'পাখিটি ছাড়িল কে'

গুলশানে আমার রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায় কড়াইল বস্তি। লেকের পাড়ে একটি ভবনের ছয় তলায় আমার থাকার রুম। তিন মাস একটানা এই রুমেই বসবাস।

বস্তিতে কত লোক বাস করে?

এক লাখ? দুই লাখ?

কেউ কেউ বলে তারও বেশি।

গুলশান-বারিধারার বাসা-বাড়িতে যারা কাজ করে, তাদের বেশির ভাগই আসে ওখান থেকে।

আমি জানালা দিয়ে দেখি, ছোট ছোট ঘর, ঘিঞ্জি, লেকের পাড়ে ছোট্ট পসরা, মানুষের হাঁটা-চলা।

দুটি কথা ভেবে অবাক হই।

এক. সত্তর দশকে গোটা সিলেট শহরের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ষাট হাজার। আর কড়াইলের এই ছোট্ট বস্তিতে বাস করে লাখের বেশি। তা কি করে পারে?

দুই. টিভি-পত্রিকায় করোনা সংক্রমিত ঢাকার অলিগলির নাম দেখি, কখনো দেখিনি কড়াইল বস্তির নাম। আল্লাহর আশীর্বাদ।

লিখতে বসলেই কুড়িগ্রামের সেই সরকারি কর্মকর্তার কথা মনে পড়ে। বড়কর্তার রোষানলে পড়া সাংবাদিককে উত্তম–মধ্যমের পর সেই কর্তাব্যক্তিটি সদুপদেশ দিলেন, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই চলে না।

মান্যবর, আপনার এই মহান বাণী ভুলিনি। আমার কোনো ইচ্ছা নেই, ডাঙা থেকে জলে পড়ার।

তবে, প্রতিদিন আশা-নিরাশায় খবর নিতে হয় করোনার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আমার ভবিষ্যৎ। সিলেট থেকে কবে হাসি ঢাকা ফিরবে, কবে প্লেনগুলো আটলান্টিক পাড়ি শুরু করবে আর নিউইয়র্কে প্রাণপ্রিয় সন্তানদের বুকে টেনে নেব?

সংক্রমণ কি কমল? ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কৃত হলো? লকডাউন কি উঠল? দিন গুনে গুনে এখন ক্লান্ত।

প্লাবনের সময় মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে, আমিও অবিরত খুঁজছি খড়কুটো।

মনটা আরও বিষণ্ন হয়, যখন দেখি বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন, ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে আমরা অনেক ভালো আছি। দোয়া করি, তাই হোক।

ফোনে হাসির কণ্ঠে ক্লান্তি ও হতাশা। নিউইয়র্কের পরিচিতদের মৃত্যুতে তাঁর শোক জানাতে গিয়ে স্বর ভারী হয়ে উঠে। বারবার বলছিলেন, নাদেরা চৌধুরী, বাবলী নেওয়াজ ও নুসরাত মজুমদারের কথা। করোনা তাঁদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

ছেলে নয়ন বলে, আব্বা, অ্যান্ড্রু কুমো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে ভালো হতো। আমি হ্যাঁ হ্যাঁ বলে সায় দিই, তবে গুরুত্ব দিই তাঁর ঘরে থাকার।

নিউইয়র্কের এত প্রিয়জনকে কি করে ভুলি?

আর হিরোদের?

এই মহাদুর্যোগে যাঁরা জীবন তুচ্ছ করে বিপন্ন বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের সম্মানিত করা উচিত। যদিও তারা বলেননি, কিছু পাওয়ার জন্য করেননি, মানবতার ডাকেই সাড়া দিয়েছেন। তবুও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর কমিউনিটি তাদের কথা মনে রাখবে, এই আশা করতে পারি।

সবার নাম আমার জানা নেই। পত্রপত্রিকায় যাদের নাম বারবার দেখেছি, যেমন ডা. ফেরদৌস খন্দকার, জেড চৌধুরী জুয়েল, ইব্রাহীম চৌধুরীসহ সবাইকে স্যালুট।

মনিজা রহমানকে ধন্যবাদ, প্রথম আলোর (উত্তর আমেরিকা) পাতায় বুড়োদের (জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের) স্মরণ করায়।

ও হ্যাঁ, আমার এক জয়ের কথা বলতে ভুলে গেছি। করোনা জয়ের পরীক্ষায় কখনো অংশ নিতে হবে কিনা তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। তবে শুকরিয়া, ষাট বছরের এক অভ্যাস, ধূমপান, ত্যাগ করেছি দুমাস আগে। এ জয় বড় গৌরবের।

ধূমপানের জন্য আগে দিবা-রাত্রি ছাদে যেতাম। এখন যাওয়া হয় না। অনুজ আতিকুর রহমানের বাড়িটি ডুপ্লেক্স। ছয়/সাত তলা মিলে। সাত তলার সমান্তরাল ছাদ। ছয় তালায় আমি থাকি।

তিন সপ্তাহ আগে হাসপাতাল থেকে টেকনিশিয়ান এসেছিল আমার ব্লাড-ইউরিন নিয়ে যেতে। এ কারণে সাত তলায় যেতে হয়। ওখানে গিয়ে দেখি ফ্লোরে ৮/১০ কেজি ওজনের ডজন ডজন পুঁটলি। ওগুলোতে কি আছে, কেন, কার জন্য, কে—আমার মনে অনেক অনেক প্রশ্ন। সব উত্তর পেলাম নিচে এসে। ভ্রাতৃবধূ মরিয়ম রহমান মনির সেবা কর্ম। নীরবে-নিভৃতে। করোনাকালে নিয়মিত। বস্তার ভেতরে আছে চাল-ডাল-পেঁয়াজ।

রাতে এগুলো নিয়ে তার গাড়ি বের হয় ঢাকার রাস্তায়। সাহায্যের আশায় নিশি রাতে রাস্তার পাশে বসে থাকা মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।

কি আশ্চর্য, একই ঘরে থেকে এ মহৎ কর্মের কথা আমাকে জানতে হলো দুমাস পর। একেই বলে দান।

এক পাখির কথা বলে লেখাটা শেষ করব।

ছাদের এক পাশে রাখা চেয়ারে বসে ধূমপানকালে প্রায়ই চোখে পড়ত, এক বালক পানির ট্যাংকের সিঁড়ির মুখে রাখা পিচবোর্ডের এক ছোট্ট বাক্সের পাশে এসে দাঁড়াতো, হাতে ছোট্ট এক পুঁটলি। তারপর বাক্সের ছিদ্র দিয়ে পুটলির সবটুকু ঢেলে দিয়ে চলে যেত।

একদিন আমার প্রচণ্ড আগ্রহ হলো, জানতে হবে বালকটি প্রতিদিন ওখানে কী রেখে যায়। যথারীতি বালকটি এল এবং তার কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিদিন তুমি ওই বাক্সে কী রেখে যাও। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল, চাচা, আপনাকে দেখাই। বলে বাক্সের একদিক উন্মুক্ত করে দেখাল, জীবন্ত এক পাখি। ছোট্ট। কিচিরমিচির নেই। শান্ত। প্রতিদিন এই পাখিটির খাবার সে দিয়ে যায়।

এর কয়েক দিন পরের ঘটনা। ছাদের এক কোণে বিষণ্ন মনে বালকটি বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। মন খারাপ কেন?

বলল, তার পাখিটি নেই।

নেই? মারা গেছে? কেউ নিয়ে গেছে? নাকি পাখিটি নিজে থেকেই উড়ে পালিয়েছে?

বালকটি বলল, তার কোনটিই হয়নি।

তবে?

তার ধারণা, তার আপু পাখিটি ছেড়ে দিয়েছে। কারণ, এই আপু তাকে বারবার বলছিল, করোনাকালে বনের পশু-পাখি রাখতে নেই, এমনকি ছুঁতেও নেই। পাখিটি যেন সে ছেড়ে দেয়।

 লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।