রংধনু জীবন

এক দেশে ছিল এক রাজা আর রানি। তাদের ছিল এক ফুটফুটে রাজকুমার। তাদের সুখের সীমা নেই। তাদের রাজত্ব ছিল সবুজে ঘেরা অপরূপ চা বাগান। সবুজ অরণ্যে যখন সকাল হতো, সূর্য যেন ঝকমকিয়ে উঠত হাজারটা সোনামুখ নিয়ে। পাখির কলতান আর ফুলের সুবাসে ভোর হতো সেই প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা রাজপ্রাসাদে। প্রকৃতি যেন প্রগাঢ় আলিঙ্গনে তাদের ঘুম ভাঙাত। তারপর কি হতো সেই তরুলতায় ঘেরা প্রাসাদে?
আচ্ছা রাজা-রানি প্রসঙ্গটা একটু পুরোনো ধাঁচের, তাই না? আর কেমন যেন একটু অচেনা আর দূরের পৃথিবীর গল্প মনে হয়।
তো শুরু হোক না সাধারণভাবেই। হ্যাঁ, ওরা রাজা–রানি নয়। খুবই সাধারণ মানুষ, আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই স্বপ্ন দেখা চোখে পৃথিবীটাকে দেখে।
আচ্ছা কি নাম দেওয়া যায় মেয়েটার? আশা, লতা, মালতী? নাকি ঘাসফুল? না, ওর নাম থাকুক নীলা। নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে খুব ভালোবাসত নীলা। আকাশের সাদা মেঘেরা যখন ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেত; কখনো একঝাঁক পাখি, কখনো ময়ূরপঙ্খী নাও, কখনো বা আরও অনেক রকম অন্য কিছু! ওর মনটা সেই সাদা মেঘের সঙ্গে মিতালি গড়ত। কতভাবেই না স্বপ্নের নাটাইটা ছেড়ে দিত দূরে-বহু দূরে!
একদিন সেই নাটাইয়ে টান পড়ল। ধুম করেই বিয়ে হয়ে গেল। না, কোন রাজকুমার নয়, একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বিয়ে হলো। যেমন আর দশজনের হয়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে এল চা বাগানে। কারণ ওর স্বামী চা বাগানের ম্যানেজার। গল্পে পড়া চা বাগান যখন বাস্তবে ধরা দিল, তাও নিজের জীবনে, নীলা তাকে গ্রহণ করল প্রগাঢ় বিস্ময়ে আর কৌতূহলে। মনে পড়ল মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের কথা। আরও মনে পড়ল ‘ন হন্যতে’–এর কথা। যেখানে চা বাগানের পরিবেশের কথা উল্লেখ আছে।
নীলার সকালটা অনেক সুন্দর হয়ে উঠত, যখন সকাল হতেই বেয়ারা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়ে বলতো, ‘মেম সাহেব, আপনার চা। আরে বাবা, না চাইতেই চা চলে এল! তাও আবার কিনা মেম সাহেব সম্বোধনে! আর বেয়ারার পোশাকটাও কী সুন্দর! ঠিক যেন ফাইভ স্টার হোটেলের মত। আর চায়ের স্বাদ! সেতো ফাইভ স্টার হোটেলের স্বাদকেও হার মানায়। একটু বেলা বাড়তেই বাবুর্চি এসে হাজির। তারপর মালি, ঝাড়ুদার, ড্রাইভার, ধোপা, আয়া। নীলাতো অস্থির, এত মানুষ শুধু ওর একার জন্য! সপ্তাহ শেষে ক্লাব, পার্টি, খেলাধুলা, বাগানের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা আরও কত কী! দিনগুলো স্বপ্নের মতো বয়ে চলল। এর মধ্যে নীলার কোল আলো করে আসল ওর রাজপুত্র। নীলার বাগানের শত রকমের ফুলের মধ্যে ওর ছেলে যেন আরও একটা ফুল হয়ে বেড়ে উঠতে লাগল।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ওই যে, রূপকথার গল্পে আছে না! রাজা-রানির সুখের সংসারে আগুন দিতে একজন দৈত্যের আগমন ঘটে। নীলার জীবনেও হঠাৎ এক দৈত্যের আগমন ঘটল। আর তার ছোবলে লন্ডভন্ড হয়ে গেল চা বাগানের ছবির মতো সাজানো সংসার।
দৈত্যের এক হ্যাঁচকা টানে নীলার জীবন চা বাগানের ঘন সবুজ ছাড়িয়ে একেবারে আছড়ে পড়ল আটলান্টিক মহাসাগরের ওই পাড়ে। একেবারে আমেরিকার নিউইয়র্কে!
এরপরের জীবন? মন্দ না! একেবারে বাস্তব মার্কা জীবন। এখানে আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। এখানে নীলা খুব সকালে উঠেই অফিসে চলে যায়। সেই আবার বিকেলে ঘরে ফিরে কোমর বেঁধে কাজে লেগে যায়। সপ্তাহান্তে বাজার করা, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করা, বেড়াতে যাওয়া। আক্ষেপ নেই। পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার নামইতো জীবন। যখন পেঁজা পেঁজা বরফে ঢেকে যায় চতুর্দিক, বড় ভালো লাগে সেই বরফে চোখ ডুবিয়ে বসে থাকতে। মনে হয়, আকাশের সেই সাদা মেঘেরা যেন ঝরে পড়ছে ওর পাশে। নিরাপদে নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরছে দিন–রাতের যেকোনো সময়। ভালো না লাগলে একাই বের হয় গাড়ি নিয়ে। ছেলে বড় হয়। ছেলের বন্ধু-বান্ধব আসে। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের। কিন্তু কি চমৎকার সখ্যয় মেতে উঠে সবাই।
জীবনের রং ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। প্রবাসও হয়ে উঠে আপন আবাস। এখানেও নীলারা মেতে উঠে পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবে, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বরে।
কখনো চেরি ফুলের আগমন উৎসবে কখনো বা টিউলিপের সমারোহে। বাদ যায় না ক্রিসমাস, থ্যাংকসগিভিং ডে বা হ্যালোইনও।
উৎসবে আনন্দে বিমোহিত জীবনের রংগুলো বদলে যেতে থাকে। আবারও অনেক রঙের কাহিনি জমতে থাকে শীত–গ্রীষ্মের পাতায় পাতায়। আকাশের সাদা মেঘে, ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে।
আর সেই ফেলে আসা জীবন? থাক না রূপকথার ভেতরেই মোড়া! যখন মনে হবে, মাঝে মাঝে একটু খুলে দেখবে, নেবে তার নির্যাস!