'স্বাধীনতা' কেনার আনন্দ

ছুটির দিনের বিকেল পেরিয়ে প্রায় সন্ধ্যা। নিউইয়র্ক নগরের এক প্রান্তের শহরতলিতে দুই ফ্যামিলি হাউসের একটি বাড়ির বেসমেন্টের দরজায় দাঁড়ানো শায়লা। ভেতরে হইচই চিৎকার চলছে জোরেশোরে। মোট পাঁচজন ওখানে। শায়লার যমজ দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সঙ্গে বান্ধবীর এক ছেলে ও এক মেয়ে। পুরো বিকেল ওরা নিচের এই বেসমেন্টে অনেকক্ষণ ধরে খেলাধুলা করছিল। দরজায় দাঁড়াতেই দুই ছেলের একজন দৌড়ে এসে বলল, ‘থ্যাংকস, মা! আমরা এতক্ষণ ধরে খেলছি, আর তুমি একবারও এসে বললে না, বাচ্চারা আস্তে, চিৎকার করো না! তা না হলে নিচতলার লোকজন অভিযোগ করবে।’ ছেলের কথা শুনে শায়লা বলল, ‘না বাবারা, এখন থেকে তোমরা যত ইচ্ছে খেলতে পারো, কেউই আর অভিযোগ করবে না। এটা তোমাদের নিজেদের বাড়ি।’

ছেলেরা কী বুঝল শায়লা জানতে পারল না। তবে কথাটি বলে সে একটু থেমে গেল। নিজের বাড়ি, এই বিদেশের মাটিতে, তাও নিউইয়র্ক নগরে। শেষে কিনা নিজেদের একটি বাড়ি হলো! ততক্ষণে শায়লা চলে গেল অনেক পেছনে, প্রায় ১০ বছর আগে। বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামী ফয়সলের সঙ্গে নিউইয়র্কে এসে উঠলেন বড় ভাশুরের তিন বেডরুমের বাসায়। নিজস্ব বাসার দোতলায় পুরো ছয় সদস্যের পরিবার। ভাশুর ও জায়ের সঙ্গে তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। বাকি পুরো বাসা বেসমেন্টসহ ভাড়া দেওয়া। পুরো ফ্লোরে বাথরুম মাত্র একটি। ছোট একটি কিচেনের পাশে এক চিলতে জায়গায় চারজনের একটি খাবার টেবিল।

শায়লা শুধু বেকার। বাকি সবাই কাজ করেন। কারও কাজ দিনে, কারও বা রাতে, কেউবা বের হন ভোরে। দিন-রাতে বেশির ভাগ সময় বাথরুমে কেউ না কেউ থাকেই। সঙ্গে আবার বাইরে অপেক্ষমাণ কেউ। কারও কাজে যাওয়ার তাড়া, কারও কলেজ যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে; তাই নিয়ে সারাক্ষণ ক্যাঁচাল। এর ওপর বাথরুম থেকে বের হয়ে নানা নালিশ-আদালত। বিশেষ করে বড় জা প্রথমে পরোক্ষে বলতেন, পরে সরাসরি বলতে শুরু করলেন যে, বাথরুম পরিষ্কার থাকে না। নতুন নতুন অনেকেই বাথরুম পরিষ্কার রাখতে জানেন না বলে দীর্ঘ বক্তৃতা-বিবৃতি ও উপদেশ শুনতে হতো।

এসব শুনতে শুনতে আর বাসার রান্নার ঘানি টানতে টানতে দু বছরের মাথায় সংসারে এল যমজ দুই পুত্রসন্তান। এবার তো ঝামেলা এক লাফে বেড়ে দাঁড়াল তিন গুণ! সংসার দেখো, সঙ্গে দুই শিশু সন্তানকে। না পেরে স্বামীকে দিলেন আলটিমেটাম, ‘এক মাসের মধ্যে ভাড়া বাড়ি দেখো। না হলে ছেলে দুটোকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাব।’ এতে কাজ হলো। নতুন করে আবার সংসার সাজালেন কুইন্সের শহরতলির এক বিরাট ভবনের এক বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। দরজায় সারাক্ষণ সাদা দারোয়ান। লন্ড্রিসহ সব সুবিধা আছে নিচে। সবচেয়ে বড় বিষয় সারাক্ষণ বাথরুম নিয়ে নেই কোনো টেনশন। কারও অনুযোগ শুনতে হয় না।

শায়লা ভাবলেন নিজে কিছু একটা করবেন। কিন্তু ছেলে দুটোকে রেখে বাইরে গিয়ে কাজ করতে ভরসা পেলেন না বলে সেই পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত। দুই ছেলের ছিল বাড়ন্ত শরীর। দুই বছরের মাথায় বেশ বড় হয়ে থপথপ করে সারাক্ষণ দুজন হাঁটতে চাইত। ঘর ভর্তি খেলনা। চলছে এটা-সেটা ছোড়াছুড়ি, সঙ্গে পইপই করে ঘরময় দৌড়াদৌড়ি। তেমনি এক সময়ে এক রাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ। স্বামী রাতের কাজে। ডোর ভিউ দিয়ে দেখলেন অপরিচিত এক মুখ। এত রাতে দরজার এপাশ থেকে আগন্তুকের পরিচয় ও কী চান জানতে চাইলেন। বাইরে দাঁড়ানো অপরিচিত ব্যক্তির উত্তর শুনে হতবাক শায়লা। তিনি তাঁদের ঠিক নিচের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। শায়লার দুই শিশু সন্তানের হাঁটা ও খেলনা ছোড়াছুড়ির শব্দে তিনি ঘুমাতে পারছেন না; সেটাই জানাতে এসেছেন শায়লাকে। দরজার এপাশে শায়লা একেবারে চুপ। দুটো শিশু খেলছে, আনন্দ করছে; তার শব্দে লোকটি ঘুমাতে পারছে না! সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ লোকটি বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে এ রকম কথাই তো বলে গেল!

শায়লার খুব রাগ হলো। আজই ওর স্বামীকে বলবে আর ভাড়া বাড়িতে থাকবে না। নিজের বাড়ি কিনতে হবে। নিজের বাড়ি। সেখানে শায়লা নিজে বাস করবে স্বাধীনভাবে, সঙ্গে ওর সন্তানেরাও। পরদিন ফয়সলকে সব খুলে বলে নিজেদের বাড়ি কেনার বিষয়টি বললেন শায়লা। ফয়সল শুনে বলল, ‘আমিও তো চাই নিজের একটি বাড়ি হোক। কিন্তু তা যে বড্ড কঠিন। সে অনেক দূরের পথ। নিউইয়র্কে বাড়ি কেনা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। প্রথমে দরকার ভালো কাজ। এ ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, নিজের ভালো ক্রেডিট হিস্ট্রিসহ ভালো ক্রেডিট স্কোর।’

সব শুনে শায়লা বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই। তুমি নিজে আরও একটি ভালো কাজ খুঁজে নাও। আমিও কাজ করব।’ ফয়সল শুনে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলছ শায়লা? তা কী করে সম্ভব?’ শায়লা খানিকক্ষণ সময় নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘অবশ্যই সম্ভব। কাজ আমাকে করতেই হবে। আমার সন্তানদের সুখ, আনন্দ আর স্বাধীনতার জন্য আমার নিজের একটি বাড়ি চাই।’

শুরু হলো দুজনের সংগ্রাম। বাসার কাজ ও সন্তানদের দেখাশোনাসহ বাসার সব কাজ ফয়সল ও শায়লা ভাগাভাগি করে নিল। ফয়সল কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভালো আরও একটি কোর্স করে নিল। ছেলেদের বয়স যখন পাঁচ, তখনই ঘর আলো করে এল রাজকন্যা বসতি। দুজনই আদর করে ডাকত ময়না। দেশে ফোন করলেই শায়লার মা কাঁদেন আর বলেন, ‘কিরে মা, তোকে কী আর আমি দেখব না! আমার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। পারলে একবার দেশে আয় মা। আমাদের দেখে যা।’ শায়লা নীরবে কাঁদে আর মনে মনে বলে, ‘আসব মা, আসব। আগে আমি সন্তানদের স্বাধীনতা কিনে নিই। তারপর আসব।’

সপ্তাহজুড়ে দুজনে কাজ করেন, আর সপ্তাহান্তে বাড়ি দেখতে বেরোন। বাড়ি ভালো তো, লোকেশন ভালো না। কোথাও আবার স্কুল ভালো না। বাড়ি পছন্দ হয় তো দেখেন যে, সাবওয়ে থেকে অনেক দূর। সব একসঙ্গে মেলেও না, বাড়িও নেওয়া হয় না। মাসে মাসে এজেন্টদের সঙ্গে, ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক আর বৈঠক। নানা ধরনের অফার। এর মধ্যেও আছে অনেক শুভংকরের ফাঁকি।

অভিজ্ঞ বাড়ির মালিকেরা বলেন, ‘বাড়ি কেনার মূল বিষয় হলো সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া, যাতে নতুন কেনা বাড়ি গলার ফাঁস না হয়।’ এদিকে ব্যাংকের নির্ধারিত ডাউন পেমেন্টের পয়সা জমাতে গিয়ে নিজের সব শখ নির্বাসিত। কারও বাসায় যেমন খুব একটা যাওয়া হয় না, বন্ধুরাও তেমনি বাসায় আসা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথায় শুধু একই চিন্তা—বাড়ি, বাড়ি, বাড়ি। যেমন করেই হোক, একটি বাড়ির মালিক তাঁদের হতেই হবে।

সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে শায়লা ভাবতে থাকেন, কী কষ্টই না করেছেন এই বাড়ির জন্য। তিনটি সন্তানের দেখভাল করে এক হাতে রান্নাবান্না সেরে সপ্তাহের পাঁচ দিন কাজ করেছেন বিরামহীন পাঁচটি বছর! এত কষ্টের মধ্যেও কখনো ক্লান্তিকে মনে ঠাঁই দেননি শায়লা কিংবা ফয়সল। প্রতিদিন পয়সা গুনতেন, আর দুজন অনেক সময় নিয়ে বাড়ির এজেন্টের সঙ্গে বিরামহীন আলোচনা করতেন। তারপর একদিন দরজায় কড়া নাড়ল অনেক অপেক্ষার সেই খবর। নিউইয়র্ক শহরের উপকণ্ঠে পাওয়া গেল দুই পরিবার বসবাস করার উপযোগী সুন্দর একটি বাড়ি। পাশেই স্কুল। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিত বেশ সন্তোষজনক। দু বার বাড়িটি ভালো করে দেখে এলেন শায়লা ও ফয়সল। সাদা চামড়ার করিতকর্মা এজেন্ট জানাল, দ্রুত একটি দিন ঠিক করে নেবে মালিকানার দলিলে সই করার জন্য। পরদিন শায়লা সকালে যখন কাজে বেরোবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, ঠিক তখনই এজেন্টের টেলিফোন। ‘হ্যালো’, বলতেই এজেন্ট বললেন, ‘মিস আমার কাছে দুটো খবর, একটি ভালো অন্যটি মন্দ। ভালো খবর হলো, আপনাদের পছন্দের বাড়ির মালিকানা বদলের আনুষ্ঠানিকতার তারিখ ঠিক হয়েছে। আর মন্দ খবরটি হলো ব্যাংক মোট ঋণের আরও ১ শতাংশ বেশি ডাউন পেমেন্ট চাইছে, যার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ডলার।’

সব শুনে শায়লার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাহলে কি শেষমেশ তীরে এসে তরি ডুবতে বসেছে? দুজনই পণ করলেন, তা হতে দেবেন না তাঁরা। ফয়সল বললেন, ‘তুমি তোমার বন্ধুদের কাউকে বলো। আমি বলব বড় ভাইয়াকে।’ দুদিনের মাথায় তা-ও জোগাড় হয়ে গেল। নতুন বাড়ির মালিকানার দলিলপত্রে সই করতে যাওয়ার আগের রাতে দুজনের কেউই এক মিনিটের জন্য ঘুমাতে পারেননি। দুজনের সামনে শুধু ছিল একটিই ছবি—ওদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ‘স্বাধীনতা’। ওরা বাড়িময় দৌড়াবে, খেলবে, হইচই করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। কেউ তাদের বলবে না—‘এই বাচ্চারা, শুনছ, তোমরা এভাবে চিৎকার আর হই হুল্লোড় করবে না। আমি ঘুমাতে পারছি না!’

মেয়ে ময়নার ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলেন শায়লা। মেয়ে ডাকছে, মা, ওপরে এসো। বাবা অফিস থেকে এইমাত্র ফিরেছে। তোমাকে খুঁজছে!