ছেড়ে আসা বন্দরের ছায়া

যারা ঘুমায় তাদের কোনো চৈতন্য থাকে না। যারা জেগে থাকে তারা পাহারা দিতে পারে। প্রহরী জীবন কি মানবসত্তাকে দিতে পারে নিরাপত্তা? কিংবা যারা জেগে থাকে তাদের চোখ কি সব সময় রাখতে পারে সজাগ দৃষ্টি? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে টাইম ম্যাগাজিনের দিকে চোখ রাখে ডা. শিফাত রোজেনবার্গ। এম ডি পাস করার পর মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। সেটা হয়নি নানা কারণে। তারপরও মনোবিজ্ঞান ও দর্শন দুটি বিষয় তার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হয়। মনে হয়, বিজ্ঞানই কখনো মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তি সেখানে শুধু পালকহীন পাখির মতো ডানা ঝাপটায়। অথবা একাকী উড়ে যায় দূরের আকাশে বিরহের তরঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে। 
এ সংখ্যা টাইম ম্যাগাজিনে চমৎকার একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ‘ঘুম’ বিষয়ে। মানুষ নাকি তার জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়েই কাটায়। আচ্ছা, ঘুম কি সৃজনের কোনো জাল বুনে দিতে পারে? অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন একজন মানুষ কি পারে প্রখর দুপুরের কিরণে সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে? সূর্যের দিকে তাকালে তো আর তন্দ্রা থাকে না। ঝলসানো রোদ ঘামিয়ে তোলে মুখাবয়ব। অথচ আমরা জানি দুই ফোঁটা ঠান্ডা জল চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিয়ে খুব সহজে তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটানো যায়। ঠান্ডা জল আর প্রখর সূর্যের কিরণ কি তবে একই সমান্তরালে জীবনের তন্দ্রাভূবনকে জাগিয়ে তোলে? প্রশ্নগুলো নিজের প্রতিই ছুড়ে দেয় ডা. শিফাত রোজেনবার্গ। 
তুমি কি চা খাবে কিংবা কফি? 
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ডা. শিফাতকে জিজ্ঞাসা করে ক্যাথরিন। 
—হ্যাঁ, একটা ব্ল্যাক কফি প্লিজ! বলেই শিফাত আবার প্রতিবেদনে মনোনিবেশ করে। 
ক্যাথরিন তারই সহকারী। সিনিয়র নার্স। এই অফিসে দুজনে কাজ করছে ১০ বছর ধরে। ডাক্তার হিসেবে সনদ পাওয়ার পর ডা. শিফাতকে এই অফিসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ডা. ফিলিপ রোজেনবার্গ। তিনি বলেছিলেন, এই ক্লিনিক কাম ল্যাবরেটরি ডা. শিফাতের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হবে। সেদিন থেকেই ডা. শিফাত এই অফিসের বড়কর্তা। এ ছাড়া এখানে সবাই শিফাতকে ডা. ফিলিপ রোজেনবার্গের সন্তান হিসেবে জানে। 
কফিতে চুমুক দিতে দিতে কথা শুরু করে শিফাত। 
—তোমার মা কেমন আছেন ক্যাথরিন? 
—না, আর খুব ভালো কই। তিনি যদি বাক্‌শক্তি ফিরে পেতেন তবে হয়তো নার্সিং হোম থেকে বাসায় নিয়ে আসতে পারতাম। ক্যাথরিন জবাব দেয়। 
তবে কী তিনি কোনো দিনই বাক্‌শক্তি ফিরে পাবেন না?—শিফাত জানতে চায়। 
—তা আমি বলব কী করে। তবে ডাক্তার বলেছে, এ রকম মানসিক বিপর্যস্তরা সাধারণত আর বাক্‌শক্তি ফিরে পায় না-ক্যাথরিন কথা শেষ করে। 
আসলে ক্যাথরিনের মায়ের এমন অবস্থার কারণ কি-সে প্রশ্নটি অনেকবারই করতে চেয়েছে ডা. শিফাত। কিন্তু পারেনি। কারণ কোনো রোগীর বিপর্যস্ততার নেপথ্য কারণ জানতে গেলে তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া সে তো আর ক্যাথরিনের মায়ের চিকিৎসকও নয়। 
মানুষের জীবনে এমন অনেক অতীত দুঃসহ স্মৃতি থেকেই যায়, যা ভাবলে মানুষ নতুন করে ভেঙে পড়তে পারে। আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে তার মানসিক অবস্থা। এমনকি অতীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কেউ হার্টফেল করেছে— এমন উদাহরণও আছে অনেক। শিফাত এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে সংযত করে।

দুই. 
ক্যাথরিন বসনিয়ার মেয়ে। ১১ বছর আগে সে তার মাকে নিয়ে বসনিয়া থেকে আমেরিকা এসেছে, সেটা শিফাত জানে। কিন্তু প্রতিটি জীবনেরই একটি ফেলে আসা স্মৃতিমালা থাকে। বিশেষ করে যারা নতুন কোনো দেশে অভিবাসন গ্রহণ করে। শিফাত সে ভাবনাতাড়িত যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়েছে আমেরিকার সেই বহুল গীত গানটির কথা। ‘তুমি কে তা বড় কথা নয়, তুমি কোথা থেকে এসেছ তা বড় কথা নয়...শুধু একটি বার বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো...’। 
হ্যাঁ, এভাবেই বেড়ে উঠেছে এই অভিবাসী জীবন। বেড়ে উঠেছে এই বহুজাতিক, বহুভাষিক মানবসংস্কৃতি। এখানে অনেকেই পূর্ব পরিচিত নয়। তারপরও একান্ত আপনজন। 
ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরিতে যারা কাজ করে, তাদের সবাইকে শীতকালীন অবকাশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। এবারও সবাই অবকাশে যাবে, সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এবারের অবকাশটি বেশ ভিন্নতর। জাহাজে সমুদ্র ভ্রমণ। নিউজার্সির সমুদ্রবন্দর থেকে ফ্লোরিডা হয়ে বাহামা যাবে। তারপর ফিরে আসবে একই পথ ধরে। সি ক্রুজের কথা ভাবতেই বেশ শিহরণ অনুভব করে ক্যাথরিন। এক সপ্তাহের সমুদ্র ভ্রমণ। কীভাবে কাটাবে, কোন কোন বই সঙ্গে নেবে তা আগাম ঠিক করে রাখে। 
ভ্রমণ নিয়ে ডা. শিফাতেরও আগ্রহ কম নয়। দীর্ঘ কোনো সমুদ্র ভ্রমণ, এটা তারও প্রথম। হাডসন নদীতে ছোট ছোট জাহাজে চড়ে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ কয়েকবার ভ্রমণ করলেও এমন দীর্ঘ সমুদ্র পথ সে কখনো পাড়ি দেয়নি। 
নির্দিষ্ট দিনে তাদের যাত্রা শুরু হয়। নিউজার্সির এলিজাবেথ শহরের ক্লিনিকের দরজায় এক সপ্তাহের ভ্যাকেশন নোটিশ বেশ আগে থেকেই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 
সমুদ্রাভিলাসী মন নাকি সব সময়ই আকাশের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে। এই মিথে শিফাতের বিশ্বাস নেই যদিও, তবু সমুদ্র বিহারে বেরিয়ে কথাটি যেন তার কাছে সত্যই মনে হয়। পঠনপ্রিয় শিফাতও ডুবে থাকে বইপত্রে, এই জাহাজের ভেতরেও। কখনো জোছনা রাতে জাহাজের ডেকে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে চাঁদটিও ঠিক সমান্তরাল ছুটে চলেছে জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ফেব্রুয়ারির এই তীব্র শীতে আটলান্টিক মহাসাগরটি যেমন উথলা হওয়ার কথা, ঠিক তেমনটি নেই। তবে কি সমুদ্রও হারাচ্ছে তার জোয়ার? কিংবা বুড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মতো? বিষয়গুলো তাকে খুব ভাবিয়ে তোলে। সে সমুদ্রের সঙ্গে মানবজীবনের সামঞ্জস্য খোঁজে। মানুষের জীবনে তাহলে সুখের দিন কতটি? যে সময়টা মানুষ ঘুমিয়ে কাটায়, তা কি তবে সুখময় বলেই বিবেচিত? এ সময়টা জেগে থাকলে তো সে আরও কিছু সৃজনশীল কাজ করতে পারত। আনমনা হয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে অন্য জাহাজগুলোর বাতি গোনার চেষ্টা করে শিফাত। 

—কি ভাবছ? ক্যাথরিনের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পায় সে। 
—না কিছু না। 
ক্যাথরিনের দিকে ফিরে তাকায় শিফাত। ক্যাথরিনের হাতে একটি বিশাল বই ‘জেনোসাইড ইন বসনিয়া’। 
—কি পড়ছ তুমি? 
—এই যে, এই বইটি। ক্যাথরিন জবাব দেয়। 
—এত বিষয় থাকতে তুমি ‘জেনোসাইড’ বিষয়টি বেছে নিলে কেন? 
—জানি না। ক্যাথরিনের চোখজোড়া ছল ছল করে ওঠে। 
—তোমার মাকে কেমন রেখে এসেছ? শিফাত জানতে চায়। 
—ভালো নেই। যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনি। ক্যাথরিন সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। 
—আচ্ছা ক্যাথরিন, তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? 
শিফাতের প্রশ্ন শুনে হঠাৎ চমকে ওঠে ক্যাথরিন। শিফাত তার অফিসের বড় কর্তা। প্রশ্ন করতে অনুমতি চাওয়ার কী আছে! 
—হ্যাঁ, প্লিজ বলো। ক্যাথরিন নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয়। 
—তোমার মা কত দিন থেকে এ রকম? 
ক্যাথরিন জানত, এ রকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে কোনো দিন হতে পারে। ক্যাথরিন বলে, তুমি কি তা শুনবে ডা. শিফাত? মন খারাপ করবে না তো? 
শিফাত আগ্রহ দেখায়। 
ক্যাথরিন শুরু করে। সে এক চরম বেদনাদায়ক ঘটনা। বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। দখলদার বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। আমার বাবা ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী। একদিন ভোরে দখলদার বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। আমার মা-বাবা দুজনকেই ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যায়। আমার বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। আমাকে আমার চাচারা তাদের কাছে নিয়ে যান। 
এর তিন মাস পর একটি আর্মি জিপ বিকেলবেলা আমার মাকে আমাদের বাড়ির সামনে রেখে চলে যায়। বাবা আর ফিরে আসেননি। মা এসেছিলেন, নির্বাক। সমস্ত শরীর জুড়ে তার অত্যাচারের দাগ। এর কয়েক দিন পর দখলদার বাহিনী আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আমার চাচা-চাচিকেও সপরিবারে হত্যা করে। রেডক্রসের সেবাকর্মীদের সহযোগিতায় আমি আর আমার মা কোনোমতে বেঁচে যাই। তারপর রেডক্রসের সহযোগিতায় রিফিউজি পাসপোর্ট নিয়ে আমরা আমেরিকা চলে আসি। 
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ক্যাথরিন থামে। হঠাৎ যেন বজ্রাহত হয় শিফাত। ক্যাথরিন আবার বলতে থাকে—, এরপর তার নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। আমেরিকার বিশিষ্ট চিকিৎসকেরা তার চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার বাক্‌শক্তি ফিরবে, এমন গ্যারান্টি কেউই দিতে পারেননি। 
শিফাত নির্বাক তাকিয়ে থাকে ক্যাথরিনের দিকে। সে মুহূর্তেই জেনে যায়, কেন ক্যাথরিন ‘জেনোসাইড ইন বসনিয়া’ বইটি এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। 
ক্যাথরিন আবার মোহ ভাঙে শিফাতের।—জানো ডাক্তার, আমি আমার পিতৃহত্যার বিচার চাই। আমার মায়ের সম্ভ্রমহানির বিচার চাই আমি। এ জন্য আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। সার্বিকভাবে আমি আইনি বিচার চাই। আমি বিভিন্ন উপাত্ত, তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছি। বিশ্বকে জানাতে চাই বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় কীভাবে, কত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ডাক্তার, যদি প্রয়োজন হয় তুমি কি আমাকে সে সহযোগিতা করবে? 
ক্যাথরিন আর কথা বলতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে। ডা. শিফাত আনমনেই হাত ধরে তার। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব ক্যাথরিন। যেকোনো প্রয়োজনে আমি তোমার পাশে দাঁড়াব-শিফাত সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে।

তিন. 
শিফাত ক্যাথরিনের ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে যায় নিজের কথা। মাত্র চার বছর বয়সের ‘শিফাত’ নামের ছেলেটিকে কীভাবে ঢাকা থেকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মাদার তেরেসার কর্মী বাহিনী। তার দুই বছর বয়সেই মারা গিয়েছিলেন তার বীরাঙ্গনা মা জমিলা খাতুন। জমিলার ছেলে বলেই পরিচিত ছিল তার, মেথর কলোনিতে। যুদ্ধশিশু শিফাতের পিতৃপরিচয় জানতে চাইত না কেউ। মায়ের মৃত্যুর পর কলোনির কেউই আর তাকে দেখতে পারত না। 
এরপরই ১৯৭৫ সালের এক সকালে মাদার তেরেসার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিফাতকেও তুলে নেয়। 
কলকাতার শিশু আশ্রমে দুই বছর কাটানোর পর শিফাতকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হন ডা. ফিলিপ রোজেনবার্গ ও মিসেস নাঈরা রোজেনবার্গ। ডা. ফিলিপ তখন দিল্লির একটি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে দায়িত্ব শেষ করে নিঃসন্তান এই চিকিৎসক দম্পতি তাঁদের পালক পুত্র শিফাতকে নিয়েই আমেরিকা চলে আসেন। তার নাম হয় শিফাত রোজেনবার্গ। 
হঠাৎ জাহাজ গাইডের ঘোষণায় ভাবনায় ছেদ পড়ে শিফাতের। গাইড লাউডস্পিকারে বলছেন, ‘আমরা এইমাত্র পোর্ট ওয়াশিংটন ছেড়ে যাচ্ছি। আরও চার ঘণ্টা পর আমরা নোঙর ভিড়াব ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি বিচ পোর্টে।’ 
শিফাত আবার ক্যাথরিনের মুখের দিকে তাকায়। নিজের অব্যক্ত কথাগুলো তাকে বলতে শিফাতের খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে তা সে খুলে বলতে পারে না। বাধাগ্রস্ত হয়। ক্যাথরিনের হাত শক্ত করে ধরে তাকিয়ে থাকে নীল সমুদ্রের দিকে। শিফাতের মনে হয়, বিশাল জাহাজটি যেন ‘বসনিয়া’ কিংবা ‘বাংলাদেশ’ নামক বন্দরগুলো একে একে ছেড়ে যাচ্ছে।