বিশ্বযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের ভূমিকা

প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশের বাস ছিল দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলোতে। অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গকে তখন অল্প মজুরিতে কাজ করতে হতো। জিম ক্রো আইন চালু করে শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা তাদের অনেক সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল।

শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকার জনজীবন ও সংস্কৃতিকে পুরোপুরি পাল্টে দিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে আমেরিকা যুদ্ধে জড়াতে চায়নি।

শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ কোন পক্ষই তখন যুদ্ধের প্রতি আগ্রহী ছিল না। ইউরোপের ঝামেলা ইউরোপেই থাকুক, এমন মনোভাব তাদের ছিল। কিন্তু ১৯১৭ সালের ২ এপ্রিল তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন কংগ্রেসের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানান। উইলসনের তত্ত্ব ছিল, এই বিশ্বকে অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে হবে। আফ্রিকান আমেরিকানরা উইলসনের এই মতবাদকে সাদরে গ্রহণ করে। তারা মনে করেছিল, এটাই হবে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য মোক্ষম সময়। ব্রানডেইজ ইউনিভার্সিটির আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চ্যাড উইলিয়াম মনে করেন, কালোদের স্বাধীনতা ও আধুনিক আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধই ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

যুদ্ধের শুরুতেই আমেরিকার অর্থনীতিতে বিরাট মন্দাভাব দেখা দিল। যুদ্ধের কারণে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় শ্রমিক আসা বন্ধ হয়ে গেল। ১৯১৫ সালের দিকে আমেরিকার জর্জিয়ায় বলউইডল নামক এক প্রকার পোকার আক্রমণে তূলার উৎপাদন মারাত্মক হারে কমে যায়। ফলে হাজারো আফ্রিকান আমেরিকান দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ছেড়ে উত্তরের রাজ্যগুলোতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আমেরিকার ইতিহাসে এটা ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে প্রায় সাত মিলিয়ন আফ্রিকান আমেরিকান দেশটির উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। ১৯২০ সালের শেষের দিকে নিউইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, ডেট্রয়েট ইত্যাদি শহরে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। কিন্তু এখানেও কপাল খোলেনি কালোদের। দক্ষিণে তারা যেভাবে বৈষম্যের শিকার ছিল, নতুন জায়গায় এসেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল তাদের। কর্মক্ষেত্র, বাসস্থান সবখানেই শ্বেতাঙ্গরা কালোদের পৃথকভাবে বিচার করতে শুরু করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেল। ১৯১৭ সালের ইষ্ট সেন্ট লুইস দাঙ্গা এ রকম একটি সাদা–কালো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ–কৃষ্ণাঙ্গ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার কথা থাকলেও বিপত্তি বাঁধে শুরু থেকে। শ্বেতাঙ্গদের রক্তে যেন কালোদের জন্য ঘৃণা ছাড়া কিছুই ছিল না। প্রথম থেকেই যুদ্ধের জন্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কালোদের অধিক হারে বাধ্যতামূলকভাবে নির্বাচন করা হতো। নির্বাচকদের সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ।

১৯১৭ সালের এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫২ জন কৃষ্ণাঙ্গ ও শতকরা ৩২ জন শ্বেতাঙ্গকে যুদ্ধের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। এবং শ্বেতাঙ্গ সেনাবাহিনী ইউনিট থেকে কৃষ্ণাঙ্গ সেনাদের ইউনিট আলাদা করে রাখা হতো। কালোদের রণক্ষেত্রে না পাঠিয়ে ক্যাম্পের ছোট খাটো কাজে নিয়োগ দেওয়া হতো। যেমন কুলি, ড্রাইভার, খালাসি শ্রমিক ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিনদের যুদ্ধ অর্জনে কৃষ্ণাঙ্গরা এসব কাজের বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আফ্রিকান আমেরিকান অফিসারদের শুধু কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য দল পরিচালনা করতে দিলেও শ্বেতাঙ্গ অফিসাররা সাদা–কালো উভয় দলই পরিচালনা করতেন। তখন কোন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মকর্তা শ্বেতাঙ্গ রেজিমেন্ট বা ট্রুপ পরিচালনা করেছেন বলে কোন নজির নেই। এমনকি শ্বেতাঙ্গ নিম্ন মর্যাদার সৈনিকেরা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারকে যথাযথ সম্মান বা স্যালুট পর্যন্ত জানাতে অসম্মতি প্রকাশ করতেন।

কালো অফিসারদের শ্বেতাঙ্গ সৈনিকের কাছ থেকে স্যালুটের আশা না করার পরামর্শ দেওয়া হতো। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ অফিসারদের শ্বেতাঙ্গদের ক্লাব কিংবা কোয়ার্টারগুলোতে প্রবেশাধিকার পর্যন্ত ছিল না। শুধু তা-ই নয়, রাতের বেলা ব্যারাকে শোয়ার জায়গাটুকু পেতেন না অনেক কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিক। এভাবে শ্বেতাঙ্গ শোষণের শিকার হয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধারা।

নিউইয়র্কের হারলেমের ২০০ জন বাসিন্দার মধ্যে আফ্রিকান আমেরিকান সৈনিকদের নিয়ে হারলেম হেলফাইটার্স নামে একটি রেজিমেন্ট গঠিত হলেও বেশির ভাগ কমান্ডিং অফিসার ছিল শ্বেতাঙ্গ। নিউইয়র্কের ক্যাম্প হুইটম্যানে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্রান্সে পাঠানো হয় মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে। ফ্রান্সে আবার প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯১৭ সালের ১৮ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত এই রেজিমেন্টটি ফ্রান্সের ১৬১ ডিভিশনের সঙ্গে মিলিত হয়ে জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
পরে ১৭০ জন কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাকে ফ্রান্সের ওয়ার ক্রস পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি মিলিতভাবে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিকেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে হ্যারি এস ট্রুম্যান সামরিক বাহিনীগুলোতে জাতিগত বৈষম্য তুলে দিয়ে একীভূত করার একটি নির্বাহী আদেশে সাক্ষর করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আফ্রিকান আমেরিকানরা তাদের পূর্ণ মর্যাদা পেতে শুরু করে।