স্বার্থপর মানুষ

লেক্সিনটন অ্যাভিনিউর সাবওয়ে স্টেশন থেকে ওপরে উঠে দুই ব্লক হাঁটলেই ঢাকিড়ার রেস্টুরেন্ট। নিউইয়র্ক সিটির মিডটাউন ম্যানহাটনের চোখ ধাঁধানো ঝাঁ-চকচকে দোকানপাটের মাঝে ঢাকিড়ার রেস্টুরেন্টটা বেশ বেমানান। অযত্ন আর অবহেলায় কোনো রকমে টিকে আছে, দেখলেই বোঝা যায়। এমন একটা জৌলুশহীন চেহারা দেখেই একদিন এই রেস্টুরেন্টে ঢুকেছিলাম কম দামে খাবার পাওয়ার আশায়। তখন মাত্র বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা এসেছি।
রাস্তায় হেঁটে হেঁটে দোকানে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। কাজ পাই না। কিন্তু পেটে খিদে পায়। মাথার ভেতর তখন ক্যালকুলেটর সেট করা—এক ডলার সমান আশি টাকা। যেকোনো খাবারের দাম শুনলেই মাথার ভেতরে মাল্টিপ্লাই হয়ে যায়। তখন ক্ষুধা দৌড়ে পালায়। সেই সঙ্গে আমিও। এ ছাড়া আছে ভাষাগত সমস্যা। খাবারের নাম জানি না। যা বলি তা দোকানদার বোঝেন না। তাই ঢাকিড়া নাম দেখে কেমন একটা বাংলা বাংলা গন্ধ পেয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। ঢুকেই দেখি এক বয়স্ক নারী ক্যাশ রেজিস্ট্রারে দাঁড়ানো। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এয়ারপোর্টে নামার পর ঠিক এমনই এক নারীর কাছে ধমক খেয়ে মনের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এখন এমন কাউকে দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। তাই কোনো কিছু না বলেই যখন বেরিয়ে আসছি তখন পেছন থেকে ওই নারী ডাকলেন।
—এক্সকিউজ মি, আর ইউ লুকিং ফর সামথিং?
—নো, নো, নো নাথিং। স্যরি।
—আর ইউ বাঙালি? আসসালামু আলাইকুম। আপনি ভালো আছেন। আমি ভালো আছি।
আমার উত্তরের তোয়াক্কা না করেই কথাগুলো বলে ফেললেন। শুনলেই বোঝা যায় শেখা বুলি। আমিও অবাক হয়ে সদ্য মুখস্থ করা বুলি আওড়ালাম।
—আই অ্যাম লুকিং ফর এ জব। ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি হায়ারিং?
—ওকে ইয়াং ম্যান। হ্যাভ এ সিট। আই ওয়ানা টক টু ইউ।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো একটা চেয়ারে বসলাম। না বসে উপায় নেই। কিছু একটা বলে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার মতো ভাষা বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। কিছুক্ষণ পর কতগুলো কাগজ হাতে নিয়ে এসে আমার সামনে বসলেন। কথাবার্তা বলার পর কিছুটা সহজ হলাম। ভয়টা কাটল, চাকরিও হলো।
—আই থিংক ইউ আর হাংরি। হ্যাভ সাম ফুড।
চাকরি পেলাম। খাবার পেলাম। পরদিন থেকে কাজ শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় ঢাকিড়ার সঙ্গে। ঢাকিড়া কথা বলেন। আমি শুনি। মাথা নাড়ি। ইয়েস নো ভেরি গুড বলি। কারণ অন্য কিছু বলতে পারি না। যা বলতে চাই তা বাংলা থেকে ইংরেজি করতে করতে বলার সময় শেষ হয়ে যায়। এভাবেই ঢাকিড়ার কাছে আমার নয় মাসের চাকরি জীবনও একদিন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কীভাবে যেন আমার জীবন বাধা পড়ে যায় ঢাকিড়ার স্নেহের কাছে। যদিও ঢাকিড়া নিজের জীবনে কখনো স্নেহ ভালোবাসা পাননি। তা নিয়ে তাঁর অনেক কষ্ট ছিল। সেই কষ্টের কথাই তিনি আমাকে বলে নিজেকে একটু হালকা করার চেষ্টা করতেন।
ঢাকিড়ার জন্ম আফ্রিকার দেশ বারকিনা ফাসো। বাবা-মায়ের খুব অভাবের সংসার ছিল। অনেকগুলো ভাই বোন। বেশির ভাগ দিনই না খেয়ে ঘুমাতে হতো। এই স্মৃতি ছাড়া তাঁর আর কোনো স্মৃতিই মনে পড়ে না। এমনকি বাবা-মার চেহারাও তিনি মনে করতে পারেন না। সাত বছর বয়সে বাবা তাঁকে বিক্রি করে দেন এক আদম ব্যাপারীর কাছে। অনেক পথ-ঘাট পার হয়ে আর হাত বদল হতে হতে তাঁর ঠাঁই হয় ঘানার এক চকলেট ফার্মে। সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করতে হতো। খাবার হিসেবে দেওয়া হতো সেদ্ধ ভুট্টা আর কলা। রাতে শেকল দিয়ে পা বেঁধে দরজা জানালাহীন কাঠের খোঁয়াড়ে অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে রাখা হতো। যেন পালাতে না পারে। কাজ ছিল, সারা দিন কোকোবিন শুকানো।
ঢাকিড়া বলতেন, কোকো ফিল্ডের পোকা, বিচ্ছু আর সাপের কামড়ে কত ছেলেমেয়ে মারা গেছে কিন্তু আমি মারা যাইনি। পালানোর চেষ্টা করলে বেধড়ক মারধর আর যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এই নির্যাতনে কেউ মারা গেলে তাকে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। এত ভয়ভীতি উপেক্ষা করেও একদিন পালিয়ে নদী আর বন পার হয়ে চলে আসেন দূরের এক গ্রামে। তখন তাঁর বয়স ১৫-১৬ বছর হবে। আশ্রয় পান সেই গ্রামেরই এক অবস্থাপন্ন বাড়িতে। সে বাড়ির আমেরিকাপ্রবাসী ছেলে ডেভিড আর তার বউ জেনি তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে। ডেভিড-জেনি দম্পতি ছিল নিঃসন্তান। তারা ঢাকিড়াকে দত্তক কন্যা হিসেবে আমেরিকা নিয়ে আসে। পরে তারা মেয়ের নামেই লেক্সিনটন অ্যাভিনিউয়ে এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করে।
ঢাকিড়া বলতেন, তাঁদের ভাষায় তাঁর নামের অর্থ সব সময় ঈশ্বরকে স্মরণ করা। অথচ দেখ, ঈশ্বর সব সময়ই আমাকে শুধু বঞ্চনা করে। দোকান চালু হতে না হতেই ডেভিড দম্পতি কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তখন দোকানে তারেক নামের একজন কর্মচারী ছিলেন। তিনি দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আমেরিকা এসেছিলেন। কোনো কাগজপত্র ছিল না। বাবা-মাকে হারিয়ে ঢাকিড়া তখন তারেকের ওপর নির্ভরশীল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাগরিকত্বের আশায় বিয়ে করে ফেলেন ঢাকিড়াকে। তাঁদের একটা ছেলে সন্তান হয়। নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তারেক সেপারেশনে যান। পরে দেশ থেকে এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে এনে ফ্লোরিডায় থাকা শুরু করেন। ছেলেকে বড় করেছে ঢাকিড়া। সে এখন অন্য স্টেটে থাকে। মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না।
রেস্টুরেন্টে ঢাকিড়ার ছেলের একটা ছবি টাঙানো আছে। ছবিটা দেখিয়ে ঢাকিড়া বলতেন, তুমি দেখতে ঠিক আমার ছেলের মতো। প্রথম দিন তোমাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যেন আমার ছেলেই আমার কাছে ফিরে এসেছে।
যদিও সে ছবির সঙ্গে আমার কাছাকাছি বয়স ছাড়া আর কোনো মিলই আমি খুঁজে পাইনি। তবু মায়ের মন আমাকেই আঁকড়ে ধরেছিল আপন করে। যে ছেলে মায়ের কোনো খোঁজ রাখে না সেই ছেলেকে খুঁজে ফেরে জনম দুঃখী এক মা অন্য ছেলের মাঝে। আমি ঢাকিড়ার মাঝে এমনই এক মায়ের সন্ধান পেয়েছিলাম।
আমি যখন অন্য ভালো চাকরির চেষ্টা করছি তখন তিনি ব্যাপারটা জেনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু বাধা দেননি। মা যেমন সন্তানকে তার কাছে রাখতে চায় অথচ সন্তানের মঙ্গলের জন্য আশীর্বাদসহ দূর দেশে পাঠিয়ে দেয় তেমনি ঢাকিড়াও আমাকে বলেছেন—তুমি অনেক শিক্ষিত মানুষ। চাকরির চেষ্টা করছ জেনে খুশি হয়েছি। তুমি অবশ্যই ভালো চাকরি পাবে। যেকোনো সহযোগিতা দরকার হলে আমাকে জানাবে। আর চাকরি পেয়ে আমাকে ভুলে যেও না।
তাঁর কথার ভেতরে এক ধরনের আকুতি ছিল—সন্তানের কাছে মায়ের আকুতি। আর তাই যখনই চাকরি পরিবর্তন করেছি, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছি, সিটি গভর্নমেন্টের এ-ডিপার্টমেন্ট থেকে সে-ডিপার্টমেন্ট গেছি, স্টেট গভর্নমেন্টের চাকরি করেছি, প্রতিবারই ঢাকিড়ার সঙ্গে দেখা করেছি। ঢাকিড়া প্রতিবারই বলেছেন, আমি তোমাকে আরও বড় জায়গায় দেখতে চাই। শেষ বার যখন দেখা করেছি তখন ঢাকিড়া বেশ অসুস্থ।
তখন বলেছেন—আমার ছেলে তো ফিরে আসবে না। তুমি আমার বিষয় সম্পদ যা কিছু আছে একটু খেয়াল রেখো। আমি সব ব্যবস্থা করে যাব।
এরপর আমার নিজের নাগরিকত্ব হয়েছে। সংসার-চাকরি সবকিছুতেই ব্যস্ততা বেড়েছে। ফেডারেল জবের জন্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা, ট্রেনিং সব মিলিয়ে বছর পার হয়ে গেছে। ঢাকিড়ার আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি।
আজ যখন ঢাকিড়ার রেস্টুরেন্টের সামনে হাজির হলাম তখন মনে হলো কোথায় যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা সংস্কার হয়েছে। মলিনতার পরিবর্তে কিছুটা নতুনত্বের ছাপ লেগেছে।
দরজা ধাক্কা দিতেই দেখলাম নতুন একজন ক্যাশ রেজিস্ট্রারে। চিনতে মোটেই কষ্ট হলো না। রেস্টুরেন্টে ঢাকিড়ার এই ছেলের ছবিই টাঙানো ছিল। আমার সঙ্গে যার চেহারার মিল খুঁজে পেতেন ঢাকিড়া। এখন ছেলের ছবির পাশে ঢাকিড়ার একটি নতুন ছবি টাঙানো হয়েছে।
—ইজ ঢাকিড়া হেয়ার? ক্যান আই টক টু হার?
—নো, সি ইজ নো মোর। সি পাসড অ্যাওয়ে লাইক ওয়ান ইয়ার। আর ইউ নোন টু হার?
ছেলেটা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল।
আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম—ইয়েস, আই নো হার।
এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরেই একটা টেবিলে বসে ভাবছি ঢাকিড়ার কথা। মৃত্যুর মুহূর্তেও হয়তো তিনি আমাকে স্মরণ করেছেন। আমি হয়তো তখন অন্য কোনো স্টেটে ছিলাম। এ ছাড়া তিনি তো আমার নতুন বাড়ির ঠিকানাও জানতেন না। আমি হয়তো নিউইয়র্ক সিটিতেই ছিলাম। ঢাকিড়ার মৃত্যু সংবাদটা জানা হয়নি। বুকের ভেতর থেকে কেমন যেন একটা ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠে গলার কাছে আটকে গেছে। মনে হলো, এইমাত্র আমি খুব কাছের কারও মৃত্যু সংবাদ জানলাম।
—এক্সকিউজ মি। টেক দিস ন্যাপকিন। ইউ লুক ভেরি আপসেট। ইজ ইওর নেম রাজু, আই মিন রাজীব সরকার।
আমি সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, ইয়েস, আই থিংক ইউ আর পিটার।
পিটার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, নাইস টু মিট ইউ।
—নাইস টু মিট ইউ টু।
—মা মৃত্যুর আগে তোমাকে অনেক খুঁজেছে। অনেকবার তোমার নাম ধরে ডেকেছে। আমাদের কাছে তো তোমার কোনো কন্টাক্ট নম্বর নেই। তবে ধরে নিয়েছিলাম, তুমি একদিন আসবে।
তারপর পিটার ভেতর থেকে একটা মুখ আটকানো ব্রাউন খাম এনে আমার হাতে দিল। বলল, মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর বাঙালি মাকেও নিয়ে এসেছি নিউইয়র্কে। আমি একা তো সবকিছু সামাল দিতে পারি না। এ ছাড়া বাবা তো এই রেস্টুরেন্টেই কাজ করতেন। আমার তো রেস্টুরেন্ট চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তুমি মাঝে মাঝে এসো। মা তোমাকে খুব পছন্দ করতেন।
কথাগুলো ইংরেজিতেই বলল। বাংলা সে কিছু কিছু বুঝতে পারলেও বলতে পারে না। আমি কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটা মানুষ শেষ জীবনটা অসহায়ভাবে কাটিয়েছেন। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ানোর ছিল না। স্বামী ত্যাগ করেছে তাঁর স্বার্থ উদ্ধার করে। ছেলে ত্যাগ করেছে। আজ তাঁর অবর্তমানে সবাই মধু খেতে ছুটে এসেছে। মানুষ স্বার্থের কাছে বড়ই অন্ধ। চক্ষু লজ্জাও কাজ করে না।
পিটারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। আমারও উচিত ছিল অসহায় মানুষটার খোঁজ খবর রাখার। তিনি তো তাঁর অবর্তমানে আমাকেই সবকিছু দেখাশোনা করতে বলেছিলেন। তখন তিনি আশা করেননি ছেলে ফিরে আসবে। স্বার্থের টানে সবাই যেমন তাঁকে ত্যাগ করেছিল—এখন স্বার্থের টানেই আবার সবাই ফিরেও এসেছে। এই সব ভাবতে ভাবতে সাবওয়েতে না নেমে কখন যে ইস্ট রিভারের পাড়ে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। হাতের খামটা খুলতে সাহস হলো না। হতে পারে তাঁর জীবনের আরও কিছু অজানা দুঃখের ভার আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চেয়েছে অথবা হতে পারে কোনো দায়িত্বের ভার। জীবনকে অযথা জটিল করে লাভ কী?
খামটা ইস্ট রিভারের স্রোতের সঙ্গে ভেসে যেতে থাকল। আমি সাবওয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।