কর্মী থেকে নেতা: উত্তরণের অসমাপ্ত কাহিনি

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২।

একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতির ভূমিকা পালন এবং অবশেষে জাতির পিতার মর্যাদা লাভ বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। এই ঐতিহাসিক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনাটি সাম্প্রতিক কালেই ঘটেছে। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ উত্তরণ সম্পর্কে দেশের বিদ্বত্সমাজের মনের, ঘটনার চমত্কারত্বের কারণে বিস্ময়ের ঘোর থাকলেও এতকালের নানা প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাব মিলবে এবং এতে তাঁর প্রতি তাদের আগ্রহ ও আস্থাও অনেকখানি বেড়ে যাবে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, পাকিস্তানি সরকারের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের বিপরীতে শেখ মুজিবের সাহসী সংগ্রামী ভূমিকা সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। কীভাবে একজন সাধারণ কর্মী দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিণত হন, আর সংগঠক থেকে নেতা হয়ে ওঠেন, তারপর কীভাবে এক জনপ্রিয় নেতা দলের গণ্ডি ছাপিয়ে জনগণের একচ্ছত্র নেতায় রূপান্তরিত হন, সেটা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা আজও এ দেশে রাজনৈতিক কলাম রচনা আর রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশের এ রকম শিক্ষিত শ্রেণীর সাধারণ ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধু লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন না, বাগ্মিতা, দেশপ্রেম আর সাহসের জোরে তিনি এত দূর উঠে এসেছেন। অনেকের মনে এমনকি আত্মজীবনীটি তাঁর লেখা কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ ছিল।

কিন্তু আত্মজীবনীটির গুণ বা বৈশিষ্ট্য হলো, লেখক এতে কোনো বিশেষত্ব আরোপের চেষ্টা করেননি। সোজাসাপটা নিজের অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ হলো শেখ মুজিবের কথা, তাঁরই জবানিতে। সাহিত্যের কোনো কৃত্রিম আবরণ সম্পর্কে তাঁর ধারণা বা আগ্রহ ছিল না; তিনি সত্যের নিরাভরণ সরল এক ভাষ্য রচনা করে গেছেন। অকপট সরল সত্যের আকর্ষণ প্রায় সর্বব্যাপী, পাঠকমাত্রকেই তা জয় করে নেয়। ফলে, এরও একটা সাহিত্য-মূল্য তৈরি হয়, ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি।

এই বইটি প্রকাশিত হওয়ায় দেশের বিদ্বত্সমাজ বঙ্গবন্ধু-চরিত্রের নতুন একটি দিক সম্পর্কে জানতে পারল, যা তাঁর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে। এটি বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও সফল ব্যক্তিটির স্বরোচিত জীবনকাহিনি বলেই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সেই সঙ্গে তাঁর জীবনকালের প্রথম পর্ব, যা এ উপমহাদেশ ও বাংলা-বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে অকপট সত্য বর্ণনা ও অত্যন্ত বিচক্ষণ বিশ্লেষণ হাজির করে ইতিহাসচর্চার অমূল্য এক ভান্ডার তিনি গড়ে তুলেছেন।

১৯২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। তাঁদের পরিবারের এবং তাঁর শৈশবের কথা বেশ বিস্তারিতই তিনি লিখেছেন। তাতে শেখ বংশের বনেদি সংযোগ জানা যায়, শরিকদের ওঠা-পড়া, শরিকিবিবাদও বাদ থাকে না। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শৈশবের ডানপিটে ছেলে ও ডানপিটেদের সরদার শেখ মুজিবকে আমরা চিনতে পারি। শৈশব থেকেই দেখি, তাঁর ছিল নিজের একান্ত গণ্ডি ছাপিয়ে দলবল নিয়ে অন্যদের বা সবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা, যা প্রমাণ করে, তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণের উন্মেষ হয়েছে তখনই। এমনকি স্কুলজীবনেই চলমান রাজনৈতিক ঘটনা অনুধাবন করে নিজে তাতে ভূমিকা গ্রহণ ও পালন করার মধ্যে ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে ওঠার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাঁর সাহস ও ত্যাগী মনোভাব, দেশ ও মানবপ্রেমের স্ফুরণও জীবনপ্রভাতেই শুরু হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত, ১৯৫৫ সালে এসে একটু আকস্মিকভাবেই শেষ হয়। এতে স্বভাবতই পাঠকের মনে অতৃপ্তি তো জাগেই, সেই সঙ্গে আফসোসও হয় এবং আফসোস বহু গুণ বেড়ে যায়, যখন দেখি পরবর্তীকালের কথা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের আরও গুরুত্ব ও তাত্পর্যপূর্ণ অধ্যায়, কিছুটা তিনি নিজেই এবং কিছু তাঁর ডিক্টেশনে অন্যে লিখলেও সেগুলোর হদিস এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর পরবর্তী অংশগুলো পড়ার তাগিদ পাঠকমহলে অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠবে। এ কারণে সেগুলো উদ্ধার ও প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার পরিবার, দল ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া এ বইয়ের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান আরও কয়েকটি খাতার কথা, যেগুলোয় তাঁর আরও স্মৃতিকথা, ডায়েরি, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি লিপিবদ্ধ রয়েছে। জাতীয় প্রয়োজনে ও পাঠকের আগ্রহে এগুলোও দ্রুত প্রকাশিত হওয়া দরকার।

দুই.

আত্মজীবনী পড়তে পড়তে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু একজন সহজ-সরল বাঙালি, যাঁর শিকড় বাংলার গ্রামেই প্রোথিত। সরলতার স্বাভাবিক অনুষঙ্গ সততা ও আন্তরিকতা শৈশব থেকেই তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। এই গুণাবলির রসায়নে তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছে জনদরদি মন, আর এর প্রেরণায় সমাজসেবার সূত্রে তাঁর মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে, তা পুষ্ট হয়েছে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমে। ফলে, অল্প বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন অঙ্গীকারবদ্ধ এক রাজনৈতিক কর্মী।

কিন্তু একেবারে গোড়ার দিকে তা ছিলেন না। বরং বেপরোয়া স্বভাবের রগচটা রাগী ছোকরা ছিলেন। নিজের সম্পর্কে অকপটে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দরকার হলে সমানে হাতও চালাতে পারতাম, আর এটা আমার ছোট্টকাল থেকে বদঅভ্যাসও ছিল’ (পৃ. ৯৬)। নিজেকে একগুঁয়ে প্রকৃতির তরুণ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। তরুণ বয়সে অন্যায়ভাবে বন্দী হওয়া এক আত্মীয়কে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়েও এনেছিলেন। তলিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়তে গিয়েই এই সংগ্রামী তরুণ অল্প বয়সে আত্মসংবরণ করতে পারতেন না। মানুষের, বিশেষ করে বাঙালি চরিত্রের কিছু বদভ্যাস তাঁকে খুবই কষ্ট দিত, প্রতিবাদ না করে তিনি পারতেন না। নানা সময়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষের মধ্যে নীচতা, ভণ্ডামি ও স্বার্থপরতার নিদর্শন দেখে দেখে তিনি তিক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতেন, যা তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। ... এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে, তবুও এরা গরিব, কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ (পৃ. ৪৭-৪৮)

সরল মানুষের মনে সহজাতভাবেই ন্যায়বোধ থাকে। এ কারণে চোখের সামনে যেকোনো অন্যায় সহ্য করা কঠিন হয়, কোনো বিহিত করতে না পারলে নিজেকেই দোষী মনে হয়। ন্যায়বোধ এমন একটি চেতনা, যা মানুষকে প্রতিকারকামী সোচ্চার সক্রিয় কর্মীতে রূপান্তরিত করে। শেখ মুজিব এভাবে পারিবারিক ও অ্যাকাডেমিক গণ্ডি ছাপিয়ে স্কুলজীবনেই দেশের ও দশের কাজে জড়িয়ে পড়ে একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন।

তাঁর তরুণ বয়স কেটেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাবহুলকালে, যখন মঞ্চস্থ হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের শেষ অধ্যায়। একদিকে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ আরেক দিকে দেশের প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও হিংসার সংঘাত—দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের দোলাচল, স্বার্থপরতা, অদূরদর্শিতা মিলে এ ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা সমস্যাসংকুল দুঃসময়। এই কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়েই শেখ মুজিব একজন খাঁটি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে উঠেছেন।

স্কুলজীবন থেকেই তিনি মাঠপর্যায়ের কর্মী। ফলে যেকোনো পরিস্থিতির ভেতর থেকে চলমান ঘটনার একজন সক্রিয় অংশীদার হিসেবে তিনি আমাদের এই ভাঙাগড়ার ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আমরা লক্ষ করি, তিনি কর্মী হলেও ঘাড় গুঁজে নেতাদের আদেশ তামিল করার পাত্র নন, প্রতিটি বিষয়ে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতামত তো থাকতই, সেই সঙ্গে চলমান ঘটনাবলি নিয়ে মূল্যবোধাশ্রয়ী ন্যায়-অন্যায়বোধও ছিল প্রখর। ফলে, শেখ মুজিব অল্প বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন অনুগত কর্মীবাহিনীর নেতা। আর সে কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি যেমন নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তেমনি তাঁদের কাছে গণ্য হওয়ার মতো একজন রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে ওঠেন। অধিকাংশই তাঁর ওপর নির্ভর করেছে, আবার অনেক সময় তাঁর প্রতি বিরূপ হলেও তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেনি কেউ।

স্কুলে থাকতেই গোপালগঞ্জে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সংবর্ধনা সভার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক গুরু শহীদ সাহেবের নজরে পড়েন। তাঁর স্কুলের সংবর্ধনার পর যখন শহীদ সাহেব, ‘হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের দিকে চললেন, আমিও সাথে সাথে চললাম। তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম।’ (পৃ. ১১) একপর্যায়ে মন্ত্রী শহীদ সাহেব, ‘নোটবুক বের করে আমার নাম ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটি চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম।’ (পৃ. ১১) সেই থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবের নেতা-কর্মীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা হয়। লক্ষ করার বিষয়, প্রবীণ নেতা ও মন্ত্রী আঠারো বছরের এক কিশোর-কর্মীকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে যেমন সোহরাওয়ার্দীর উদার গণতান্ত্রিক মানসের পরিচয় মেলে, তেমনি বোঝা যায়, গ্রাম্য কিশোর শেখ মুজিবের মধ্যে চোখে পড়ার মতো অনন্যতাও কিছু ছিল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাড়াও সে সময়কার গুরুত্বপূর্ণ সব মুসলিম নেতার সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। শেরেবাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখের সঙ্গে তাঁর কখনো সহজ আর কখনো দ্বন্দ্ব-কঠিন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সে প্রসঙ্গে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।

তিন.

শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু এক বনেদি মুসলিম পরিবারে। তাঁদের এলাকাটি ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত। তাঁর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয় নিজের সম্প্রদায়ের পিছিয়ে থাকার বেদনা ও গ্লানি নিয়ে। তিনি খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামেন স্বজাতির কল্যাণের ব্রত নিয়ে। ব্রিটিশ শাসন আমলের ‘ভাগ করে শাসন করো’ নীতির আড়ালে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ফলে, ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির জাতি-চেতনা ও জাতি গঠনের যিনি কান্ডারি, সেকালে তাঁরও জাতি-চেতনায় ধর্মীয় বোধই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাঁর সে সময়ের মনের কথা এ রকম, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ ‘আজাদ’ যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয়।’ (পৃ. ১৫)

কিন্তু এই তরুণ ছাত্রনেতার চোখ-কান খোলা, বিচার-বিশ্লেষণের মন আছে, পক্ষ-বিপক্ষ বুঝতে সক্ষম এবং নিজের ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনের সাহস ও সামর্থ্য দুটোই আছে। সে আমলে মুসিলম লীগে দুটি উপদল সক্রিয় ছিল, ‘এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুইটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটি প্রগতিবাদী দল, আর একটি প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদসাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই।’ (পৃ. ১৭) শেখ মুজিব ওই বয়সেই পীড়িত বোধ করেছেন দেখে মুসলিম লীগ তখনো জনগণের নয়, ‘জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল।’ (পৃ. ১৭)

দেখা যাচ্ছে, গোড়া থেকেই তিনি রাজনীতি করেছেন জনকল্যাণের জন্য, যদিও তখনো জনগণ বলতে প্রধানত পূর্ব বাংলার সংখ্যাগুরু মুসলিম প্রজাদের কল্যাণই তাঁর বিবেচনার বিষয় ছিল। তাঁর মনে সাধারণভাবে হিন্দুবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িক মনোভাব না থাকলেও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁকে ‘হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ’ (পৃ. ২৩) করেই বক্তব্য দিতে হয়েছে।

পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েও এবং মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েও শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিষয় বাদ রাখেননি। সে আমলে একদিকে ‘হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল’ আর অন্যদিকে ‘ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার পথ ধরে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ছিল।’ পাশাপাশি হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি বৈরী ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যেই অনেকে স্বাধীনতার জন্য ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফাঁসিতে যেতে বা কারা ভোগ করতে দ্বিধা করেনি। বাস্তবতার সবটা দিকই তিনি দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন বলে তাঁর উপলব্ধি, ‘এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ (হিন্দু) স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। (পৃ. ২৩-২৪) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ বসু ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অনেক সময় এ ব্যাপারে হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছেন, সে প্রসঙ্গও টেনেছেন। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের ধকল ব্যক্তিগতভাবে তাঁকেও সইতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ পড়েনি। পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়েও কীভাবে তিনি অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধকে টিকিয়ে রাখলেন, সেটা তাঁর লেখা থেকেই বুঝতে হবে। তিনি লিখেছেন—

‘অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষে মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে।’ (পৃ. ৩৬)

পরবর্তীকালে দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের ভোগান্তিতে যেন প্রমাণিত হলো, এ ছিল এক আদর্শবাদী তরুণের সরল বিশ্বাসের প্রকাশ।

অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে তাঁর বিশ্বাস গোড়া থেকেই পোক্ত ছিল এবং তা অটুট থেকেছে বরাবর। জেলে এক আদর্শবান হিন্দু সমাজসেবককে তিনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’ (পৃ. ১৯১) এই বিশ্বাস থেকে তিনি সরে আসেননি কখনো। হয়তো সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে তাঁর এ বিশ্বাস রক্ষা করা সম্ভব কি না, সেটা আগাম আঁচ করতে পারেননি তিনি, যেমন দেশভাগের অনুষঙ্গ হয়ে দাঙ্গা কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, তা বুঝতে পারেননি নেহেরু-জিন্নাহর মতো অনেক বর্ষীয়ান বাঘা নেতাও। কিন্তু শেখ মুজিব যখনই বুঝতে পেরেছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর লিয়াকত আলী খান সব ক্ষমতার মালিক হয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন এবং ‘বাঙালি ও পাঞ্জাবি সদস্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখে শাসন করতে’ (পৃ. ১৭২-৩) চাইছেন, তখন তিনি প্রস্তুত হতে থাকেন কঠিন ভবিষ্যতের জন্য। আর যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় নিহত হলেন, তখন ‘পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে, তাতেই ভয় হল’ (পৃ. ১৯৫) এই প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকের। তিনি লিখেছেন, ‘এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হল পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারি কর্মচারী হলো গভর্নর জেনারেল (গোলাম মোহাম্মদ), আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী (চৌধুরী মোহাম্মদ আলী)। খাজা সাহেব (খাজা নাজিমুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা ও উদ্যোগের অভাব ছিল। এ কারণে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল।’ (পৃ. ১৯৫)

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ। দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নেতা হিসেবে শেখ সাহেব স্পষ্টভাবেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এভাবে, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি।’ এরপর সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত ও পুঁজিবাদের প্রতি অবিশ্বাস একেবারে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ (পৃ. ২৩৪)

আওয়ামী লীগ গঠন করার পর পাকিস্তানি শাসকদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তিনি লিখছেন—‘আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনো দিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান।’ (পৃ. ২৫৮)

তখনো শেখ মুজিবের মনে আশা, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে তাঁদের স্বপ্নের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের কৈশোর-যৌবনের আরাম এবং ব্যক্তিগত পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন সেই সাধের দেশ সম্পর্কে সব আশা ত্যাগ করা সহজ ছিল না। যখন ‘লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’ তখন তাঁর বিচারে, ‘যে নির্যাতন ও নিপীড়ন রাজনৈতিক বন্দিদের উপর (হয়েছে) তা দুনিয়ার কোনো সভ্য দেশে কোনো দিন হয় নাই।’ (পৃ. ১৭২) কিন্তু তবুও তখনো পাকিস্তান সম্পর্কে আশা তিনি ছাড়েননি, স্বাধীন পাকিস্তানে জেলজুলুম-অত্যাচারকে ‘ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস’ আখ্যায়িত করলেও এই স্বাধীনতার তাত্পর্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেও নিজের কর্তব্য তিনি ভোলেন না—‘ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।’ (পৃ. ২০৯)

কিন্তু ক্ষমতা একবার আমলাতন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত হলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির দাপটে সেখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি সহজে সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। ফলে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বাংলার দেশপ্রেমিক তরুণসমাজ এবং এই পাকিস্তান রাষ্ট্র পরস্পরের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। ফলে, পাকিস্তানের কেন্দ্রে যখন ক্ষমতার ভোগদখল নিয়ে খেয়োখেয়ি চলছে, তখন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে বসে বাংলার ছাত্র-তরুণেরা মাতৃভাষা ও অন্যান্য ন্যায্য অধিকার নিয়ে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। আমরা জানি পরবর্তী ইতিহাসে প্রমাণিত হয় যে এই তরুণসমাজই সেই চ্যালেঞ্জে শেষ পর্যন্ত সফল হয়। আর তাতে আন্দোলনের সামনের কাতারের একজন হয়ে দেখা দেন তরুণ শেখ মুজিব। সেই রোমাঞ্চকর চমত্কার গৌরবময় কাহিনির সূচনা-পর্বটুকুটই এখানে তাঁরই জবানিতে জানতে পারি আমরা।

চার.

মুসলিম লীগের সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র শেখ মুজিব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। তবে তাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা যে কঠিন ছিল, সেটা বুঝতেও কষ্ট হয়নি, ‘যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তত্পর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল।’ (পৃ. ৩৫)

অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।’ (পৃ. ৭৫) এ ছিল মূলত শেরেবাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি ও অন্য অবাঙালি নেতাদের ষড়যন্ত্র, মূল লক্ষ্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের বাসভূমি পূর্ব বাংলাকে দাবিয়ে রাখা।

শেখ মুজিবের মতো নেতাদের প্রথম ধাক্কা খেতে হয় বাংলা ভাগের ফলে। তাঁরা কেবিনেট মিশনের কাছে যুক্ত বাংলা প্রত্যাশা করেছিলেন, পরে শরত্ বসু-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত বাংলার উদেযাগের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাস্তবে অন্য রকম ঘটায় শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেশ তীব্র—‘আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা।’ (পৃ. ৭৩)

কিছু পরে আবার লিখছেন, ‘নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম।’ (পৃ. ৭৯)

নেতাদের ভুলগুলো শেখ সাহেব তাঁর সহজ বুদ্ধিতেই যেন ধরতে পারতেন। একদিকে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আর অন্যদিকে লীগের বাঙালি নেতাদের দুর্বলতা, দোলাচল, আপসকামিতার মধ্যে শেখ মুজিব বাংলার জনস্বার্থে ক্রমেই সোচ্চার হয়েছেন এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা যেন ছিল জন্মগত, কৈশোর থেকেই তিনি দক্ষ সংগঠক, নিষ্ঠাবান কর্মী ও সহজাত নেতা।

পাকিস্তান আন্দোলন এবং পরে আওয়ামী লীগ গঠনের সময় আমরা লক্ষ করি, নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতা কীভাবে তাঁকে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশিষ্ট করে তুলছে। এই উভয় দলেই তাঁর চেয়ে প্রবীণ নেতা ছিলেন সংখ্যায় বেশি, তাঁর চেয়ে বিদ্বান নেতার সংখ্যাও কম ছিল না, এমনকি সাংগঠনিক পদে তাঁর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন অনেকেই, কিন্তু মুজিব—একজন তরুণ কর্মী হয়েও—দিনে দিনে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রামের নানা বাঁকে, সরকারি জুলুম প্রলোভন ও ষড়যন্ত্রের নানা ফাঁদে অনেকেই পথ হারিয়েছেন। আর শেখ মুজিব পথ চলতে চলতে রাজনৈতিক গুরু, যেমন আবুল হাশিম, শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব, যেমন মৌলানা আকরাম খাঁ, বর্ষীয়ান নেতা, যেমন খাজা নাজিমউদ্দিন, রাজনৈতিক সতীর্থ, যেমন অলী আহাদ—এ রকম অনেককে ছেড়ে এসেছেন, অনেককে ছাপিয়ে উঠেছেন।

কিন্তু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের ও পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আর তার বিপরীতে বাঙালি রাজনীতিবিদদের আপসকামিতা ও দুর্বলতায় তিনি তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এর বিপরীতে শেখ মুজিবের চরিত্রটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর মধ্যে দেশ ও দশের জন্য কাজ করার প্যাশন ছিল তীব্র, তাঁর চরিত্রে দলীয় বা রাষ্ট্রীয় পদ বা অর্থবিত্তের মোহ ছিল না, ভীরুতা-কাপুরুষতা-আপসকামিতাকে তিনি অন্তর থেকে ঘৃণা করেছেন। কোনো রকম লুকোছাপা, ব্যক্তিগত লক্ষ্য ও কপটতা তাঁর মধ্যে ছিল না। বরাবর সরল, খাঁটি ও সত্ থেকেছেন তিনি। ফলে, তাঁর পক্ষে আত্মত্যাগ যেমন সহজ ছিল, তেমনি সাহসী ভূমিকা বা ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিতে পেরেছেন অনায়াসে। আর দীর্ঘদিন রাজনীতির ভেতরে থাকার ফলে কেন্দ্রের চালগুলো যেমন বুঝতেন, তেমনি সময়োচিত রাজনৈতিক চাল কী হওয়া উচিত, সেটাও ভালো বুঝতেন। কিছু ক্ষেত্রে তাঁর স্বভাবজাত প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতায় অর্জিত বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।

যখন তিনি বর্ষীয়ান আবুল হাশিমকে মিল্লাত প্রেস বিক্রি না করার জন্য চাপ দিয়ে ভয় দেখান, তখন সেটি অভিজ্ঞতাপ্রসূত চাল, আবার পরে যখন তাঁর কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন সেটা তাঁর স্বভাবজাত প্রজ্ঞারই প্রকাশ ঘটায়। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর (আবুল হাশিম) সাথে ভিন্নমত হতে পারি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে যে রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছি, সেটা তো ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনো দিন কষ্ট হয় নাই।’ (পৃ. ৮০) তেমনি আবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করলেন সেটাও যে ভুল হয়েছে, তা নিজের রাজনৈতিক গুরুকে জানিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি— ‘শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে।’ (পৃ. ২৮৩)। হ্যাঁ, এমনকি ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বের মোহেও জড়াননি তিনি।

পাঁচ.

শেখ মুজিবুর রহমানের জেদ ছিল মুসলিম লীগকে ব্রিটিশের খয়ের খাঁ আর জোতদার-জমিদারদের কবজা থেকে বের করে গণমানুষের দলে পরিণত করবেন। আর সেভাবে সদ্য স্বাধীন দেশটি যাতে এদের মতো অপদার্থ নেতাদের কারণে আমলাতন্ত্রের হাতে ষড়যন্ত্রের পীঠস্থানে পরিণত না হয়, সে তাগিদ বোধও তাঁর মধ্যে কার্যকর ছিল।

কিন্তু তাঁর এই জনদরদি মন, দেশ ও মানুষের প্রতি আন্তরিক অঙ্গীকার, বিভিন্ন ইস্যুতে ক্ষমতার অন্ধ অনুকরণ না করে জনকল্যাণের বিচারে অবস্থান গ্রহণের ফলে তিনি হয়ে ওঠেন পাকিস্তানি শাসনযন্ত্রের চোখে বিপজ্জনক ব্যক্তি। অবশ্য পাকিস্তান তাঁর তুলনায় মধ্যপন্থী ও নমনীয় নেতা শেরেবাংলা বা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহী আখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। আর শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন, বন্দিমুক্তি, খাদ্য আন্দোলন ইত্যাদি ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতার পরের বছর থেকেই পাকিস্তান সরকারের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছেন। এদিকে বাংলার মুসলিম লীগ রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল অংশে বিভক্ত ছিল গোড়া থেকেই। পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হওয়ার পরে এবং ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিভাজন থেকে দলের মধ্যে নানা রকম মেরুকরণ হতে থাকল। এ সময় ফজলুল কাদের, শাহ আজিজসহ অনেক তরুণ নেতা ক্ষমতার প্রসাদ পেতে রক্ষণশীল দলে যোগ দেন। এসবই হয়েছে লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে কোটারি ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হওয়ার কারণে। পাকিস্তান  সৃষ্টির পরপরই টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে তরুণ নেতা শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খান পন্নী পরাজিত হন। পাকিস্তানের জন্য জোয়ার সৃষ্টিকারী দলের এ পরিণতির কারণ,  শেখ সাহেবের ভাষায়, ‘কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা  গ্রহণ না করার ফলে।’ (পৃ. ১১৯) আর তাই জেলে বসে তিনি কর্মী সম্মেলনের সংগঠকদের জানাতে কুণ্ঠিত হন না, ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না।’ (পৃ. ১২০) শেখ সাহেব জেলে থাকতেই কর্মী সম্মেলন থেকে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

এবার শেখ মুজিবের লক্ষ্য হলো পাকিস্তানকে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দক্ষ বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তাই স্বভাবতই তিনি থাকলেন নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে। তিনি হলেন প্রথম কমিটির প্রথম জয়েন্ট সেক্রেটারি। সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং সম্পাদক শামসুল হক; আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আলী আমজাদ খান প্রমুখ হলেন সহসভাপতি।

আওয়ামী লীগের খসড়া মেনিফেস্টোতে এ দেশের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। এই দাবি এবং সরকারবিরোধী ভূমিকার আশঙ্কা থেকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জন্মলগ্নেই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আওয়ামী মুসলিম লীগের ওপর—‘নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সভায় ঘোষণা করলেন, ‘যো আওয়ামী লীগ করে গা, উসকো শের হাম কুচাল দে গো।’ (পৃ. ১৩৪)

আওয়ামী লীগের ওপর পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে মওলানা ভাসানীর পরামর্শে শহীদ সাহেবের সহযোগিতায় দলকে সারা পাকিস্তানভিত্তিক করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর প্রত্যুত্তরে লিয়াকত আলী সোহরাওয়ার্দীকে অকথ্য ভাষায় গাল দিয়ে বলেছেন, ‘ভারত কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে।’ (পৃ. ১৩৫)

একদিকে পাকিস্তান সরকারের আক্রমণ, ষড়যন্ত্র ও নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি চলেছে আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দল গঠনের কাজ চলছিল। আমরা লক্ষ করি, একদিকে দলকে পাকিস্তানভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামোতে গড়ে তোলার কাজ কখনোই যথেষ্ট শক্ত ভিত্তি পায়নি, আর অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে এ দলের সাংগঠনিক ভিত্তি সরকার ও ষড়যন্ত্রকারীদের শত বাধার মুখেও কেবল শক্তিশালী ও ব্যাপ্ত হয়েছে। দেখা যায় সভাপতি মওলানা ভাসানীর মধ্যে নানা সময়ে দোলাচল থাকলেও—যা শেখ সাহেব নিজেও লক্ষ করেছেন—তিনি জেলায় জেলায় ঘুরে সভা-সমিতির মাধ্যমে সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে শেখ মুজিবকে সহায়তা দিয়েছেন। সম্পাদক শামসুল হক তত দিনে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়ায় দলের সাংগঠনিক দায়-দায়িত্ব প্রধানত জয়েন্ট সেক্রেটারি মুজিবের কাঁধে এসে পড়েছে। বস্তুত শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন দলের সাংগঠনিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু এবং তারও চেয়ে বড় কথা, কেন্দ্রে ও সারা দেশের কর্মীবাহিনীর প্রেরণা, ভরসা ও দিশারি নেতা হয়ে উঠেছেন শেখ মুজিব। ফলে, শামসুল হকের অসুস্থতার পর সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাঁর কথাই যে নেতা-কর্মী সবার মনে পড়বে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

সাংগঠনিক কাজ আর জেল-জুলুম-অত্যাচারের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিব এক দৃঢ়চেতা তরুণ দলীয় নেতা থেকে ক্রমে জনগণের নেতায় পরিণত হচ্ছিলেন। মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহযোগিতায় সারা দেশে সংগঠন গড়ে তোলার কাজের মূল চালিকা শক্তি হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব—‘শহীদ সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্ঠান গড়তে সাহায্য করতে লাগলেন। প্রত্যেকটা জনসভার পরেই আমি জেলা ও মহকুমার নেতাদের ও কর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভা করে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গঠনে সাহায্য করতে লাগলাম।’ (পৃ. ২৩৫)।

অন্যত্র লিখেছেন—‘মওলানা ভাসানী, আমি ও আমার সহকর্মীরা সময় নষ্ট না করে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। পূর্ব বাংলার জেলায়, মহকুমায়, থানায় ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করতে সক্ষম হলাম।’ (পৃ. ২৪৩)

শেখ মুজিব কেবল সংগঠন গড়ে তোলেননি, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাকিস্তানের সংকট এবং বাঙালির ভবিষ্যত্ রাজনীতির দিগ্দর্শনেরও সন্ধান পাচ্ছিলেন। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি তিনি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন; পূর্ব বাংলার সম্পদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন, অর্থাত্ বৈষম্য ও বঞ্চনার বিষয়টি তিনি তখনই অনুধাবন করেছেন। এ ছাড়া পাঞ্জাবি আমলা চক্রের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার এবং এর অংশ হিসেবে ‘পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে বিষাক্ত করে’  (পৃ. ২৪১) তোলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন তিনি উপলব্ধি করেন। একনিষ্ঠভাবে পরিশ্রম করে সংগঠন দাঁড় করাতে গিয়ে শেখ মুজিব একদিকে অনেক নেতা-কর্মীর দোলাচল, দুর্বলতা ও দলাদলি দেখে হতাশ হয়েছেন আর অন্যদিকে কর্মীদের ত্যাগ ও সংগ্রামী স্পৃহা দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন-পর্যায়ে শেখ মুজিব কিন্তু এর বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিমত বেশ কঠোর ছিল বলা যায়। সভায় যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরোধিতা করে তাঁর বক্তৃতায় শেখ সাহেব বলেছিলেন—‘যাদের নীতি ও আদর্শ নাই তাদের সাথে ঐক্যফ্রন্ট করার অর্থ হল কতকগুলি মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলা। এরা অনেকেই দেশের ক্ষতি করেছে। রাজনীতি এরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে করে, দেশের কথা ঘুমের ঘোরেও চিন্তা করে না।’ (পৃ. ২৪৮)

এ বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন বেশ প্রণিধানযোগ্য—‘যাদের সাথে নীতির মিল নাই, তাদের সাথে মিলে সাময়িকভাবে কোন ফল পাওয়া যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ঐক্য থাকতে পারে না, তাতে দেশের উপকার হওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে।’ (পৃ. ২৪৫) তিনি এ সময় শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলামী বা কমিউনিস্টদের সম্পর্কেও প্রায় সমভাবেই অনাস্থা পোষণ করছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর একজন খাঁটি গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এটি রক্ষার এবং নির্বাচনী বিজয়ের জন্য কাজ করে গেছেন।

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি সাধারণ কর্মী ও জনসাধারণের কাছাকাছি এসে তাদের মন জয় করেছিলেন। এবার তাঁর উপলব্ধি হয়, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে, যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্যে জীবন দিতেও পারে।’ (পৃ. ২৫৭) এই হলো তাঁর দলের নেতা থেকে জননেতায় পরিণত হওয়ার সূচনা। তাঁর অঙ্গীকার যেমন বাড়ল, তেমনি বাড়ল সংগ্রামের সাহস, ত্যাগের স্পৃহা এবং বাড়ল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এ যেন তাঁর শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পথে প্রথম পদক্ষেপ।

যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়—বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা লাগিয়ে, ক্ষমতালোভী নেতাদের ভাগানোর চেষ্টা চালিয়ে, দুর্বলচিত্ত নেতাদের ভয় দেখিয়ে। পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত তাদের কাজ হাসিলও করে নেয়। ৯২ ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া, শেখ মুজিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেবকে দিয়ে ভুল স্বীকার করিয়ে বিবৃতি লিখিয়ে পূর্ব বাংলার ঐতিহাসিক বিজয় তারা ছিনিয়ে নেয়। শেখ সাহেবের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলো। শেখ সাহেবের মনে হয়েছে, ‘এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ. ২৭৩)

আমরা লক্ষ করি হক সাহেব, এমনকি শহীদ সাহেব, তা ছাড়া আতাউর রহমান খানসহ যুক্তফ্রন্টের সিনিয়র নেতাদের পাকিস্তান সরকার আপসে বাধ্য করতে সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতিতে শেখ সাহেবের জন্য তাঁদের অগ্রাহ্য করে বা প্রয়োজনে মোকাবিলা করে এগোনো ছাড়া পথ থাকেনি।

পরবর্তী সময়ের ইতিহাসে আমরা দেখি আরও জঘন্য সব ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক ডিগবাজি, চরম নির্যাতন ও স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বাধা ডিঙিয়ে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষের জয়যাত্রার রথ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রবীণ, শ্রদ্ধেয় নেতা ও সমসাময়িক কালের নেতৃবৃন্দকে ধীরে ধীরে ছাপিয়ে উঠেছেন তিনি। সে কাহিনি সবার জানা হলেও তাঁর জবানিতে সে ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার স্বাদ যেমন ভিন্ন হতো, শিক্ষাও হতো সুদূরপ্রসারী ও তাত্পর্যপূর্ণ। আমরা আশা করে থাকলাম, অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পূর্ণতা লাভ করবে। হারানো অমূল্য সম্পদ একদিন নিশ্চয় পাওয়া যাবে।