[বাংলাদেশের সঙ্গে ইয়ান মার্টিনের সম্পর্ক বেশ পুরোনো। ১৯৭০ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন। আর ১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হচ্ছে, তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের হয়ে কাজ করছেন ঢাকায়। ২৫ মার্চের কালরাত্রে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের গুলশান অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখেছেন পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ, কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ঢাকার নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন সেই বিভীষিকা। কিছুদিনের মধ্যেই চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়। এরপর গণহত্যার তদন্ত করতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই আবার ফিরতে চেয়েছিলেন এ দেশে, কিন্তু অনুমতি পাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরের মাসেই, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, আবার ঢাকায় আসেন তিনি।
পেশাগত জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। একসময় ছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব। জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১১ সালের ২২ মার্চ তিনি ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও কথাবার্তা বলেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্তি ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে তাঁর ভাষণের অনুলিখন ছাপা হলো এখানে।]
এখানে আসার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বিশেষত, কৃতজ্ঞ এ কারণে যে, এখানকার সবচেয়ে মহতীপূর্ণ ঘটনাবলির সাক্ষী হওয়ার ঠিক ৪০ বছর পর এ উপলক্ষ আমাকে আবার ঢাকায় নিয়ে এসেছে। একাত্তরের ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনের সামনে সমবেত মানুষের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন আমি তাঁর বাসার আঙিনায়। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান দিবসের নাম পাল্টে রেখেছিলেন প্রতিরোধ দিবস। সেই ২৫ মার্চে আমি সর্বশেষ যে মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। সেই সাক্ষাত্ ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টারে। সেই সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে আমাদের থাকার জায়গা সেদিনের ছোট্ট শহর গুলশানে ফিরে আসতে আমার ও আমার সহকর্মীদের শেষ চেষ্টা বাধার মুখে পড়েছিল স্থানীয় মানুষের সড়ক অবরোধ করার কারণে। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়েছেন, আলোচনা ভেস্তে গেছে—এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় এই অবরোধ। গাড়ি চালিয়ে গুলশানের দিকে যাওয়ার সময় আমরা দেখলাম, সেনানিবাস থেকে পাকিস্তাান সেনাবাহিনীর ট্যাংক বেরিয়ে আসছে। সেই রাতে আমরা গেস্ট হাউসের ছাদে উঠে অসহায় আতঙ্কে শুনছিলাম স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি আর বিস্ফোরণের আওয়াজ। আক্রমণের সাক্ষ্য বহন করছিল আকাশ। আমরা বুঝতে পারছিলাম, এই আক্রমণের লক্ষ্যস্থল বিশ্ববিদ্যালয় আর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ লাইনস। আমাদের কাছাকাছি এলাকায় এক নির্বাচিত আওয়ামী লীগারকে গ্রেপ্তার করতে পাঠানো সেনারা যখন তাঁর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে পেল না, তখন বাসার এক কর্মচারীকে বিনা কারণে হত্যা করল। কাছেই এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুদ্ধিজীবীকে। সান্ধ্য আইন তুলে নেওয়ার পরপরই আমরা আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতে বের হই। সেটাই আমাদের শেষ ঘুরতে বের হওয়া। সেদিন ছিল ২৫ মার্চ। আগে বহুবার রেসকোর্সের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়েছি মাঝখানের কালীমন্দিরের দিকে। এবার দেখলাম, সেটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা জানলাম, কী ধরনের হামলা চালানো হয়েছে: হামলার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের কেন্দ্র ইকবাল হল শুধু নয়, বরং সুচিন্তিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে হিন্দু শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের ওপরও। শহরের অন্যান্য জায়গায়ও একইভাবে হিন্দুদের ওপর হামলা চলেছে। দীর্ঘ নয় মাস পর ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আমি জানতে পারলাম, ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ঢাকার কাছে চলে আসার সময় যেসব বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়, তাঁদের মধ্যে মুনীর চৌধুরীও ছিলেন।