কোভিড-১৯: চিকিৎসার জটিলতা ও আশার আলো

নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করছে। ছবি: রয়টার্স
নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করছে। ছবি: রয়টার্স

গত সপ্তাহে প্রথম আলোতে আমি লিখেছিলাম—শত শত করোনা রোগীকে বাঁচানো যাবে শুধু অক্সিজেন দিয়ে। নিউইয়র্কে আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এই কথা লিখেছিলাম। সেখানেই লিখেছিলাম স্বল্প সময়ে করোনাভাইরাস দমনের কৌশল নিয়ে কিছু আশার কথাও।

এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করেছি নিউইয়র্কে আমার কর্মস্থল এলমহার্স্ট হাসপাতালের কথা। এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণের ‘এপিসেন্টার অব এপিসেন্টার’ হয়ে পড়া নিউইয়র্কের এই হাসপাতালে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের অনুসৃত পথের কথা। আমরা যা করছি সেটাই সঠিক, অথবা সবারই এমন করা উচিত—এমন কথা বলার সুযোগ নেই। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ এখানে নেই।

করোনাভাইরাসের চিকিৎসা, বিশেষ করে ড্রাগ থেরাপি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এর কারণ হলো বৈজ্ঞানিক বিধি অনুযায়ী পরিচালিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিশ্চিতভাবে এখনো কোনো ওষুধের সন্ধান পাওয়া যায়নি, যা ভাইরাসটির বিরুদ্ধে পুরোপুরি কার্যকর। এই মুহূর্তে শতাধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, যা এই মুহূর্তে কোন ওষুধটি সবচেয়ে কার্যকর এবং কেন, তা নির্ধারণে পরিচালিত হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, যত দিন কোনো ওষুধের কার্যকারিতা সঠিকভাবে প্রমাণিত না হচ্ছে, তত দিন কী করবেন চিকিৎসকেরা? আমাদের চোখের সামনে একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছে। আমরা কি শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত ওষুধ পাওয়া না যাচ্ছে? না। প্রত্যেক চিকিৎসক তাঁর নিজস্ব বিচারবুদ্ধি থেকে সিদ্ধান্ত নেবেন কোনটা ভালো হবে তাঁর রোগীর জন্য। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই, বিতর্ক নেই। আমরা চিকিৎসকেরা যখন কঠিন সিদ্ধান্তের সংকটে পড়ি, তখন নিজেকেই প্রশ্ন করি—রোগী আমার বাবা-মা হলে কী করতাম? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে আমাদের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি।

গত সপ্তাহের লেখায় আমি শুধু আমাদের সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেছি। নিউইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য ও হাসপাতালব্যবস্থায় যে ১১টি হাসপাতাল রয়েছে, তাদের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞেরা একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোভিড-১৯ চিকিৎসায় Hydroxychloroquine ও Azithromycin-এর ব্যবহার শুরু করা হবে। এটি ব্যবহার করা হবে শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য। আমাদের এই সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে এর কার্যকারিতা ইতিবাচক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। চীন থেকেও এই দুই ওষুধের কার্যকারিতার কথা জানানো হয়েছে। মানুষ যখন নদীতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন সে খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়। আমাদের এখন ঠিক সেই রকম অবস্থা। শিগগিরই জানতে পারব—আমাদের এই চেষ্টার সাফল্য ও ব্যর্থতা।

বিশ্বের অসংখ্য বিজ্ঞানী এই মুহূর্তে নিয়োজিত রয়েছেন করোনাভাইরাসের একটি কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কারে। এই সপ্তাহেই জানা গেছে, কৃমিনাশক ওষুধ IVERMECTIN এই ভাইরাসকে দ্রুত মেরে ফেলে। ইন-ভিট্রো বা পরীক্ষাগারে পরিচালিত প্রাথমিক পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এর ব্যবহারের ফলে করোনাভাইরাস পাঁচ হাজার গুণ কমে যায়। আমরা নিউইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালে চলতি সপ্তাহ থেকে মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীদের ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটাই বাস্তবতা। এখানে বিলাসিতার সুযোগ নেই, সুযোগ নেই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে—এমন ওষুধের অপেক্ষার।

এলমহার্স্ট হাসপাতালের সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক
এলমহার্স্ট হাসপাতালের সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক

বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে যেসব ওষুধ আমরা প্রয়োগ করছি, সেগুলো হলো Hydroxychloroquine, Azythromycin, Ivermectin, Tocilizumab, Sarilumab, Remdesivir ও Immunoglobulin। রোগীদের অনুমতি নিয়ে, শেষ চেষ্টা হিসেবে এসবের ব্যবহার হচ্ছে। গুরুতর রোগীদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে Immunoglobulin কার্যকরী হবে বলে বিশ্বাস করি আমরা। এ ছাড়া অ্যান্টি-ভাইরাল মেডিকেশনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। সব শেষে ভ্যাকসিন বা টীকা হবে শেষ অস্ত্র এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে, তার আবিষ্কারও কেবল সময়ের ব্যাপার।

আমেরিকায় আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য করণীয় কী হবে, গত সপ্তাহে সে বিষয়েও আলোকপাত করেছিলাম। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে ব্যাপকভাবে অক্সিজেনের ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে ব্যাপকভাবে এই ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা। অ্যান্টিবডি থাকলে সেট সংগ্রহ করে মজুত রাখাটা সঠিক পদক্ষেপ হবে। এটা দুরূহ কাজ, যদি কার্যকরভাবে পরীক্ষা না করে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করা হয় তাহলে রক্তের মাধ্যমে অন্যান্য অসুখ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকবে।

আগেই বলেছি ভ্যাকসিন বা টীকা আবিষ্কার শুধু সময়ের ব্যাপার। টানেলের শেষে আলো অবশ্যই আছে। আতঙ্ক নয়, সচেতনভাবে বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে এই বিপর্যয়।

আমর আশরাফ: নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের অধ্যাপক ও এলমহার্স্ট হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ।