আমাদের কবি কাজী নজরুল

কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম

কাঠবিড়ালির সঙ্গে একজন খুকির কথোপকথন আর একজন লিচু চোরের নাক খপতা খাওয়ার ভেতর দিয়েই শৈশবে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। এরপরেই পাঠ্যপুস্তকে পরিচয় হয় একজন দুখু মিয়ার সঙ্গে। যে ছেলেটির জন্ম ১৮৯৯ সালে ভারতের একটি গ্রামে, বর্ধমান জেলার চরুলিয়া। গরিব পরিবার। ৮ বছর বয়সে পিতৃহারা। মক্তবে পড়া। লেটোর দল নামে এক ধরনে গ্রামীণ গানের দলে যোগ দান। রুটির দোকানে কাজ। তিনি আমাদের বিদ্রোহী কবি। তিনিই আমাদের জাতীয় কবি। ছোটদের মন দুঃখ পেতে কতটা ভালোবাসে জানি না। তবে দুখু মিয়া পড়াতে গিয়ে স্কুলের পণ্ডিত স্যার বলেছিলেন, ছেলেটা গানের দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় বাঁশি বাজিয়ে বেড়িয়েছে, রুটির দোকানে কাজ করেছে। তারপরও সে তার নিজের চেষ্টা দিয়ে বিখ্যাত কবি হয়েছে। যে কারণে কাউকে গরিব দুঃখি বলে ছোট ভাবতে নেই। হয়তো আজ যে ছোট, কাল সে অনেক বড় কিছু হবে।

আমাদের বাড়িতে তখন একটা ছেলে কাজ করত। ওর আসল নাম ছমির। আমরা ডাকতাম সমীর। বাড়ি খুলনা। যাত্রা দলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এসে আমাদের বাড়িতে কাজ নিয়েছিল। ছেলেটা খুব ভালো বাঁশি বাজাত এবং গানও গাইতো। ভাবলাম সেও একদিন কাজী নজরুল ইসলামের মত বড় কিছু হতে পারে। যদিও সে খুব বেশি দিন আমাদের বাড়িতে ছিল না। চল চল চল করে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার কোথাও চলে গেছে। আর আমাদের শৈশব চল চল করে কৈশোরে এসে পড়ে গেল এক দোলাচলে। নব–নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশ্মশান নাকি গোরস্থান, তা আমরা নির্ধারণ করতে পারি না। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-১৯৭১) এই কবিতাটি স্কুলে পড়ানো হতো, তখন স্কুলপাঠ্য সরকারি বইতে ‘মহাশ্মশান’-এর পরিবর্তে ‘গোরস্থান’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই কবিতাটিকে আমাদের রণসংগীত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এই শব্দটির বিষয়ে আমরা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোরস্থান আর মহাশ্মশান পরিবর্তন হতে থাকে পর্যায়ক্রমে। ছমির যেভাবে সমীর, অথবা সমীর যেভাবে ছমির হয়ে যায়। জাতি হিসেবে আমাদের কোন মৌলিকত্ব থাকে না। সবকিছুকে আমরা নিজেদের মত করে গড়ে নিতে চাই।

কর্মসূত্রে একবার ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল গিয়েছিলাম। সেখানে অন্য এক কাজী নজরুল ইসলামকে খুঁজে পেলাম। সাধারণ মানুষের নজরুল। কিংবদন্তির নজরুল। জীবন্ত নজরুল। সাধারণ মানুষ সেখানে এমন করে গল্প করে, যেন এইতো গতকালও সে এই বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজিয়েছে। এই পালঙ্কে ঘুমিয়েছে। নাটক করেছে। গান গেয়েছে। কোন একজন বিখ্যাত নজরুল গবেষক রাচেল সাহেব নিউইয়র্ক থেকে নজরুল সম্পর্কে তথ্য নিতে ত্রিশাল আসেন এবং এই গাছের তলে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তোলেন। এই প্রচলিত গল্পগুলো ত্রিশালবাসীর লোকসংস্কৃতির অংশ। অথচ নজরুল যখন জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছে, তখন হয়তো তার এমন রাজকীয় পালঙ্কে শোয়ার সৌভাগ্য হয়নি। হওয়ার কথা নয়। যেখানে এখন বটগাছ দেখানো হচ্ছে, সেখানে এখন একটি অশ্বত্থ গাছ। গোড়া ইট দিয়ে পাকা করা। আগের বটগাছটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। মানুষ তার ভালোবাসার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

কিশোর কাজী নজরুল যখন ত্রিশালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। নজরুল তার জীবনযুদ্ধের অনেকগুলো পর্ব শেষে করে ফেলেছেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল মক্তব পাস করে কিছুদিন মক্তবে পড়ানো আর মসজিদে খাদেমের কাজ করেছেন। সেখান থেকে লেটোর দলে যোগ দিয়েছেন। কবির চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন লেটো দলের ওস্তাদ। চাচার কাছে ফারসি ভাষা শিখতেন এবং তার প্রভাবেই তিনি ছোট বেলায় উর্দু-ফারসি মিশ্রিত বাঙলায় পদ্য রচনা শুরু করেন। লেটো দলে নিজের লেখা গান গেয়েছেন। নতুন নতুন পালা রচনা করেছেন। তারপর আবার কিছুদিন স্কুলে পড়ার চেষ্টা। অভাবের তাড়নায় আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করেন। সেখানে আশ্রয়হীন নজরুলের সঙ্গে ত্রিশালের কাজী রফিজউল্লাহ দারোগার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় সূত্রে নজরুলের ত্রিশাল আগমন। সেখানে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে বছর দু-এক পড়াশোনা। ১৯১৫ সালে তিনি রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর সৈনিক জীবন কাটান।

এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন। আশ্রয় নেন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। তখন থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। তবে জীবনের আরেকটি মূল ঘটনা ঘটে ১৯২১ সালে। নজরুল গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা আসেন। আর এখানেই পরিচয় হনয়প্রমীলা দেবীর মা বিরজা সুন্দরী দেবীর সঙ্গে। কুমিল্লা থেকে ফিরে আকবর খানের ভগ্নীর সঙ্গে তার বিয়ের আক্দ হয়। তবে নজরুল ঘরজামাই থাকতে রাজি না হওয়ায় সে বিয়ে ভেঙে যায়। তিনি অসুস্থ অবস্থায় কুমিল্লা এসে বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়।

সারা জীবনের আশ্রয়হীন একজন মানুষ, যিনি ভেসে বেড়িয়েছেন জলে ভাসা পদ্মের মতো, তিনি হৃদয়ের আশ্রয় খুঁজে পেলেন প্রমীলা দেবীর কাছে। এরপর থেকে বাক্শক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারানোর পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য গান কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে নজরুল হয়ে উঠলেন সমগ্র বাঙালি জাতির চেতনার আশ্রয়স্থল। সে সময়ের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সমসাময়িক কালের যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রেম ও প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাই তার গানে, তার কবিতায়। তিনি নিজে আজীবন সংগ্রাম করেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে। তাঁর হৃদয় চিরে বেরিয়ে আস—‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান।’ নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি উচ্চারণ করেন—‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। নারীকে তার বন্দিত্ব ঘোচানোর জন্য লেখেন ‘চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল/মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!’ তিনিই আবার অপার ভালোবাসায় গেয়ে ওঠেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল।’

আমরা আজ গোরস্থান আর মহাশ্মশান নিয়ে দ্বন্দ্বে আছি। অথচ তিনি যে হাত দিয়ে শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, সে হাত দিয়েই লিখেছেন গজল ও ইসলামি গান। তাঁর প্রতিভার সোনার কাঠির স্পর্শে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধারার ভক্তিগীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেছেন: ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহীয়ান।

নজরুল তার শেষ ভাষণে উল্লেখ্য করেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনোটাই না। আমি শুধু হিন্দু–মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। ”

নজরুল আজীবন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর সাহিত্যজীবনের বড় লক্ষ্যই ছিল অন্যায় শাসন-শোষণের অবসান। কেবল ইংরেজ শাসন অবসানে নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও নজরুলের কবিতা ও গান মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এ জন্যই তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা।

মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে বিদ্রোহী কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাক্শক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়।

বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ১৯৭২ সালে তাকে সপরিবারে ঢাকায় আন হয়। তার আশ্রয় হয় ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি ভবনে। যার নাম দেওয়া হয় ‘কবি ভবন’। ১৯৭৫ সালের ২৩ জুলাই কবিকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (এখন যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মারা যান।

নজরুল সাহিত্য আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থাৎ সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। এই করোনাক্রান্ত সময়েও জাতীয় কবি নজরুলের ‘বিশ্বাস ও আশা’ কবিতা হতে পারে আমাদের আশ্রয়—

থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,

যুদ্ধ না করে তাহাদের সঙ্গে নিরাশায় মরিও না

ভিতরে শত্রু ভয়ের ভ্রান্তি মিথ্যা ও অহেতুক

নিরাশায় হয় পরাজয় যার তাহার নিত্য দুঃখ।