দুই রমণী

অফিস থেকে বের হয়েই চৈতীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এক সময়ের বর্ষা পাগল মেয়েটির এখন বৃষ্টি দেখলেই মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন বাড়ি ফেরা বা কাজে যাওয়ার তাড়া থাকে। বাসায় থাকলে বা ছুটির দিন হলে অবশ্য আলাদা কথা। তখন অবশ্য ঘটা করে বর্ষা উদ্‌যাপন করতে ভালোই লাগে। ইলিশ মাছ ভাজা, শুকনো মরিচের সঙ্গে রসুনের ভর্তা অথবা ভুনা গরুর মাংসের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা ভুনা খিচুড়ি।
এসব ভাবতে ভাবতে চৈতীর পেটে খিদে যেন চনমন করে মোচর দিয়ে উঠল। মেয়েটাও হয়েছে চৈতীর মতোই, খিচুড়ি প্রিয়। মনির অবশ্য এসব খাওয়া তেমন পছন্দ করত না। সাদা ভাতের সঙ্গে তরকারি ছিল তার পছন্দ। তাতে নাকি তরকারির স্বাদ ভালো বোঝা যায়। চৈতী খুব শখ করে খিচুড়ি বা পোলাও রান্না করলে মনির সেদিন বিরস মুখে খাবার খেত। এরপর থেকে চৈতী এই ধরনের বিশেষ কিছু খাবার রান্না করলে মনিরের জন্য আলাদা সাদা ভাত করে দিত। এসব তুচ্ছ মত বিরোধেও কোনো সমস্যা ছিল না। যদি না মনিরের সেই ভয়াবহ সেডিস্ট রূপটা ধীরে ধীরে তাদের দুজনের সম্পর্ককে বিষাক্ত, তেতো করে তুলত।
রাস্তায় যানজটের দিকে তাকিয়ে চৈতী খানিকটা নস্টালজিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি খালি রিকশা দেখে সে আবার বাস্তবে ফিরে এল। সে প্রায় দৌড়ে গেল রিকশা ধরতে। কিন্তু চৈতী পৌঁছাতে পৌঁছাতেই মধ্যবয়সী আরেক ভদ্রলোক এসে দরদাম শুরু করে দিল। চৈতী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, রিকশাটা কিন্তু আমিই আগে হাত তুলে ডেকেছিলাম...।
—কিন্তু আমি আপনার আগেই কথা বলে ঠিক করেছি।
—তা করেছেন, আমাকে তো শাড়ি সামলে তারপর দৌড়াতে হয়েছে। আপনার তো সেই সমস্যা নেই।
—আপা, এমন বৃষ্টির মধ্যে বাইরে কী করেন? ঘরে থাকবেন, তা না...যত্তসব।
—আপনি বাইরে কী করেন? মেয়েদের কোনো কাজ থাকে না, নাকি?
চৈতীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লোকটি প্রায় জোড় করেই রিকশায় উঠে বসল। লোকটির অসভ্য আচরণে চৈতীর মন খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই আজকে নয়টা-পাঁচটা শিডিউলের বাইরেও প্রায় ঘণ্টা তিনেক ওভার টাইম করতে হয়েছে। তার ওপর এখন এই মুষলধারে বৃষ্টি। বাড়ি পৌঁছাতে আজ মনে হচ্ছ ১০টা বেজে যাবে। চৈতীর বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে শুরু করল। কাজের তাড়ায় আর বসের খবরদারির কারণে তখন মনে পড়েনি, চারতলার ভাবিকে বললে সে হয়তো নিচে এসে মৌকে সঙ্গ দিত অথবা ওকে ডেকে ওপরে নিয়ে যেতে পারত। এখন কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরও ভাবি ফোন ধরছে না। হয়তো ব্যস্ত। দুটো বাচ্চা আর বুড়ো শাশুড়িকে সামলাতে বেচারিকে সারাক্ষণ হিমশিম খেতে হয়। তাও সকালে মৌ আর ভাবির বড় মেয়েটিকে চৈতী স্কুলে পৌঁছে দেয় বলে সকালবেলা ভাবি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। তার স্বামী একেবারে লাটসাহেব। একটি কাজও হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায় না। স্বামী আর মেয়ের সকালের নাশতা, তাদের লাঞ্চ রেডি করা, ছোট্ট ছেলেটিকে সামলানো, শাশুড়ির খোঁজ রাখা, দেখভাল করা সবই একা তাকে সামলাতে হয়। তবুও বেলা দুইটার মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে তিনি মৌ আর সুমিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসেন। তাই মৌকে আনার টেনশনটা অন্তত চৈতীর করতে হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো চৈতী ফেরার আগ পর্যন্ত এই সময়টুকু মৌকে একাই থাকতে হয়। একটা কাজের মানুষের বাড়তি অনেক খরচ। কম বেতনে বিশ্বাসী কাজের লোক পাওয়াও খুব কঠিন। চৈতীর এই আয়ে বাসা ভাড়ার পর সব খরচ মেটানোই অনেক শক্ত হয়ে যায়।
আরেকটি খালি রিকশা দেখতে পেয়েই চৈতী এবার আর কোনো রিস্ক না নিয়ে একহাতে শাড়ি প্রায় হাঁটু অবধি তুলে অন্য হাতে ছাতা ধরে দৌড়ে রিকশার কাছে চলে এল। বুড়ো রিকশাওয়ালাকে ‘না’ বলার বা দরদামের সুযোগ না দিয়েই বলল, চাচা, দয়া করে না কইরেন না। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় আমার ছোট মেয়ে একা। এতক্ষণে মনে হয় ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করছে...।
চৈতীর কথার তোড়ে রিকশাওয়ালা কিছু না বলে রিকশার পর্দা সরিয়ে চৈতির বসার ব্যবস্থা করে দিল।
—আফা, এইবার কন দেহি যাইবেন কই?
চৈতী রিকশাওয়ালাকে বাড়ির ঠিকানা বলে নিজে এবার ভালো করে গুছিয়ে বসল। তার শাড়ি আর পেটিকোটের নিচের অংশ ভিজে চুপচুপ করছে। দুই পা হাঁটু অবধি ভেজা। স্যান্ডেলের ভেতরে পানি ঢুকে জবজবা। ভেজা শরীরে তার অস্বস্তি হতে লাগল।
—চাচা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি যে আমাকে নিতে রাজি হয়েছেন। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এদিকে রাতও বেশি হয়ে যাচ্ছে।
—আফা, আফনের ছুডু মাইয়াডা একলা বাড়িতে, কেমনে না কই কন? আমগোরওতো পুলাপাইন আছে, মায়া মহব্বত ঠিকই বুজি...গরিবের মায়া আর বড়লোকের মায়ায় তেমন ফারাক নাই গো আফা।
চৈতী রিকশাওয়ালার প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করল। মনে মনে ঠিক করল তার ন্যায্য ভাড়ার চেয়েও সে তাকে বেশি ভাড়া দেবে। তারপর চারতলার ভাবিকে আবার ফোন করল, এবার ভাবি ফোন ধরল।
—হ্যালো ভাবি, আমি এখনো বাসায় ফিরতে পারিনি, অফিসে কাজের চাপ ছিল।
—ওমা, এখন তো বেশ রাত হয়ে গেছে, তার ওপর যা বৃষ্টি হচ্ছে। মৌর সঙ্গে কথা হয়েছে? সে ভয় পাচ্ছে না তো?
—ভাবি, ওর ফোনটা নষ্ট, তাই সারা দিন কোনো কথাও হয়নি। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
—কিন্তু আমার বাসায় তো মেহমান আসছে আপা, রান্না নিয়ে একটু ব্যস্ত। ওকে কী চারতলায় নিয়ে আসব?
—থাক ভাবি, আপনার ঝামেলা হবে। রিকশায় উঠে গেছি, হয়তো আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
ফোন রেখে দিয়ে চৈতী মনে মনে ভাবল, কোনো কারণে মৌ চারতলায় সহজে যেতে চায় না। এর চেয়ে নিজেদের বাসায় একা থাকতেই তার বেশি পছন্দ। জোড় করে তাকে ওখানে না পাঠালেই বরং ভালো। চৈতী ঠিক করল এখন থেকে সে মেয়ের সঙ্গে মেয়েলি ব্যাপার এবং নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে যতটা সম্ভব খোলামেলা কথা বলার চেষ্টা করবে। আর যেহেতু মেয়ের পিরিয়ডও শুরু হয়ে গেছে তাই সেক্স সম্পর্কেও তার কিছু প্রাথমিক জ্ঞান থাকা দরকার।
রিকশাওয়ালার কথায় চৈতীর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। কখন যে লম্বা এতটা পথ চলে এসেছে চৈতী টেরই পায়নি। গলির অনেকটা পথই পার হয়ে এসেছে। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে বলল, এইবার আমারে মাফ করতে অইবো আফা, এই আন্দারে বাঙাচুড়া রাস্তায় আমি যামু না।
—চাচা, এত অন্ধকারে আমিও ভয় পাইছি, প্লিজ আরেকটু চলেন।
—না, আফা, এই হারাডা দিন বাইষ্যার মধ্যে কাম কইরা যা কামাইছি হের সবই ওই ড্যারাগ খাঔন্যারা কাইরা নিব, আফা আমারে ক্ষেমা দেন।
উপায় না দেখে চৈতী রিকশা থেকে নেমে বকশিসসহ ভাড়া মিটিয়ে দিল। ভাগ্য ভালো বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে। কারেন্ট কখন আসবে কে জানে। ছাতা খুলে হাঁটা শুরু করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তার চোখ ‘মুকুল ভিলা’র বারান্দায় চলে গেল। শূন্য বারান্দার দিকে তাকিয়ে চৈতীর বুক ব্যথায় ভার হয়ে এল। মুকুল ভিলার সামনে দিয়ে প্রতিবার আসা যাওয়ার পথে তার কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। এই বাড়ির মিষ্টি মেয়েটা কীভাবে সুইসাইড করে মারা গেল। মিতুর সঙ্গে তার খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। মিতু মৌকেও খুব ভালোবাসত। হঠাৎ করেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আজও মৃত্যু রহস্যের জট খুলল না।
দারোয়ান বজলু বলছিল, ‘আপা, ওই মুকুল ভিলার ম্যাডামতো ঘুমের বড়ি খাইয়্যা সুইসাইড করছে। হ আপা, হেগোর ভারাইট্টা ওই বখাইট্যা পোলাডার লগে মনে হয় লটরপটর আছিলো।’
কথা শেষ করে বজলু কেমন বেহায়ার মতো হাসছিল। দেখে চৈতীর মন খুব খারাপ হয়েছিল। ঘৃণায় গা রিরি করে উঠেছিল। মানুষের মন এমন নোংরা কেমন করে হয়, তাই ভেবে। সে খুব দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। একটা অজানা ভয়ে তার গা ছমছম করতে লাগল। মরাবাড়ি বা কবরস্থানের সামনে দিয়ে হাঁটতে তার সব সময়ই কেমন যেন ভয় করে।
দ্রুত হেঁটে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কারেন্ট চলে এল। চৈতী তার তিনতলার বারান্দার দিকে তাকাতেই লাইটের আলোয় দেখতে পেল, মৌ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। সে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েকে দেখেই তার মন ভালো হয়ে গেল। কিন্তু গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই চৈতী ভয়ে চমকে উঠল। কালো একটি কুকুর লেজ গুটিয়ে বাড়ির দিকেই মুখ করে বসে আছে। খেয়াল করে তাকাতেই মনে হলো কুকুরটির জ্বলজ্বলে কালো চোখ দুটো যেন তিনতলার বারান্দায় দাঁড়ানো মৌকেই দেখছে।
চৈতী গেট দিয়ে ঢুকতে যাবে এমন সময় দারোয়ান বজলু তার বসার কাঠের টুলটি থেকে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে বলল, আফা, আপনি মাত্তর আসলেন? এতক্ষণ তো কারেন্টও আছিল না। মাত্রই কারেন্ট আসল। আফনের মাইয়ারে তো দেকলাম বারিন্দায় খাঁড়াই রইছে। এত রাইতে এতক্ষণ হ্যায় একাই আছিল, কন কী আফা?
—বজলু ভাই, আপনি চিন্তা কইরেন না। ওর সঙ্গে চারতলার ভাবি, বা কেউ না কেউ থাকে। এ ছাড়া আমি সব সময়ই ফোনে কথা বলি। আচ্ছা যাই। কারেন্ট গেলে সব সময় গেট আটকিয়ে গেটের কাছেই থাকবেন। বলা তো যায় না, যা চুরিটুরি হচ্ছে আজকাল।
কথা শেষ করেই চৈতী তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। বজলু লোকটা একবার কথা বলার সুযোগ পেলে কথা আর থামে না। ননস্টপ কথা বলতেই থাকে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ করেই তিনতলার কাছাকাছি এসে, চৈতীর মনে হলো কে যেন তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। খুব চেনা একটা ঘ্রাণ; একটা চেনা অস্তিত্ব। চৈতীর গায়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অজানা ভয়ে।
কলিং বেল চাপতেই মৌ দরজা খুলে দিয়ে পাশে দাঁড়াল। চৈতী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকল। তারপর তাড়াতাড়ি ভিজে শাড়ি, পেটিকোট পাল্টে ঢিলেঢালা সূতির একটি ম্যাক্সি পরে নিল। মনে মনে ভাবল, আহ্, এতক্ষণে যেন শান্তি। শাড়ির হ্যাপা সামলানো চাট্টিখানি কথা না। ব্রা, প্যান্টি ছাড়া খোলামেলা ধরনের, গোড়ালির ওপর পর্যন্ত খাটো ঝুলের ম্যাক্সিতে যেন দম ছাড়ার সুযোগ পেল শরীর। সারা দিনের আটসাট পোশাক থেকে মুক্তি পেল কর্মব্যস্ত শরীর আর মন। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েই খানিকটা চাল আর মসুরের ডাল একত্র করে ছোট্ট একটি সসপ্যানে চুলোয় বসিয়ে দিল সে।
ঘর থেকে মেয়ে গলা তুলে ডেকে বলল, ‘মা, আমি জানি তুমি এখন খিচুড়ি রান্না করছ।’
চৈতী মেয়ের কাছে গিয়ে, একটু হাসল। তারপর চোখ কপালে তুলে, একটু বিস্ময়সূচক ভঙ্গি করে বলল, ‘কী করে বুঝলে, আমি খিচুড়ি করব?’
—বাহ্, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে না? এ ছাড়া আমাদের দুজনেরই খিচুড়ি পছন্দ। আর খিচুড়ি রান্না সবচেয়ে সোজা কাজ।
চৈতী মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে নিজের কাজে ফিরে এল। ততক্ষণে খিচুড়ি ফুটে উঠেছে। চটপট দুটি ডিম ভেজে ফেলল চৈতী। টেবিলে প্লেট দিয়ে তাতে ডিম ভাজা আর লেবু দিয়ে মেয়েকে খেতে ডাকল। হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি মেয়ের প্লেটে দিতে দিতে চৈতী বলল, কারেন্ট চলে গেলে ভয় পেয়েছিলে মা?
—হু, একটু, তেমন না। আমি এখন বড় হয়েছি না।
—হুম, অনেক বড় হয়ে গেছ। কয়েক দিন পর আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফ্রিজে অবশিষ্ট খাবার গুছিয়ে রেখে লাইট অফ করে শোয়ার ঘরে এল চৈতী। ইতিমধ্যে মৌ তার পড়ার টেবিলে ফিরে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে স্কেচ প্যাডে আঁকা শুরু করেছে।
—মৌ লাইট অফ করে শুয়ে পর মা, আমি মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছি।
—মা, আমি ওই কালো কুকুরটাকে এঁকেছি দেখবে?
মৌ খুব আগ্রহ নিয়ে চৈতীকে তার আর্ট দেখাল।
—ওয়াও, তুমি এত দারুণ ছবি এঁকেছ? একেবারে সেই কালো কুকুরটা।
চৈতীর গায়ে আবারও কাঁটা দিয়ে উঠল। ছবিতেও যেন কুকুরটি তার সেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো কুকুরটির মধ্যে কেমন যেন একটা ভৌতিক ব্যাপার আছে। চৈতী মশারি টাঙিয়ে মেয়েকে শুতে তাড়া দিল। শোয়ার ঘরের লাইট অফ করে সে বাথরুমে গেল দাঁত ব্রাশ করতে।
ফিরে এসে মেয়ের পাশে শুয়ে পরল। মৌ মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, মা জানো, আমি না আজকে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি।
—কী স্বপ্ন? আমাকে বলবে তোমার স্বপ্নের কথা?
—হুম। কারেন্ট চলে গেলে আমি বিছানায় এসে শুয়েছিলাম, কখন ঘুমালাম বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ মনে হলো কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। আমি উঠে দরজা খুললাম। দেখি মুকুল ভিলার সুন্দর আন্টি এসেছে আমাদের বাসায়। আমাকে বলল, কেমন আছ সোনামণি? আমি বললাম, ভালো, তুমি কেমন আছ আন্টি?
তারপর আন্টি বলল, ভালো। তুমি অন্ধকারে ভয় পাও? ভয় পেয়ো না। আমি তোমার পাশেই আছি।
—মা, জানো আন্টি আমায় সেই আগের মতোই চিবুকে ধরে আদর করল। বলল, আমার মতো তোমারও চিবুকে তিল আছে। আন্টি অনেক মজার মজার হাসির গল্প বলছিল। তারপর আন্টি বলল, মৌ তোমার মা এখনই চলে আসবে, আমি যাই।
তারপর পট করে কারেন্ট চলে এল। আর ফ্যানটা জোড়ে শব্দ করে ঘুরতে শুরু করলে আমারও ঘুম ভেঙে গেল।
চৈতীর বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সে মৌকে ভালো করে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর বলল, মৌ, তুমি ঠিক দেখেছ, স্বপ্নের ওই মিতু আন্টিকে?
—হ্যা মা।
—সে তোমার সঙ্গে কথাও বলল? কী আশ্চর্য, তাই না?
—হ্যা মা, এটাতো স্বপ্ন ছিল। তাই
চৈতী মেয়ের কাছে তার ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা গোপন করতে পারছিল না। মৌ বুঝতে পেরে অবাক হয়ে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন মা?
—নাহ্। ভয় পাব কেন?
স্বাভাবিক হতে প্রসঙ্গ বদলে চৈতী একটু হাসার চেষ্টা করল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে মা, এখন ঘুমাও। খুব সুন্দর স্বপ্ন।
—জানো মা, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম দেখি কালো কুকুরটা গেটের কাছে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তুমিও গেট দিয়ে ঢুকছ। তোমাকে দেখেই মন ভালো হয়ে গেল।
—লক্ষ্মী মা, এখন ঘুমাও।
—মা, স্বপ্নের মিতু আন্টি কী করে জানল তুমি এখনই আসবে?
—এর ব্যাখ্যা হলো, তুমি মনে মনে আমার আসার অপেক্ষায় ছিলে। আর স্বপ্নেও তোমার ব্রেন তোমাকে সেই সুখবরটাই দিয়েছে। এভাবেই মানুষ নানা রকম স্বপ্ন দেখে। তুমি যা ভাবো সেটাই ঘুমের সময় স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়।
—কিন্তু আমিতো জানি আন্টি মারা গেছে। তার কথা কেন ভাবব?
—আন্টি তোমাকে খুব ভালোবাসত। তুমিও আন্টিকে খুব পছন্দ করতে। তাই হয়তো তুমি তাকে স্বপ্নে দেখেছ। মৌ, মানুষের ব্রেন অনেক জটিল। ব্রেন অনেক কাজ করে, যার কারণ আমরা জানি না। তুমি বড় হয়ে যদি এ বিষয়ে পড়াশোনা কর, তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবে।
মৌ খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল। মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব মা।
—অবশ্যই, তোমার যা ভালো লাগে, তাই পড়বে, মৌ। তুমি কী আমাকে বলবে, কেন তুমি চারতলার আন্টিদের কাছে গিয়ে থাকতে চাও না?
মৌ এবার কোনো কারণে খুব বিমর্ষ হয়ে চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রাখল। চৈতী একটু অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা অজানা আশঙ্কায় তার দম আটকে আসতে লাগল। মেয়েকে বলল, ঠিক আছে মা, এখন বলতে হবে না। তোমার যখন ইচ্ছে হবে বলো।
তারপর একটু থেমে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার বলল, তোমার কোনো সমস্যা, ভয় বা অনিচ্ছা আমাকে না বললে আর কাকে বলবে মৌ? আমাকে জানালেই তো আমি সে সব বুঝতে পারব। তা নইলে অযথা জোড় করে তোমায় আমি কোনো কিছু করতে বাধ্য করতে পারি।
—মা, আমি চারতলার আংকেলকে পছন্দ করি না, তাই।
একটা অমঙ্গল চিন্তায় চৈতীর বুকের ভেতরে ছ্যাত করে উঠল। বুকের ভেতরে যেন পোড়ার মতো অনুভূতি হলো। সে এবার মনোযোগ দিয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। ডিম লাইটের নীলাভ আলোয় মেয়ের মুখে যেন একটি বেদনার ছায়া দেখতে পেল সে। আরও ঝুঁকে পরে মেয়ের কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল, মৌ, আমাকে বল মা, কেন তুমি আংকেলকে পছন্দ কর না? তুমি যেতে চাইতে না, তবুও আমি তোমায় জোড় করে পাঠাতাম। কারণ তা না হলে যে তোমাকে একা একা ঘরে থাকতে হতো। কিন্তু তুমিতো আমায় কখনো কারণ বলনি? কেন?
—আমিতো প্রথমে বুঝতে পারিনি। ভাবতাম, আংকেল খুব ভালো। তাই এভাবে আদর করে...তারপর...।
কথা বলতে বলতে মৌ একটু বিব্রত ভঙ্গিতে থেমে গেল। চৈতী যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বলল, তারপর?
—আমি আর সুমি এক সঙ্গে থাকলেও আংকেল এসে আমার পাশে বসত। আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত, আমার বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরত। আমার প্যান্টির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিত। সুমি বলত, ‘আব্বু, তুমি মৌকে এত আদর কর, আমাকে কর না কেন’। মৌয়ের তো বাবা নেই, তাই ওকে একটু বেশি আদর করি, তাই না মৌ?
—জানো মা, আংকেল এসব কথা বলে আমাকে আরও বেশি এভাবে ধরা শুরু করেছিল। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম, এটা আদর নয়, অন্য কিছু। একদিন আংকেল সুমিকে তার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে পাঠিয়ে আমার প্যান্টির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমার দুই পায়ের মাঝখানে তার হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। তারপর থেকেই আমি ওই বাসায় আর যেতে চাইনি, তুমি জোড় করলে আমি রাগ করেছি।
কষ্টে চৈতীর বুক ভেঙে যেতে লাগল। সুমির আব্বু কীভাবে এটা পারল? তার ছোট্ট মেয়েটার সঙ্গে? এমন জঘন্য একটা মানুষকেই কিনা এতটা সম্মান দেখিয়েছে সে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, প্রতি শুক্রবার পরিপাটি হয়ে নামাজ পরতে যাওয়া অমায়িক ওই ভদ্রলোকটি তার কন্যার সামনে তারই বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে কী করে এমন জঘন্য আচরণ করতে পারে?
—মৌ, মামনি, স্যরি। আমি জানতাম না। তাই জোড় করে তোমায় ওখানে পাঠাতাম নিরাপত্তার জন্য। আর কখনো এমন হবে না।
—মা, আমি তোমায় বলিনি, ভেবেছি তুমি বিশ্বাসই করবে না।
—মৌ, শুধু মা নয়, আমি তোমার বন্ধুও। প্লিজ, এখন থেকে আমার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করবে। তুমি বড় হচ্ছ, তোমার আরও অনেক কিছুই জানা এবং শেখার আছে। আমি এখন থেকেই তোমার সঙ্গে সে সব নিয়ে কথা বলব।
চৈতীর অনেক পুরোনো একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। মৌয়ের মতো এমনি বয়সে তাকেও একবার তার প্রতিবেশী এক চাচার হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। সেই ঘটনা সে আজীবন বুকে চেপে রেখেছে। কারও সঙ্গে কখনো শেয়ার করতে পারেনি। এরপরও চাচা বহুবার তাদের বাড়িতে এসেছে। অবলীলায় তার মায়ের হাতের চা, পিঠা, পায়েস খেয়ে হেসে হেসে গল্প করেছে। মনের ভেতরে পুরুষদের প্রতি একটি অব্যক্ত ঘৃণা পুষে রেখে চৈতী বড় হয়েছে। তারপর তার স্যাডিস্ট স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আরও তীব্রতর ঘৃণা নিয়ে সে ঘর ছেড়েছে।
তার মেয়ের ক্ষেত্রেও কী সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে? না, কিছুতেই চৈতী তা হতে দেবে না।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চৈতী এবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার কিশোরী বয়সের সেই অপমান, লাঞ্ছনা, কষ্ট, তার ব্যর্থ বিবাহিত জীবন এই সমস্ত কিছুই যেন সে তার আত্মজার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাইল। মা মেয়ের বয়সের, সম্পর্কের সব পার্থক্য যেন মুহূর্তেই ঘুচে গেল। শুধু দুজন রমণী যেন পরস্পরের কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিতে চেষ্টা করছিল সেই রাতে।