ভালোবাসি নীরবে

রাত ১২টায় অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ম্যাসেজ এল সাদিয়ার মোবাইলে। লেখা, ‘আই লাভ ইউ।’ সাদিয়া ভাবে অচেনা নম্বর, হয়তো ভুল করে কেউ ম্যাসেজ দিয়েছে। কিন্তু পরপর তিনটি ম্যাসেজ এল, প্রতিটিতেই লেখা, ‘আই লাভ ইউ।’ সে ভাবছে, কে হতে পারে? উত্তর দেবে কি না? এই ভাবনার মধ্যেই কল এল। সাদিয়া ফোনটা রিসিভ করে বলে, ‘হ্যালো কে বলছেন?’ অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘আমি হাসান।’
-ওহ তুই বান্দরটা নাকি?
-এটা আমার নতুন নম্বর। আর শোন, আমাকে কথায় কথায় বান্দর বলবি না। আমি তোর ছেলের বাপ হব একদিন জেনে রাখিস। আমাকে বান্দর বললে তুই বান্দরের বউ। শোন সাদিয়া আমার একটা কথা রাখবি আজ?
-কী বল।
-আয় না, একটু ছাদে যাই।
-কেন?
-কেন আবার! আমার মন চাইছে তোকে দেখতে। আজ ভালোবাসা দিবস না।
-তোর পাগলামো স্বভাবটা কি যাবে না? ভালোবাসা না ঘোড়ার ডিম দিবস—এসব আমি পালন করি না। মন কেন চাইছে এত রাতে আমাকে দেখার? সন্ধ্যায় তো দেখা হলো।
-আচ্ছা তুই কি কোনো দিন বুঝবি না আমাকে? আয় না প্লিজ ছাদে যাই।
সাদিয়া ছাদে যাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে দরজা খুলবে, ঠিক তখনই মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে এত রাতে কই যাস?’
-মা, আমার ঘুম আসছে না। একটু ছাদে যাব।
-না, এত রাতে কেন যাবি? আয় আমার কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়ে যাবি।
কোনো উপায় না দেখে সাদিয়া মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল। মায়ের আদর পেয়ে ছাদের কথা ভুলে কখন যে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম ভাঙল যখন ফজরের আজান হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই ভাবল, হাসান যে ছাদে আসার কথা বলেছিল। সে আস্তে দরজা খুলে ছাদে গেল। দেখল হাসান ঠান্ডার মধ্যে কয়েকটি মোম জ্বালিয়ে বসে আছে। ‘কী রে এখন এলি! আমি তো সারা রাত তোর অপেক্ষায়। আর তুই শেষ রাতে এলি?’
-কী করব, আসার সময় মা আটকে দিলেন। মা ঘুম পাড়িয়ে দিলেন যে।
-কেন তুই কি শিশু? তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে?
-আমি তাদের কাছে শিশুই। একটি মাত্র মেয়ে তো। সে তুই বুঝবি না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাদিয়া আবার বলল, ‘সরি রে, ঘুম চলে এল। কী করব বল? এখন বল কেন ডেকেছিলি?’
-কেন আবার, আমার সুইট বউটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব, তাই।
-আমাকে আবার নতুন করে দেখার কী আছে। রোজই তো দেখিস। একই বিল্ডিংয়ে থাকি। চার বছর ধরে দেখছিস। একই কলেজে পড়ি। দুজন দু ক্লাসে এই যা। আর শোন, কথায় কথায় আমাকে বউ বউ করে ডাকবি না। লোকে শুনলে কী বলবে?
-লোকে কী বলবে মানে? আমার তো ইচ্ছে করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই তুই আমার বউ।
-প্লিজ হাসান এভাবে বলিস না। মা-বাবা জানলে তোর খবর আছে।
-করুক, আমি ভয় পাই না। আর তারা আমার খবর করলে তোর কী? তুই তো আমাকে ভালোবাসিস না।
-দরকারি কিছু থাকলে বল। রোজই তো বলিস এসব ভালোবাসার কথা। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তা ছাড়া মা দেখলে সমস্যা হবে; আমি যাই।
-তুই তো ঘুমের রানি। খালি ঘুম আর ঘুম। দিনে ফোন দিলে বলে ঘুমে ধরেছে, রাতে দিলে তো ঘুমই। আমি যে তোর জন্য সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম।
-আমি কি বলছি তোকে না ঘুমিয়ে ঠান্ডার মধ্যে ছাদে বসে থাকতে?
-বলিসনি ঠিক আছে, কিন্তু তুই কি বুঝিস না কেন আমি এসব করি? তোকে আর কীভাবে বোঝাব? প্লিজ একবার আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা কর। একবার মুখ ফুটে বল আমাকে ভালোবাসিস। আমি এ নিয়ে কতবার তোকে ‘আই লাভ ইউ’ বলেছি হিসাবে আছে?
-আজ তিনবার বলেছিস। এই নিয়ে প্রায় হাজারবার হবে হয়তো।
-তুই কি এই জীবনে একবারও বলবি না?
-না।
-প্লিজ আজকে ভ্যালেনটাইন ডে। তুই আমাকে একবার অন্তত ভালোবাসি বল না রে। এই কথাটি শোনার জন্য সারা রাত অপেক্ষায় আছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ তুই একবার বল।
-না, পারব না এসব বলতে। আমি যাই, ঘুমাব।
-যা ঘুমা, তোর মুখ দেখতে চাই না আর।
সাদিয়া কিছু না বলেই ছাদ থেকে চলে যায় একবারও হাসানের দিকে না তাকিয়ে। হাসান অপলক চোখে সাদিয়ার চলে যাওয়া দেখে। তার আশা, সাদিয়া ফিরে এসে বলবে, ‘ভালোবাসি’। কিন্তু না, সাদিয়া নীরবে চলে যায়। সাদিয়া ফিরে আবারও বিছানায় লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ওঠে ঠিক সকাল ১০টায়। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল হাসানের ম্যাসেজ। লেখা, ‘ঘুম থেকে উঠে ছাদে যাবি।’ ঘুম থেকে উঠে ছাদে গেল সাদিয়া। গিয়ে দেখল, ছাদে একটা খাম পড়ে আছে, সঙ্গে কিছু ফুল ও চকলেট। খামটা খুলে দেখল, একটা চিঠি। তাতে শতবার লেখা ‘আই লাভ ইউ’। রক্ত লাল অক্ষরে লেখা। শেষে লেখা, ‘আমি আজ ৩টার ফ্লাইটে কানাডা চলে যাচ্ছি। তোকে আর বারবার বলব না ছাদে আয়। কিংবা ফোন দিয়ে যখন-তখন ঘুম থেকেও তুলব না। গত রাতে ছাদে ডেকেছিলাম তোকে। ভাবলাম, যদি এই ভালোবাসা দিবসের রাতে একবার ভালোবাসি কথাটা বলিস। কিন্তু তুই এলিই না। শেষ রাতে যাও এলি, বললি না কিছু। ঘুম ধরেছে বলে চলে গেলি। আমার কপাল খারাপ তোকে আমার মনের কথা বোঝাতে পারিনি। যখন-তখন তোকে ডাকতাম, বিরক্ত করতাম—এ সবই করেছি তোকে পাওয়ার জন্য। তোকে এক পলক দেখতে আর ডাকব না, বিরক্তও করব না। কতটা ভালোবাসি তার অনেক প্রমাণ তোর কাছে আছে। কিন্তু তারপরও তুই নীরব। জানি না এর কারণ। তুই আমার জীবনের প্রথম ভ্যালেন্টাইন—এটা জেনে রাখিস। খুব কষ্ট পেয়েছি। তোকে খুব মিস করব। ভালো থাকিস। আমার ভালোবাসা ভুলে যাস।’
চিঠিটা পড়ে সাদিয়ার চোখে পানি জমে গেল। শুধু মনে মনে বলতে লাগল, ‘ঘোড়ার ডিমের ভালোবাসা দিবস। আমি তোকে বারো মাস ভালোবাসি। আচ্ছা ভালোবাসি কথাটা কি শুধু মুখে বলতে হয় প্রিয়জনকে। কিছু কিছু ভালোবাসা বুঝে নিতে হয়রে গাধা। তোর পাগলামিকে যে বড্ড ভালোবাসি। ভালোবাসি বলে দিলেই তো তোর পাগলামি বন্ধ হয়ে যাবে; তা আর আমি পাব কই? নীরবে কি ভালোবাসা যায় না? শুধু কি মুখে বলতে হবে গাধা? মুখের বুলির জন্য বসে আছিস, আর দিনে যে শতবার বলছি ভালোবাসি, তা শুনিস না?’
সাদিয়ার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। আর মন থেকে বলছে, ‘ইউ আর মাই ভ্যালেন্টাইন।’ বিড়বিড় করে শুধু বারবার বলছে, ‘অভিমানী চলে যেয়ো না। সবে তো এলে। এখনো তোমায় ভালোবাসি বলা হয়নি। তোমার চোখে রংধনুর সাত রং মাখিয়ে আলপনা করা হয়নি। অভিমানী তুমি যেও না।’