ভারতে প্রাচীনকালে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। শিক্ষা ছিল কেবল শাসক, পুরোহিত ও সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্য। চতুর্বর্ণের সর্বনিম্ন স্তরে থাকা শূদ্রদের এবং সকল বর্ণের নারীদের, শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। প্রাচীন ভারতে শূদ্ররা ছিল জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ। তাদের সবার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। প্রাচীন ভারতে বেদ পাঠ ছিল শিক্ষালাভের একটি প্রধান দিক। প্রাচীন ভারতের শিক্ষার বিষয় নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। এই কালপর্বে শিক্ষা যেমন সর্বজনীন ছিল না, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপও বহুকাল পর্যন্ত লক্ষ করা যায় না। মহাভারত থেকে জানা যায়, উপনয়নের পরই শিক্ষার শুরু। হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখিত ষোড়শ সংস্কারের অন্যতম হলো উপনয়ন। উপনয়ন সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত কেউ দ্বিজ হতে পারে না। দ্বিজ কথাটার অর্থ হলো দ্বিতীয় জন্ম। দ্বিজত্ব লাভের সারকথা হলো ব্রহ্মচর্যের সঙ্গে পরিচয়। দ্বিজত্বপ্রাপ্তির মানে তাই শিশুর প্রথম জন্ম পিতামাতার দ্বারা, আর দ্বিতীয় জন্ম গুরুর কাছে শিক্ষালাভের মাধ্যমে।১ উপনয়নের মাধ্যমে গুরু আনুষ্ঠানিকভাবে শিষ্যকে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। উপনয়ন-কালে নতুন শিষ্যকে মূলত গায়ত্রী মন্ত্র শেখানো হয়। প্রাচীন সমাজে উপনয়ন সংস্কার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সমাজের নানা কাজে যুক্ত হওয়ার অধিকার জন্মাত বর্ণহিন্দুর। উপনয়নের মাধ্যমে দ্বিজত্ব লাভ করলে তবেই বেদবিদ্যা অধ্যয়নের অধিকার জন্মায়। সুপ্রাচীনকালে উপনয়নই ছিল বিদ্যারম্ভের একমাত্র বা প্রধান সংস্কার। প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় তাই উপনয়নের স্থান ছিল সর্বাগ্রে। দ্বিজত্ব লাভ বা উপনয়নের মধ্য দিয়েই একটি বালক সমাজের পূর্ণসদস্য হয়েছে বলে গণ্য করা হতো। উপনয়ন সংস্কারের জন্য নির্ধারিত বয়স ব্রাহ্মণের জন্য আট, ক্ষত্রিয়ের ১১, আর বৈশ্যদের বেলায় ১২। উপনয়নের পর শিক্ষার্থী একজন ব্রাহ্মণ গুরুর গৃহে কয়েক বছর থেকে শিক্ষা অর্জন করত। পণ্ডিতগণ উপনয়ন অনুষ্ঠানের আরেকটি অর্থ করেছেন, এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ব্রত, সংযম, নিয়ম, গুরু ও দেবতার সংস্পর্শে আসতেন। ব্রহ্মচর্যকালে শিক্ষার্থীর বেশভূষা বলতে ছিল নিম্নাঙ্গে বাস, ঊর্ধাঙ্গে অজিন, মুণ্ডিত মস্তক, দণ্ডধারী ব্রহ্মচারীর বেশ। দণ্ড ধারণের অর্থ হলো শিক্ষাজীবনে দীর্ঘ পরিক্রমার জন্য প্রয়োজনীয় অবলম্বন। এ ছাড়া থাকত যজ্ঞোপবীত বা পৈতা। উপনয়ন অনুষ্ঠানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে নাম ও জন্মপরিচয় দিয়ে নবীন শিক্ষার্থী গুরুর কাছে শিষ্যত্বলাভের আবেদন জানাতেন। শিক্ষাজীবনে একনিষ্ঠ থাকার শপথ নিতে হতো শিক্ষার্থীর। এই অনুষ্ঠানে শিষ্যের উদ্দেশ্যে গুরু যা বলতেন তার ভাবার্থ এ রকম: তাঁর হূদয়ের সঙ্গে শিষ্যের হূদয়ের যোগসূত্র স্থাপিত হোক, শিষ্যের অন্তর গুরুর অনুগামী হোক এবং গুরুতেই যেন শিষ্যের অবিচল মতি থাকে, শিষ্যের চিন্তা-ভাবনা-শ্রদ্ধা সবকিছু যেন গুরুতেই কেন্দ্রীভূত হয় ইত্যাদি। শিক্ষার প্রধান অবলম্বন ছিল বেদ।২