আপন ঐতিহ্য খননকারী দেবেশ রায়

ভোরের দুঃসাহসে ভর করে দুর্দিনের স্নানের মতো, রোদ্দুর বুকে পৌরাণিক হাঁসের জয়গানে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন যিনি; নিখুঁত রাগে অরণ্যের ছায়া মাড়ানো কোণ-সেচা প্লাবন দেখে, গাঙচিলের উদাসী খাতিরে নিঃস্ব হতে আহ্লাদিত প্রেমিক হয়ে ওঠেন যিনি; কেবল তিনিই পারেন চৈত্রের তরুণ অথচ উড়ন্ত আকাশ ফালি করে ভালোবাসার দুরন্ত কঙ্কালে, বকুলের মতো ঢেউ ভাঙতে। ব্যাকুল চোখের রঙিন শরীরে অচেনা চাতকের রুগ্‌ণ প্রার্থনায়, কেবল তিনিই খুঁজে নিতে পারেন-নীলিমা তাড়ানো শিবের দ্বিধান্বিত অথচ স্ফূরিত মৌনতা। গ্রামীণজীবন ও সমাজের নিচুতলার মানুষদের নিয়ে ছক ভাঙা কথাসাহিত্যের মুনশিয়ানায় ত্রিশোত্তর সাহিত্য রচনার যে ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল, তা যথোপযুক্তভাবে ধারণ করে পথ হেঁটেছেন দেবেশ রায়। দূরপাল্লার নৌবহরেই তাঁর সমগ্র কথাসাহিত্য ভাষার রহস্যের অপার নীলিমায় দৃশ্যমান হয়েছে; ফিরে পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্ময়। দেবেশ রায় সমাজ, বিশ্ব, আর ব্যক্তিমানুষকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে গভীরতম স্পর্শে তরঙ্গায়িত করেছেন। তাঁর লেখনীতে ইতিহাস আর পুরাণের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিমানুষের উত্থান উঠে এসেছে প্রিয় বিষয় হয়ে। আর তপ্ত বালুতটে ভাঙনের মন্ত্র হয়ে আধুনিকতার নামে ধোঁকাতন্ত্রের বাঁধন খুলেছেন তিনি শক্ত হাতে।

১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দেবেশ রায়। দেশভাগের আগে ১৯৪৩ সালে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে যান। জলপাইগুড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হন আনন্দচন্দ্র কলেজে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। ১৯৫৯ সালে আনন্দচন্দ্র কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আর রাজনীতির সূত্রেই চষে ফেলেন সম্পূর্ণ উত্তরবঙ্গ। রাজবংশী ভাষায় করেন অনায়াস বিচরণ। কলকাতা শহরে ট্রেড ইউনিয়ন করায় শ্রমিক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয় তাঁর। নিজেকে খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে বলেন, ‘আমি জলপাইগুড়ির ছেলে। বলতে পারো উত্তরবঙ্গেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য, পার্টির নেতা...মন খারাপ করার সময় আমার ছিল না।’
প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মিশতেন বলেই হয়তো দেবেশ রায়ের দাঙ্গা, খরা, শিল্পায়নের প্রতিবেদনের মতো ক্ষুরধার লেখা পাঠকের মনকে ছুঁয়ে গিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে তাঁর জনবৃত্তে পদার্পণ, সে কথা বারংবার মনে করিয়ে দেন তিনি। তাঁর ‘যযাতি’, ‘মানুষ খুন করে কেন’, ‘আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে থেকে মফস্বলি বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ কিংবা ‘সাম্প্রতিক সাংবিধানিক এজলাস’ (২০১৯) বোধকরি সেই অভিযাত্রারই প্রতি চিত্রায়ণ।
প্রবহমান নৈর্ব্যক্তিক জলধারার মতো ঘটনাবলির চিত্রায়ণ হয় দেবেশ রায়ের লেখনীতে। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় তিনি প্রতীক এবং সংকেতকে রূপকের হাতছানিতে আলিঙ্গন করেছেন বারংবার। বঙ্কিমচন্দ্রের ইউরোপীয় নভেল ঘরানার প্রতিস্পর্ধী এক ‘নিজস্ব’ ‘দেশীয়’ ঐতিহ্যের আখ্যান সন্ধানী দেবেশ তাঁর কথাসাহিত্যে ‘বৃত্তান্ত’, ‘পুরাণ’, ‘প্রতিবেদন’ নামকরণে তাই ফিরে ফিরে পাতা উল্টিয়েছেন পালাকীর্তন, মঙ্গলকাব্য কিংবা গ্রামীণ বচনের। আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে, নবীন-নবীন আধুনিকতার সঙ্গে-সঙ্গে, বাংলা গল্প-উপন্যাস বাঙালির লোকজীবন থেকে সরে গেছে। তার ভাষা থেকে ঝরে গেছে লোকবাচনের রহস্যময়তা অথচ স্পষ্টতা, লোক কৌতুকের প্রবল পৌরুষ, পৌরাণিককে ভেঙে ফেলার অদম্য লোকায়ত সাহস আর কাহিনিকারের নিজস্ব বিবরণের স্পষ্টতা’ (উপন্যাস নিয়ে, পৃ ২৮)। লেখনীর প্রসঙ্গে ১৯৮৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রথম পরিচ্ছেদে লেখক হিসেবে লিখেছি, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পাঠক হিসেবে রিঅ্যাক্ট react করেছি, বাইরে থেকে দেখলে প্রথম পরিচ্ছেদ উপন্যাস, দ্বিতীয়তে আত্ম সংলাপ। এই ভাবে। কিন্তু উপন্যাস তো ওইভাবে তৈরি হয় না। ফরমটাকে আমি বাইরের জিনিস মনে করি না। একটা ফরম যখন তৈরি হয় তখন লেখক বিষয়টাকে কীভাবে ধারণ করছেন, তাই ফরম হয়ে যায়।... আমি লিখবার সময় পাঠককে এটুকুই সাবধান করতে চেয়েছি যে তাঁরা যেন একে আমার অভিজ্ঞতা মনে না করেন। পাঠক ও লেখকের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা করে তুলতে চেয়েছি।’ আপাতদৃষ্টিতে তিনি শান্তি কল্যাণী ময়ূরের প্রবাহমানতায়, কাহিনির বীভৎস আনন্দের ছন্দে মৃত্যু উপত্যকাকে রূপকেই আঁকড়ে ধরেছেন। আর তাতে তাঁর লেখনীর প্রতিটি শব্দের বিস্ফোরণ ধ্বনিত হয়েছে স্ব-উৎসাহে। ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর শাণিত লেখনীর মহাঅবয়ব, চরিত্র কিংবা ঘটনা।
শৈশবে উত্তাল যমুনার পাড়ে হয়তো স্বপ্নিল শীতলতায় নিজেকে দেবেশে অনুভব করেছেন দুঃখিত লাবণ্যে। তাই তো জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার ঘাপটি মারা পঙ্কিল আবর্তে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত–এর হাত ধরে মৌসুমি দাপটের কান মলে টগবগে স্পর্ধায় মুচকি হেসেছেন, ঐতিহ্য খনন করেছেন নগরবৃত্তে। রূপায়িত ইতিহাস আর মানুষের অচরিতার্থ স্বপ্নের চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক মনুষ্য প্রতিমা তাঁর এ উপন্যাসের চরিত্র বাঘারু। তাঁর প্রথম প্রকাশিত সৃষ্টি ‘যযাতি’। ৮৪ বছরের পথচলায় দেবেশ রায় ২০২০ সালের ১৪ মে না–ফেরার দেশে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ধ্বংস ও ধসের সামনে লেখনীকে দেখেছেন সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ হিসেবে। কারণ, প্রতিটি লেখনীই আমাদের মৌলিক চিন্তার শাণিত অস্ত্র। তাই অসম সাহসিকতার ঘাসের দানার মাঝেও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিরন্ন মিছিলের রূপসী মুখ। তাঁর লেখনীতে বিচিত্র চিহ্নের আলোকিত সুর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে মানব মনে। পাঠককে তিনি দিয়েছেন প্রেম-বিদ্রোহ, সমাজ-সংসার, অতীত-বর্তমান, ইতিহাস-সংবাদ, সরকারি তৎপরতা-নিষ্ক্রিয়তা, চায়ের দোকানের আড্ডা-আলোচনা, রান্নাঘর-অরণ্যবাস্তবতা, হাস্যকৌতুক-বিবরণী কিংবা দ্বন্দ্ব-ছন্দময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হাজারো উচ্চারণে মহালয়ার ন্যায় কোনো বাঁধানো ভবিষ্যতের আভাস। বিকল্প সন্ধানী লেখকসত্তাই তাঁর গদ্যরীতিকে তরল, সহজপাঠ্য অঙ্গসংস্থানে সচেতনভাবে পল্লবিত করেছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারী সংগঠক।