বড় ভাইয়ের সঙ্গে বেঙ্গালুরু

চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতাল। আমার হাত থেকে বোনম্যারো নেওয়া হলো। ডাক্তার লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে নিডলের মাধ্যমে স্যাম্পল নিলেন বায়োপসির জন্য। রিপোর্ট দেবেন পাঁচ দিন পর। রিপোর্ট দেখে সে অনুযায়ী চিকিৎসা হবে। এ হাসপাতালে প্রথম দেড় মাস টানা ভর্তি ছিলাম। এরপরও কয়েকবার ছিলাম। পরে বহিরাগত রোগী হিসেবে একদিনের জন্য থেকে বাসাতেই থাকতাম। বাসা ভাড়া নিতাম। কেননা অ্যাপোলো হাসপাতালে অনেক বেশি খরচ আসত, যা আমাদের সাধ্যের বাইরে। ডাক্তার প্রতি বছর আমার বায়োপসি রিপোর্ট নিতেন। সেটা ২০০১ সাল। সে বছরও এ রকম হলো। পঞ্চমবার আমার বড় ভাই সঙ্গে গেলেন। এভাবে মামুন কামরান বেশ কয়েকবার গেছে। একবার গেল আমার খালাতো ভাই কয়সর। আমাদের আপন ভাইবোন আর কাজিন ভাইবোনদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সুতরাং বলা যায়, আমার এই চার ভাই–ই আমার সফর সঙ্গী ছিল। একবার বড় আপা গেলেন। প্রতিবারই কিছু না কিছু সিনেমাটিক ঘটনা ঘটে। একবার তো এয়ারপোর্টে আমাকে না পেয়ে মামুন সে কী কান্না। সব লিখলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। আজকে শুধু বড় ভাই পর্ব বলি।
হাসপাতাল থেকে আসার পর আমার বড় ভাই হঠাৎ বললেন,
-সুরমা তোর কী অবস্থা? শরীর ভালো তো?
⁃হ্যাঁ ভালো। কেন?
⁃না বলছিলাম, তোর যদি সমস্যা না হয় তাহলে বেঙ্গালুরু থেকে ঘুরে আসতাম। এখানে তো তোর সব দেখা। পারবি? পাঁচ দিন এমনি বসে থাকতে হবে।
পারবো কোনো সমস্যা না।

বেঙ্গালুরুতে দেখার মত কী কী চমকপ্রদ স্থান আছে সবই তিনি উপস্থাপন করলেন। আমাদের সর্বোচ্চ কত খরচ হতে পারে তাও বললেন। সমস্যা না, সেটা উনি দেখবেন। তারপরও আমাকে অবশ্য রিপোর্টের পর কী রকম খরচ হয় না–হয় সেটিও মাথায় রাখতে হবে। ভাইজান অনেকটা ছেলে মানুষের মতো। এমনিতে সহজ–সরল একেবারে। স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে কিছু বলবেন না। আমি শরীর নিয়ে না পারলেও ওরা কোথাও যাওয়ার কথা বললে না করতাম না। আমার সঙ্গে এক রুমে ওরা বসে থাকে, ব্যাপারটা আমারই ভালো লাগত না।

বিশেষ করে প্রথমবার মামুন খুব কষ্ট করেছে। দীর্ঘ দেড় মাস সে হাসপাতালে কাটিয়েছে। বের হলে নিজে অনেক কষ্ট পেতাম। বিশেষ করে পায়ের যন্ত্রণা বেড়ে যেত। আসলে দেহের হাড় এমন একটি জিনিস, যা একবার ভেঙে গেলে বা কেটে ফেললে সেটার সূক্ষ্ম ব্যথা সব সময়ই জানান দেয়। কিন্তু আমি ঠিক সব সয়ে যেতাম এবং এখনো যাই। কেন জানি না, যন্ত্রণা ভোগ করতাম না। এটা দোষ না গুণ তখন না বুঝলেও এখন জানি, এটা খুব ভালো একটা বৈশিষ্ট্য। যা মানুষকে নেতিবাচক শক্তি বিতরণ করা থেকে বিরত রাখে। অথচ অনেক মানুষকে দেখি, সামান্য ব্যথায় সারাক্ষণ যন্ত্রণাতেই বাতাস দিচ্ছেন। যাকে সামনে পান ব্যথার কথা বলেন। এ কথাটাই বহু বছর পর জানলাম ব্যথা বা পেইন এবং ভোগান্তি বা সাফার ভিন্ন জিনিস। ব্যথা নিয়ে সেটাকে ভুলে থাকতে পারা অনেক ভালো কিন্তু তার জন্য প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা উপলব্ধি করা মানে নিজেকেই মেরে ফেলা। আমি তো আমাকে মারতে চাই না। পরিপূর্ণভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। নিজের অজান্তেই তখন সেটা করতাম।

কেন হঠাৎ বড় ভাই পর্ব মনে হলো? তাও বলি। চামুন্ডি পাহাড়! এই পাহাড় সবার চেনার কথা না। কিন্তু আমি চিনি। শুধু চিনি বললে ভুল হবে। একেবারে ওপরে উঠে এসেছি। সমতল ভূমি থেকে যার উচ্চতা ৩ হাজার ৩০০ ফুট। আমি যখন ওপরে উঠি চোখ বন্ধ করে ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন’ পড়তে পড়তে আমার জীবন যায়। সাধ গুরুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে এই চামুন্ডি পাহাড় আমার মাথায় ঘুরছে। হঠাৎ ওনার কথা শুনতে শুনতে মনে হলো, আরে এ পাহাড়ে তো আমি গেছি। জীবনে বহু বার ভারতে গিয়েছি। মানে যেতে হয়েছে কিছুটা বাধ্য হয়ে। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এমনও বছর গেছে, দুই/তিনবার গেছি। এতে করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দেখে এসেছি।

তো যেই কথা, সেই কাজ। দুপুরের খাবার সেরে ভাইজান রাতের দুটি ট্রেনের টিকিট নিয়ে আসলেন। সঙ্গে নেওয়ার মত ছোট দুটি ব্যাগেজ নিয়ে রাত নয়টায় চেন্নাই এক্সপ্রেস ধরলাম। স্লিপিং বাথ নেননি। বসার মত সিট। তবে আশার কথা, অনেক সিট খালি ছিল। কোনো রকম শুয়ে কাটাতে পারছি। ক্রমশ রাতে অনুভব করতে লাগলাম, আমার জ্বর আসছে। এ দিকে হাতে ব্যথা শুরু হয়েছে। হাতের রেডিয়াস গ্রাফ্ট করা। তার ওপর যখন আবার খোঁচাখুঁচি হয়, তা খুবই বেদনাদায়ক। সঙ্গে ওষুধ ছিল, খেয়ে নিলাম। খুব ভোরবেলা বেঙ্গালুরু পৌঁছালাম। প্রথম যে হোটেলে গেলাম, তাঁরা আন্তর্জাতিক বোর্ডার রাখেন না। অন্য একটা হোটেলে গেলাম। সিএনজি চালক স্টেশনেই বলেছেন, আপনারা যতটা হোটেল দেখতে চান, দেখবেন আমাকে মাত্র দশ রুপি দিলেই হবে। তাঁর ব্যবহারে ভাইবোন মুগ্ধ হয়ে তাঁকে পনেরো রুপি দিলাম। সব মিলিয়ে এই শহরের মানুষকে আমার খুব ভদ্র মনে হয়েছে। আরেকজন ড্রাইভার যে নিয়ম ভেঙে সোজা যেতে পারত, কিন্তু ঘুরে রাস্তা পার হলো।

সকালের নাশতা খেয়ে সে দিন আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। এ শহরে বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের একটা মার্কেট আছে। আমি সেটি থেকে একটি জয়পুরী সিল্ক নকশিকাঁথা স্ট্রিচের শাড়ি কিনেছিলাম। পরদিন একটা পর্যটক ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। গাইড পুরো শহর ঘুরে দেখালেন। গাড়িতে আমরা ছাড়া আরও ভারতীয় পরিবার ছিলেন। ওপরে ঝুম বৃষ্টি হয়। আমরা ভিজতে ভিজতে সে শহর দেখলাম। আমার সালোয়ার কামিজ গায়েই আবার শুকালো। কোনো রকম হাতের ব্যান্ডেজ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি। অনেকের সর্দি কাশি হলেও আমার কিছু হলো না। উল্টো আমার জ্বর কমে গেল। তবে পায়ের আর হাতের ব্যথা মাঝে মাঝে বলে যে, তারা সঙ্গে আছে। পথে যেতে যেতে একটা পাবলিক লাইব্রেরি চোখে পড়ল।এ রাস্তায় দুজন সেলিব্রেটির পায়ের ধুলা আছে। আমাদের ছবিও তুলতে বললেন। তখনো রিলের যুগ। আমি বুঝেশুনে ক্লিক করি। মৃত আগ্নেয়গিরি পর্বত, মিউজিয়াম, গ্রিন হাউস এ রকম অনেক কিছু দেখা হলো। পরদিন শুরু হবে আমাদের আসল ভ্রমণ।

খুব ভোরে বড় একটা কোচে আমরা উঠলাম। কোচ ভরা মানুষ। প্রথম দিকের একটা সারিতেই বসলাম আমরা। গাইড বললেন, টিপু সুলতানের মাজার, মহিশূরে কাবেরী নদীর ওপর ফাউন্টেন গার্ডেন, মহীশূরের রাজার প্যালেস। কর্ণাটক সিটির চামুন্ডি পাহাড় এবং সে পাহাড়ের ওপর চামুন্দেশ্বরী মন্দির—এসব জায়গায় ভ্রমণ হবে এবং ফিরে আসতে আসতে পরদিন সকাল হবে। বেশ একটা চাঞ্চল্যকর অবস্থা সবার মাঝেই। বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় কোচ থামায়। কাশ্মীরি দোকান থেকে একটা শাল এবং কারুকাজ খঁচিত গয়নার বাক্স কিনলাম। নাশতা খেয়ে গাড়িতে বসার কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, আমার ভাই তো আর ভাই নেই, পুরোপুরি শরাবী অমিতাভ বচ্চন। হঠাৎ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠেছেন, ‘এ দোস্তি হাম নেহী তুড়েঙ্গে”....! তখনো কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। বাসে একটা পিকনিক পিকনিক আমেজ। ভাই গলা ছেড়ে গান গেয়ে চলছেন। আমি অতিষ্ঠ হয়ে পেছনে গিয়ে এক মহিলার সঙ্গে বসলাম। তবু তার গান থামছে না।

বাস টিপু সুলতানের মাজারে নামল। বাসের সবার সঙ্গে গিয়ে ছবি তুলে আসলাম। একটা ছেলে ছবি তুলে দিল। বড় ভাই টিপু সুলতানের পুরো ইতিহাস, টিপু সুলতানকে মনে করিয়ে দিলেন। কত কী যে বললেন টিপু সুলতানকে। ওনার সংলাপগুলো আমার মনে নেই। তখন চোখের পানি ফেললেও এখন মনে হলে আমার হাসি পায়। আমি যখনই পাবলিক বুথ পাই, কামরানদের ফোন করে কাঁদতে থাকি। তোমরা কার সঙ্গে আমাকে পাঠালে?

পথে পর্যটন স্টোর থেকে একটা মঙ্গল সূত্র কিনেছি। তখনতো স্টার প্লাস আর সনি টিভির বদৌলতে খুব ফ্যাশন মঙ্গল সূত্র পরার। নেলী আবার তার জন্য গয়না কেনার টাকা দিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে মঙ্গল সূত্রের। আমি ওর জন্য কিনতে গিয়ে নিজের জন্য কিনেছি। এখন তো আমার পেছনে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছেন।

এই তুই মঙ্গল সূত্র কেন কিনলি? এটাতো হিন্দুরা পরে। তুই কেন পরবি? কোনো হিন্দু ছেলেকে বিয়ের চিন্তাভাবনা করছিস? তুই আমাকে সত্য কথা বল। যা গিয়া শাঁখা কিনে আন, সিঁদুরও আন। আর বল কে সে? আমি এই খানে তোর সাত পাকের ব্যবস্থা করব। আমি আর কোনো কথা বলি না। রেস্টুরেন্টে আমি একা একা দুপুরের খাবার খেলাম। কী আর করা? তবে সে ভদ্রলোক ভাইকে লেবুর শরবত খাইয়েছিলেন।

আমরা এসে পৌঁছালাম মহীশূরের রাজার প্যালেসে। সেটা আমার তাজমহলের চেয়েও বেশি সুন্দর মনে হয়েছে। তার কারণ অবশ্য দামি রঙিন সব পাথর তখনো মহলের ভেতরে খঁচিত ছিল, যা তাজমহলে আর নেই। হয়তো সে জন্য। পথে এল অমর আকবর অ্যান্টনি সিনেমার সেই বিখ্যাত চার্চ। সেখানেও আমার ভাই অমিতাভের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমার জীবনের স্মরণীয় ভ্রমণ কাহিনি।

এখান থেকে বের হয়ে রওনা হলো বাস চামুন্ডি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সে যে কী খাঁড়া পাহাড়। পুরো পাহাড় ঘুরে ঘুরে বাস ওপরে ওঠে। জানালা দিয়ে গিরি খাঁদের মতো দেখা যায়। আমার এমনিতেই ফোবিয়া আছে। আমি শিলং যাইনি কখনো এই ভয়ে। এক সময় বাস ওপরে উঠল। বাসের সবাই যাচ্ছে। আমিও রওনা দিয়েছি মন্দিরের দিকে। এটি একটি বিখ্যাত মন্দির। আমি মামুনের সঙ্গে কর্ণাটকের অনেক বিখ্যাত মন্দির ঘুরে দেখেছি।

পরে ভেতরে কোথাও গিয়ে এমনি বসেছিলাম। এ জন্য এ পাহাড়ের কথা মনে আছে। ভাইয়ের নানা কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হলেও তাঁকে এমনিতে কিছু বলার সাহস নেই, হাজার হোক বড় ভাই। মানুষের সামনে আর কী বলব? ততক্ষণে সব একটু সয়েও এসেছে। তবে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি না।

এখান থেকে নেমে পরে বাস গেল কাবেরী নদীর ওপর ফাউন্টেন গার্ডেনে। নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। আর নদীর ওপর সে বাঁধে মাইলের পর মাইল পানির ফোয়ারা বাগান। এ নদীর ওপরে ব্রিজের মতো করে দেওয়া অংশটুকুতে দাঁড়িয়ে নিমেষে যেন আমার সব কষ্ট মুছে গেল। পানির গতির দিকে তাকিয়ে আমি কেমন যেন আত্মহারা। প্রকৃতি যে আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনে, এ দিনটি তার প্রমাণ। আমি সব ভুলে গেলাম নিমেষে। খুশি হয়ে বললাম, ভাইজান এখানে আমার ছবি তুলে দাও। উনিও ছবি তুলে দিলেন। আমার চেহারায় সে রাগ নেই। এখানে বাংলা সিনেমার একটা গান দেখেছিলাম ছায়াছন্দে। চম্পা ও ইলিয়াস কাঞ্চনের বাংলা একটি সিনেমার গানের কথা, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’...মুহূর্তটা মনে হতেই কিঞ্চিৎ উদাসও হয়েছিলাম। আমি বাঁচব তো নাকি আমারও জীবনের গল্প অল্প বাকি আছে? আমার রিপোর্ট ভালো তো?

হাঁটতে হাঁটতে কাবেরীর বুকে ফোয়ারা বাগানে এলাম। মনে হয় কত চেনা! ভাইজান বললেন, সুরমা, তুই এখানে পানিতে দাঁড়া ছবি তুলি। ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করতেই পুলিশ দৌড়ে এলেন। আমি ততক্ষণে উঠে ‘সরি’ বলে জানালাম, জানি না। তবে আমরা ভাইবোন বিজয়ের হাসি হাসলাম। এখানে পানিতে পাবলিকের নামা বারণ। কিন্তু আমরা তো দুজনেই নিয়ম ভাঙতে ওস্তাদ। অসম্ভব সুন্দর এই বাগান, যা লিখে বলার মতো না। ক্রমে দিনের আলো পড়ে এল। ফোয়ারার লাল–নীল বাতি যেন আকাশে-বাতাসে মুগ্ধতা ছড়ায়। এখানে থাকার মতো একটা তিন তারা হোটেল আছে। কিন্তু আমাদের থাকার মতো অবস্থা না। তাই থাকা হয়নি। যদিও মনে মনে ভেবেছি, হয়তো কখনো আবার যাব। এত কিছুর পর আমার কৃতজ্ঞতা আমার ভাইদের প্রতি। নতুবা অনেক কিছু মিস করতাম।