গুডবাই

চার্চের সামনে বসে আছি। আমার চুল সোনালি। চুল কান পর্যন্ত সুন্দর করে কাটা। পারলারে কেটেছি। পরনে কালো স্কার্ট আর সবুজ শার্ট। এখন হালকা শীতের সময়। গায়ে গোল্ডেন কোট। কালো স্যু, সাদা মোজা পায়ে। আমার নাম এলিজা।
১৯৩৬ সালে ইতালির সিসিলিতে জন্ম। জন্মের পর চার বছর বাবা-মার কাছে থেকেই বড় হচ্ছিলাম। চার বছর বয়সের সময় চাকরির কারণে বাবা বেলজিয়ামে চলে যান। মাঝে মাঝে আসতেন। এ কারণে আমি মায়ের সঙ্গে থাকতাম। বয়স যখন ১২ তখন সপরিবারে আমেরিকায় চলে আসি। আমেরিকায় এসে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের বেনসনহার্স্টে বাড়ি কিনলেন বাবা। ফোর ফ্যামিলি হাউস। এই বাড়িটির এক অংশে আমরা থাকি আর বাকি তিনটি অংশ ভাড়া দেওয়া।
স্কুলে ভর্তি হলাম। একে একে এলিমেন্টারি মিডল স্কুল শেষ হলো। হাইস্কুলের শেষ ধাপ। প্রেম হয়ে গেল বয়সে একটু বড় স্যামুয়েলের সঙ্গে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙেও গেল সেই প্রেম। সম্পর্কে খোলামেলা হতে না চাওয়ায় ব্রেকআপ হয় স্যামুয়েলের সঙ্গে। একটি চুমু ছাড়া প্রেমে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
পরে ব্রুকলিনের কিংস বরো কলেজে ভর্তি হলাম। ইতিমধ্যে ক্যাপিটাল ওয়ান ব্যাংকে কাজ শুরু করি টেলার হিসেবে। শনি ও রোববার চার্চে যাই। চার্চে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। কখনো শুক্রবার কাজের পর সোজা চার্চে চলে যাই। চার্চের কাজে সাহায্য করতে খুব ভালো লাগে।
এরই মাঝে মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাকে দেখাশোনার জন্য ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলাম। মায়ের দেখাশোনা আর চার্চ এই করে করে সময় কাটছিল। কিছুদিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যু হলো।
মায়ের মৃত্যুর পর দেখলাম একদম শূন্য আমার জীবন। সেই মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম দিনরাত চার্চে থাকতে ভালো লাগছে। পাস্টর বা যাজক এরিখকে আমার ভালো লাগছে। চার্চের একগোছা চাবি আমার কাছেই থাকে। সকালে উঠে এক কাপ কফি খেয়েই চার্চে যাই।
একদিন বুঝতে পারলাম আমি এরিখকে
অসম্ভব ভালোবাসি। আমার ধারণা এরিখও আমাকে ভালোবাসে। মনে মনে প্রতিদিন ভাবি, আজ বুঝি এরিখ প্রপোজ করবে।
ইতিমধ্যে ব্রুকলিন স্টুডিও স্কুলে চাকরি পেয়ে যাই। রোববার গির্জায় একটা পার্টি আছে। আগের দিন সেলুনে গিয়ে চুল ব্লো ডাই করেছি। মেনিকিউর পেডিকিউর করেছি। তারপর অফ হোয়াইট মিডি ড্রেসের ওপর কালো ব্লেজার পরেছি। আমি সব সময় জুয়েলারি ভালোবাসি। তাই জুয়েলারি পরলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ। যখন আমি পৌঁছালাম তখন সাজানো শেষ করেছে। সবকিছুই মনোহর। যে পরিবারের অনুষ্ঠান তারাও চার্চে এসে গেছে। সিক্সটিন বার্থ ডে যে মেয়েটির তার বড় বোনের নাম জেসমিন। সে মাঝে মাঝে আসে এখানে। তাদের মা আমাকে ডেকে কথা বললেন। আমি লক্ষ্য করলাম জেসমিন নামের ওই মেয়েটির ডান হাতের অনামিকায় একটি আংটি। জেসমিনের মাকে হেসে হেসে বললাম—ওর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে?
—হ্যাঁ, এই তো গত সপ্তাহে এরিখের সঙ্গেই। শিগগির বিয়ে করবে ওরা।
আমার সারা পৃথিবী দুলে উঠল। আমি এত শকড হলাম যে, তাকে অভিনন্দন জানাতে ভুলে গেলাম। পাথর হয়ে গেলাম। একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বসে পড়লাম।
আর মনে মনে বলতে লাগলাম, আমাকে শক্তি দাও প্রভু। প্রভু আমাকে শক্তি দাও।
বাসায় গিয়ে তিন দিন বিছানায় শুয়ে থাকলাম। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে একাই থাকি দুই বেডরুমের এই বাড়িতে। কখনো আমি এত শোকাহত হইনি। আজ আমি ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি। মায়ের মৃত্যুর পর এরিখ আমার দুঃখে মাথায় হাত বুলিয়েছিল। বাসায় ফুল আর খাবার নিয়ে এসেছিল। একেই ভালোবাসা ভেবেছিলাম।
এক সপ্তাহ পরে একটা সাদা কাগজে গুডবাই লিখে আমার কাছে থাকা চার্চের চাবি পৌঁছে দিতে গিয়ে এরিখের সামনে পড়লাম। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কাগজের ওপর চাবি রেখে চলে এলাম। সেই যে এসেছি এরপর এত বছরেও ওই চার্চের দিকে যাইনি।
পঞ্চাশ বছর আমি আর যাইনি ওই গির্জায়। তবে চাবি দেওয়ার পরদিন এরিখ এসে জানতে চেয়েছিল, আমি কোথাও মুভ করছি কিনা। আমি মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেছিলাম—না মুভ করছি না। তবে আমার মন মুভ করছে।