যানজটের এই শহরে

অমর একুশে বইমেলা চলছে। আর আমি একজন লেখক, ২০২০ বইমেলায় যার একটি সদ্য প্রকাশিত বই এসেছে; রয়েছে আগে প্রকাশিত আরও চারটি বই, সে কিনা বেকার হয়ে ঘরে বসে আছে। আমার মন ছুটে যায় বইমেলায়। ইচ্ছে করে বইয়ের স্টলে প্রতিদিন গিয়ে বসি। পাঠকের সঙ্গে, বইপ্রেমীদের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করি। কিন্তু প্রতিদিন সকাল হলেই ভাবি, আজ মেলায় যেতে পারব তো? যেদিন যাওয়া হায়, মন আনন্দে নেচে ওঠে। যেদিন যাওয়ার সুযোগ হয় না, সেদিন মন খারাপ করে বসে থাকি। এই কষ্টের কথা কাকে বলি? কারণ, এখন আমি ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট চিনি না। কোনো সঙ্গী না পেলে, একটি নির্ভরযোগ্য যানবাহন না পেলে একা পথে নামতে ভয় পাই। এই ভয় পথ হারানোর। এই ভয় নিরাপত্তার। এই ঢাকা আমার কাছে আগের মতো পরিচিত নয়। আমি পথে নামলে পথ হারিয়ে ফেলি; দিগ্ভ্রান্ত হই। প্রচণ্ড যানজট, বিপুল জনস্রোত আমাকে বিব্রত, ভীত, কোণঠাসা করে ফেলে। মনে মনে ভাবি, এই কি সেই ঢাকা? এই কি সেই তিলোত্তমা শহর? আমার বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা প্রিয়তম শহর ঢাকা, তোমায় আমি কোথাও আর খুঁজে পাই না কেন? এ কি আমার ব্যর্থতা? নাকি তুমিই আমূল বদলে গেছ? আঠারোটি বছরের ব্যবধান! কম সময় তো নয়!

আমার জন্ম ঢাকা শহরের মিটফোর্ড হাসপাতালে। তখনো পুরান ঢাকা তেমন পুরোনো হয়নি। শুধু ঢাকাই হয়তো ছিল। ওটা ষাটের দশকের কথা। তারপর মাঝখানে লম্বা কয়েক বছরের বিরতি। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ শূন্যতা। ওই সময়টা ব্যাংকার বাবার চাকরির সুবাদে পুরো পরিবার পিরোজপুর, ভোলা, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নানা জায়গায় বাস করছিলাম। তাই আমার শৈশব, কৈশোরের শুরুটা কেটেছে দক্ষিণে।
এরপর আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন; ১৯৭৫ সালে। পরবর্তী পড়াশোনা চলল ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে। বিয়ের সূত্রে আবার যেতে হলো দক্ষিণে; সেই কৈশোরের ফেলে আসা বরিশাল শহরে। তিন বছর কাটল বরিশালে। কিন্তু আমি তো ঢাকার মেয়ে। ঢাকার বাইরে থাকলেই জল থেকে তোলা মাছের মতো ছটফট করি। জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
আবার ফিরে এলাম ঢাকায়। জীবন একসময় খুব গতানুগতিক হয়ে উঠল। মন আনচান করতে লাগল। আরে জীবন যে ফুরিয়ে আসছে। বিধাতার তৈরি এত সুন্দর পৃথিবীটা একটু ঘুরেফিরে দেখব না। নিজের চোখে দেখতে চাইলাম, স্বপ্নের শহর প্যারিস, রোম, লন্ডন, নিউইয়র্ক। আকাশ আমায় হাতছানি দিল। আমি বাক্সবন্দী জীবনকে গুডবাই বলে উড়ে গেলাম স্বপ্নের নগরী নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক আমায় হতাশ করেনি। দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিয়েছে। তার আলিঙ্গনে আমি সুখী হয়েছি; আশ্বস্ত হয়েছি। সেখানে একটি নিরাপদ ভুবন গড়ে তুলেছি। এখন নিউইয়র্কই আমার হোমটাউন।
কিন্তু একটা সময় এল। নতুনের উন্মাদনা কিছুটা হলেও কেটে গেল। বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা আমার তরুণকাল, আমার যৌবন, সংসার, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটানো নানা স্মৃতি আমাকে দিনমান তাড়িত করতে শুরু করল। মনে পড়ে গেল প্রিয় দেশ, প্রিয়তম শহর ঢাকার কথা। মধ্যবয়স। নতুন দেশ, নতুন শহরে টিকে থাকার সংগ্রামরত জীবনে একটু স্থিতিও এল। ঘুরে তাকানোর ফুরসত মিলল। জীবিকা অর্জনের ধান্দায়, সকাল থেকে সূর্যাস্ত, সূর্যাস্ত থেকে মধ্যরাত অবধি খেটে খাওয়া মন বিদ্রোহ ঘোষণা করল একসময়। মনের কথাই শুনলাম। মস্তিষ্ককে রেখে আবেগকে প্রশ্রয় দিলাম। আর কাজ নয়। একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু হলেই আমার বাকি জীবন চলে যাবে। খুব একটা বিলাসিতার প্রয়োজন আমার নেই। যত দিন বাঁচব মনের আনন্দে বাঁচতে চাই; রাজার মতো। কারও ক্রীতদাস হয়ে নয়। তাই বাঁধাধরা কাজকে গুডবাই জানালাম।
মন চাইল প্রচুর পড়ব, সেই কিশোরীকালের মতো। যখন লুকিয়ে, চুরি করে রাজ্যের সব বই পড়ে ফেলেছিলাম। বই পড়ার সে কী আনন্দ। নিষিদ্ধ ড্রাগের মতো তখন কেবলই বই সংগ্রহ করতাম। খেয়ে, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে বই পড়তাম। প্রেম করতাম রবিবাবু, বুদ্ধদেব বসু, মুজতবা আলী, শরৎ চন্দ্র, সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু, আর নজরুলের সঙ্গে। আব্বার বুককেস থেকে লুকিয়ে পড়েছিলাম আশাপূর্ণা দেবীর কত কত বই। এখন অনেক বইয়ের নাম, লেখকের নাম ভুলেও গেছি। গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটিও একসময় পড়া হয়ে গিয়েছিল। তারপর একসময় পড়তে শুরু করলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখা। পরে যোগ হলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। আমাদের সেই সময়টাতে বই পড়াই ছিল আমাদের একমাত্র নেশা। তাই নেশার জন্য আমাদের কোনো নিষিদ্ধ ড্রাগের প্রয়োজন হয়নি। আমরা বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকতাম নেশাখোরের মতোই। তার জন্য মায়ের বকুনিও খেতাম; ঘর-সংসারের কাজে মায়ের সঙ্গে হাত না লাগানোর জন্য, ছোট ভাইবোনদের দেখভাল না করার জন্য। সেই নেশাটি ছিল স্বাস্থ্যকর।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের নেশার খবর শুনলে গা গুলিয়ে ওঠে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। এর কারণ কী একটু ভেবে দেখেছেন এ যুগের বাবা-মায়েরা? কত জনের সাজানো ড্রয়িংরুম বা বসার ঘরে একটি বুককেস আছে বলতে পারবেন? জানি অনেকেরই ড্রয়িংরুম খুব সাজানো গোছানো। অনেক দামি সোফা, টেলিভিশন, কার্পেট, শোকেসের ভেতর দামি ও দুষ্প্রাপ্য শো-পিস রয়েছে। সেগুলো আপনারা দেশ-বিদেশ ঘুরে সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বইয়ের একটি শেলফ বা বুককেস জঞ্জাল মনে করে সেখানে ঠাঁই পায় না। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। অনেকেই বইমেলায় যান। ঘুরেফিরে আড্ডা দিয়ে সেলফি তুলে বাড়ি চলে আসেন। কিন্তু খুব কমজনই বই কেনে। অনেকে বলেন, এখন আর বই কিনে কী হবে? অনলাইনেই তো সব পড়া যায়। আপনার হাতে একটি বই দেখলে আপনার পাশে শুয়ে বা বসে থাকা সন্তানটিও কিন্তু সেই বইটি নেড়েচেড়ে দেখবে। তখন সে সেই লেখকটির সঙ্গে পরিচিত হবে। তার লেখনীর সঙ্গে পরিচিত হবে। তাতে করে তার মনোজগতের একটি বদ্ধ জানালা খুলে যাবে। মনের ভেতরে সেই জানলা গলিয়ে আলো পড়বে। সেই আলোতে মনের অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। এবার একটু ভাবুন তো একটি বইয়ের মূল্য কি এতই বেশি, যা আপনি বহন করতে অক্ষম? অথচ আপনার সন্তানটি বাজে সঙ্গে পড়ে যখন মাদকাসক্ত হচ্ছে বা বেহিসেবির মতো আপনার কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করছে, তখন সেই বিপুল অর্থের জোগান কিন্তু আপনাকেই দিতে হচ্ছে।
এই যুগের মায়েদের কাছে আমার আকুল আবেদন আপনারা বই কিনুন। ঘরে একটি সুন্দর বুককেস রাখুন। তাতে বই সাজিয়ে রাখুন। নিজেও পড়ুন। সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পড়ুন। তাদের কাছে লেখকদের নাম বলুন, তাদের লেখনী নিয়ে কথা বলুন। আপনার ঘরে একটি সুবাতাস বইতে শুরু করবে। সন্তানদের সঙ্গে কোয়ান্টিটি হিসেব করে নয়, কোয়ালিটি হিসেব করে সময় কাটান। তাদের বন্ধু হয়ে উঠুন। তাদের শেখান এবং তাদের কাছ থেকেও শিখুন। দেখবেন এই বন্ধ্যাসময় একদিন কেটে যাবে। আমাদের সন্তানেরা অনেক স্মার্ট। তাদের শুধু একটু আলোর পথ দেখান।
ধান ভানতে গিয়ে হয়তো শিবের গীত গাইতে শরু করেছিলাম। আবার বইমেলা প্রসঙ্গে ফিরি। ফিরে যাই আমার আক্ষেপে। রুটি রুজির ধান্দা বাদ দিয়ে যখন একটু অবকাশ মিলল, মন চাইল আমি লিখব। এত এত বিপুল কথার ভান্ডার আমার মনের ভেতরে জমে আছে, তার অর্গল খুলে দিতে খুব ইচ্ছে করল। ইচ্ছে করল মনের ভেতরের শুঁয়োপোকাটাকে মুক্তি দিই। সে প্রজাপতি হয়ে মুক্ত আকাশে ডানা মেলুক। আমি নিজেই না হয় মুগ্ধ হয়ে তার উড়ে বেড়ানো দেখব। আর আশপাশের কিছু ভাবুক মন যদি তা দেখে আনন্দ পায়, দু দণ্ড শান্তি পায়, তাহলে আমার সেই প্রজাপতি মনও শান্তি পাবে। তার প্রজাপতি জীবন সার্থক হবে।
লেখক হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে মুক্ত প্রজাপতি হতে পেরেছি। মনের আনন্দে উড়ি। সেই উড়ে বেড়ানো দেখে কেউ কেউ আনন্দ পায়। কেউ কেউ মুক্ত প্রজাপতি হতেও চায়। আমার রঙে তাদের ডানা রঙিন করে তুলতে চায়। এতেই আমার আনন্দ। এটাই আমার লেখালেখির সার্থকতা।