করোনা নতুন করে বাঁচতে শেখাচ্ছে

জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি খুব ব্যস্ত ছিলাম। গ্রোসারি ও সুপার মার্কেটে যাওয়ার সময়ই ছিল না। ঘরে বাজার নেই খেয়াল করিনি। হঠাৎ অশনিসংকেত করোনাভাইরাস ধেয়ে আসছে! নিউইয়র্কে মৃত্যুর প্লাবন বইয়ে দেবে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল কয়েকটা গ্রোসারিতে গিয়ে কিছুই পেলাম না। তারপরও যত্সামান্য যা পেলাম নিয়ে আসি।
১৯৮১ সালে ডিয়ান কুনৎস রাশিয়ার কোন একটি শহরের পাশে কোনো এক বায়োলজিক্যাল ল্যাবে তৈরি করোনাভাইরাস নিয়ে একটা রোমাঞ্চকর অলীক কাহিনি ‘দ্য আইজ অব ডার্কনেস’ লিখেছিলেন। প্রায় ৪০ বছর পর ২০২০ সালে উপন্যাসের কাহিনি পুরোপুরি বাস্তবেও ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীর রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কে। এ রকম অবিশ্বাস্য কাকতালীয় ব্যাপার স্বয়ং ডিয়ান কুনৎসেরও বিশ্বাস করার কথা নয়। সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘দ্য আইজ অব ডার্কনেস’ বইটি লেইগ নিকল ছদ্ম নাম নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। কাল্পনিক বায়োলজিক্যাল উইপেন গোর্কি ৪০০ রাশিয়ার গোর্কি শহরের কোনো ভাইরোলজি ল্যাব থেকে ভুলবশত মানুষের তৈরি অর্গানিজমগুলো ছড়িয়ে পড়ে। যারা সংক্রমিত হবে, ৪ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত। যে ভাইরাস এখন নিউইয়র্কে মৃত্যুর তাণ্ডব চালাচ্ছে, তার মৃত্যুর হার তিন থেকে চার পার্সেন্ট। উহার ৪০০ মেন-মেইড! ভাবতে গিয়ে ভয়ে গা হিম শীতল হয়ে গেল। না, বাস্তবে এমন ভয়ংকর জীবাণু মানুষ মারার জন্য কেউ তৈরি করতে পারে না। অথচ তাই ঘটতে যাচ্ছে।
১৯৭৭ সালে রিচার্ড হ্যারিস, সুফিয়া লরেন এবং ও জে সিমসন অভিনীত ‘দ্য ক্যাসান্দ্রা ক্রসিং’ সিনেমার মুভির দৃশ্যগুলো চোখের সামনে মুহূর্তে ভেসে ওঠে। জেনেভা থেকে স্টকহোমের উদ্দেশ্যে ট্রান্সকন্টিনেন্টাল এক্সপ্রেস ট্রেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ডেডলি ভাইরাস ইনফেকটেড সুইডিস টেররিস্ট ট্রেনে। কয়েকজন যাত্রী ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ কোনো স্টপেজই এই ট্রেনকে থামতে দিতে রাজি নয়। নির্দিষ্ট গন্তব্যে না থামিয়ে ট্রেনকে যাত্রীসহ নড়বড়ে ক্যাসান্দ্রা ক্রসিং ব্রিজটির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের সবার মৃত্যু নিশ্চিত। ১৯৭৯ সালে মধুমিতা সিনেমা হলে দেখা সেই ছবির প্রতিটি উত্তেজনাকর মুহূর্ত যেন এখন আমার সামনে ভিন্ন রূপে ঘটে চলছে। এমন বিপর্যস্ত অবস্থা নাইন–ইলেভেনের পর আমার এই প্রথম প্রত্যক্ষ করা।
আমি ও আমার মেয়েকে নিয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত চেষ্টা করি অনলাইনে গ্রোসারির ওয়ার্ডার দিতে। ফুড বাজার, ট্রেড ফেয়ার এবং কসকোসহ আরও কিছু জায়গায় অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিলাম। সব চেষ্টা ব্যর্থ। এখন সামান্য চাল–ডাল এবং কয়েকটি ডিম আছে। কয়েক দিন হয়তো চলবে। ডিপ ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর দুটোই খালি। বেশ কয়েক বছর আগে অতিরিক্ত একটা ডিপ ফ্রিজ নিয়েছিলাম। মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি দিয়ে ভরা থাকত। নিচ তলার প্রতিবেশীরাও ঈদের মাংস এনে জমা রাখত। সেই ফ্রিজে এখন কিছু শুকনো পুটলাপুটলি ছাড়া আর কিছু নেই।
তিন সপ্তাহের ওপরে বাসায় পুরোপুরি লকডাউনে আছি। আত্মীয়স্বজনেরা বললেন, যা আছে তাই নিয়ে আপাতত চালিয়ে নিতে। তাদের কীভাবে বোঝাব যে, আমরা ডালভাত খেয়ে কদিন কাটিয়ে দিতে পারলেও মেয়ে এই খাবার মুখেই তুলবে না। পেস্তা, চিজ, ব্রেড বাটার, হালাল টার্কি ব্রেস্ট, টুনা ফিশ, স্যামন ফিশ, বিনস আরও কত কিছু। প্রায় সবই ক্যান ফুড এবং প্যাকেজ জাত খাবার। আমরা স্বামী-স্ত্রী সহজে ক্যান ফুড খাই না। পরিস্থিতির কারণে সামারের আগেই মেয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে চলে আসবে, কে জানত। এখন বাসা থেকেই অনলাইনে ক্লাস করবে। কিছুক্ষণ পরপর স্ন্যাক্স চাই। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কয়েক দিন পর আমাদের ডাল–ভাতও জুটবে না।
বাইরে অবস্থা ভয়ানক খারাপ। বের হওয়া মানেই মৃত্যুর হাতছানি। কোথায় করোনাভাইরাস ঘাপটি মেরে লেগে আছে, কে জানে। তিন সপ্তাহের বেশি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হইনি। একদিন পোস্টম্যান দরজার কলিং বেল বাজায়। বলে লেটার বক্স থেকে যেন মেইলগুলো নিয়ে আসি। প্রতিদিন মেইল চেক না করায় নতুন মেইল রাখার জায়গা নেই। সেদিনই ভয়ে ভয়ে নিচে নামলাম। ফিরে এসে হাত–মুখ ও চাবি সাবান দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করি।
জীবনটা হঠাৎ করেই দুঃসহ হয়ে উঠল।
বছরটি নতুন উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করব, সেই পরিকল্পনা ছিল। শুরুতেই প্রচণ্ড হোঁচট। ছোট ছেলে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বলছিল, বাবা পেশাটি চেঞ্জ করো। তোমার বর্তমান পেশাটি আর ভালোর দিকে যাবে না। নিউইয়র্কে একটা ভালো ইনস্টিটিউটের খোঁজ পেয়েছি। এই বয়সে আবারও পড়াশোনা! প্রথমে না বলে দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত জানুয়ারিতে নতুন একটা কোর্সে ভর্তি হলাম। সপ্তাহে চার/পাঁচ দিন ম্যানহাটনে আসা–যাওয়া করছি। ভোরে ট্রেনে ম্যানহাটনে যেতাম। সকালে এস্টোরিয়া থেকে ম্যানহাটনে যেতে ট্রেনে লোকে গিজগিজ করত। অনেক দিন পরে মনে হলো, আমি আমেরিকান। ডিটমার্স স্টেশন থেকে ট্রেনের যাত্রা। পরের স্টেশন এস্টোরিয়া বুলেভার্ড। আমি এখান থেকেই উঠি। দীর্ঘ ৩০ বছর এস্টোরিয়ায়। সাবওয়েতে তেমন যাতায়াতের প্রয়োজন পড়ে না। এত বছর পর এখন প্রতিদিনই ম্যানহাটনে যাচ্ছি। বায়োলজিক্যাল ক্লকটাও নতুনভাবে সেট হয়ে গেছে।
শীতের সকাল। কম্পার্টমেন্ট যাত্রী ভর্তি। দেখেই বোঝা যায়, সবাই ভালো জব করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ এবং সাদা চামড়ার লোক। আমিই ব্যতিক্রম। নিজের একাকিত্ব ঢাকার জন্য ক্রিস্টিন বেকরনের এক্সাম পাস বইটিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। বলতে গেলে এখন এস্টোরিয়া পুরোপুরি সাধা চামড়া অধ্যুষিত এলাকা।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। সিজনাল ফ্লু প্রতিবছর ঠান্ডায় সবারই একটু-আধটু হয়ে থাকে। এটা নিয়ে চিন্তার কারণ দেখি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে পীড়াপিড়ি করতে লাগল হাসপাতালে যেতে। সামান্য ফ্লুর জন্য হাসপাতালে যাব? প্রশ্নই ওঠে না। তিন-চার দিন পর স্ত্রীর ফ্লুর লক্ষণ ধরা পড়ে। স্ত্রীর অভিযোগ, বাইরে থেকে ফ্লুর ভাইরাস নিয়ে এসেছি। তখনো নিউইয়র্কে করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এসব চাইনিজদের ব্যাপার। সাপ–বিচ্ছু–বাদুড় খাওয়ার জাতি। তাদের ভাইরাসে ধরবে না তো আমাদের ধরবে?
ইতিমধ্যে আমি তিনটা থ্রেরাফ্লু খেয়ে মোটামুটি ভালো। দুটো থ্রেরাফ্লু খেয়ে স্ত্রীও সুস্থ। অবশ্য সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে আমার কেন যেন জ্বর জ্বর ভাব থাকত। তাপমাত্রা মেপে দেখলাম মাত্রই ৯৭ ডিগ্রি। খুব নরমাল। তবে কেন জ্বর জ্বর লাগবে? ইতিমধ্যে করোনা তার নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে নিউইয়র্কে। দুই/তিন দিন পরে ছেলের দেওয়া ফিটবিট ঘড়িটি হাতে থাকায় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, সকালে ঘুম থেকে ওঠার মুহূর্তে পালস বিট নরমাল না। সামান্য কম। ঘরে একটুখানি হাঁটাচলা করলেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সেই মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত করোনার ভয় চলে গেল।
অবস্থা যাই থাকুক, খাবার কিনতে তো বাইরে যেতে হবে। একটা মাস্কও নেই। মাস্ক ছাড়া কীভাবে বের হব? আমার মেয়ে ইউটিউব দেখে ফুল হাতা গেঞ্জি দিয়ে চমৎকার মাস্ক বানানো শিখে ফেলল। কিচেনের ড্রয়ারে একটা পুরো প্যাকেট পাতলা গ্লাভস খুঁজে পেলাম।
সবাই নিষেধ করায় সেদিনও ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করতে পারলাম না। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেল। সবার সতর্ক বাণী উপেক্ষা করে বের হয়ে পড়ি। না খেয়ে মরতে চাই না। গাড়িতে আগে থেকেই ডিসইনফেক্টিং স্প্রে এবং হ্যান্ড সেনিটাইজার ছিল।
কসকোতে গিয়ে দেখি বিরাট লাইন। পার্কিং লট ছাড়িয়ে রাস্তায় পুরো একটা ব্লক পর্যন্ত। কোনো বিকল্প নেই। লাইনে দাঁড়াতে হবে। আসলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় অনেক লম্বা লাইন। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে ভেতরে ঢুকে গেলাম। কসকোর ভেতরে ফাঁকাই। মোটামুটি সব জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু জিনিস একটা বা দুটার বেশি কেনা যাবে না। আমাদের কার্ট জিনিসপত্রে উপচেপড়া দেখে অনেকেই বক্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। মেয়ে বললে, ‘বাবা ওরা মনে হয় আমাদের রাক্ষস ভাবছে।’ আমরা এসব ভ্রুক্ষেপ করিনি। আবার কবে আসব ঠিক নেই। পরে এস্টোরিয়া লাইভ চিকেনে গেলাম। সেখানেও প্রচুর চিকেন এবং বিফ নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি।
এত বাজার চার তলায় তুলব কীভাবে? অনেক কষ্টে চার তলায় তুলি। কিছুদিনের জন্য অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেল। বাজারগুলো ভাইরাসমুক্ত করার জন্য ডিসইনফেক্টিং স্প্রে করে আলাদা বক্সে ছেলেদের রুমে রেখে দিলাম। ওরা অনেক দূরের স্টেটে থাকে। দুদিন পরে দেখি ডিপ ফ্রিজে রাখার মতো একটা আইটেম বাইরে থেকে গেছে। তাড়াতাড়ি ডিপ ফ্রিজে এনে রেখে দিলাম। তখন ফেলে দেওয়ার মতো বিলাসিতা আর ছিল না। এই কিছুদিনে মনে হচ্ছে, ঘর থেকে বের হলেই আমরা কত অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতাম। করোনা নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে।