করোনা ও নারীশক্তি

লেখাটির একটি পটভূমি আছে। সেটি হল, দীপক চন্দ্র নামে এক ভারতীয় তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে তিনি ও তার বউ এক সপ্তাহ ধরে অষ্টপ্রহর একসঙ্গে ঘরে থেকে কাজ করছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, ভাইরাসের কারণে মারা যাওয়ার আগেই হয়তো সংসারে খুনোখুনি ঘটে যেতে পারে।’
আমার এক সুমনা বোন ফেসবুক মেসেঞ্জারে বিষয়টি শেয়ার করেছেন, যা আমাকে এই লেখাটি লিখতে প্ররোচিত করেছে।
যেকোনো সমাজ কাঠামোতে পরিবার, সম্প্রদায় বা কমিউনিটি এবং বিয়ে—এই তিনটি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এরা সব সময় একে অন্যকে প্রভাবিত করে নানাভাবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন, সে যে কারণেই হোক না কেন, তা উপরিউক্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নাড়া দেয় বিভিন্ন মাত্রায়। কখনো মৃদুভাবে ধীরলয়ে, আবার কখনো দ্রুতলয়ে একেবারে ওলটপালট করে। প্রথমোক্ত পরিবর্তন সংস্কারনির্ভর আর দ্বিতীয়টি সমাজে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে বিপ্লব সংগঠিত হলে ঘটে। পরিবার কাঠামোতে ও এ পরিবর্তনের প্রভাব অবশ্যই পরে। সব ধনতান্ত্রিক সমাজে এ পরিবর্তন সমানভাবে পড়ে না, যেমনটি সব সমাজতান্ত্রিক সমাজেও নয়। আমাদের এই আলোচনা যেহেতু আমেরিকার প্রেক্ষাপটে, তাই সমাজতান্ত্রিক সমাজের অভিজ্ঞতা টানা তেমন প্রাসঙ্গিক হবে না।
সনাতন পরিবার কাঠামো বা ব্যবস্থা বলতে যে ছবিটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো একটি একান্নবর্তী পরিবারের, যেখানে দাদা বা তার অবর্তমানে বড় ছেলে পরিবারের কর্তা হিসেবে থাকে। সঙ্গে মা, অন্য ভাইয়েরা ও তাদের সন্তান এবং অবিবাহিত মেয়ে, ভাইদের সন্তানাদি একসঙ্গে বসবাস করত। গ্রামীণ বাংলাদেশের সনাতন পরিবার কাঠামোর এই যে চিত্র, তার সঙ্গে আমেরিকার আদি বাসিন্দা এবং কলোনি স্থাপনের পরেও দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিদ্যমান পরিবার কাঠামোর তেমন কোনো অমিল ছিল না। পরে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার—এসব কারণে একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে। তবে, এখন এ পদ্ধতি অনেকটা বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। এখন সমাদৃত ব্যবস্থা হল, বিবাহিত দম্পতি বা বিবাহ সম্পর্কের বাইরেও নারী-পুরুষ একক বা যৌথভাবে বা সমলিঙ্গধারীরা পরিবার গঠন করতে পারে।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিয়েকে একসময় যে একটি পবিত্র ও সর্বজনীন ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেওয়া হতো, আজ আর সে রকমটি নেই। পরিবার সংগঠনটি আজকাল কাঠামোর দিক থেকে তো বটেই, এর যে পারিবারিক পরিবেষ্টনের বাইরেও নানা ধরনের ভূমিকা ছিল, তার পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানের লালন-পালন, সামাজিকীকরণ, শিক্ষা-দীক্ষা, মূল্যবোধ সঞ্চালন এবং শিশুদের মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখত, আজকাল তা নার্সারি, ডে-কেয়ার, ফ্রি-কিন্ডারগার্টেন, হেডস্টার্ট ইত্যাদি প্রোগ্রাম পালন করছে। বয়স্কদের মধ্যে মানসিক ও দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ যারা, তাদের জন্য পরিবারকে আজকাল আগের মতো ভূমিকা পালন করতে হয় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। ওল্ড কেয়ার সেন্টার বা নার্সিং হোম ইত্যাদি সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সার্বক্ষণিক সেবাযত্ন ও চিকিৎসা দেয়।
সত্তর দশকে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারী স্বাধীনতা যেমন সমাজ কাঠামোতে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছিল, সে একই ধারাবাহিকতায় পারিবারিক কাঠামোয় পরিবর্তন ও নারীর অবস্থান, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে আলোড়িত করে চলেছে। নতুন নতুন পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে, একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এও সত্যি যে এখনো অনেক আমেরিকান, এশিয়ান আমেরিকান ও নেটিভ আমেরিকান পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলেমেয়ে, এমনকি চাচা–চাচিকে একান্নবর্তী পরিবারের মতো জীবনযাপন করতে দেখা যায়। আমেরিকায় সব সম্প্রদায়ের লোকজনকে এখনো জন্মদিন, বড়দিন ও অন্যান্য উৎসবে একত্রিত হয়ে একান্নবর্তী পরিবারের আদরযত্ন, উষ্ণতা ও পারস্পরিক সান্নিধ্য উপভোগ করতে দেখা যায়। পরিবারের বয়স্ক সদস্য যেমন দাদা-দাদি, নানা-নানি অনেক পরিবারেই শিশুদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা এবং স্কুলে আনা-নেওয়া করেন। এ রকম ব্যবস্থা ইদানীং লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান।
বর্তমান সময়ে আমেরিকায় দাম্পত্য সম্পর্ককে (‘স্পাউসাল রিলেশনশিপ’) বিয়ে বলে ধরা হয়। আসলে এ সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই সমঝোতার মাধ্যমে নর–নারীর একসঙ্গে থাকার একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় আজকের নারী বা স্ত্রীর অবস্থান আগে সময়ের চেয়ে ভিন্নতর; ধর্মীয় বিধিনিষেধের সঙ্গে এ ধরনের পারিবারিক সম্পর্কের ফারাক যোজন–যোজেনের। এখানে আরও কিছু বিষয় না বললে এ তথ্য ধোঁয়াশা থাকতে পারে। আমেরিকায় শতকরা ৯০ জন মহিলা তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে একবার হলেও বিয়ে করে। যাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই আবার বিয়ে করে। অনেক অঙ্গরাজ্যে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে এখন আইনত বৈধ। ২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন সমকামী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রতিযোগিতা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে গিয়ে তার বিবাহিত পুরুষ পার্টনারকে স্টেজে নেন। তিনি বক্তৃতাও করেন। দর্শকেরা এ সময় তাকে হাততালি ও হর্ষধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায়।
সাম্প্রতিক এই উদাহরণ থেকে সহজেই বোধগম্য, আমেরিকার সমাজে বিয়ের ধরন বদলেছে। সমলিঙ্গের বিয়ে নারী-পুরুষের বৈধ সম্পর্কের মতো হয়ে গেছে। সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক এখন ডাল-ভাতের মতো হয়ে গেছে। কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপের বেশ কিছু যেমন, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে সমলিঙ্গ বিয়ে ও নারী-পুরুষের বিয়ে প্রায় একই সমতায় এসে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। শিশু জন্মদানের বা জনসংখ্যা বাড়ার ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ প্রভাব কী হবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে দত্তক নেওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সন্তান না নেওয়ার স্বাধীনতা ও ভ্রূণ নষ্ট করার মতো বিষয়গুলোতে এ ধরনের সম্পর্ক গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়া, পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে আশির দশকে বিশেষত রোনাল্ড রিগ্যানের সময়ে যে প্রচণ্ড বিতর্ক হয়েছিল, তাও লিঙ্গবৈষম্য দূর এবং দাম্পত্য সম্পর্ক দ্রুত নতুন করে সংজ্ঞায়ন হচ্ছে বিধায় আগের মতো নেই। পরিবারে নারী বা স্ত্রীর ভূমিকার পরিবর্তন হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে—এ সত্যটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
পরিবর্তিত পরিবার সমীকরণে পুরুষ বা স্বামীর কর্তৃত্বসুলভ ভূমিকাটি আগের মতো নেই। দম্পতিগণ শিশুপালন, শিশুর শিক্ষা, হেলথ ইত্যাদির তদারক করে আলোচনার মাধ্যমে শেয়ার করে। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, অন্তত এক পারিবারিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে গেছে। দুজনের আয় ছাড়া সংসার চলে না যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি এক সঙ্গীর আয় অনেক সময় অন্যজনের চেয়ে বেশি। উপমহাদেশের যারা এখানে স্পেশালিস্ট যেমন ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ইত্যাদি কাজ করেন, তাদের সংসারে একজনকে ঘরে সময় দিতে হয় বেশি, আরেকজনকে টাকার জোগান দিতে হয় সংগত কারণেই। চিত্রটি আমেরিকায় সব কমিউনিটিতেই কমবেশি প্রযোজ্য। বউ চাকরি করে এমন অনেক নারীর স্বামী সন্তান দেখাশোনা করেন, ঘরের কাজে বেশি সময় দেন, ছেলে–মেয়েদের এমনকি নাতি–নাতিনদেরও স্কুলে আনা–নেওয়া করেন। গ্র্যান্ড প্যারেন্টসরাও আজকাল গ্র্যান্ড কিডস লালনপালনে সহায়তা করেন।
পরিবার, বিয়ে ও দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এহেন পরিবর্তনে নারী শক্তি নিশ্চয় অনেক বেড়েছে। নারী আজকাল অকল্পনীয়ভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে অনেক বেশি স্বাধীন।