সব কথা যায় না বলা...

চাইলেই কি সব বলা বা লেখা যায়? যায় না।
কেন যায় না?
কিসের বারণ, কিসের খড়্গ?
রাষ্ট্রের, ধর্মের, মানবতার, লজ্জার, বিবেকের?
নাকি নিজের অযোগ্যতার?
না বলা কথা কি আদৌ বলার?
সে কথা কি আসলেই কোন কথা?
ইউটিউবে কত কিছু দেখা যায়। কলকাতার এক বাংলা সিনেমার কিছু অংশ দেখছিলাম। নাম ‘বাঙালি বাবু ইংলিশ মেম’। নায়ক-নায়িকা সোহাম চক্রবর্তী ও মিমি চক্রবর্তী। মিমি ভারতীয় লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ। কমেডি ছবি। উপভোগ্য।
‘মধু’ (সোহাম) ইংরেজি জানেন না। কানাডায় এক ইংলিশ মেমকে প্রেমে পটিয়ে বিয়ে করে সে দেশে বৈধতা পেতে চান। ‘গঙ্গাপুরী’ (মিমি) এগিয়ে আসেন সোহামের সাহায্যে। মেমকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব নেন তিনি।
বাংলা শিখিয়ে মিমি একদিন খাবার টেবিলে ডাকলেন সোহামকে। মিমি বললেন, মেম সোহামকে বাংলায় কিছু বলতে চায়। সোহাম খুশিতে আটখানা।
কি বলবে মেম? ভালোবাসার কথা?
তা শোনার আগে ‘সর্বজনীন’ বক্তাদের কথা কিছু শুনি। আপনারা কি তাদের সঙ্গে পরিচিত?
তারও আগে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুলের’ এক অভিজ্ঞতার কথা বলি।
সম্প্রতি আমার মরহুমা মায়ের নামে স্থাপিত স্কুল নিয়ে একটা পোস্ট ফেসবুকে দিয়েছিলাম। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছার সঙ্গে অনেকেই মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। তবে একজন মরহুমা মায়ের ‘দীর্ঘ জীবন’ কামনা করেছেন। আমি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছি, কারণ তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ। শুভ কামনাই তাঁর লক্ষ্য। এ ভুল তাঁর অনিচ্ছাকৃত। কখনো কখনো ভালোবেসে এমন সব শব্দ আমরা ব্যবহার করি, আপাতত মনে হতে পারে তা করা ঠিক হয়নি। এই যেমন অনেকেই ডাকি এই ‘দুষ্টু ছেলে’। তাই বলে সে ‘দুষ্টু’ নয়।
মাওলানা ভাসানীর এক বক্তৃতা আমার মনে পড়ে। ষাটের দশকের শেষ ভাগ। স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সিলেটের রেজিস্ট্রি মাঠের জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন মাওলানা ভাসানী। সে কি জ্বালাময়ী ভাষণ। ছন্দময়। যখন বলছিলেন, আমি আইয়ুবের বুকে পদাঘাত করি, পদাঘাত করি—তখন একই সঙ্গে পা দিয়ে স্টেজে আঘাত করে যাচ্ছিলেন, কেঁপে উঠছিল স্টেজ। সে মুহূর্তে আমাদের রক্তেও যেন নাচন শুরু হয়েছিল।
সিলেটে স্থানীয়ভাবে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষকে কেউ কেউ ‘মাইমল’ বলে ডেকে থাকেন, যদিও প্রকাশ্যে তা উচ্চারিত হয় না। মনে করা হয়, এ সম্বোধন শোভনীয় নয়। এতে ওই সম্প্রদায়কে খাটো করা হয়। কিন্তু ভালোবাসার কাছে সব হার মানে।
মাওলানা ভাসানী বক্তৃতার শুরুতে যখন পেশাজীবীদের একে একে সম্বোধন করছিলেন, যেমন বলছিলেন-আমার কৃষক ভাইয়েরা, আমার শ্রমিক ভাইয়েরা, এক পর্যায়ে এসে বললেন–আমার মাইমল ভাইয়েরা...। নাহ, কেউ কিছু মনে করেনি। এ যে ভালোবাসার ডাক। ভাসানীর ডাক।
‘অভ্যাসের’ বক্তার কথা কখনো শুনেছেন?
গত সপ্তাহে শুনলাম ফেসবুকে। আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠান। মঞ্চে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন সাংসদ আবদুস সোবহান (গোলাপ)। নিউইয়র্ক জীবনে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। এখন দূরত্ব বেড়েছে। এক বক্তা তার বক্তৃতায় বারবার ‘ম্যাডাম’ ‘ম্যাডাম’ বলছিলেন। আওয়ামী লীগের সভায় এই শব্দ উচ্চারিত হওয়ার কথা নয়। সভাস্থলে কিছুটা অস্বস্তি। বক্তা শেষ করলেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে। নেতৃবৃন্দ বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ।
ওই বক্তা মাইকের সামনে আবার এলেন, ক্ষমা চেয়ে বললেন, অভ্যাসের কারণে তিনি বলে ফেলেছেন।
এরপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু সিলেটের ওই বক্তার অভ্যাস কিনা জানা গেল না।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট সফরের শতবর্ষ পালন হলো বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে। এ উপলক্ষে সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতকে প্রধান করে একটি উদ্‌যাপন কমিটি গঠিত হয়েছিল। সে কমিটির সভায় এক কর্মকর্তা বক্তৃতার সময় বললেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া...। অবশ্য কর্মকর্তাটি স্বপদে থাকতে পারেননি। পদত্যাগ করে কমিটিকে স্বস্তি দিয়েছিলেন।
‘সবজান্তা’ বক্তাদের চিনেন? টকশোতে কখনো কখনো দেখা যায়। সব বিষয়ে তারা কথা বলতে পারেন। গণপরিবহন, জলবায়ু, সন্ত্রাস, চিকিৎসা, শিক্ষা, খেলা—সব বিষয়ে। রাজনীতি তো সবচেয়ে সহজ। এই প্রবাস কমিউনিটিতেও ‘সবজান্তা’–দের অস্তিত্ব আছে। তাদের আরেক নাম ‘সর্বজনীন’ বক্তা। কোন সীমা নেই, দল নেই, এলাকা নেই—সব জায়গায় বিচরণ। মুক্তিযুদ্ধ বলুন, চেতনা বলুন অথবা সাহিত্য, সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, নাটক অথবা স্মরণ, শোক-জন্ম, পিকনিক, মেলা-কখনো কখনো রাজনীতি, সভা-শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, আবার কখনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের দেখা মেলে। নেশা বক্তৃতা। অপেক্ষায় থাকেন কখন ডাক পড়ে। মাশাআল্লাহ, আয়োজকেরা ডাকেনও তাদের। তারাও সব বিষয়ে বলতে পারেন। কখনো কখনো ভাবি, আমি হয়তো জানি না, নিশ্চয়ই তাদের গুণ আছে, যার জন্য এত কদর।
প্রবাস কমিউনিটির সভা-সমাবেশের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে—তাতে অন্যের কথা জানি না, আমি রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠি। সৌভাগ্য আমার, ইদানীং আমাকে যেতে হয় না।
এই সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ৩০/৩৫ জনের সমাবেশে প্রায় ৩০ জন বক্তা। সর্বশেষ বা প্রধান বক্তার সময় হল প্রায় খালি। বক্তারাও চলে গেছেন। কারণ তাদের কাজ শেষ। বেচারা প্রধান অতিথি!
আমি এক আয়োজকের কাছে জানতে চাইলাম, বক্তার সংখ্যা কি কমানো যায় না?
উত্তরে বললেন, কী করে কমাব। আগেই বক্তৃতার সুযোগ দেওয়ার কথা দিয়েছি। সে জন্য সভায় এসেছেন, অন্যথায় আসতেন না। এখন না করি কেমনে?
সম্প্রতি এক সভায় মঞ্চে আমার পাশে বসা ছিলেন জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের বিদায়ী সভাপতি বদরুল এইচ খান। বড় সংগঠনের ব্যস্ত নেতা। প্রতি সপ্তাহেই আছে সভা-সমাবেশ। জিজ্ঞেস করলাম, কি করে এতটা সামাল দেন? চার-পাঁচ ঘণ্টা স্টেজে বসে থাকা, ২৫/৩০ জনের বক্তৃতা শোনা? কণ্ঠে তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ পেল। বললেন, কী করব মেনে নেওয়া ছাড়া।
মেনে নেওয়া যায় অনেক কিছুই। যাদের বক্তৃতার কথা আলোচনা করলাম, তাদেরটাও। তারা কেউই এতটা বিপজ্জনক নয়, যতটা না বিপজ্জনক ওরা, যে বা যারা গাছেরটাও খায়, আবার নিচেরটাও কুড়িয়ে নেয়। অর্থাৎ এক হৃদয়ে ধারণ করে দুই বিপরীত চেতনা। প্রিয় হয়ে থাকতে চায় দুই শিবিরেই। এটা কি ভণ্ডামি নয়?
শুধু দেশে কেন, রাজনৈতিক চেতনায় এই প্রবাস কমিউনিটিও দুই ভাগে বিভক্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চেনা যায়, কে কোন পক্ষের। যাদের চেনা যায়, তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যাদের যায় না, তাদের?
এই শিবিরে এসে বলবেন, আপনি মহান, আবার ওই শিবিরে গিয়েও বলবেন আপনিও মহান। এই মহানুভবতা আর যাই হোক, কপটতা, ভণ্ডামি। এই শ্রেণির লোকজন খুবই বিপজ্জনক।
সিলেটী একটা প্রবাদ আছে, ‘চেনা ইমানদার থেকে খাঁড়া বেইমান ভালো।’ অচেনা থেকে চেনা লোক ভালো। দ্বিচারিতা পরিহার করুন, পরিচয় স্পষ্ট করুন—এই আবেদন সর্বজনীন।
সিনেমার ওই গল্পে ফিরে আসি।
ইংলিশ মেম কি ভালোবাসার কথা বলবে? মধুর (সোহাম) চোখে-মুখে আনন্দের দ্যুতি। মেম আজ বাংলায় ভালোবাসা নিবেদন করবে। আহা কি আনন্দ! মেমের চোখে-মুখেও হাসির ঝলক। প্রেমময় চাহনি। মধুর আর তর সইছে না। মেমের আরও কাছে গিয়ে-‘বলো বলো’ বলে তাগাদা দিচ্ছেন।
মেম মধুর আরও কাছে ভিড়ে প্রেমময় সুরে বলল-‘মধু, তুমি হারামজাদা’!
মুহূর্তে চুপসে গেলেন সোহাম। যেন বজ্রপাত হলো। চোখ-মুখ লাল ফ্যাকাশে। এ কথা শোনার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না। কী আর করা। মিমির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গঙ্গাপুরী, এ কি শেখালে তুমি। ভালো কিছুতো শেখাতে পারতে।’

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।