ডেটলাইন নিউইয়র্ক: করোনায় আমাদের সাংবাদিকতা

নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে গত ১ মার্চ প্রথম কোনো নারীর দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। আগে থেকে চীনে এই অসুখের কারণে গণমৃত্যুর সংবাদ আমরা জেনেছি। ফলে নিউইয়র্কের প্রথম মৃত্যু নিয়েও আমরা সংবাদ প্রকাশ করি। কার্যত সেদিন থেকেই আমাদের করোনা সাংবাদিকতা শুরু হয়ে যায়। সহকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিই। ৫ মার্চের প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নারী দিবসের অনুষ্ঠান। ৮ মার্চ নারী দিবস। আমরা আগেভাগেই করে ফেলি। নিউইয়র্কে নারী দিবসের বাকি সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়।

যেকোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের ব্যাপক উত্তেজনা থাকে। তার ওপর নারী দিবসের অনুষ্ঠান। কে কী পরবেন, কোন লিপস্টিক কোন শাড়ির সঙ্গে যাবে—এ নিয়ে যেমন কথা হয়েছে, তেমনি কোন পাঞ্জাবি পরে নারীদের এ অনুষ্ঠানে পুরুষদের যেতে হবে, তা নিয়েও কথা কম হয়নি।

তখনো সোশ্যাল ডিফেন্সিভ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না। আমরা অনুষ্ঠান করলাম। আমাদের নারী সাংবাদিক, লেখকসহ নিউইয়র্কের সব আলোকিত নারী এলেন। তাঁরাই অনুষ্ঠান করলেন। আমরা কিছু পুরুষ লোক যেমন বাসায় চুপসে থাকি, তেমনি থাকলাম। দেখাই সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আসলে কিছুই আর নিয়ন্ত্রণে নেই আমাদের। বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। হাসিমুখে ছবি উঠালাম সেরা সুন্দরী নারীদের সঙ্গে। পরের অনুষ্ঠান আরও কত জমকালো করা যায়, এ নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা অনুষ্ঠান শেষ করলাম। আমাদের পরের অনুষ্ঠান ছিল প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার বর্ষপূর্তির।

পরদিনই নিউইয়র্কের মেয়র বক্তব্য দিলেন। কিছুটা আভাস পাওয়া গেল ভাইরাসটি ধেয়ে আসছে। আমরা তখনো জানি না, কোন দিকে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যেই আমাদের পরের সপ্তাহের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। আগে থেকেই আমি কাজের ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম। আমাদের সব লেখক, এমনকি বাণিজ্য বিভাগের লোকজনকেও ঘরে বসে কাজ করা নিয়ে অভ্যস্ত করতে পেরেছিলাম। অফিসে উপস্থিত না হয়েও কীভাবে বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা যায়, তার একটা অনুশীলন আমাদের ছিল।

আমরা ১২ মার্চ অফিসে সবাই উপস্থিত। টের পাওয়া যাচ্ছিল, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার আমাদের অফিসে এক ভিন্ন আবহ। আমাদের লেখক, কন্ট্রিবিউটাররা আসেন। জম্পেশ আড্ডা হয়। ১২ মার্চ কোনো কিছু না বলেই আমি অনেককে অফিসে আসতে নিরুৎসাহিত করি। এরপরও অনেকেই আসেন। আলাপ–আড্ডা সংক্ষিপ্ত করি। সবার মনে তখন ভিন্ন ভাবনা। কাউকে তেমন প্রাণবন্ত মনে হয় না। দ্রুতই অফিস ত্যাগ করে ঘরে ফিরি। নিউইয়র্কের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি আর মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। এর মধ্যেই আমরা পরের সপ্তাহের পত্রিকা বের করি স্বশরীরে অফিসে না গিয়ে। রাজ্যের গভর্নর ২০ মার্চ থেকে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ জারি করেন। মৃত্যুর বেপরোয়া তালিকা আসতে শুরু করে।

নিউইয়র্কের সংবাদমাধ্যমের পরিচিত মুখ ইলিয়াস খসরু শুরুতেই হাসপাতালে ভর্তি হন। স্বপন হাই হাসপাতালেই ছিলেন। ফরিদ আলম হাসপাতালে যাওয়ার খবর পাই। যার সঙ্গে শেষ কর্মদিবসে কথা বলেছি ফোনে, বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি সেই কামাল আহমেদ ও স্বপন হাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাই। আমার একনিষ্ঠ বন্ধু সাবেক ছাত্রনেতা শাহাব উদ্দিনের সংকটাপন্ন অবস্থার সংবাদ আসে। সবাই ঘরে আবদ্ধ। আমার অন্য উৎকণ্ঠা বাড়ে। আমাদের লেখক, কন্ট্রিউবিটরদের নিজ নিজ এলাকার খবর নিয়ে সক্রিয় হতে বলি। সবাই কাজের গতি বাড়ান।

আমাদের রাজুব ভৌমিক পুলিশের কর্তা। তাঁকে সামনের সারিতে কাজ করতে হয়। সারা রাত কাজ করেন তিনি। এর মধ্যেও সংবাদ, ছবি পাঠাতে থাকেন। মনীষা তৃষা ব্রঙ্কসে থাকেন। জানান, তিনি বাইরে গিয়ে রিপোর্ট করতে চান। আমার ভয় বাড়ে। নিজেকে নিরাপদ রাখতে বলি। তৃষা কঠিন লকডাউনের সময়ে বাইরে গিয়ে রিপোর্ট করেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। আসিফ মোক্তাদির বাফেলোতে থাকেন। বিশাল কমিউনিটি বাফেলোতে। আসিফ প্রতিদিন আপডেট জানান, খবর পাঠান। ইশতিয়াক রূপু, আমাদের অন্যতম প্রাণপুরুষ। সদা উৎফুল্ল এ মানুষটি ঘরে বন্দী, ভাবতেও পারি না। পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে সবার খোঁজখবর রাখার দায়িত্ব তিনি পালন করেন। প্রতিদিন নানা খবর আসে, স্বজনের মৃত্যুর খবর আসে। ইশতিয়াক রূপু খবর তৈরি করেন।

তরুণ সহকর্মী শাহ আহমদ। নানা তাড়না নিয়ে একজন সংবাদকর্মী কাজ করেন। শাহ আহমদ সেসব তাড়নার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই আমার সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন। নিউইয়র্ক হয়ে উঠে করোনা মহামারির কেন্দ্রস্থল। আমরা সব রিপোর্ট একসঙ্গে করি। জাহিদা আলম একসময়ের দাপুটে সাংবাদিক। কড়া লকডাউনে তাঁকে অ্যাসাইন করা রিপোর্ট করেন। শাহ আহমদকে নিয়ে লকডাউনের নিউইয়র্ক নিয়ে সংবাদচিত্র করেন তাঁরা। জাহিদার মেয়ে ক্যামেরা ধরেন। নিউইয়র্কে করোনা লকডাউনের এসব ভিডিও লাখ লাখ লোক দেখেন। শাহ আহমদ করোনাকালে আমার প্রতিদিনের রিপোর্ট লেখার এক অপরিহার্য সঙ্গী এখন। তারুণ্যের উদ্যম আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

নিউইয়র্ক তখন সারা বিশ্বের নজরে। মনিজা রহমান সবার পরিচিত সাংবাদিক। স্কুলে কাজ করেন। স্কুল বন্ধ নয়। ঘরে থেকে কাজ করতে হয়। ঘরে স্পেশাল চাইল্ড। এর মধ্যে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কথা হয় আমাদের। মনিজা দ্রুত তা পাঠকদের জন্য লিখে দেন। নিউইয়র্কে আমাদের জ্যেষ্ঠদের করোনাকাল নিয়ে রিপোর্ট করেন। এইচ বি রিতা অসুস্থ। করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর রিতার সঙ্গে কথা বলতেও আমার ভয় লাগে। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের রোগী। এইচ বি রিতা লড়াকু মানুষ। নানা বিষয়ে লেখাপড়া তাঁর। একের পর এক রিপোর্ট করতে থাকেন। আমার বুক কাঁপে।

আমাদের মধ্যে রওশন হক বেপরোয়া মানুষ হিসেবে এর মধ্যেই খ্যাতি পেয়েছেন। ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। লকডাউনে তাঁকে কাজে যেতে হয়। এর মধ্যে লেখেন নিজের অভিযাত্রার কথা। লেখেন সহকর্মীর স্বজনের মৃত্যু নিয়ে। সেলিনা আক্তার প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার বনেদী লেখক। লেখতে থাকেন একের পর এক আশাবাদী উপাখ্যান।

ভায়লা সালিনা, যাকে আমরা লিজা বলে ডাকি। বেচারা নিজের অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সংগ্রাম করছেন। হাসপাতাল–ক্লিনিক তাঁর সঙ্গী বেশ কিছুদিন ধরে। করোনায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টের সুপার মারা যান। ব্যক্তিগত আবেগের কথা লেখেন। আমাদের বিমর্ষতা বাড়ে। জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না কবি মানুষ। কবিতা ছেড়ে রিপোর্ট লেখেন। রোকেয়া দীপা আমাদের অতি সংবেদনশীলদের মধ্যে একজন। দীপা স্ট্যাটেন আইল্যান্ড থেকে রিপোর্ট করেন। ঘরের কাছেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। স্পটে চলে যান। আমার ভয় বাড়তে থাকে। করোনাকালে পাপী মনা করোনা নিয়ে গান করেছেন। সেটা উঠে আসে দীপার লেখায়। রূপা খানম, শিমু আফরোজা ও আইরিন রহমান আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন নানাভাবে। তাঁরা লেখা দেন, খোঁজ নেন সবার।

রহমান মাহবুব ভিন্নধর্মী রিপোর্টের জন্য এর মধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ইহুদিদের নিয়ে প্রথম একটি রিপোর্ট করেন, যারা সোশ্যাল ডিস্টেন্স মানে না বা বোঝেই না। মাহবুব একের পর এক রিপোর্ট করতে থাকেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, নাগরিক সহযোগিতা প্রাপ্তির আবেদনের নানা সমস্যা নিয়ে। এম আর ফারজানা আমাদের নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর। থাকেন নিউজার্সিতে। প্রতি সপ্তাহে করোনাকালের নানা উপাদান আসতে থাকে তাঁর কাছ থেকে। আবদুশ শহীদ সবার আগে কোয়ারন্টিনে যাওয়া মানুষ। নিজের অসুস্থতা নিয়ে সদা সচেতন আবদুশ শহীদ চরম উৎকণ্ঠা নিয়েও সচল থাকেন। লেখেন প্রতি সপ্তাহে। মনের নানা জটিল অভিধা ফুটে ওঠে তাঁর ভাবনায়। ব্রুকলিন থেকে রোমেনা লেইস নিয়মিত লেখেন। নিউজের নানা উপাদান নিয়ে লেখেন, লেখেন লোকজনের বিপৎসংকুল অভিযাত্রা নিয়ে। প্রবীণদের একজন সুব্রত বিশ্বাস। এস্টরিয়ার বাসায় থেকে ফোনে সবার খোঁজ নেন। বলি, দাদা লিখতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এবারের যুদ্ধ নিয়ে লিখে জীবন পূর্ণ করেন। মলিন হাসেন চির তরুণ সুব্রত বিশ্বাস।

জর্জিয়ায় থাকেন সাহিত্যিক মঈনুস সুলতান। ইবোলা মহামারিতে কাজ করেছেন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আমাকে মহামারি ও সংক্রমণ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান। আমরা রিপোর্টে তা উল্লেখ করি। প্রফেসর ডা. জিয়াউদ্দিন নিজে থেকে তথ্য দেন। নিজে লিখে পাঠান। আমরা প্রকাশ করতে থাকি।

এর মধ্যে রাজুব ভৌমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। করোনায় আক্রান্ত হয়েও তিনি ‘উত্তরের পথে’ পাতা বের করেন। তাঁর স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা ভৌমিক আমাদের কন্ট্রিবিউটর। উদ্বেগ বাড়ে। রাজুব সুস্থ হন। প্রিয়াঙ্কার নিকটাত্মীয় মারা যান। বিপন্ন সময়ে শোকের পর শোক।

এম বি তুষার আমাদের ফটোগ্রাফার। কাজ করেন ইমার্জেন্সি সার্ভিসে। হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাচ্ছেন, আসছেন। খবর নেই। বুক কাঁপে। তিনি নিজেই খবর হয়ে ওঠেন তাঁর কাজের কারণে। নিউইয়র্কের বিপন্ন সময়ে নাইন–ইলেভেনে কাজ করা তুষারের মহৎ কাজের বিবরণ জানেন আমাদের পাঠকেরা। নিউইয়র্কে হাবিবুর রহমান আমাদের এক সহযোগী পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। নিউইয়র্কে অধিকাংশ ছাপা পত্রিকা বন্ধ। যদিও কারও কারও অনলাইন চলছে। হাবিবুর রহমান ব্রঙ্কস ঘুরে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমাদের জন্য সংবাদ দেন। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। আটলান্টিক সিটি থেকে সুব্রত চৌধুরী লেখেন করোনাকালের রিপোর্ট।

ফারুক ফয়সল কবি, লেখক। আমাদের ‘কবিতার এক পাতা’ সম্পাদনা করেন। সংবেদনশীল মানুষ ফারুক ফয়সল প্রতিদিন সবার খোঁজ নেনে। কাঁপা কণ্ঠে জানান, নিজে কী করছেন। আমি সাহসের কথা বলি। তাঁর কথায় প্রাণ আসে না। বিমর্ষ হয়ে জানান, করোনাকালের কবিতার সংগ্রহের কথা। লেখা পাঠান আহমাদ মাযহার, ফকির ইলিয়াস, ফারহানা ইলিয়াস, আবদুল্লাহ জাহিদ, মাকসুদা আহমেদ, কান্তা কাবীর। সবার মন খারাপ। এ এক অসহনীয় বাস্তবতা!

দেশে গিয়ে আটকে পড়েছেন আমাদের দুজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। মাহবুবুর রহমান আর শেলী জামান খান। মাহবুবুর রহমান দেশে গিয়ে নিজে পড়েছেন দুর্ঘটনায়। তিনি ঢাকায়, তাঁর স্ত্রী সিলেটে। সন্তানেরা নিউইয়র্কে। পরিবার–অন্তঃপ্রাণ মাহবুব ভাই চরম অসুস্থতা নিয়ে নিয়মিত আমাদের খোঁজ রাখেন। আমাকে আশ্চর্য করে লেখা পাঠান। তাঁর সমৃদ্ধ লেখায় ফুটে ওঠে নানা মর্মবেদনার কথা। শেলী জামানের অবস্থা আরও নাজুক। তাঁরও অর্ধেক পরিবার নিউইয়র্কে। এখানে করোনার তাণ্ডব। প্রতিদিন খবর পাচ্ছেন, লোক মারা যাচ্ছে। আমাদের উত্তর আমেরিকা অফিসের প্রাণ শেলী জামান, সবার খবর নেন। নিজের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা নিয়ে, দেশের বাস্তবতা নিয়ে লেখেন। কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। মাসিক অণুগল্পের পাতা ঠিকই সম্পাদনা করে পাঠান। লেখক ফরিদা ইয়াসমিন জানান, তিনিও লিখছেন। সহকর্মী মনজুরুল হক এই বিপন্ন সময়েও কমিউনিটির ভেতরের খবর নিয়ে রিপোর্ট লেখেন। অফিস সামলে রাখা সানজিদা ঊর্মি নিজের রান্নাঘর, শ্বশুর–শাশুড়ির মাঝখানেই অফিসের কাজে নামেন।

ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার একান্ত স্বজন। ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠান করে আমাদের অনুপ্রেরণা দিতে এগিয়ে আসেন।

মোস্তফা তানিম প্রকৌশলী, লেখক। বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য থাকে তাঁর লেখায়। জানালেন রিপোর্ট করবেন সাংবাদিক হিসেবে। সাক্ষাৎকার নেবেন কমিউনিটি হাসপাতালে কাজ করেন এমন একজনের, ডা. বক্সের। সাক্ষাৎকার নিলেন। সমৃদ্ধ কথাবার্তায় নানা সব তথ্য। কদিন পরেই মোস্তফা তানিম জানান, ডাক্তার বক্স নিজেই লড়াই করেছেন নিজের জীবন নিয়ে। আমাদের অন্য নিয়মিত লেখক তন্ময় ভট্টাচার্য, বেচারার স্ত্রী দেশ থেকে এসেই করোনার কবলে পড়েছেন। এর মধ্যে তন্ময় তাঁর তথ্য–উপাত্ত নিয়ে লেখা পাঠান।

মিশিগান আমাদের প্রবাসীবহুল অন্য একটি এলাকা, সেখান থেকে আমাদের পুরোনো সহকর্মী পার্থ দেব, নবীন কর্মী ফারজানা চৌধুরী প্রতিদিন রিপোর্ট করেন। একাধিক এসব রিপোর্টে থাকে চলমান বিষণ্নতার নানা সংবাদ।

জুয়েল সাদাত সংবাদ পাঠান ফ্লোরিডা থেকে। দূরের এ রাজ্যের খবর আমরা পাই তাঁর কাছ থেকে।

নিউইয়র্কে একধরনের চৌকস রিপোর্টের জন্য আমাদের তফাজ্জল লিটন বেশ পরিচিত নাম। তফাজ্জল লিটন এই করোনাকালেও ঘুরে বেড়ান। খাওয়াদাওয়া কেমন চলেছে, জানাতে ভোলেন না। লেখেন বিশেষ কিছু রিপোর্ট। লিখেই তাঁর আর তর সয় না। কখন অনলাইনে যাবে, তাঁর পাঠকদের খোরাক দেবেন। স্বপন বিশ্বাস কাজ করেন জরুরি বিভাগে। বিপন্ন এই সময়েও যুক্ত থাকেন আমাদের সঙ্গে। প্রতি সংখ্যায় লেখেন। ইমাম কাজী কাইয়্যুম, আহবাব চৌধুরী, জাহেদ জারিফ নিয়মিত লেখেন আশপাশের ঘটনা নিয়ে। করোনাকালের বাস্তবতা নিয়ে।

হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। জানালেন, করোনাকালের লকডাউনে তিনি নগর ঘুরে ছবি ওঠাবেন। তাই করলেন। আমাদের ছাপা ও অনলাইনে তাঁর ছবি ইতিহাস হয়ে থাকবে। অনির্বাণ শুধু তা–ই করলেন না, আমার জন্য গ্রোসারি নিয়ে নিউজার্সি পর্যন্ত চলে এলেন। ঝুল বারান্দায় রেখে চলে গেলেন ভবিষ্যতের কোনো বিখ্যাত সিনেমা নির্মাতা। বাবুল নকরেক আলোকিত মানুষ। জানালেন, এভাবে বসে থাকলে হবে না। বেরোতে হবে। বেরিয়ে পড়লেন নগরে। কথা বললেন, ছবি নিলেন। সরেজমিনে মাঠ থেকে আসা রিপোর্ট আমরা প্রকাশ করলাম। সৈয়দ উতবা ট্রাফিক ইউনিয়নের নেতা। জানালেন বিপন্ন এ সময়ে সুরক্ষাসামগ্রী দিতে চান সাংবাদিকদের। ওসব নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সিতে এসে একই কায়দায় ঘরের বাইরে রেখে চলে গেলেন। লকডাউনের সময়ে নানা তথ্য–উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেন।

সোহেল মাহমুদ ব্রুকলিনে থাকেন। দাপুটে সাংবাদিক সোহেল মাহমুদ ব্রুকলিনকে নিজের তল্লাট মনে করেন। ছবি দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন নিজের ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও।

এভাবেই আমরা একের পর এক রিপোর্ট করতে থাকি। এ কাজ চলছে। কবে শেষ হবে, আমরা কি শিগগিরই আগের অবস্থায় ফিরতে পারব? কেউ জানি না। আমাদের সহযোগী, সহকর্মীদের হাত দিয়ে করোনাকালের বহু রিপোর্ট গেছে। পাঠকদের হামলে পড়া দেখছি। সবার নাম এখানে আসেনি। ঠিক এক বছর আগে আমাদের সম্পাদক মতিউর রহমান নিউইয়র্কে এসে সবাইকে বলেছিলেন, আশপাশের কথা লিখেন। আশপাশের মানুষের ব্যথা–বেদনা, সাফল্যের কথা, সংকটের কথা লেখেন। সবাই যেন সে কাজটাই করলেন। নিজেদের নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়।

করোনার এই তাণ্ডবের সময়ে নিউইয়র্কে বাংলা সংবাদমাধ্যমের লোকজন যে যাঁর সাধ্য অনুযায়ী সক্রিয় আছেন। পরস্পরকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। সংবেদনশীলতা ও সহমর্মিতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তাঁরা। কেউ কথা বলেছেন ফেসবুকে, কেউ আইপিটিভিতে। রিপোর্ট লেখার কাজও করেছেন অনেকেই। তাঁদের এই কর্মযজ্ঞ শুধু সময়ের কাজই নয়, ইতিহাস হয়ে থাকবে।

আমাদের লেখক, সাংবাদিকেরা অবশ্য কথা কম বলেছেন। লিখেছেন বেশি। তাঁরা মনে করেছেন, যাঁরা যে কাজ ভালো পারেন, তাঁদেরই সে কাজ করা উচিত। এতই কাজ করেছেন, তাঁদের কাছে লেখা, রিপোর্ট দেশ–বিদেশে অনেককেই চেয়ে নিতে হয়েছে। তাঁরা কাউকে না করেননি। পাড়া–মহল্লার পত্রিকা থেকে দেশের পত্রিকা পর্যন্ত তাঁদের বিচরণ ছিল সর্বত্র।

বিপদ তো আর নিউইয়র্কেই থেকে থাকেনি। ঢাকা অফিসে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়। আমাদের প্রায় সব কনটেন্টের চূড়ান্ত হয় ঢাকা থেকে। দেশের নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকা অফিসে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকে চালানোর ঘোষণা আসে। আমি চোখে কদম ফুল দেখি। সম্পাদক ফোন করেন। কাঁপা হাতে ফোন ধরতে গিয়ে পড়ে যায়। খোঁজ নেন প্রত্যেকের। নিরাপদ থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমাদের ঢাকার সার্বক্ষণিক সহকর্মীদের অবস্থা টের পাই। তাঁদের সঙ্গে অস্বভাবসুলভ সমীহ নিয়ে কথা বলি। তাঁরা প্রতিদিন জানতে চান, আমরা কি নিরাপদ আছি? তাঁদের বিষণ্নতা নিয়ে আমার আর জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয় না।

দুই মাসের বেশি হয়। এত কাজ, এত রিপোর্ট আমরা এর আগে কখনো করিনি। এমন করতে হবে, তা ভাবনায়ও ছিল না। এখানে প্রত্যেকের পারিবারিক জীবন, পেশাগত জীবনে বিষণ্নতা চরমে। এখনো অনিশ্চিত অনেক কিছুই। শুধু ভালোবাসা দিয়ে কাজ করা মানুষের উত্তাপ দেখে বারবার মাথা হেঁট হয়েছে। এ উদ্যম বৃথা যেতে পারে না। এমন উদ্যমী মানুষের জয়ের মধ্য দিয়েই সমাজ–সভ্যতা এগিয়ে যায়। এ মানুষগুলোই ইতিহাসের মানুষ হয়ে থাকেন যাঁর যাঁর অবস্থানে।

কৈশোরে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে চাচা মঈন উদ্দিন চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশটা স্বাধীন হলো কেমনে?

কাঁধে রাইফেল নিয়ে নতুন পতাকা স্যালুট করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ভাইকে হারিয়েছেন যুদ্ধে। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। অল্প বয়স হলেও মর্মবেদনাটা বুঝেছিলাম সেদিন।
আজকের করোনাকালের পর পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে যদি কেউ এমন কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আমাদেরও কিছু বলার থাকবে না। নীরবে গড়ানো অশ্রুতে ভাসবে করোনায় হারিয়ে যাওয়া বহু স্বজন, পরিজনের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। আমাদের মর্মবেদনাটা কি বুঝবে ভবিষ্যতের মানুষগুলো?