বাংলা ভাষার বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

পিতৃসমতুল্য একজন অভিভাবকের প্রস্থান হলো। জাতি হারাল একজন শিক্ষাবিদকে, যিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ১৪ মে ৮৩ বছর বয়সে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয় সিএমএইচে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শরীরে করোনার উপস্থিতি ছিল। মানে করোনা ভাইরাসই কেড়ে নিল বাঙালি জাতির এই জাগ্রত মানুষটিকে।

স্যার যে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বাসায় গিয়েই বুঝতে পারি। এরপর দেখা হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি খন্দকার রাশিদুল হকের দেওয়া ঢাকা ক্লাবে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। আবার দেখা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে। কিন্তু সেই দেখাই যে শেষ দেখা হবে, কখনো ভাবিনি।

স্যারের শরীর ক্রমান্বয়েই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। মার্চের শেষ দিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নিয়মিতই খোঁজ রেখেছিলাম। সিএমএইচ-এ যেদিন স্থানান্তর করা হলো, সেদিন তীব্র একটা কষ্ট অনুভব হওয়ায় ভাবিকে (সিদ্দিকা ওহাব) ফোন করলাম। ভাবির সঙ্গে কথা বলে ৯ মে ফেসবুকে তাঁর শরীর খারাপ নিয়ে একটা পোস্টও দিই। এরপর ১৩ মে ভাবির সঙ্গে কথা বলে ফেসবুকে আবার আপডেট দিই। ভাবি বলেছিলেন, তাঁদের মেয়ে স্যারকে দেখে এসেছেন। তিনি কিছুটা ভালোর দিকে। প্রার্থনা করতে বললেন আমাদের। বললাম, 'ভাবি, আমি কেন বাংলাভাষী সব মানুষই স্যারের জন্য প্রার্থনা করছেন। আপনি ভালো থাকবেন।' ২৪ ঘণ্টাও পার হলো না। স্যারকে আমাদের হারাতে হলো।

ব্যক্তিগতভাবে অনেক স্নেহ, অনেক উপদেশ পেয়েছি স্যারের কাছে, বহুভাবে আমি ঋণী হয়ে থাকব। দীর্ঘ পথযাত্রায় মুক্তধারার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর অনেক স্মৃতি। আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রতি ছিল তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। তাই বারবার যোগ দিয়েছেন বইমেলাসহ আমেরিকার বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সম্মেলনগুলোতে। মুক্তধারার প্রতি ছিল তাঁর নিঃশর্ত ভালোবাসা।

যত দূর মনে পড়ে, ১৯৮৫ সালে স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় পুথিঘর-মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহার ৭৪ ফরাশগঞ্জের বাড়িতে পয়লা বৈশাখের ভোজে। স্যার তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভোজের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বরেণ্য লেখকদের প্রায় সবাই যোগ দিতেন। তখন বাংলাদেশের সাহিত্য ও প্রকাশনা বলতে মুক্তধারাকেই বোঝাত। চিত্তরঞ্জন সাহার লেখকদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল, তার টানেই সবাই সেই ঐতিহাসিক আড়াই-তলা বাড়িতে উপস্থিত হতেন। সে সময় মুক্তধারায় সার্বক্ষণিক সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও আমীরুল ইসলাম। জহর লাল সাহা, প্রভাংশুরঞ্জন সাহা, অজিত রঞ্জন সাহা, মিন্টু রঞ্জন সাহা ও স্বপন সাহারা তখন চিত্তরঞ্জন সাহার কর্মযজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন।' ৮৪ সালের শেষদিকে আমি, শ্যামল দত্ত, অশোক নাগ, যুবরাজ দাস, ভবরঞ্জন দাসসহ একঝাঁক তরুণ কর্মী মুক্তধারায় যোগ দিই। মূলত সেই সময় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয়–সম্পৃক্ততার শুরু।

১৯৮৭ সালে মোস্তফা জব্বার সম্পাদিত সাপ্তাহিক আনন্দপত্রের ঈদ সংখ্যার দায়িত্ব পালনকালে লেখা সংগ্রহ করার সুবাদে ড. আনিসুজ্জামান, আবু ইসহাক, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়। তারপর তো এরশাদের পতন হওয়ার কিছুদিন পরই ১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর আমি আমেরিকায় চলে আসি। আসার পর নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাসীতে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আমেরিকায় প্রথম বাংলা বইয়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুক্তধারা নিউইয়র্কের কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয় জাতিসংঘের সামনে শহীদ মিনার স্থাপন করে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রথমবারের মতো ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আমেরিকায় বাংলা বইমেলার গোড়াপত্তন। বাংলাদেশে অনেক দিন যাওয়ার সুযোগ ছিল না।

১৯৯৫ সালে নিউইয়র্ক বইমেলার দ্বিতীয় দিন স্যারকে নিয়ে আসলেন তাঁর ভায়রা ভাই মোবারক হোসেন শাহ নিউজার্সি থেকে। আমাদের সে কি আনন্দ। আমরা জানতামই না স্যার যে নিউজার্সিতে এসেছিলেন বেড়াতে। স্যারকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো একটি আলোচনা অনুষ্ঠান। সে বইমেলায় যে কথাটি বলেছিলেন, আমেরিকায় অভিবাসী বাঙালিরা যে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করছে, তাতো ভাবাই যেত না। যেখানে একটি বাংলা শব্দ শোনার জন্য সপ্তাহের ছয় দিন অপেক্ষা করতে হত, সেখানে বাংলা বইমেলা হচ্ছে, সাহিত্য চর্চা হচ্ছে—এটা একটা বিশাল পাওয়া। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার ফলেই কিন্তু বাংলাভাষী মানুষেরা আজ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে বইমেলা করছেন। আগে এটা ছিল না। এর একটা ভালো দিক হল, দেওয়া আর নেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। যে সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করবে।' স্যার সেবার এক বিকেল ছিলেন নিউইয়র্কে। রাতে ফিরে গেছেন আবার নিউজার্সিতে।
আবার চার বছর পর দেখা হল ১৯৯৯ সালের ৬ জুন টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরে। সেখানকার সংগঠন অবাক–এর উদ্যোগে সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। স্যারের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আরও এসেছিলেন আহমেদ ছফা ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদার। লন্ডন থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরী। মুক্তধারার বইয়ের স্টল নিয়ে আমিও তখন অবাকের আমন্ত্রণে সে অনুষ্ঠানে যোগ দিই। অনুষ্ঠান শেষে আনিসুজ্জামান স্যারসহ সবাই নিউইয়র্ক বেড়াতে আসেন। মুক্তধারার উদ্যোগে আমরা আয়োজন করি লেখক-পাঠক আড্ডা।

১৯৯৯ সালে আমি আমেরিকায় আসার পর প্রথম বাংলাদেশে গেলে সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত হয় উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্তধারা নিউইয়র্ক শীর্ষক সেমিনার। সেই অনুষ্ঠানে কবির চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, মুস্তফা নূরুল ইসলাম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেনসহ আরও অনেক লেখক-সাহিত্যিক আলোচক ছিলেন। ২০০১ সালে মুক্তধারা নিউইয়র্ক প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র উদ্বোধনেও তিনি ছিলেন।

আর ২০০৭ সালের কথাতো কখনো ভোলার নয়। বইমেলা উপলক্ষে পুরো এক মাস তিনি ভাবিসহ আমাদের সঙ্গে আমেরিকায় কাটিয়েছেন। সে বছর 'আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা' আমেরিকার ৪টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্কের লাগোয়ার্ডিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত বইমেলা উদ্বোধন করেন গোলাম মুরশিদ। ডালাস কনভেনশন সেন্টারের বইমেলা উদ্বোধন করেন ড. আনিসুজ্জামান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্যার, বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের কথা বলেন। বলেছেন, এখানকার অভিবাসী সমাজের জীবনযাপন নিয়ে রচিত লেখাই একদিন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে। এখানে জন্ম হওয়া পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাকে মূলধারায় তুলে ধরবে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ফিতা কেটে বইমেলা উদ্বোধনের সময় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন। লস অ্যাঞ্জেলেস বইমেলা উদ্বোধন করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নিউজার্সির বইমেলা উদ্বোধন করেন সমরেশ মজুমদার। সেবার বইমেলায় চারজন উদ্বোধক ছাড়াও আরও যোগ দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, ফেরদৌস ওয়াহিদ, হাবিব ওয়াহিদ, মাহমুদুজ্জামান বাবু, কুদ্দুছ বয়াতি, কৌশিকী চক্রবর্তী, প্রকাশক ফরিদ আহমেদ ও মহিউদ্দীন খান খোকা প্রমুখ। বাংলাদেশ থেকে আরও এসেছিলেন অনেক শিল্পী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা।

আমরা ঠিক করেছিলাম, সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারণা নিয়ে সে বছরই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হবে। একসঙ্গে চারটি শহরের বিশাল বিশাল অডিটোরিয়ামে বইমেলা। প্রথম পরিকল্পনাটা জানাই বুদ্ধদেব বসুর জামাতা জ্যোতির্ময় দত্তকে। তখন আমরা নিউজার্সির এডিসনে বসবাস করি। জ্যোতিদা-মিনাক্ষীদি-গোগোর সঙ্গে আমাদের খুব যোগাযোগ। ২০০৫ সালে ১০ শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই জ্যোতির্ময় দত্তকে আমার খুব মনে ধরে। আমার সব অদ্ভুত ভাবনাগুলোকে বাস্তবায়ন করার যোগ্য একজন পরামর্শক পেয়ে গেলাম ভেবে আমি মহাখুশি! তাঁর কথা বলার ধরন থেকে চিঠিপত্র ড্রাফট করা সবকিছুতেই আমি বিমোহিত। যত কঠিনই হোক সেই পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করার জন্য কোন বাধা-বিপত্তিই আমার কাছে বাধা মনে হয় না। ২০০৪ সালে আমেরিকার প্রখ্যাত একটি সংস্থার কম্পিউটার প্রোগ্রামার তরুণ সাহা ব্যবস্থা করে দিলেন অনলাইনে ১০ শ্রেষ্ঠ বাঙালির ভোট প্রদানের ব্যবস্থা। ভোট প্রদান, ভোট গণনা থেকে ফলাফল ঘোষণা সবকিছুতেই ছিল অনলাইন প্রোগ্রামিং ব্যবস্থায়। সব আয়োজন প্রস্তুত, এখন প্রয়োজন দুই দেশের দুজন করে চারজনের বিচারক মণ্ডলী। প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের দুজনের নাম আসে যারা প্রাজ্ঞ এবং একই সঙ্গে তাঁদের ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ। প্রথমই আসে ড. আনিসুজ্জামান, দ্বিতীয় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নাম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রথমে আসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও দ্বিতীয় পবিত্র সরকারের কথা।

চারজন বিচারকের সঙ্গে পৃথকভাবে দেখা করেই আমরা জরিপের বিষয়টি জানাই। তাঁরা রাজি হওয়ার পর আমরা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে যখন বিষয়টি জানাব, তখনই একটা বিপত্তি ঘটে। পবিত্র সরকারের পিএইচডির থিসিস নিয়ে তখনকার সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম আমাদের সংকটে ফেলে দেয়; আমাদের সংবাদ সম্মেলন পিছিয়ে যায়। দ্রুত অন্য তিন বিচারকের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলে পবিত্র সরকারের পরিবর্তে আমরা সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে অন্তর্ভুক্ত করি। সবকিছু ঠিকঠাক। বিচারকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন হলো দুই দেশে। অনলাইনে ভোটের বাইরে ৫০ লাখ কার্ড ছাপা হলো বাংলাদেশে। ৫০ লাখ ছাপা হলো পশ্চিমবঙ্গে। ঢাকার জিপিও এবং কলকাতার পোস্ট অফিসে সবচেয়ে বড় মেইল বক্স ভাড়া নেওয়া হলো। এ ছাড়া লন্ডন, টরন্টো ও নিউইয়র্কের ঠিকানায়ও মেইলের ব্যবস্থা রাখা হলো। নির্ধারিত সময়ে হাজার হাজার ভোটার ভোট দিয়ে পোস্ট অফিসে পাঠালেন। ৫টি শহর থেকে সব ভোট সংগ্রহ করে তার চূড়ান্ত ফলাফল ঢাকার শেরাটন হোটেলের বলরুমে ঘোষণা করা হবে। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা থেকে এলেন দুই বিচারক।

বাংলাদেশের দুই বিচারকের একজন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সকালে জানালেন, তিনি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকতে চান না। ছুটে গেলাম সবচেয়ে আস্থার জায়গায়, ড. আনিসুজ্জামান স্যারের বাসায়। তাঁকে বিষয়টি বললাম। আমাদের অবস্থার কথা বললাম। তিনি বললেন, তোমরা যেভাবে আমাদের ফলাফল দেখিয়েছ ঠিক সেভাবেই প্রেসকে দেখাবে। আর অনলাইনের ভোট প্রদানের সব কিছু ওপেন করে দেবে। যাতে যে কেউ সেই ভোটের ফলাফল ইচ্ছে করলে দেখতে পারে। আমরা দ্রুত আপ স্টেট নিউইয়র্কে তরুণ সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করে সে ব্যবস্থা করি। বিকেল ৪টায় ফলাফল ঘোষণা। সাংবাদিক তোয়াব খান, মতিউর রহমান, আবেদ খান, ইমদাদুল হক মিলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রথিতযশা সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক সবাই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ফলাফল ঘোষণা হল, চারজনের পরিবর্তে তিনজন বিচারক স্বাক্ষর দিলেন। পরে বাংলাদেশের সব দৈনিক পত্রিকার ৫ কলাম থেকে ৩ কলাম সংবাদ ছিল সেই ফলাফল। সৈয়দ শামসুল হক যিনি ফলাফল ঘোষণার দিন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কাছে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ হারিয়ে যাচ্ছে তখন ১০ শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালির জরিপ এক অনন্য দৃষ্টান্ত হতে চলেছে। ফলাফল ঘোষণার পর দিন যখন তিনি দেখলেন তাঁর নাম নেই, স্বনামে একই পত্রিকায় লিখলেন ঘোড়সওয়ার যেভাবে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারে ঠিক সেভাবে। নানান প্রশ্ন তুলে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন এই প্রক্রিয়াকে।

পরদিন সকালে আমাকে ডাকা হয় এনটিভির সকালের অনুষ্ঠানে। তিনজন সাংবাদিক প্রশ্নপত্র তৈরি করে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমার শুভ সকাল শুরু করেন। সেখানে আমি বলেছিলাম, কেউ জন্ম থেকে শিখে আসে না, কাজ করতে গিয়েই যোগ্যতা অর্জন করে। এখন প্রশ্ন হলো, সেই কাজে কোন অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে কি না? আনিসুজ্জামান স্যার এই অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন। আমি টেলিভিশন থেকে সরাসরি স্যারের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। দেখলাম, তাঁর সামনে দৈনিক জনকণ্ঠসহ ওই দিনের আরও কয়েকটি পত্রিকা। এই প্রক্রিয়া যে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা স্যার জানতেন। জেনেই তিনি রাজি হয়েছিলেন। তিনি প্রথম দিনই আমাকে বলেছিলেন, তোমাদের কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই বিধায় তোমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। সবচেয়ে যে কথাটি তিনি বলেছিলেন, তা আজ আরও বেশি করে মনে পড়ছে, বাঙালির জাগরণে তোমরা বহির্বিশ্ব থেকে কাজ করছ—এটিই তো অনেক বড় কথা। নানান সমালোচনার মধ্যেও স্যার সরে যাননি, তিনি অবিচল ছিলেন আমাদের প্রতি তাঁর সমর্থনের সিদ্ধান্তে।

নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সেন্টারে ঘটা করে ১০ শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালির অনুষ্ঠান হয়ে গেল। স্যার খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কীভাবে স্পনসররা শেষ মুহূর্তে সরে পড়েছেন। বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয় সেবার মুক্তধারা নিউইয়র্ক।

মাঝখানে ২০০৬ সালে এস্টোরিয়ার পিএস ১২ মিলনায়তনে তরুণ লেখক আনিসুল হক বইমেলা উদ্বোধন করেন। সেবার তাঁর 'মা' বইটি বিক্রি হয় শতাধিক কপি। কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন ও ফরিদুর রেজা সাগরও এই বইমেলায় যোগ দেন। এসেছিলেন বাংলাদেশের সময় প্রকাশনার প্রকাশক ফরিদ আহমেদসহ আরও দুজন প্রকাশক। বইমেলায় আগতরা নানা পরামর্শ দিলেন, মুক্তধারা নিউইয়র্ক যেহেতু একটি বই বিক্রেতা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, তাই বইমেলা জাতিসংঘের সামনে একুশ উদ্‌যাপনসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো একটি অলাভজনক সংস্থার মাধ্যমে করলে ভালো হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি বইমেলার সঙ্গে যাঁরা দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করি। তাঁরাও এই ভাবনাকে সমর্থন করেন। বইমেলার পরপরই কবি ও সিপিএ বদিউস সালামের মাধ্যমে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ইন্ক নামে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়।

এরপর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি। চারটি শহরে বইমেলা হবে। সব শহরে দুজন করে আহ্বায়ক থাকবেন। নিউইয়র্কের জন্য নির্বাচন করা হয় ড. জ্যোতির্ময় দত্ত ও হাসান ফেরদৌসকে। ডালাসের জন্য নূরুল আমিন চৌধুরী ও ড. সৌরি ভট্টাচার্য, লস অ্যাঞ্জেলেসের জন্য ড. রফিকুজ্জামান ও ড. সমর সরকার ও নিউজার্সিতে ড. নূরন নবী ও আলোলিকা মুখোপাধ্যায়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রতিটি শহরেই একজন বাংলাদেশের ও অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আহ্বায়ক ছিলেন। ভাবনা ছিল, বইমেলায় যেন দুই বাংলার বাঙালির সম্মিলন ঘটে। আহ্বায়ক যিনিই থাকুন না কেন, ওই সব স্থানে বইমেলা করা সম্ভব হয়েছে, কারণ সেসব স্থানে মুক্তধারার শাখা ছিল। যেমন ডালাসে সুবীর রায়, মিনু রায় ও ইউসুফ রেজা। লস অ্যাঞ্জেলেসে মমিনুল হক বাচ্চু ও শংকু আইচরা ছিলেন প্রধান শক্তি। নিউজার্সিতে সহযোগিতার হাত বাড়ায় নাসরিন সোহরাওয়ার্দী, ফারুক আজম ও নওরীন কাদির।

এসব পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৬ সালের শেষের দিকে আনিসুজ্জামান স্যারকে জানালে তিনি তো অবাক। বললেন, কী বলো! এটা কী করে সম্ভব? কীভাবে করবে। টাকা আসবে কোত্থেকে? নানান সস্নেহ প্রশ্নে আমাকে বললেন, আগামীকাল ঢাকা ক্লাবে এসো। সেখানে আলোচনা হবে। ১৯৯১ সালে দেশ ছাড়ার আগে একবারই আমি ঢাকা ক্লাবে গিয়েছিলাম সাংবাদিকতা পেশার কারণে, জিনাত মোশাররফের স্বামী সচিব মোশাররফ হোসেনের সাক্ষাৎকার নিতে। আমার মনেও নেই যে স্যুট-প্যান্ট ও শু পরে যেতে হয় ঢাকা ক্লাবে। আমি প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি ও চামড়ার স্যান্ডেল পরে ঢাকা ক্লাবে গিয়েছিলাম স্যারের সঙ্গে দেখা করতে। যথারীতি গেটে আমাকে আটকে দেওয়া হলো; স্যার এসে একটা জামা কিনে দিয়ে আমাকে ঢাকা ক্লাবে প্রবেশ করার ব্যবস্থা করলেন। আলোচনা হলো, পুরো পরিকল্পনা স্যারকে জানালাম। বললাম একটি আবাসন কোম্পানি আমাদের সঙ্গে চারটি শহরেই স্টল করবে। সেখান থেকে আমরা বেশ কিছু টাকা পাব। তা ছাড়া শ্রীকান্ত আচার্য ও হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে আমাদের চুক্তির কথা বললাম। স্যার বারবার বলছিলেন, ২০০৫ সালে যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছ, এবার হলে আমেরিকায় যে বইমেলাটা করতে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

আমি স্যারকে নিশ্চিত করলাম। ঢাকায় আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করত আমাদের যে বন্ধু মহিউদ্দিন খান খোকন, তিনিও এসে পৌঁছালেন ঢাকা ক্লাবে। জুন মাসের ২ ও ৩ তারিখ নিউইয়র্ক দিয়ে শুরু হয়ে ৯ ও ১০ জুন ডালাসে, ১৬ ও ১৭ জুন লস অ্যাঞ্জেলেসে এবং ২৩ ও ২৪ জুন নিউজার্সিতে বইমেলা আয়োজনের তারিখ ঠিক হলো। মানে ৪ সপ্তাহ স্যারকে থাকতে হবে আমেরিকায়। এত দিনের জন্য স্যার তো আর একা আসতে পারেন না, সঙ্গে ভাবির আসার কথাও চূড়ান্ত হলো। স্যার নিজে থেকেই বললেন, তোমাদের ভাবির টিকিট খরচ দিতে হবে না। সেটা আমিই বহন করব। মানে স্যার রাজি হলেন। আসা নিশ্চিত। চিন্তা করা যায় ড. আনিসুজ্জামান, ড. গোলাম মুরশিদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেশ মজুমদারকে আমরা পাব নিউইয়র্ক বইমেলায়! গোলাম মুরশিদ নিউইয়র্কের বইমেলা শেষে ফিরে গেছেন লন্ডনে। আর বাকিরা সবাই ৪টি স্টেট ঘুরেছেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানের ম্যধে যে ৪ দিন ফাঁকা থাকত, সেই দিনগুলো ছিল অনেক মধুর। কত জায়গায় আমরা ভ্রমণ করেছি। সেই ভালো লাগার রেশ ধরেই স্যারের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক কাছের ও নির্ভরতার জায়গায় পৌঁছায়।

২০০৭ সালের পর আরও দুবার এসেছিলেন নিউইয়র্কে। মুক্তধারায় তাঁকে নিয়ে অনেক আড্ডা হয়েছে। বিশেষ করে সমরেশ মজুমদার আর আনিসুজ্জামান স্যার যে দুবার একসঙ্গে হয়েছিলেন, সেই আড্ডা তো কখনোই ভোলার নয়। প্রতিবারই তাঁকে নিয়ে আমরা বেড়িয়েছি। বিভিন্ন বইয়ের দোকানে গেছি। কিন্তু দুটো আক্ষেপ রয়েই গেল। এক. স্যারকে দিয়ে কখনো নিউইয়র্ক বইমেলা উদ্বোধন করানো হয়নি। দুই. স্যার যতবারই এসেছিলেন বইমেলায় কখনোই আমাদের বাসায় থাকা হয়নি। তখন আমরা বসবাস করতাম নিউজার্সিতে। প্রতিবারই স্যার উঠেছিলেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের অন্যতম সদস্য ফাহিম রেজা নূর ও জাকিয়া ফাহিমের বাসায়।

২০১৪ সাল পর্যন্ত যতবারই দেশে গিয়েছি, ততবারই স্যার ঢাকা ক্লাবে আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। ২০১৫ সাল থেকে আমি আর যেতাম না ঢাকা ক্লাবে। বাসাতেই দেখা করতাম। স্যারের সবচেয়ে যেই গুণটি সারা জীবন মুগ্ধ হয়ে দেখেছি তা হলো, আমার মতো সাধারণ মানুষদেরও আপন করে নেওয়ার বিশাল ক্ষমতা। কখনো দেখিনি বিরক্ত হতে। এত বড় একজন মানুষ, নিজের বিরক্তি কখনো কাউকে বুঝতে দিতেন না। এত সুন্দর করে গুছিয়ে প্রতিটি কাজ করতেন, তা আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত। জীবনের প্রত্যেকটি কাজ কাঁটায় কাঁটায় সময়ানুবর্তিতা মেনে করতেন। ১০টার সময় বললে ১০ টাতেই সে কাজ তিনি করতেন। এত সুন্দর করে ডায়েরি লিখতেন, দিন, তারিখ, সময়-কিছুই বাদ যেত না। আমার বিশ্বাস স্যারের অপ্রকাশিত ডায়েরি যেই প্রকাশকই প্রকাশ করবেন, তার সম্পাদনার প্রয়োজন হবে না, সব কাজই স্যার করে গেছেন। ভাবির (মিসেস সিদ্দিকা ওহাব) কথা না বললেই নয়। জীবনে আমি দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি যিনি এত বড় একজন খ্যাতিমান মানুষের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার পরও অনেক গুণী এই মানুষটি নিজেকে কখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে চাননি। এটি এই যুগে বিরল।

আমেরিকায় বড় হওয়া শিশু-কিশোরদের জন্য বাংলা শেখার বই চূড়ান্ত করে স্যারকে দেখাই। স্যার একদিন সময় নিয়ে বললেন, এভাবে হবে না। একটা রীতি মেনে এটি লিখতে হবে। নতুবা কোমলমতি শিশুরা বিভ্রান্ত হবে। তিনি পথ দেখালেন এশিয়াটিক সোসাইটির ধ্বনিগত রীতি অনুযায়ী রচনা করতে। এরপর সেই গ্রন্থটি আহমাদ মাযহার হয়ে ভাষাবিজ্ঞানী মাহবুবুল হক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক মামুন-অর-রশীদের হাত ঘুরে বর্তমানে সেমন্তী ওয়াহেদের কাছে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বইটি হয়তো প্রকাশিত হবে, বইটি রচনায় যেমনটি করেছেন তেমনি আমাকে ও মুক্তধারাকে তিনি আরও অনেক আলোর পথ দেখিয়েছেন। আসলে তাঁর মতো মানুষতো জন্মগ্রহণই করেছিলেন অন্ধকারে আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখাবার জন্য। যেখানে অন্ধকার নেমে আসবে, সেখানেই আনিসুজ্জামান স্যার সম্মুখ সারিতে দাঁড়াবেন সব সময়ের মতো। যেমন তিনি তাঁর আত্মজীবনী 'বিপুলা পৃথিবী'র শেষ বাক্যে লিখে গেছেন—'আমাদের পথচলা এক সময় থেমে যায়, জীবন থামে না।' স্যার জেনেশুনেই লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে জীবনের শেষ সময়ের মর্মবাণী।

(বিশ্বজিত সাহা: লেখক, সাংবাদিক)