স্ত্রী-সন্তান রেখে ভারতই চলে আসেন শাহ নাওয়াজ

আমাদের বয়সী যাঁদের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগের জন্ম, তাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলমানদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই ধারাবাহিক লেখা

জেনারেল শাহ নাওয়াজ খান ছিলেন একজন ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দ্বিতীয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। জেনারেল শাহ নওয়াজ খান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ নামের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গিয়ে জাপানিদের পক্ষ নেওয়ার অপরাধে দশজনকে গ্রেপ্তার করেছীল। সেই ১০ জনের একজন ছিলেন নাওয়াজ। পরে ১৯৪৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিচারে প্রথম দশের মধ্যে যে তিনজন অভিযুক্ত হন তিনি ছিলেন সেই অভিযুক্তদের একজন।
প্রাথমিক জীবন: জেনারেল শাহ নাওয়াজ খানের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাওয়ালপিন্ডির (বর্তমানে পাকিস্তানে) জেলার কাহুত এলাকার মাসোর নামক গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন মাতালোর ক্যাপ্টেন সর্দার টিক্কা খান, যিনি প্রায় ৩০ বছর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। শাহ নাওয়াজ খান দেহরাদুনের প্রিন্স অফ ওয়েলস রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
কর্মজীবন: সফলভাবে শিক্ষা শেষ হওয়ার পর শাহ নওয়াজ ১৯৪০ সালে এশিয়ায় যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন ও অল্প সময়ে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৪২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পরাজিত হলে জাপানিরা তাঁকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করে। এর অল্প পরে মোহন সিং কর্তৃক ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি গঠিত হয়। কিন্তু প্রথম দিকে এর সদস্য হতে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদান: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পুনর্গঠিত হয়। সে সময় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু প্রিজনার অব ওয়ারদের প্রতি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগ দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার প্রয়াসে যুদ্ধ করার উদাত্ত আহ্বান জানান। এই ডাকে চমৎকৃত হয়ে শাহ নাওয়াজ লিখেছেন, ‘It will not be wrong to say that I was hypnotized by his personality and his speeches. He placed the true picture of India before us and for the first time in my life I saw India, through the eyes of an Indian’.
এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে শাহ নওয়াজ খান ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি আরজি হুকুমত-ই-আজাদ-এ-হিন্দ মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। হুকুমত-ই-আজাদ মানে মুক্ত ভারতের অস্থায়ী সরকার, যাকে সংক্ষেপে আজাদ হিন্দও বলা হতো, যার মানে স্বাধীন ভারত, ফ্রি ইন্ডিয়া। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুভাষচন্দ্র বসু সেনাবাহিনীর শীর্ষ সদস্যদের মধ্য থেকে বাছাই করে একটি রেজিমেন্ট প্রস্তুত করেন, যাদেরকে ভারতে অগ্রিম নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে পাঠানো হয়। এই রেজিমেন্ট সুভাষ ব্রিগেড নামে পরিচিত ছিল এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শাহ নাওয়াজ খানকে এই রেজিমেন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। এই ব্রিগেড আগে হাকা, আরাকান, কোহিমা এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মান্দালয়ে ১ নম্বর ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবেও শাহ নাওয়াজ খান নিযুক্ত হয়েছিলেন। এসব অপারেশনের সময় শাহ নাওয়াজ খান ৩০০০ মাইল বিস্তৃত যাত্রাপথের ওপর সৈন্যদের কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আইএনএর বিচার: যুদ্ধ শেষের পর কর্নেল রাজা হাবিবুর রহমান খান, কর্নেল গুরবক্স সিং ধিলন, কর্নেল প্রেমকুমার সেহগাল ও জেনারেল শাহ নওয়াজ খানকে ‘ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা’র অপরাধে দিল্লিতে কোর্ট মার্শালের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে এই বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা জরিমানার মুখোমুখি হওয়ার কথা। এদের পক্ষে ওকালতি করেন জওহরলাল নেহরু, ভুলাভাই দেশাই, কৈলাশ নাথ কাটজু, স্যার তেজ বাহাদুর সপ্রু, আসফ আলী প্রমুখ আইনজীবীরা। এঁরা দাবি করেন, এই বন্দীরা কোন বেতনভোগী সৈন্য নয়। বরং তারা স্বাধীন ভারতের প্রাদেশিক সরকারের সদস্য, আরজি হুকু্মাত-এ-আজাদ হিন্দ। সে জন্য তাঁদের যুদ্ধবন্দী বা ‘প্রিজনার অব ওয়ার’ হিসেবে শনাক্ত করতে হবে। এই বিচারের সময় শাহ নাওয়াজ খান বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ব্রিটিশ সৈন্য ও ইন্ডিয়ান সৈন্যদের আলাদা আলাদা, তারতম্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। কোন ইন্ডিয়ানকে কোন ডিভিশনের কমান্ডের পদ দেওয়া হয় না। মাত্র একজনকে একটি ব্রিগেড কমান্ড করতে দেওয়া হয়েছে। বিচারে খানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ইন্ডিয়ান আর্মি চিফ তাঁর মৃত্যুদণ্ড লাঘব করেন।
বিচারপরবর্তী অবস্থা: সুভাষ চন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ব্রিটিশ ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আইএনএর অফিসার ও সৈন্যদের বন্দী করা হয়। মেজর জেনারেল শাহ নাওয়াজ খান, কর্নেল প্রেমকুমার ও কর্নেল গুরবক্স সিংদের কোর্টে বিচার করা হয়। এ সময় আল্লামা মাশরিকীর আদেশ অনুসারে খাকসার বাহিনী তাঁদের মুক্তির জন্য নিদারুণ চেষ্টা করে ও সফল হয়। শাহ নাওয়াজ খান আল্লামা মাশরিকী ও খাকসার তেহরিককে ধন্যবাদ দেন এবং তিনি নিজে কর্নেল প্রেমকুমার সেহগাল সমেত আল্লামার সঙ্গে ছবি তোলেন।
শাহ নাওয়াজের রাজনৈতিক জীবন: বিচার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান ঘোষণা দেন, তিনি সহিংস পথ পরিত্যাগ করে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের অনুসারী হবেন এবং সেভাবেই কংগ্রেস দলে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে তিনি মিরাট থেকে প্রথম লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে তাঁর কর্মজীবন বেশ স্মরণীয় ও কর্মবহুল ছিল। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন, যেমন—
l সংসদীয় সচিব ও রেলপথ ও পরিবহন উপমন্ত্রী (১৯৫২ থেকে ১৯৫৬) এবং (১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪)
l খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী (১৯৬৫)
l শ্রম, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন মন্ত্রী (১৯৬৬)
l ইস্পাত ও খনি মন্ত্রী এবং পেট্রোলিয়াম রাসায়নিক শিল্প মন্ত্রী (১৯৭১ থেকে ১৯৭৩)
l কৃষি ও সেচ মন্ত্রী (১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭)
l চেয়ারম্যান, জাতীয় বীজ করপোরেশন লিমিটেড
l চেয়ারম্যান, ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া
শাহ নাওয়াজ খান মিরাট থেকে ১৯৫১, ১৯৫৭, ১৯৬২ ও ১৯৭১—এই চার দফায় লোকসভায় নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৬৭ ও ১৯৭৭ এর নির্বাচনে হেরে যান। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁর ছেলে মাহমুদ, পাকিস্তানের একজন আর্মি অফিসার ছিলেন। সে জন্য সে সময় বিরোধী দলগুলো তাঁকে সরকার থেকে বহিষ্কারের কথা বলেন। কিন্তু তখনকার প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সে কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে খানের বিশাল আত্মত্যাগের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেন।
শাহ নাওয়াজ খানের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল বামপন্থী। তিনি ভূমি সংস্কার ও জনসাধারণের মধ্যে বিলি ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ধর্মের বিধান অনুসারে চিরস্থায়ী পৃথক পার্সোনাল ল’-কে সাপোর্ট করার জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে জনসংঘের কাছে পরাস্ত হন। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে যান। ১৯৭১ সালে ‘গরিবি হটাও’ ক্যাম্পেন করে তিনি মিরাট থেকে আবার নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি জনতা পার্টির কাছে হেরে যান ও সেখান থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়। অবশ্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কংগ্রেস সেবা দল প্রধানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
শাহ নওয়াজ কমিটি: ১৯৫৬ সালে মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান স্বাধীন ভারত সরকার কর্তৃক নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটনের জন্য গঠিত নিরপেক্ষ কমিটির প্রধান হন। সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই সুরেশ চন্দ্র বসুও এই কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে শাহ নওয়াজ কমিটি তাদের কাজ শুরু করে এবং চার মাস পর তদন্তের কাজ শেষ হয়। সুরেশ চন্দ্র বসু ছাড়া কমিটির বাকি ৩ সদস্যের মধ্যে দুজন জানান, সুভাষচন্দ্র বসু নিশ্চিতভাবেই ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট ফরমোজার (বর্তমান তাইওয়ান) তাইহোকুর (তাইপেয়ীর জাপানি শব্দ) বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
মৃত্যু ও পরিবার: জেনারেল শাহ নাওয়াজের মৃত্যু হয় ১৯৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৬৯ বছর। তিনি তিন ছেলে, তিন মেয়ে রেখে গেছেন, যাদের মধ্যে এক মেয়ে লতিফ ফাতিমাকে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। এই লতিফ ফাতিমা আজকের বলিউডের বাদশা, সুপার স্টার শাহরুখ খানের মা।
জনপ্রিয় ছায়াছবি: ২০০৫ সালে ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটেন হিরো’ ছবিতে খানের চরিত্রের রূপদান করেন চিত্রনায়ক সনু সুদ। রেড ফোর্টের বিচারের ওপর চলচিত্র ২০১৭ সালে নির্মিত ‘রাগদেশ’ সিনেমায় তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেন কুনাল কাপুর।
জেনারেল শাহ নাওয়াজ খানকে ভারতের সর্বোত্তম দেশপ্রেমীদের একজন বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ, প্রথমত তাঁর বাবার মতো তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে ক্যারিয়ার শুরু করলেও নেতাজি সুভাষ বসুর স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হওয়ার ডাকে তখনই সাড়া দিতে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন ও নেতৃত্ব দেন।
শাহ নাওয়াজের পৈতৃক ভূমি পেশোয়ারে হলেও এবং দেশ বিভাগের ফলে তা পাকিস্তানে চলে গেলেও তিনি স্ত্রী ও পুত্র–কন্যাদের সেখানে ফেলে ভারতে চলে আসেন কেবল দেশপ্রেমের টানে। তিনি অখণ্ড ভারতের মতো খণ্ডিত ভারতকেও নিজের দেশ মনে করতেন ও দেশপ্রেমের জন্য নিজের জন্মভূমি ও পরিবারবর্গকে ত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।