বাঙালির বদনা ও টয়লেট টিস্যু

‘শোন মা আমিনা, বদনাটা কই, ত্বরা করে মোরে বল
প্রকৃতির ডাক আসিয়াছে, তাই এখনই লাগিবে জল।
নদীর কিনারা ঝোপেঝাড়ে ভরা,
প্রকৃতির ডাকে আছে মোর ত্বরা
কই রে আমিনা, তাড়াতাড়ি কর, জলদি বদনা আন,
কাপড় নষ্ট হইলে কিন্তু ছিঁড়িব তোর দু’কান।’
হুমায়ুন কবীরের ‘মেঘনার ঢল’ অবলম্বনে একটি প্যারোডি কবিতার লাইন কটি দিয়েই আজকের বদনা ও টয়লেট টিস্যুর সামাচার লেখার পরিকল্পনা। এই জীবনে কোনো দিন বদনা নিয়ে লিখব, এই চিন্তা কোনো দিনই মাথায় আসেনি।
হঠাৎ করেই করোনাভাইরাস আতঙ্কে নিউইয়র্কের সব সুপার শপে টয়লেট পেপারের মজুত শেষ হয়ে গেছে। ফলে বদনার চিন্তা আমাকে রীতিমতো গ্রাস করে ফেলেছে।
করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তাতে টয়লেট রোল নিয়ে মনে হচ্ছে এ রকম আতঙ্কে ভুগছেন অনেক মানুষ। টয়লেট পেপারই হয়ে উঠেছে এখন সবচেয়ে আরাধ্য সামগ্রীগুলোর একটি।
ফেসমাস্ক, তরল সাবান বা জীবাণুনাশক লোশন যেখানে করোনাভাইরাস ঠেকাতে কিছুটা ভূমিকা রাখে, সেখানে টয়লেট পেপার নিয়ে কেন এত টানাটানি, সে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সুপার শপে টয়লেট পেপারের মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় একজনকে তিন বক্সের বেশি কিনতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যদিকে হংকংয়ে এক ব্যক্তি ৬০০ রোল চুরি করার দায়ে সাজা খাটছেন। এ ছাড়া চীন, জাপান, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও ফ্রান্সে করোনা আক্রান্ত টয়লেট পেপারের মজুত করার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।
দৈনন্দিন জীবনযাপনে মানুষের কত প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র আর খুঁটিনাটি সামগ্রী কাজে লাগে। এগুলোর মধ্যে দরকারি একটি সামগ্রী হচ্ছে বদনা। পানি বহন ও ব্যবহারের জন্য সাধারণত বাংলাদেশ এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে বদনা বা লোটার ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু গুগল ঘেঁটে জানা যায়, এর উৎপত্তি প্রাচীন বঙ্গে। মূলত কম পরিমাণে পানি, দুধসহ যেকোনো তরল স্থানান্তরের কাজে বদনা ব্যবহৃত হত। ভারত উপমহাদেশের লোকজন সাধারণত পানি ব্যবহার করে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করে, তাই শৌচকার্যে এই অঞ্চলের মানুষ পানির পাত্র হিসেবেও বদনা ব্যবহার করে। ধর্মীয় আচারেও এর ব্যবহার রয়েছে যেমন, মুসলমানদের অযুতে ও গোসলে বদনা ব্যবহার করা হয়।
এটা স্বীকার করতে হবে, বাঙালির জীবনের অতীব দরকারি একটি তৈজসপত্র হচ্ছে বদনা। বদনার অন্য একটি প্রচলিত হচ্ছে ‘লোটা’। বদনা দেখতে অনেকটা চায়ের কেটলির মতো। এখনো গ্রামের পথে কাউকে বদনা হাতে ছুটতে দেখলে যতই জরুরি থাক, সেই সময় তাকে পিছু না ডাকার অলিখিত নিয়ম আছে।
সংস্কৃত কালজয়ী কাব্য ‘মেঘদূতম’-এর অমর রচয়িতা ছিলেন কালিদাস। অথচ তার মতো প্রতিভাধর কবিকেও নাকি তার স্ত্রী ঘর হতে বের করে দিয়েছিলেন অকর্মণ্যের অজুহাতে। গৃহ ত্যাগকালে কবি কিছুই নিলেন না নিজের বদনা আর কম্বলটা ছাড়া।
প্রাচীনকালে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন না। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি পায়খানাও তখন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই আগান-বাগান আর ঝোপঝাড়ই ছিল মানুষের ভরসা। আর কর্ম সম্পাদনের পর পরিচ্ছন্ন হতে বদনাই ছিল প্রধান অবলম্বন।
অথচ সময়ের ব্যবধানে ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল, তারপর পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ। রাজা গেলেন, রাজা এলেন। অনেক কিছুই বদলে গেল। শুধু বদলায়নি বদনা। একজন রসজ্ঞ বিদগ্ধজন তার এক লেখায় লিখেছিলেন ‘বাঙালি লুঙ্গি ছাড়তে পারে। কিন্তু বদনা ছাড়তে পারে না।’ আমাদের জীবনে বদনার আবেদন এমনই চিরন্তন।
বদনা আসলে বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ; হয়তো আমাদের জাতীয় তৈজসপত্র। একে নোংরা জ্ঞানে তাচ্ছিল্য করার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। বদনা সাম্যবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণও হতে পারে। ধনী-গরিব, আবাল–বৃদ্ধ–বনিতা নির্বিশেষে সবাকেই সে একই মাত্রায় সমাদর করে। এত দিন শুনে এসেছি, প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের পর আমেরিকানরা বদনা ব্যবহার না করে টিস্যু ব্যবহার করা হয়।
আসার আগে আমার প্রশ্ন ছিল, আমেরিকার বাজারে বদনা কিনতে পাওয়া যায়? তাহলে খুব ভালো।
ধরে নিলাম বদনা পাব না। সে ক্ষেত্রে বাঙালির উপযোগী কোনো ব্যবস্থা আছে? সেটা কি?
পরিচিত ব্যক্তিরা বলেছেন, বদনা কিনতে পাবেন আশা করি৷ চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে না, এমনটা নয়৷ কারণ ইউরোপীয়রাও বদনা ব্যবহার করে না৷ কিন্তু বাংলাদেশি বাসাগুলোতে ঠিকই বদনা দেখেছি৷ তবে একান্ত না পেলে পানির বোতল তো আছেই৷ প্রথম প্রথম অনেক কিছুই গায়ে লাগবে। তবে ধীরে ধীরে সবকিছুই গা সওয়া হয়ে যায়।
হ্যান্ড-শাওয়ার কোথাও পাবেন না। কারও বাসায় পেলে পেতে পারেন, যদি সে নিজের গরজে বাথরুমে লাগিয়ে থাকে। বাইরে কোথাও পাবেন না। সে ক্ষেত্রে অনেক অনেক টিস্যু একমাত্র সম্বল। আমিও যখন আমেরিকায় থাকার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করেছি, তখন থেকেই এক রকম দুশ্চিন্তা ছিল, কমোডের সঙ্গে হ্যান্ড-শাওয়ার কী করে লাগাব। আর বদনা ব্যবহার করতে হলে কমোডে বসার আগে থেকেই গোসলের কল থেকে বা অল্প দূরত্বে থাকা বেসিন থেকে বেশ কসরত করে বদনা বা বোতলে পানি ভরে আমাকে পানির ব্যবহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যদি কখনো প্রকৃতির বিশেষ তাড়ায় আপনি কমোডে বসে পড়েন, তাহলে এই টয়লেট পেপার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
যথারীতি আমিও অনুধাবন করলাম, এই দেশের বিশ্রাম কক্ষে কোনো পানির উৎস থাকে না। এই জাতি শুধু পাতলা কাগজ দিয়াই কার্য সম্পন্ন করে। বদনার মাহাত্ম্য এতক্ষণে বোঝা গেল। হঠাৎ এসে অনেকেই চোখ মেঝেতে রেখে বদনা আবিষ্কারের আশায় মনের আনন্দে নিম্নচাপ সেরে বিপদে পড়ে যান, অবশেষে কী আর করা বুঝতে না পেরে টয়লেট পেপার দিয়ে কাজ সারেন। আর আমেরিকাকে এক প্রস্থ গালাগালি করেন। সঙ্গে বুঝলাম, বাঙালি চিপায় পড়লে লুঙ্গি ছাড়া থাকতে পারবে, কিন্তু বদনা ছাড়া অন্তত আমেরিকায় থাকা অসম্ভব। এই টয়লেট টিস্যুর হাহাকার মারামারি ও কাড়াকাড়ির একমাত্র কারণ হলো, এ দেশে বদনার ব্যবহার না থাকা। হায়রে আধুনিক দেশ, তোমরা যদি জানতে বদনার সুফল, কখনোই আজ বদনা ফেলে সামান্য টিস্যুর জন্য মারামারি করতে না।
যতদূর মনে পড়ে, ২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল ‘বদনা’। বৃহত্তর সিলেটের অরাজনৈতিক কল্যাণমূলক সামাজিক সংগঠন সিলেট কল্যাণ সংস্থা ওই দিন বদনা হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। পাবলিক টয়লেটসহ সিলেট সিটি করপোরেশনের আওতাধীন পাবলিক টয়লেটগুলো পুনঃস্থাপন, খোলা ও সংস্কারের দাবিতে মেয়র কার্যলয়ের সামনে বদনা হাতে সর্বস্তরের নাগরিক এই দিন সমবেত হন।
আমি বড় হয়েছি, চট্টগ্রামের আমিরবাগ আবাসিক এলাকায়। নিউইয়র্ক আসার আগ পর্যন্ত থেকেছি পাঁচলাইশ এলাকায়। কাজেই সেই বদনা শাহের মাজারের কথা উল্লেখ না করে আমার এই লেখা থেকে বের হওয়া রীতিমতো অন্যায় হবে। তাই বদনা নিয়ে এখনো মাতামাতি চলে চট্টগ্রামের বদনা শাহের মাজারে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের পশ্চিম গেটের সঙ্গে লাগোয়া বিশেষভাবে খ্যাত এই বদনা শাহের মাজার। মাজারে ঝোলানো থাকে শত শত বদনা। হরেক রকম বদনা। আশপাশের দোকান থেকেও বদনা কেনা যায়। ভক্তরা মাজারে বদনা দান করেন। এতে আর যাই হোক, কিছু ব্যবসায়ীর কপাল খুলে।
এমন দুর্যোগের দিনে আপনাদের মনে হতে পারে, আমি জাতির সঙ্গে তামাশা করছি। নাহ, একদম না। গত দুই দিন টয়লেট পেপার নিয়ে পত্রিকার জন্য প্রতিবেদন করব বলে ঘুরেছি, কসকো ওয়ালমার্ট হোম ডিপোসহ আশপাশের বেশ কটি সুপার শপ। কোথাও খুঁজে পেপার না পেয়ে এই লেখা লিখতে আগ্রহী হলাম।