নারী দিবস নিয়ে দিন শেষের ভাবনা

.
.

প্রগতিশীল নারীবাদী সমাজের কাতারে দাঁড়াতেই অসংখ্য প্রশ্ন এসে মাথায় ভর করল। আমরা কি আমাদের ছোট করছি, না বড় করছি? কোনো কিছুর হ্যাঁ তে হ্যাঁ, বা না তে না মিলাবার আগে নিজের জ্ঞান কী বলে? সে ব্যাপারে একবার খতিয়ে দেখার প্রবণতা, ভাবনা আমাকে সদাই ক্ষতবিক্ষত করে। চেষ্টা করি নিজের ক্ষমতাটুকু দিয়ে সত্যকে উপলব্ধি করতে। তাই উচ্চারণ করেছিলাম, উপস্থিত নারী-পুরুষ সবার মধ্যে আত্মসম্মানের পাল্লা কার কতটা ভারী? কারও আঘাতে কেউ অপমানবোধ করেন কী না, প্রতিবাদ করেন কী না? উত্তর তেমন জুতসই পাইনি। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের কিঞ্চিৎ মন্তব্যের আঘাত রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে সমূহ ভূমিকা রাখছে, সেহেতু সমালোচনামূলক এ প্রবন্ধের শুরুতেই আমার ভাবনার কৈফিয়ৎটুকুও নিজেই দিয়ে রাখলাম।
প্রকৃতি নারীকে অসাধারণ এক অধিকার দিয়েছে। হিসেব করলে নারীর অবস্থান অনেক ওপরে। জন্ম একমাত্র নারীই দিতে পারে। অধিকারের সমতায় আমরা যখনই লিঙ্গ দিয়ে নারী-পুরুষকে ভাগ করছি, তখনই একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করছি। লিঙ্গ শুধুমাত্র একটা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সম্পর্ক। অন্যথায়
সর্বক্ষেত্রেই সমান। এটা আমার নয় গুণীজনের কথা এবং এমন অকাট্য যুক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া বোকামির নামান্তর। বিষয়টা শুরু হয়েছিল মানবাধিকার
নিয়ে, যেখানে মজুরি বৈষম্যই ছিল মুখ্য। তাই
একে মানবাধিকার দিবসে রূপান্তর করাই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ।
১৮৫৭ সালে নিউইয়র্ক শহরে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে মজুরি বৈষম্য রোধ, শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে ৮ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা ও কারখানায় কাজের পরিবেশ উন্নয়নের দাবিতে ৮ মার্চ সংঘটিত বিক্ষোভ দিবসটিকেই ১৯১০ সালে ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে’ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেন বিখ্যাত জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ‘নারী দিবস’ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটিই শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসের
সঙ্গে জড়িত। তাই একে নিজেদের ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে সমতার উৎসাহ খোঁজা কিছুটা বোকামি বটে।
সমতার প্রশ্নে ২০২০ সালে নারী দিবসের জন্য কথা বলতে এসে কোনো প্রগতিশীল নারী যদি বলেন, ‘আমরা নারীরা প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল! কারণ, আমাদের বানানো হয়েছে আদমের (আ.) পাঁজরের হাড় থেকে।’ শুধু তাই নয় নারী অগ্রযাত্রায় অবদান রাখায় তিনি বেগম রোকেয়ার স্বামীর নামের সঙ্গে নিজের স্বামীর নামও উল্লেখ করেন। আরেক ভদ্রমহিলাও যখন আদম-হাওয়ার কথা বললেন, তখন আমার মতো কারও মনে ভীষণ জোরে ধাক্কা লাগতেই পারে। প্রতিটি ধর্ম প্রত্যেক জাতির একান্ত নিজস্ব বিশ্বাস। সমতার প্রশ্নে প্রথমেই নারীরা ধর্মের হাতিয়ার দিয়ে নিজেই তৈরি করে দিলেন বৈষম্যের দেয়াল। আমার প্রশ্ন হলো যাঁরা অন্য ধর্মের, তাঁদের জন্য কী কিছুই ভাবলেন না? বা যাঁরা একান্ত একা তাঁরা কী ডুবে মরবে??
তাঁরা কার হাত ধরে সমতা খুঁজবে? তাঁদের তো হাত ধরে এগিয়ে নেওয়ার কেউ নেই। তবে কী সমতা মানে পরনির্ভরতা?
আমার এমন খটকায় নিজেকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, থাক যার যার নিজস্ব ভাবনা এসব। অন্যকে নিয়ে তুমি ভেবো না। কিন্তু এর মধ্যে দু দিন গড়িয়ে যেতেই সনাতন ধর্মীয় এক বন্ধু ফোন করে বলেই ফেললেন, ভদ্রমহিলার কথা শুনে আমি লাইভ দেখা বন্ধ করে ফেসবুক থেকে লগ আউট করে ফেললাম। আমরা হয়তো কাকের মতো চোখ বন্ধ করে মরিচ লুকাতে পারি। কিন্তু যারা দেখার দেখেই ফেলেছে। এমন প্রশ্ন ওঠার আগে আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কী বলব, আর কী বলব না? এমন মঞ্চে আমাদের ভাবনা দিয়ে অন্যকে
বিচার করার আগে দেখতে হবে পৃথিবীতে কার কী অবস্থা। বিশ্বব্যাপী এক মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। সা-সাহারান আফ্রিকায় এ ধরনের মায়েদের ৩২ শতাংশের বাস। আর লাতিন আমেরিকায় রয়েছেন এমন ২৪ শতাংশ মা। সুতরাং এ বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই কিন্তু পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরি হননি। যাদের জন্য কোনো বাঁকা হাড় নেই, তাঁদের কথাও ভাবতে হবে। নারীকে নারীবান্ধব হতে গেলে অন্যের কথা আগে ভাবতে হবে।
কথা বলছিলাম, আমার এক বিদেশি সহকর্মীর সঙ্গে নারী দিবসের তাৎপর্য নিয়ে। আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করতেই আসল তুরুপের তাস ছাড়লেন তিনি। সমাজ পরিবর্তনের জন্য আসলে যারা কিছু করেন, তাঁদের প্রায়ই সামনে দেখা যায় না। কিন্তু তথাকথিতরা এসে বোল ছাড়েন। যেখানে সমাজ পরিবর্তনের চেয়ে বিভক্ত হয় বেশি। এমন কথায় সায় জানিয়ে বললেন, তাঁর আপন কাজিন সিস্টার ইউএনের অনেক বড় পদধারী ছিলেন, যাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল টেলিভিশন ও জাতীয় পত্রিকায় মুখ দেখান। এখন বড় মিডিয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন, শুধু তোমার আমার দেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এমন চলছে। চোখে পড়ল রাহাত জাহিদ নামে এক ভদ্রলোকের লেখা পোস্ট, ‘এটি উপেক্ষা (মজুরি বৈষম্য) করে অধুনা প্রতিষ্ঠিত ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ মার্কা নারী দিবসের হাত থেকে নারী সমাজকে উদ্ধারই হোক অঙ্গীকার!
প্রশ্ন হলো কে করবে অঙ্গীকার? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু বক্তব্য শুনে মনে হলো, নারীর সমতা মানে ধর-মার-কাট করে কীভাবে পুরুষকে শায়েস্তা করা যায়? তাই যেন সমতার প্রশ্নে এক পুরুষ বন্ধু বলেই ফেললেন, নারীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গয়নাগাটি কেনার, পরার ও যখন-তখন ঘর থেকে বের হতে দিতে
পারলেই তারা খুশি। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে
অধুনা ফটোসেশন সেলফি যুগের হাতছানি। নিজের সন্তানের যত্নের চেয়ে সমাজের কিটি
পার্টি ও ভোগবিলাসই যদি হয় নারী দিবসের মূলমন্ত্র, তবে তা কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনবে তাও ভাবতে হবে।
নারী দিবস নয়; মানবাধিকার দিবস হওয়া উচিত। পৃথিবীতে কোনো কিছু ধ্রুব নয়, সব আপেক্ষিক। নারী যেমন নির্যাতিত, পুরুষরাও অনেক ক্ষেত্রে রেহাই পান না। সমতার প্রশ্নে যদি কথা বলতেই হয় আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি পুরুষ জাতি দারুণভাবে পরাধীন। আমার
দৃষ্টিতে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব সব নারীরাই বেশির ভাগ করেন। পুরুষ নির্যাতিত হলেও লজ্জায় তা প্রকাশ পর্যন্ত করে না। তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা মানবাধিকার দিন হোক, নারী দিবস নয়।
সর্বোপরি যেখানে নির্যাতনের প্রশ্ন সেখানে ব্যাপারগুলো ঘটেই মনোবিকারের কারণে। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের স্বীকার শুধু নারী নয়, পুরুষও হন। মানবাধিকার দিয়ে দিন গড়ুন। বিপ্লব যদি করতেই হয় মানবতার জন্য করুন। পারিবারিক বন্ধনে সব ক্ষেত্রে যে মিনাকে হেয় করা হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে এক বোনের একটি শাড়ি বা পোশাকের দাম দিয়ে তিনজন ছেলের পোশাক কেনা হয়। নারী অনেক ক্ষেত্রই মর্যাদায় পরিপূর্ণ। মা-বাবার মনে প্রেম তৈরি হোক সন্তানের জন্য; আলাদা করে ছেলে বা মেয়ের জন্য নয়। মমতার আঁচলে বাঁধা সংসারে নারীর অবস্থান সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। সে হোক মা, বোন, স্ত্রী বা প্রেমিকা; কোনো ক্ষেত্রেই তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সব ক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান হোক সম্মানের। যেখানে বৈষম্য, সেখানে নরনারী উভয়ের অধিকার রক্ষায় মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আলাদা করার মাঝে নয়, মিশে থাকার মাঝেই বিশেষত্ব রয়েছে।