অনুগল্প

অনুগল্পের এপ্রিল সংখ্যাটি এমন ভয়াবহ একটি সময়ে প্রকাশিত হচ্ছে, যখন পৃথিবীজুড়ে নভেল করোনাভাইরাস তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনার ভয়ংকর থাবা এড়াতে, প্রাণে বাঁচতে কয়েক মাস ধরে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ফলে আক্রান্ত মানুষের শরীরে ভর করেই করোনা পৌঁছে গেছে এক মানব শরীর থেকে অন্য মানব শরীরে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এই শত্রু অদৃশ্য, ছোঁয়াচে ও প্রবল পরাক্রমশালী। তাই আমাদের লড়াইটা হয়ে উঠেছে কঠিন। বদলাতে হয়েছে লড়াইয়ের ধরন। আইসোলেশন বা নিজেকে ‘গৃহবন্দী’ করাই হল নভেল করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। এই যুদ্ধ নিজেকে আড়াল করে, লুকিয়ে থেকে। তাই নিজের বা প্রিয়জনের শরীরে বাসা বাঁধা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে হলে, বাঁচাতে হলে ভাইরাসের প্রসার রুখে দিতে হবে। কোন আলিঙ্গন নয়, করমর্দন নয়, পাশাপাশি বসে কথা বলা নয়। নিজেকে সবার থেকে দূরে রাখাই হল এখন আমাদের প্রতিরোধের উপায়। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে, লকডাউনই হলো আমাদের লড়াইয়ের একমাত্র হাতিয়ার। আসুন সবাই লকডাউন মেনে চলি। বিপন্ন মানবতাকে বাঁচাতে হলে এই কঠোর প্রতিরোধ আমাদের মানতেই হবে। প্রিয় বন্ধুরা, আপনারা যে যেখানে আছেন, অনুগ্রহ করে হোম কোয়ারেন্টিন মেনে চলুন। নিজে ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে থাকুন, অন্যকেও নিরাপদে থাকতে দিন। এপ্রিল মাসের অনুগল্পের পাতাটি আমরা উৎসর্গ করলাম করোনা যোদ্ধাদের জন্য—শেলী জামান খান


করোনা

স্বপন বিশ্বাস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একজন আমাদের পার্কের বেঞ্চে রেখে চলে গিয়েছিল। ভাবছিলাম, কোথায় যাই, কি করি? ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে একজনের হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙল। বয়স্ক ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াক সেরে বেঞ্চে এসে বসলেন। তারপর মোবাইলে ইউটিউবে গান শুনতে লাগলেন। সঙ্গে আমরাও গান শুনছি, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’—বেশ সুন্দর গান।
ভদ্রলোক মোবাইলটি পকেটে রেখে পার্কের কলে গেলেন হাত ধুতে। আমরাও তার হাত ধরে কল পর্যন্ত গেলাম। আমাদের কয়েকজন কল ধরে খেলতে লাগল।। হাত ধুয়ে সে কল বন্ধ করল। তারপর চোখমুখ মুছে বাড়ির পথ ধরলেন। আমাদেরই কয়েকজন আটকে গেল তার চোখমুখে। একটি বাচ্চা ছেলে পার্কে বল খেলছিল। সেও হাত ধুতে এলে আমাদের দলের কয়েকজন বালকের সঙ্গে তাদের বাড়ি চলে গেল।
ভদ্রলোক বাসার ফিরে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টেবিলে রেখে হাত ধুতে গেলেন। আমাদের সেই খুদে গ্রুপটি তখন মোবাইলে বসে খেলছিল। ঠিক সেই সময় ভদ্রলোকের ছোটমেয়ে কুমুর কল এল। বড়মেয়ে রুমু ঘুম জড়ানো চোখে বাবার ফোনটি ধরে বোনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। রুমুর স্বামী ডা. অরূপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, কার টেলিফোন?
তোমার ছোট শ্যালিকার।
দেখি টেলিফোনটা।
অরূপ টেলিফোনটা নিয়ে শালীকে করোনাভাইরাস বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়ে টেলিফোনটা শাশুড়িকে দিলেন কথা বলার জন্য।
শাশুড়ি টেলিফোন ধরে কান্নাকাটি শুরু করল। চারদিকে লোকজনের করোনাভাইরাস হচ্ছে। তোর বাবাকে কত নিষেধ করলাম। শুনল না, আজও পার্কে হাঁটতে গিয়েছিল। চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোরা সাবধানে থাকিস।
ভদ্রমহিলার নাতি নানির হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিয়ে গেম খেলতে বসে গেল। আমরাও ওর আঙুলের সঙ্গে নেচে নেচে খেলতে থাকলাম। ছেলেটার কচি আঙুলগুলো খুব সুন্দর।
আমরা এত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে আমাদের খালি চোখে কেউ দেখতেই পায় না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস বলে কেউ পাত্তাই দেয় না। পাত্তা না দিলে কার না রাগ হয়? তাই তো সবার অজান্তেই কেমন একজন থেকে আরেকজনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। তারপর সেখানেই ঘরবসতি গড়ে তুলছি।
এবার দেখ আমাদের পাত্তা না দেওয়ায় ফল। আমরা করোনারা কেমন শক্তি রাখি দেখলে তো? গোটা পৃথিবী এখন আমাদের দাপটে থরথর করে কাঁপছে…!

পদস্খলন

রাজিয়া নাজমী
টেবিল–চেয়ার তেমনই আছে, শুধু মলিন, শূন্য। তুমি নেই বলে।
একদিন ওই চেয়ারে বাবা বসতেন। টেবিলে কাগজ–কলম গুছিয়ে রাখতেন মা। সব তেমনই আছে, শুধু ওঁরা নেই। বাবা খেতে বসেছিলেন। খাবার শেষ না হতেই ওরা বাবাকে নিয়ে চলে গেল। ভাই বাবার খোঁজে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেল। রক্তাক্ত হৃদয়ে মা ঘুমিয়ে গিয়ে আর ঘুম থেকে উঠল না।
তুমিও বাবার অসমাপ্ত লেখা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে সেই যে উঠে গেলে আর ফিরলে না। আমি দেখলাম, তোমার চলে যাওয়া রাস্তার শেষ অবধি। যেমন দেখেছিলাম বাবা আর ভাইয়ের যাওয়া।
যাওয়ার আগে আমার কপালে আদর করে গেলে যেমন করতে সব সময়। সেদিনও তোমার ভেজা চুম্বনের স্বাদ আঁচলে মুছে নিয়েছিলাম। তুমি বললে, ‘অপেক্ষায় থেকো নতুন কিছুর জন্য!’
আমি প্রতিদিন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি ফিরবে সেই আশায়। তুমি এলে। তবে অন্য এক তুমি।
তোমার ছোঁয়ায় চমকে গেছি আমি। কোথায় আমার চেনা মুখ? চেনা শরীর?
তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার ভাবনা বদলে গেছে বিপরীত দিকে।
তোমাকে ছুঁয়ে খুঁজেছি আমার সেই বলিষ্ঠ, সাহসী মানুষটাকে। পুরোনোকে ভেঙে নতুনের স্বপ্ন দেখত যার চোখ। সেই চোখ ঢেকে গেছে অন্য কিছুতে! লালসায়?
তোমার হাতে নেই বাদামি কাগজে মোড়া ইশতেহার। মুখে নেই চেনা হাসি।
আমাকে বুকের ভেতর নিয়ে আগের মতো বললে না, ভয় কেন? সূর্য উঠবে, আলো আসবে, দেখে নিয়ো।
তুমি বললে অন্য কিছু যা আগে আমাকে কখনো বলনি।
ভীষণ যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে গেল। এও কী সম্ভব তুমি যেতে পার ভুল কোন পথে?
না! তোমার সমস্তটা আমার চেনা। তোমাকে আমি বড় বেশি জানি! এই তুমি সেই তুমি নও।
তুমি আসবে ফিরে বাদামি ঠোঙায় করে নতুন সম্ভাবনার, আশার কথা নিয়ে! যাদের কাছে তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে তাদের কাছে তুমি আসবে ফিরে।
এক গোছা চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে তুমি আসবে, আমার কাছে। সম্পূর্ণ তুমি!

ধুলো

স্বপন চক্রবর্তী
শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ আকাশে গা এলিয়ে দিতেই বকুল ছায়া পড়ল উঠোনজুড়ে।
একটুক্ষণ আগেও সেখানটায় জমেছিল গাঢ় অন্ধকার! শিউলি গাছের আড়াল হতে পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসে সে, সে এক চাঁদের পরি! তাকে তো চিনি আমি সেই কিশোরবেলা থেকে!
তার কখনো বয়স বাড়ে না। সে চিরন্তনী কিশোরী, সময়কে ধারণ করে আছে! আমি একদিন ব্যাকুল হয়ে বলেছিলাম তাকে, ‘আমাকেও কি তুমি অমন অনন্ত কিশোরবেলা দিতে পারো’! সে ঝিরঝির ঝরনার মতো কুলকুল করে হেসে লুটিয়ে বলেছিল, ‘পারি বৈকি, যাবে আমার সঙ্গে’?
না, আমার ইচ্ছে হয়নি যেতে, আমি চলে গেলে আমার সদ্যোজাত বোনটিকে দেখবে কে? সে কাছে আসতেই দেখি, এ তো সেই চেনা পরি নয়, অন্য কেউ! কখনো দেখিনি তাকে আগে! সে জিজ্ঞেস করল, ‘কে গো তুমি?’ আমি বললাম, ‘ধুলো’! সে খুব অবাক হলো, ‘ধুলো বুঝি কারও নাম হয়!’ আমি বললাম, ‘হলেই বা মন্দ কি’! সে কাচ ভাঙার শব্দের মতো ঝনঝন করে হেসে বললে, ‘মন্দ আর কি’।
তারপর, এক দমকা হাওয়ায় দিগ্‌দিগন্ত উন্মাতাল করে দিয়ে সে উড়ে যেতে যেতে বলল, ‘ধুলো তোমায় উড়িয়ে দিলাম হাওয়ায়’! বলতে বলতেই আমি ঝুরঝুর ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে উঠোনের আরও ধুলোর মাঝে মিশে গেলাম! এই প্রথম জানলাম, আসলেই আমার এই অবয়ব ধুলো ছাড়া আর কিচ্ছুটি নয়!

মিখাইল আসবে বলে

মনিজা রহমান
-মিখাইল আসবে কাল ?
-কি বলছ! ওকে আসার অনুমতি দিলে কেন?
-আমি কি বলব? না আসতে? ও বলল, কাল রিসার্টিফিকেশনের শেষ দিন। না আসতে পারলে সৃজনের সব সার্ভিস বাতিল হয়ে যাবে।
আমতা-আমতা করে শেষের কথাগুলো বললাম আমি।
আমার স্বামীকে কথাগুলো আমার আরও শক্ত গলায় বলা উচিত ছিল। মিখাইল তো আমাদের কত দিনের পরিচিত। গত পাঁচ বছর ধরে আমাদের বাসায় আসছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এজেন্সির সেবাপ্রাপ্তদের শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেওয়া ওর কাজ।
মিখাইল কাজের চেয়ে গল্প করে বেশি।
-জানো আমার জন্মভূমি উজবেকিস্তানের বুখারায়। যেটা তোমাদের পবিত্র স্থান।
- সহিহ্ হাদিসের জন্য বিখ্যাত ইমাম বুখারির জন্মভূমি।
-বুখারাতে আমরা ছিলাম সংখ্যালঘু। মুসলমানরা সব সময় আমাদের দেখলে বিদ্রূপ করত। দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলত। আমার বয়স যখন আট বছর, বাবা-মায়ের সঙ্গে নিউইয়র্কে চলে আসি। এখানে এসে আমার বাবা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে।
শনিবার দিন মিখাইল কখনো ফোন ধরে না। ওদিন ওদের সাবহাত। ইহুদি পুরুষদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মাথায় টুপি পরে সে। বয়স কত হবে? ২৫ কি ২৬ বছর! ওর স্ত্রীর বয়স ২২ বছর। স্বামীর মতো সেও নার্সের কাজ করে। তবে সে কাজ করে লং আইল্যান্ড জুইশ হাসপাতালে। যেখানে এখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের আর্তনাদে বাতাস ভারী। দেড় বছরের কন্যাকে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে স্বামী স্ত্রী বেড়িয়ে পড়ে কাজে।
মিখাইল আসবে শুনে আক্ষরিক অর্থে সেই রাতে আমার স্বামীর ঘুম আসে না। মিখাইলকে কীভাবে আসতে বারণ করবেন? ফোন করে নাকি টেক্সট পাঠিয়ে? সকাল থেকে ফোন হাতে দ্বিধান্বিত চেহারায় তাকে বসে থাকতে দেখি।
বেলা গড়াতে থাকে। আমাদের কোন কাজ করা হয় না। মিখাইল বলেছে, সকাল নয়টা থেকে বারোটার মধ্যে সে আসবে!
দীর্ঘদিন আমাদের বাসায় কেউ আসে না। আমরাও কোথাও যাই না। আমাদের কেমন ভয়ংকর অনুভূতি হয়! কেউ একজন বাইরে থেকে আসবে বাসায়!
একটা চেয়ার নিয়ে ঘরের দরজার সামনে রাখি। মিখাইল এলে বসবে সেখানে। আমরা থাকব ছয় ফুট দূরত্বে। আমরা থাকব নিরাপদে।

অপ্রত্যাশিত 

কবিতা হোসাইন
গত রাতে হঠাৎই মিলির জ্বর এল। অথচ কাল সকালে যেতে হবে কুইন্সের একটি স্কুলে। একটি বাচ্চার স্পিচ ইভালুয়েশন করতে হবে। অ্যাসাইনমেন্টটা সকাল নয়টায়। আগে থেকেই সব সেট করা। অনেকটা সময় লাগবে ব্রঙ্কস থেকে যেতে। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হলেও সে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা বাতিল করতে চাচ্ছিল না। কোনমতে নিজে তৈরি হয়ে, বাচ্চাকে তৈরি করে একসঙ্গেই দুজনে রওনা হয়ে গেল। বাচ্চাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে রওনা হলো নিজের গন্তব্যে।
ট্রেনভর্তি মানুষ। প্রথম ট্রেনটিতে উঠতে পারল না সে। ভীষণ ভিড়। অনেক কষ্টে পরের ট্রেনে উঠল। সময় মতো পৌঁছতে না পারলে তার আওয়ার কাটা যাবে। এমনিতেই ভিড় ঠেলে এত দূরের স্কুলে যেতে হচ্ছে, তার ওপর যদি আওয়ার কাটা যায়, তবে তো কষ্টটাই বৃথা। মিলি ঘড়ি দেখছে, আর ভাবছে। নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে মিলি দেখল, তার যাওয়ার রাস্তাটিতে রিপেয়ারিং কাজ চলায় হলুদ টেপ দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী করবে বুঝতে না পেরে মিলি তার স্বামীকে কল দিল। সে তাকে বিকল্প আরেকটি পথের সন্ধান দিল।
কিন্তু ততক্ষণে মিলি রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করেছে। তাকে অনটাইমে স্কুলে পৌঁছাতেই হবে। পথে সে এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করল, পিএস ৬৯ স্কুলটি কোথায় হতে পারে? সে কিছুই বলতে পারল না। রাস্তা ক্রসিংয়ের সময় একজন ইউপিএস ড্রাইভারকে অ্যাড্রেসটি দেখাতেই তিনি দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট গন্তব্যটি। মিলি হাঁটছে আর ভাবছে কী বলবে সে, যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করে কেন তার দেরি হলো। উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সে পৌঁছাল স্কুলে।
ঘড়িতে তখন নয়টা বেজে সাত মিনিট। মেইন অফিসে ঢুকে তার পরিচয় দিয়ে কী উদ্দেশ্যে সেখানে আসা, সেটি জানাল। কিছুক্ষণ বাদেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল এলেন। তিনি এসেই বললেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত। তুমি যেই স্টুডেন্টকে ইভালুয়েশন করতে এসেছ, সে আজকে ফিল্ড ট্রিপে চলে গেছে। আমি তার শ্রেণি শিক্ষককে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ সে আরও বলল, ‘তবে তুমি তোমার অ্যাসাইনমেন্টের পুরো পারিশ্রমিকই পাবে। কারণ ভুলটা আমার।’ কথা শেষ করেই অ্যাসাইনমেন্ট ইনভয়েসটা স্বাক্ষর করে সে সেটা মিলির হাতে দিলেন।
মিলি স্কুল থেকে বের হতে হতে ভাবল, বাহ, কাজ না করেও সে পুরো পারিশ্রমিকই পেয়ে গেল। সত্যি, ‘লাইফ ইস ফুল অফ সারপ্রাইজ’।

স্কেচ

লুৎফা শাহানা

নান্দনিক একটা ছবির গ্যালারি ঘুরে দেখছে পপি। ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকা, প্রদর্শনীতে যাওয়া, গ্যালারি ঘুরে দেখা তার নেশা ছিল। তারপরও এই নেশাকে আপন করতে পারেনি পরিবারের কারণে। তাঁদের মতে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা নাকি উচ্ছৃঙ্খল টাইপের হয়। ছবি আঁকার নাম করে সারা দিন বন–বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। নেশাটেশাও করে। পরিবারের এই মিথ্যা ধারণার কারণে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায় পপির। তবে ছবির সঙ্গে আত্মার কথোপকথন থেমে যায়নি কখনোই।
এখনো সে দেশে- বিদেশে যেখানে যায়, সেখানেই আর্ট গ্যালারি হয় তার মূল আকর্ষণ।
এই মুহূর্তে যে ছবিটার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের স্কেচ। নিখুঁত হাতে আঁকা। ভবনটাকে ঘিরে রেখেছে পাতলা নেট। যার কারণে ছবিটা ধোঁয়াটে লাগছে।
ছবিটার প্রতি কেমন যেন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করছে সে।
একের পর এক হৃদয়ের পলেস্তারা খুলে যেন বেড়িয়ে আসছে ভয়ংকর এক সত্য। আস্তে আস্তে পর্দা উঠে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। সেখানে তুলির আঁচড়ের জায়গা নেই। আছে অসংখ্য ক্ষত ইট, বিক্ষত মানুষের কঙ্কাল আর ঘামের সূক্ষ্ম রেখাপাত।

তাল দুপুরে বালক

ইশতিয়াক রূপু
বাসার পেছনে, উত্তর পশ্চিম কোনের, মজা পুকুরের উত্তর পাড়ে সাচনার বাসার দক্ষিণে ছিল এক জোড়া তাল গাছ। ভাদ্র মাসের নীরব দুপুরে ঝুপঝাঁপ শব্দ তুলে টপ টপ করে পাকা তাল ঝরত। আওয়াজ শুনে বালক গৃহ সহকারী করিমের ভোঁ দৌড়। পুকুর পাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মরা ডাল আর শুকনো পাতাকে দাপিয়ে মাড়িয়ে সবুজ ঝোপঝাড় লাফ দিয়ে টপকিয়ে বেত বনের পাশ কেটে হাঁপাতে হাঁপাতে সে হাজির হতো জোড়া তালগাছ তলায়। বেত ঝোপের এক পাশে কালচে রঙের বেশ মোটা একটি তাল, আয়েশে হেলান ভঙ্গিতে বসে মিট মিট করে দেখছে বালক করিমের লোভী চোখে তাল রসের স্বাদ খোঁজার শিশুসুলভ আকুলতা। বালকের দুই চোখ ডানে বামে ঘুরছে। ঝুপ ঝুপ আওয়াজে বোঝা যাচ্ছিল তাল পড়েছে দুটি। তাহলে বাকি তালটি গেল কোথায়?
বাসায়ই তো অনেক লোকজন। এর ওপর আজ সিলেট থেকে আসবেন আরও গোটা ৪–৫ জন অতিথি। একটা তালে সবার কী হবে?
বালকের সন্ধানী চোখ পড়ল সামনের মরা বেত ঝোপের ভেতরে। শুকনো পাতার নিচে উঁকি দিচ্ছে জোড়া তালের আরেকটি। বালক করিমের চোখ চক চক করে উঠল কালচে পাকা তালের এই দারুণ আবিষ্কারে। বাদামি হয়ে যাওয়া মরা বেতের লতাপাতা সরিয়ে, নানা কসরত করে তালের নাগালে পৌঁছাল বালক করিম। দুই হাতে বগলদাবা করে দুটো তাল নিয়ে করিমের কতইনা আনন্দ। তাল দুপুরে পুকুরের দক্ষিণ পাড় থেকে অপর পাড় পর্যন্ত বেত ও বুনো গাছের ঝোপ টপকাতে টপকাতে দৌড়ে চলেছে বালক।
মনিবের স্ত্রীকে গতকালই সে বলেছিল, ‘নানি সুগন্ধি তালের ডুবো পিঠা খাইতে মন চায়। উত্তরের পুকুর পাড়ের তালগাছের ঝরা তালের মালিক কইলাম আমি। দেইখেন, কাল হেলে যাওয়া দুপুরে দুইটা তাল আমি নিয়েই আসব।’
বালক করিম তাই করল। সে দুটি সুগন্ধি পাকা তাল জোগাড় করেছে!