোরশেদ বলেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক আজ আমাদের সেই প্রার্থনা। সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণী শাহিদা আরবি আর দুই সন্তান মাহরুখ–ওয়াফিকা। তারা আজ আনন্দময় শৈশব কাটাচ্ছে। বলছে, আমরা সবাই রাজা।
স্বপ্নপথ সুন্দর একটি সমাজের স্বপ্ন দেখে। এই সংগঠনের আহ্বায়ক নাসির জোসি। দেশে উদ্বেগহীন জীবনের নিশ্চয়তা চান। কোলে তার কন্যা সোফিয়া। বললেন, এবারই তার প্রথম ঈদ। সুকান্তের মতো উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করে, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। নাজিম মোহাম্মদ কবিতা লেখেন। তিনি বলেন, পোস্টার সংস্কৃতির শুভেচ্ছা ঈদের প্রকৃত আমেজকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তিনি তার কাব্যময় ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চান তাবৎ বন্ধুদের মাঝে।
হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা মানুষের অন্তরে বিষ ঢেলে দিয়েছে। এর থেকে নিষ্কৃতি চাচ্ছে সবাই। ভাবছে মানুষ, ভাবছি আমিও।

দুই সন্তান মাহরুখ-ওয়াফিকার সঙ্গে মোহাম্মদ খোরশেদ ও শাহিদা আরবি দম্পতি
দুই সন্তান মাহরুখ-ওয়াফিকার সঙ্গে মোহাম্মদ খোরশেদ ও শাহিদা আরবি দম্পতি

এর মধ্যে ছবিয়াল বোরহানউদ্দিন একটি ছবি পাঠালেন। ফোনে বললেন, এই ছবিটি আপনার জন্য। সেখানে উদ্দাম ছেলেরা মিলেছে। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। ভাবলাম, বাঁশি বাজবে মিষ্টি সুরে। আবুধাবির এই তরুণের দেওয়া ছবিটির সঙ্গে আরেক মিল খুঁজে পেলাম। কানাডায় অবস্থান করেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এক। লেখক বন্ধু সুব্রত কুমার দাস। তিনি পড়ছেন লন্ডনপ্রবাসী মুজিব ইরমের শ্রীহট্ট কীর্তন। এই তুলসীতলা/ শঙ্খধ্বনি/ উলুধ্বনি/ দেহাতি আজান....../ তোমার হাতে কেঁপে ওঠা সন্ধ্যা প্রদীপ/ সিঁদুরের টান....../ এসব ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। সুব্রত জন্মভূমিকে উপলব্ধি করেন গভীরভাবে। হৃদয়ে তার বাংলাদেশ। তার প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি উদ্যোগে সে বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি বলেন, ইরমের কীর্তনগাথা কবিতা তার মধ্যেকার জমাটবাঁধা ভাবটি কাটিয়ে দেয়। আশায় বুক বাঁধি।
আমি দেখি যমুনার জল প্রবহমান। কদম গাছে বসে কৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন। সে সুর মিলছে নদীর তরঙ্গের সঙ্গে, পাখির কলকাকলিতে, ধান গাছের দোলায়। বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। খালেদা সরকার, নুরুননাহার আর কবির আজমাল আবেগে আপ্লুত হন। সুমাইয়া ইসলাম, সন্ধ্যা রায় আসেন নদী পাড়ে। হাতে নৈবেদ্য। সব সুর, সব কথা, সব আবেগ মিলে যায় এক জায়গায়। আমি এগোই। নিশ্বাস ফেলি পরম আনন্দে।