খনার বিজ্ঞান-দর্শন

পুবে ধনু নিত্য ঝরা

পচ্চিমে ধনু নিত্য খরা

(খনার এ বচনে বলা হয়েছে, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পুব আকাশে রংধনু দেখা দিলে বৃষ্টি হবে এবং পশ্চিমে দেখা গেলে খরা হবে।)

‘খনা’ কি ‘খনার বচন’ নিয়ে বিদ্যমান আলাপ কি নথিতে আমরা বরাবর ছকবদ্ধ কিছু একরৈখিক ধরন ও সূত্র দেখতে পাই। যদিও খনা কি খনার বচন নিয়ে গুরুত্ব তৈরি করার মতো লেখালেখি আমাদের নাগাল কি হদিসে তেমন একটা নেই। মহামতি খনা তাঁর অমর সৃষ্টি ‘খনার বচনের’ ভেতর দিয়েই আমাদের ইতিহাসে জোরদার দৃশ্যমানতা তৈরি করেছেন। হয়তো সেই কারণেই খনাবিষয়ক আলোচনায় প্রধান হয়ে ওঠে কেবল তাঁর বচনসমূহ। বচনভিন্ন খনা বারবার আমাদের অধিপতি আলাপের ঘেরাটোপ থেকে বিচ্ছিন্ন কি অদৃশ্য হয়ে যান বা তাঁকে আড়াল করে রাখা হয়। এমনকি খনার বচন নিয়ে আলাপের সূত্রগুলো তাঁর বচনের ‘কৃষি ও আবহাওয়ার সম্বন্ধকে’ এমন কায়দায় উপস্থাপন করে বারবার, যেখান থেকে আমরা খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শন নয় কেবল ‘কৃষি কি আবহাওয়ার উপযোগিতামূলক পরামর্শই’ ঠাহর করতে পারি। সচরাচর খনার ‘বিদুষী’, ‘জ্যোতিষী’, ‘কৃষি বচন রচয়িতা’, ‘কিংবদন্তি’ ইত্যাদি পরিচয় নির্মাণেরই চল প্রতিষ্ঠিত। ‘খনার বচনও’ সচরাচর ‘লোকসংস্কৃতির’ এক প্রবল বলপ্রয়োগে বন্দী, যেখান থেকে নিম্নবর্গের রূপান্তরধর্মী জীবন কি আখ্যানের কোনো আন্দাজ পাওয়া যায় না। খনা কি খনার বচন নিয়ে যত ধরনের লেখালেখি হাতের নাগালে পাওয়া যায়, সেসব লেখালেখির ধরন ও কাঠামো প্রায় একই। প্রচলিত নথিগুলো পয়লা খনার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করে (যা জন্মরহস্য বলে একধরনের দক্ষিণ এশীয় ফ্যান্টাসি তৈরি করে), পরবর্তীতে তাঁর একধরনের ‘সংক্ষিপ্ত জীবনী’ তুলে ধরে। এসব জীবনীর একটা প্রধান অংশজুড়েই খনাকে পরিবারকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে টেনে টেনে সামাজিকীকরণ করা হয়। খনার শ্বশুর, স্বামী, রাক্ষসপুরীতে বড় হওয়া ও জ্যোতিষজ্ঞান লাভ, রাজদরবার সব মিলিয়ে খনাকে ‘প্রকাশ’ করা হয়। রয়েছে খনার জন্মস্থান বিতর্ক এবং বচনের ভাষিক বাহাস। তারপর খনার বচনগুলোর একটা সংকলন তুলে দেওয়া হয়। ছন্দোবদ্ধ বচনটির পর একটি বর্ণনামূলক মানে দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বচনগুলো শ্রেণীকরণ করে ব্যবহূত হতে দেখা যায়। যেমন, কৃষিবিষয়ক বচন, তিলতত্ত্ব, হলুদবিষয়ক, কচুবিষয়ক, বৃষ্টি গণনা, কলার চাষবিষয়ক ইত্যাদি। খনার এক বচন ছাড়া প্রচলিত অধিকাংশ রচনায় খনাকে ‘ইতিহাসের এক নিষ্ক্রিয় ও প্রতিরোধহীন’ ব্যক্তি হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ‘খনার জিহ্বা কেটে নেওয়ার ঘটনাকে’ পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন ও নারীর জ্ঞানকে প্রান্তিক করে তোলার উদাহরণ হিসেবে ব্যাখা দেওয়া হয়। কেউ কেউ খনার বচনের ‘জনমত’ ও গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডের খনা-ভাবনাসমূহ খনা কি খনার বচনকে ‘লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ কৃষিসমাজের বিষয়’ হিসেবে এক প্রশ্নহীন অপরত্বের মোড়কে সমাজ রূপান্তরের ধারাপাত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এর ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, নিম্নবর্গের যাপিতজীবন ও রাষ্ট্রবিকাশের আখ্যান থেকে খনা কি খনাদের সৃষ্টি ও দর্শনকে ‘অস্বীকৃত’ ও ‘অবাঞ্ছিত’ করে রাখা হয়। যাপিতজীবনের দেনদরবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে খনাদের ‘ধরাছোঁয়ার বাইরের অচিন রূপকথা কি নাগালহীন কিংবদন্তি’ করে তোলা হয়। ক্ষমতাবানদের রচিত ইতিহাসে কেবল খনা নয়, উলগুলান বা মুণ্ডা বিদ্রোহের কারিগর বীরসা মুণ্ডা কি হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ফুলমণি মুর্মুদেরও এভাবেই ‘অপর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নিরন্তর বিজ্ঞানমনস্কতা কি সামাজিক বোঝাপড়া দিয়ে তখন এসব চরিত্র কি তাদের চিন্তা ও দর্শন নিম্নবর্গের নাগালের বাইরে থেকে যায়। আর সেখান থেকেই আজকের আলাপখানি৩ শুরু করতে চাইছি। খনা ও খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শনকে আজকের আলাপে বোঝার চেষ্টা করব। আলাপের সূত্র ধরে খনার বৃত্তান্ত, প্রচলিত আখ্যান ও কাহিনিগুলো আমাদের টানতে হবে ক্ষমতার রাজনীতি ও ইতিহাসের বৈষম্যের ব্যাকরণকে স্পষ্ট করার জন্য। আলাপের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক তাত্ত্বিক পাটাতন অনেকখানি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। নিম্নবর্গের প্রতিরোধী জ্ঞানকাণ্ডের বিজ্ঞানমনস্কতা আলাপের অলিগলি ঘুরতে আমাদের টানটান রাখবে। প্রতিবেশ-নারীবাদী৪ তত্ত্ব-তালাশের ভেতর দিয়ে চলতি আলাপ তার আসর জমানোর মানত করেছে। বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত খনা ও খনার বচন নিয়ে লেখালেখিগুলোর প্রায় গরিষ্ঠভাগই (যা পাওয়া গেছে এ শর্তকে মেনে) চলতি আলাপে টেনে আনা হয়েছে। খনার বচনের ক্ষেত্রে নিজস্ব সংগ্রহ, রাস্তা কি মেলাতে বিক্রীত বই থেকে শুরু করে গবেষণা পুস্তক-জার্নাল-পত্রিকা-সাময়িকী এবং ওয়েবদুনিয়াতে যা পাওয়া গেছে তা-ও গুরুত্ব দিয়ে আলাপের সঙ্গী হয়েছে। খনার বচন এবং খনার বিজ্ঞান-দর্শনকে জানতে-বুঝতে দেশের নানান প্রান্তে গ্রামীণ জনপদে নিম্নবর্গের বাহাস ও দেনদরবার কাজে লেগেছে। নিম্নবর্গের এই প্রজ্ঞা ও গতিই বিজ্ঞানের সত্যকে প্রকাশ করে, খনার বচন কি খনার দর্শন জীবনব্যাপী যে সত্যের সীমানা তৈরি করেছে। চলতি আলাপ থেকে আমরা অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডের ক্ষমতার বলপ্রয়োগ ও নিম্নবর্গের জ্ঞানদুনিয়ার প্রান্তিকীকরণ ও নিরন্তর টিকে থাকার লড়াইয়ের ধরনটিও বোঝার চেষ্টা করব। কারণ খনা ও খনার বচনকে দাবিয়ে রাখার মৌলিক সূত্র ও কারণ ক্ষমতার রাজনীতির ভেতরেই সীমাবদ্ধ।

আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ও কাটা জিব

আমি অটনাচার্যের বেটি

গনা-বাছায় কারে বা আঁটি

খনার বচন

খনার পরিচয় ঘিরে তৈরি হয়েছে এক দীর্ঘ বৈষম্যের গণিত ও উপস্থাপনের রাজনীতি। বলা হয়ে থাকে, খনার বচন বাংলার কৃষিজীবনের এক অবিস্মরণীয় ভিত। যদি তা-ই হয়, তবে এখনো কেন খনার কোনো উল্লেখযোগ্য জীবনী রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশিত নয়? বিদ্যমান নথি ও দলিলে খনাকে আমরা কীভাবে দেখতে পাই এ আলাপের এ অংশে তার একটি ছোট্ট ফিরিস্তি হাজির করছি। খনার বচন বিষয়ক পুস্তকগুলোর মলাটে আমরা খনার ছবি দেখতে পাই। প্রতিটি বইয়ের মলাটে প্রচ্ছদের ধরন একই রকম। গ্রামবাংলার কৃষিজীবনের ছবি, বৃষ্টিমুখর দৃশ্য, ধানজমিন, কৃষক-কৃষাণী জমিনে কাজ করছে, কোনো গণক পুরুষ গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটছে। এসবের ভেতর একজন নারীর ছবি তুলনামূলকভাবে বড় আকার ও জায়গা জুড়ে থাকে। উপস্থাপনে বোঝা যায়, তিনি বাঙালি সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারী। স্বাস্থ্যবতী ও হাস্যোজ্জ্বল এই নারীর চুল কালো ও দীর্ঘ। সব ছবিতেই এই নারী তাঁর ডান হাত আশীর্বাদদানের মুদ্রা নিয়ে উপস্থাপিত। রংতুলিতে আঁকা এই নারীই খনা। তবে সব ছবিতেই খনাকে একটি বৃত্তের ভেতর আঁকা হয়েছে। কোথাও এই বৃত্তকে পৃথিবী এবং কোথাও সৌরমণ্ডল হিসেবে দেখানো হয়েছে। খনার চারধারে শনি, মঙ্গল গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানি উপস্থাপন ও দৃশ্যমানতার রাজনীতি আছে। প্রতিটি দৃশ্যমানতাই রাজনৈতিক। খনা বিষয়ে নিম্নবর্গের চিন্তাজগতে যে রূপ তৈরি হয়েছে, তাই উপস্থাপিত হচ্ছে এসব চিত্রের ভেতর। কিংবা অন্যভাবে দেখলে খনার এই চিত্র আমাদের নিম্নবর্গের খনাবিষয়ক এক রূপকল্প। শ্রেণীবিভাজিত সমাজে নিম্নবর্গ তার প্রান্তিকতার জায়গা থেকে খনাকে গ্রহণ করেছে আপন লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে। তাই অধিপতি ধারার বিরুদ্ধে খনার এই রূপচিত্র হয়তো নিম্নবর্গের আরেক পাল্টা আওয়াজ।

জেন্ডার বিশ্বকোষ বইতে সেলিনা হোসেন (২০১২) খনা সম্পর্কে বলেন, বিদুষী নারী খনা তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে বাংলার কৃষিব্যবস্থায় সংযোজন করেছিলেন নতুন দিকনির্দেশনা। চাষপদ্ধতিতে তাঁর বচন প্রয়োগ করে অভিজ্ঞ হয়েছিল কৃষক এবং সাফল্য এনেছিল তাদের ফসল উত্পাদনে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, বাংলাদেশে কৃষির সূচনাপর্বে খনা তাঁর বচন রচনা করেছিলেন। খনা কৃষকদের কাছের মানুষ হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। খনার এই জ্ঞান ও জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেননি তাঁর শ্বশুর পণ্ডিত বরাহ। তাঁর ছেলে মিহির ছিলেন খনার স্বামী। খনার অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা চারদিকে রটে গেলে পুরুষতন্ত্রের জিঘাংসা প্রবল হয়ে ওঠে। পণ্ডিত বরাহ তাঁর পুত্র মিহিরকে নির্দেশ দেন খনার জিব কেটে ফেলতে। মিহির বাবার আদেশ পালন করার জন্য তৈরি হন। তবে জিব কাটার আগে তিনি খনাকে কিছু বলার সুযোগ দেন। খনা চাষপদ্ধতি, মাটি, আবহাওয়া, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং গৃহস্থালির বিভিন্ন দিক ও মানবজীবনের নানা সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলেন। এরপর তাঁর স্বামী তাঁর জিব কর্তন করলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে খনার বচন মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এই বচনগুলো বাংলার গার্হস্থ্য-জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। এসবের ভেতর দিয়ে মানুষ অসাধারণ দিকনির্দেশনা পেয়েছে। এ কারণেই পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো গবেষক খনাকে পুরুষ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পুরুষের ঊর্ধ্বে কোনো নারীর এত জ্ঞান তো মানা যায় না, এ-ই ছিল তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতন্ত্রের হাতে নারীর প্রজ্ঞা মুছে ফেলার আরও প্রমাণ এই যে, ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাসে বিদুষী খনার উল্লেখ নেই।৬ উইকিপিডিয়া খনাকে একজন ভারতীয় নারী কবি ও ঐতিহাসিক জ্যোতিষী হিসেবে বর্ণনা করেছে।৭ কোথাও আবার খনাকে একজন ‘বাঙালি নারী’, বচন রচয়িতা ও জ্যোতিষী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। যোগেশ চন্দ্র রায়ের আমাদের জ্যোতিষ ও জ্যোতিষী  বইতে অত্যন্ত কৃপণতার সঙ্গে খনার উল্লেখ থাকলেও এতে বেশি কিছু নেই।

উপিন্দর সিং (২০০৮) তাঁর আ হিস্ট্রি অব অ্যানশিয়েন্ট অ্যান্ড আর্লি মেডিয়াভাল ইন্ডিয়া: ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু দ্য ১২ সেঞ্চুরি  বইতে খনাকে বরাহমিহিরের পুত্রবধূ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ডাক ও খনার বচনকে ‘প্রাচীন বাংলার জনপ্রিয় কৃষি ভাষ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।১০ খনাকে নিয়ে তিতাশ  চৌধুরী (২০০০) তাঁর একটি লেখায় জানান, খনাই তাঁর নামে প্রচলিত বচনের নির্মাতা। আর একসময় খনাকে কাল্পনিক চরিত্র মনে করা হতো। অবশ্য জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার বলেছিলেন, খনা কাল্পনিক চরিত্র না-ও হতে পারে, তাঁর একটি বাস্তব অস্তিত্ব আছে নিশ্চয়ই।১১ ২০০৯ সালের ১৫ জুন ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি-বাংলায় ‘খনা’  নামের একটি মেগাসিরিয়াল শুরু হয়, যেখানে খনাকে এক পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চৌধুরী (২০০০) তাঁর একটি লেখায় জানান, বরাহমিহির খনার স্বামী ছিলেন না। ছিলেন শ্বশুর। সেই শ্বশুরই তাঁর জিব কেটে দিয়েছিলেন ক্রোধে ও ঈর্ষায়। তবে খনা একটি বচনে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি অটনাচার্যের বেটি/ গনা-বাছায় কারে বা আঁটি।’ এ স্পর্ধার কারণেই সম্ভবত খনা শ্বশুর কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন। এবং এর ফলেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন নির্মমভাবে।১২ কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় খনার পিতার নাম বলা হয়েছে অনাচার্য। ‘খনা: এক কিংবদন্তি নারীর দুঃখগাথা’ শিরোনামে ব্লগার চয়ন ‘চতুর্মাত্রিক’ ব্লগে ২৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখে পোস্টকৃত তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া ইতিহাসের এক কিংবদন্তি খনা বা ক্ষণা। কোনো এক শুভক্ষণে তাঁর জন্ম বলে নাম দেওয়া হয় ক্ষণা। আর ‘ক্ষণা’ থেকেই ‘খনা’ নামের উত্পত্তি বলে মনে করা হয়’।১৩ বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যগত কৃষির ওপর খনার বচনের প্রভাব নিয়ে লেখা এক গবেষণা নিবন্ধে সেন (২০০৮) খনাকে তত্কালীন বাংলাদেশের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারাসাতের দেওলী গ্রামের এক নারী জ্যোতিষী ও বচন রচয়িতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৮০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের ভেতর যাঁর জন্মকাল। খনার বচনকে তিনি বাংলার কৃষকের লোকায়ত কৃষির গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা হিসেবেও উল্লেখ করেন। খনার বচনের সঙ্গে ভারতের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারে প্রচলিত ঘাঘ ও ভাদ্রির মিল রয়েছে। পাশাপাশি ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ডাকের বচনের সঙ্গেও এর মিল রয়েছে।১৪ আমরা এখন খনার ‘জীবনী’ হিসেবে প্রচলিত কিছু আখ্যান ও আখ্যানের ভিন্নতাগুলো দেখার চেষ্টা করব।

আখ্যান : ১

পণ্ডিত রামপদ ভট্টাচার্য তাঁর খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন  বইতে ‘খনার জীবনী’১৫ বর্ণনা করেছেন এভাবে:

খনার জীবন-কাহিনি সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ কাহিনি রহিয়াছে। কেহ কেহ বলেন খনার পিতা ময়দানব, আবার অনেকে বলেন খনা ছিলেন রাজকন্যা। রাক্ষসগণ সেই রাজবংশের প্রায় সকলকেই নিধন করিয়া, রাজকন্যা খনাকেই বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। রাক্ষসগণই মায়াবশে খনাকে লালন-পালন করে এবং তাঁহাকে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দেয়। তদানীন্তনকালে মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার বরাহ পণ্ডিতেরও একটি পুত্র হয়। বরাহ পণ্ডিত জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হইয়াও ভ্রমবশত পুত্রের আয়ু শতবর্ষস্থলে দশবর্ষ গণনা করেন। পুত্রের প্রতি বিশেষ মায়া সঞ্জাত হইবার পূর্বে বরাহ পণ্ডিত তত্পুত্র মিহিরকে একটি তাম্রনির্মিত পাত্রে করিয়া সমুদ্রে ভাসাইয়া দিলেন। ঈশ্বরের অপার লীলা। সেই তাম্রপাত্রখানি ভাসিতে ভাসিতে সুদূর সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইল। রাক্ষসগণ তাম্রপাত্রস্থিত সন্তানকে নিজেদের আবাসে লইয়া গিয়া খনার সহিত লালন-পালন করিতে লাগিল এবং জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দিল ও খনার সহিত বিবাহ দিল। রাক্ষসদের আশ্রয় হইতে মিহির ও খনা অনেক পথ ঘুরিয়া উজ্জয়িনী নগরে উপস্থিত হইলেন। বরাহ পণ্ডিত পুত্র ও পুত্রবধূকে পাইয়া আনন্দিত হইলেন। ধীরে ধীরে খনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খনা মুখে মুখে যাহা বলিত, তাহাই ধ্রুব সত্য হইতে লাগিল। শেষ পর্যন্ত খনার খ্যাতিতে স্বামী ও শ্বশুরের যশ ম্লান হইল। খনা নিজের স্বামী ও শ্বশুরের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখিবার মানসে নিজের জিহ্বা নিজেই কর্তন করিলেন। এই প্রতিভাসম্পন্না মহিলার আত্মত্যাগ তাঁহাকে আরও মহীয়সী করিল। স্বামী ও শ্বশুরের সম্মান বাঁচিল, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক তথ্য অজ্ঞাত রহিয়া গেল। তবু খনা মুখে মুখে জ্যোতিষশাস্ত্রের সারমর্ম যতটুকু উদ্ঘাটন করিয়াছিলেন, তাহাই মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া আজিও খনার বচন নামে প্রসিদ্ধ। 

আখ্যান: ২

দাস (১৪১৫) তাঁর বৃহত্ খনার বচন পুস্তকে ‘বরাহমিহির ও খনার জীবনী’১৬ শীর্ষক লেখায় বলেছেন:

মহারাজ বিক্রমাদিত্য যখন উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন, তখন মালাবার প্রদেশের চুঙ্গীনামে খণ্ড গ্রামে বিখ্যাত জ্যোতিষাচার্য্য বরাহের ঔরসে শ্রীমতী ধরাদেবীর গর্ভে মিহির জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাহ গণনা করে দেখেন, তাঁর পুত্রের আয়ু মাত্র এক বত্সর। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিচক্ষণ ব্যক্তি বরাহ ভুলবশত পুত্রের আয়ু মাত্র এক বত্সর জানতে পেরে প্রচণ্ডভাবে চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হলেন। আবার গণনা করে দেখলেন অবিকল পূর্বের মতো অবস্থা। এবার বরাহ ভাবলেন, এরূপ অল্পায়ুযুক্ত পুত্রকে বৃথাই লালন-পালন করে মায়ামোহে বিজড়িত হয়ে কোনো লাভ নেই। তাই অনেক চিন্তার পর পুত্রের অকালমৃত্যু প্রতিহার করার জন্য সদ্যজাত শিশুকে একটি তাম্রপাত্রে করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিলেন। সেই পাত্রটি জলে ভাসতে ভাসতে এস হাজির হলো একেবারে সিংহলদ্বীপে। পূর্বে এই দেশের নাম ছিল লঙ্কা। যেখানে রাজা রাবণ অযোধ্যারাজ দশরথের পুত্রবধূ সীতাকে হরণ করে রেখেছিল। আমাদের দেশের সাহসী ও শক্তিমান পুরুষ বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করে তাঁর নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করেন সিংহল। তখন সিংহলের অধিপতি ছিলেন ময়দানব। দুরন্ত রাক্ষসগণ তাঁকে নিধন করে তাঁর একমাত্র গুণবতী ও রূপবতী কন্যাকে জীবিত রেখেছিলেন। তাঁরা জানতেন, অজস্র মায়াজাল এবং জ্যোর্তিবিদ্যা। খনাকে কন্যা হিসেবে লালন-পালন করে তাঁকে জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। খনা ক্রমে রক্ষকুলের অনুকম্পায় জ্যোর্তিবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা লাভ করে তাঁদের আশ্রয়ে পালিতা হয়ে বড় হতে থাকেন। তাম্রপাত্রটি যখন ভেসে ভেসে সিংহলের সমুদ্র তীরে গিয়ে হাজির হলো তখন খনা কয়েকজন রাক্ষসী রমণীর সঙ্গে সাগরজলে স্নান করতে গিয়েছিলেন। খনা ভাসমান পাত্রে একটি সুন্দর বালককে দেখে তার পরমায়ু গণনা করে দেখেন, এই বালকের আয়ু এক শ বছর। ভ্রমবশত তার পিতা বরাহ তাকে পরিত্যাগ করেছেন মাত্র। এবার ভবিষ্যত্ জ্ঞাতা জ্যোতিষী খনাদেবী সেই বালককে নিজ আবাসে নিয়ে গিয়ে পালন করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে রাক্ষসদের ও খনার আশ্রয়ে থেকে তাঁদের লালন-পালনে মিহির বড় হলো। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিহিরও রাক্ষসীদের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা করে ব্যুত্পত্তি লাভ করলেন। তারপর রাক্ষসীগণ মিহিরকে যোগ্য পাত্র স্থির করে তাঁদের সকলের একমাত্র আদরের কন্যা খনাকে বিয়ে দিলেন। এভাবে মিহির ও খনার বাল্যকাল থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত রাক্ষসদের আশ্রয়ে অতিবাহিত হলো। কয়েক দিন পরে জ্যোতিষতত্ত্ব মাধ্যমে মিহিরের নিজের পূর্ব বৃত্তান্ত অবগত হয়ে স্বদেশে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য মনে উদ্বেগ দেখা দিতে থাকে। কিন্তু এই বিশাল জলধিবেষ্টিত রাক্ষসদ্বীপ থেকে কেমন করে ফিরবেন তাই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। স্বামীর বিষণ্নতাভাব দর্শন করে খনা বিচার করে বুঝতে পারলেন, তাঁর স্বামীর মন চেয়েছে স্বীয় মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে। তাই সব বিষয় অবগত হয়ে খনা একদিন মিহিরকে ডেকে বললেন—এখন মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত, আমাদের যাত্রা করার শুভ সময়। এ সময় যাত্রা করলে কোনো প্রকার বাধা বিঘ্ন দেখা দেবে না। অতএব আর বিলম্ব না করে বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সত্বর গৃহ হতে বহির্গত হওয়া একান্ত কর্তব্য। তারপর সুযোগমতো উভয়ে কয়েকটি জ্যোতিষশাস্ত্র গ্রহণ করে দুজনে গৃহ হতে বহির্গত হলেন। দ্বারে এক রাক্ষস প্রহরী ছিল। সে গিয়ে সিংহলের রাক্ষসপ্রধানকে তাদের বহির্গত বিষয়ে অবগত করাল। রাক্ষসপ্রধান সব কথা শুনে বললেন, তারা মাহেন্দ্রক্ষণে যাত্রা করেছে। সুতরাং, তাদের আর কোনো বিঘ্ন ঘটতে পারে না। তিনিই ভৃত্যকে আদেশ করলেন, উভয়কে সমুদ্রের পরপারে রেখে এসো। তখন মায়াবী রাক্ষস মায়াবলে কাষ্ঠের জলযানে পরপারে অর্থাত্ ভারতের উপকূলে তাঁদের পৌঁছে দিল। এভাবে সুদূর সিংহল থেকে রাক্ষসের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে ফিরে এসে তাঁরা সোজা চলে গেলেন তাঁদের পিতা বরাহের কাছে। প্রথমে বরাহ তাঁদের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। কারণ, আবার তিনি গণনা করে দেখলেন, মিহিরের আয়ুষ্কাল মাত্র এক বছর। বরাহের গণনার বিষয় লক্ষ্য করে খনা বললেন:

কিসের তিথি কিসের বার

জন্ম নক্ষত্র কর সার।

কি কর শ্বশুর মতিহীন

পলকে আয়ু বারো দিন

বরাহ খনার জ্যোর্তিবিদ্যার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আর কালবিলম্ব না করে বরাহ পুত্র ও গুণবতী বধূমাতাকে সাদরে গৃহে স্থান দিলেন। সেই থেকে খনাদেবী শ্বশুরালয়ে স্বামীসহ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। এদিকে ক্রমে ক্রমে মিহির ও স্বীয় পিতার ন্যায় মহারাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করে জ্যোতির্বিদ্যায় ভালো যশস্বী হয়ে উঠলেন। সভায় তিনি নবরত্নের মধ্যে অন্যতম রত্নরূপে পরিগণিত হলেন। একদা রাজা বিক্রমাদিত্য পণ্ডিতরত্নদের মধ্যে এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আকাশে নক্ষত্র সংখ্যা কত? কোনো পণ্ডিত হিসাব করে কোনো কিছু বলতে সাহস পেলেন না। তখন বরাহ ও মিহির পিতাপুত্র নানা প্রকার গণনা করে যথাযথ উত্তর না দিতে পেরে মহারাজের কাছে মাত্র এক দিনের সময় নিয়ে গৃহে প্রত্যাগত হলেন। তারপর মহাগুণবতী খনা শ্বশুর ও স্বামীর মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হয়ে অনায়াসে তা গণনা করে বলে দিলেন। মিহির গিয়ে রাজার কাছে সঠিক উত্তর দিতেই রাজা খুশি ও আনন্দিত হলেন। রাজা ক্রমে ক্রমে সন্ধান নিয়ে গুণবতী খনার কাহিনি জানতে পেরে আরও কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে থাকেন বরাহ-মিহিরকে। খনা গৃহে থেকে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর বলে দিতেন। ক্রমে অল্পকালের মধ্যে খনার যশ ও সৌরভ চারদিকে পরিব্যাপ্ত হলো। রাজা বিক্রমাদিত্য সমুদয় বিষয় অবগত হয়ে খনাকে তাঁর সভার জনৈক রত্ন করে রাখবেন বলেই বরাহকে আদেশ করলেন তাঁর পুত্রবধূকে রাজসভায় আনার জন্য। বরাহ ভাবলেন, বাড়ির বউমাকে রাজসভায় থাকতে দেখলে সমাজ মন্দ বলবে ও কলঙ্কে দেশ ভরে যাবে। সুতরাং, খনা সেখানে থাকলেও যাতে কথা না বলতে পারেন, সে জন্য তাঁর জিব কর্ত্তন করলে ভালো হবে। বরাহ কলঙ্কের ভয়ে ছেলেকে খনার বাকশক্তি লোপ করার জন্য তাঁর জিব ছেদন করতে আদেশ দিলেন। পিতার নিদারুণ আদেশ শ্রবণ করে মিহির আর স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মিহির পিতার আদেশ পালন করতে ইতস্তত করতে লাগলেন। তখন খনা স্বামী ও শ্বশুরের মনের অবস্থা উপলব্ধি করে বললেন, আমার মৃত্যুকাল আসন্ন স্বামী। আপনি আপনার পিতার আদেশ পালন করুন। মিহির ভাবলেন, একদিকে পিতার আদেশ, অপরদিকে পত্নীর অন্তিম অনুরোধ। বেশ তা-ই হোক। ধারালো ছুরি হাতে ধরলেও মিহিরের হাত কাঁপতে থাকে কিন্তু শ্রীহরির নাম নিয়ে উভয়ের আদেশ ও আবেদন রাখতে অনায়াসে খনার জিব টেনে ছেদন করলেন। কিছুক্ষণ পর প্রকৃতির নিয়মানুসারে খনার পঞ্চভূতের দেহ পঞ্চভূতে মিশে গেল। এখানে খনার জীবন নাটকের যবনিকা পতন ঘটল। কিংবদন্তি আছে খনার জিব কেটে টুকরাটি যেখানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এক টিকটিকি সেই জিব খেয়ে ফেলে। বরাহ ও মিহির সেই দৃশ্য দেখে বলেছিলেন, তোদের সমস্ত টিকটিকির পাওনা হোক এই জিব। যখন তোরা কারও ভালো-মন্দ কথার উত্তরে টিকটিক করে শব্দ করবি, তখন তাদের সে কথা সত্যে পরিণত হবে। তাই অদ্যাবধি আমরা টিকটিকির ডাককে সত্য বলে মানি। জ্যোতিষ ভারতী খনার অশরীরী আত্মার কল্যাণ ও হরিভক্তি কামনা করে আমার লেখনী বন্ধ করলাম। জয় খনা।

আখ্যান: ৩

খনার বচনের বিশিষ্ট সংগ্রাহক ও খনার বচন পুস্তকের রচয়িতা শ্রী বিজয় চন্দ্র রায় তাঁর খনার বচন বইয়ের পূর্বাভাসে খনার এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস উল্লেখ করেছেন। রায় (১৯৯৮) লিখেছেন১৭:

খনার জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ আছে। কেহ বলেন খনার পিতা ছিলেন দানব, আবার কেহ বলেন খনা রাজকন্যা ছিলেন। লঙ্কাবাসী কোনো এক রাক্ষস খনার পিতাকে সপরিবারে নিধন করিয়াছিলেন। কিন্তু মায়াবলে একমাত্র খনাকে বাঁচায়ে তাহাকে প্রতিপালন করেন। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহার বুদ্ধির তাত্পর্য দেখে রাক্ষসগণ তাহাকে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দেন। তত্কালে উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যও নবরত্নসভায় বরাহ পণ্ডিতের এক পুত্র সন্তান হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও ভুলবশত বরাহ পণ্ডিত পুত্রের আয়ু শতবর্ষের স্থলে মাত্র দশ বছর গণনা করেন। পুত্রকে লালন-পালন করে শোকগ্রস্ত হতে হবে, ভাবিয়া তিনি সদ্যজাত পুত্রকে একটি তাম্রপাত্রে ভরিয়া সমুদ্রে ভাসাইয়া দেন। সেই তাম্রপাত্র সন্তানসহ ভাসিতে ভাসিতে লঙ্কার উপকূলে উপনীত হয় এবং রাক্ষসগণের হাতে পড়ে। রাক্ষসগণ খনার সহিত মিহিরকে লালন-পালন করেন এবং খনার সহিত বিবাহ দেন। রাক্ষসদের আশ্রয়ে থাকিতে ভালো না লাগায় সুযোগ বুঝে মিহির ও খনা পলায়ন করেন। ঘুরিতে ঘুরিতে তাঁহারা উজ্জয়িনী নগরে উপস্থিত হন। বরাহ পণ্ডিত পুত্রবধূ ও পুত্র পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত। তাহাদের সুখ্যাতি ক্রমাগত চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খনা মুখে যাহা বলিত উহা সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইত। পুত্রবধূ খনার সুখ্যাতিতে শ্বশুর ও স্বামীর মন ম্লান হইয়া যায়। প্রবাদ আছে, স্বামী ও শ্বশুরের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখিবার জন্য খনা স্বয়ং নিজের জিহ্বা নিজেই কর্তন করিয়াছিলেন।

আখ্যান: ৪

অভিষেক ও অমৃতা ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে Khannar Vachan-1 : Varamihir’s daughter-in-law শিরোনামে ধারা বর্ণনাসহ প্রায় সত্তরটি খনার বচনের একটি বিবরণী তৈরি করেছেন। যেখানে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, পৌরাণিক জ্যোতিষী বরাহমিহির তাঁর পুত্র পৃথুয়াসকে বাঁচাতে পাত্রে ভরে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেন। সমুদের জল থেকে ছোট্ট পৃথুকে রক্ষা করেন লঙ্কার রাজা এবং তাকে বড় করেন। লঙ্কা রাজ্যেই সেই পুত্র জ্যোতিষশাস্ত্রে বিজ্ঞ হয়ে ওঠে। একদিন একটি গাভির বাচ্চা হওয়ার আগে তিনি বলেন, বাচ্চার রং হবে সাদা। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর দেখা যায় বাচ্চাটির রং গোলাপি। পৃথুয়াস তখন ক্ষোভ ও অপমানে তাঁর জ্যোতিষশাস্ত্রের সব বই সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, বাছুরটির রং সাদা হয়েছে এবং পৃথুয়াস তাঁর পূর্বানুমানের সঠিকতা খুঁজে পেয়ে আবার সমুদ্রের কাছে যান। কিন্তু আর তিনি তাঁর বইগুলো ফেরত পাননি। এদিকে পৃথুয়াসের স্ত্রীও জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পৃথুয়াস উজ্জয়িনীতে তাঁদের রাজ্যে ফিরে আসেন। বরাহমিহির তাঁর পুত্রবধূর এই অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ও জ্ঞান মেনে নিতে পারেননি। সিদ্ধান্ত হয় পুত্রবধূর জিব কেটে ফেলার। জিব কাটার আগে পৃথুকে তাঁর স্ত্রী নিজের সব জ্ঞান অভিজ্ঞতা শিখিয়ে যান। এই পাঠ্যের নামই খনার বচন। জিব কেটে ফেলার পরই পৃথুয়াসের স্ত্রী খনা নামে পরিচিতি পান।১৮

আখ্যান: ৫

বাংলাদেশের ঢাকাভিত্তিক নাট্যদল ‘বটতলা’ খনা নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ করছে। নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুত্ফা নিত্রা এবং নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২০১৩ সালের ২০ মার্চ নাটকটির ৩০ তম মঞ্চায়ন হয়। নাটকটিতে খনাকে জ্ঞান ও সত্যের এক অসাধারণ নারী সাধক ও সমকালীন বিদুষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যাঁর আরেক নাম লীলাবতী। খনা নাটকের কাহিনি অনুযায়ী, খনার স্বামী মিহির ও শ্বশুর বরাহমিহির। ভারতের চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতু গড়ের খনাকে নিয়েই কাহিনি এগিয়েছে। ইছামতী আর ভাগীরথী নদীবিধৌত প্রাচীনভূমি গঙ্গারিদ্ধি আর বালহন্ডার দেউলনগরের রাজা ধর্মকেতুর রাজজ্যোতিষী বরাহমিহির। একদিন নিজ সন্তান মিহিরের কোষ্ঠী গণনা করে তাকে তামার পাত্রে ভরে ভাসিয়ে দেন বিদ্যাধরীর জলে। পঁচিশ বছর পর লঙ্কাদ্বীপের রাজকন্যা খনা মিহিরকে নিয়ে বরাহমিহিরের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর গণনার ভুল প্রমাণ করেন। এরপর ধর্মকেতুর সভায় খনা ও মিহির রাজসভাপদ লাভ করেন। একসময় খনা তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে বরাহমিহিরের রোষানলে পড়েন। ক্রুদ্ধ বরাহমিহির ছেলেকে আদেশ দেন খনার জিব কেটে তাঁকে উত্সর্গ করতে। এভাবেই নাটকের কাহিনি এগিয়ে যায়।১৯

আখ্যান: ৬

পান্ডের (১৯৯০) বইতে ‘খনার জীবনী’ শিরোনামে যে কাহিনিটি আছে তা অন্য রকম। সেখানে বলা হয়েছে খনা সিংহলরাজ তনয়া। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সভায় নবরত্নের একটি রত্ন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ। পুত্র মিহিরের জন্মপঞ্জিকা গণনা করে তিনি দেখেন, পুত্রের আয়ু মাত্র এক বছর। তারপর পুত্র মিহিরকে তিনি একটি পাত্রে ভরে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেন। মিহিরকে উদ্ধার করে বড় করেন সিংহলরাজ। তাঁরা উভয়েই জ্যোতিষশাস্ত্রে অসাধারণ নৈপুণ্য লাভ করেন। গণনায় স্বীয় পরিচয় জেনে মিহির খনাসমেত জন্মভূমি দর্শনের জন্য উজ্জয়িনীতে আসেন। আসন্নপ্রসবা একটি গাভিকে দেখে খনা মিহিরকে কি রঙের বাছুর প্রসব হবে জিজ্ঞেস করেন। মিহির বলেন সাদা। কিন্তু বাছুরটির রং হয় কালো। মিহির তাঁর সঙ্গে আনা জ্যোতিষগ্রন্থ দুটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। জন্মের পর বাছুরটির শরীর যখন গাভিটি চেটে দিল, দেখা গেল আসলেই বাছুরটির রং সাদা। মিহির আবার সমুদ্রে গিয়ে তাঁর জ্যোতিষগ্রন্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হন। মিহির পিতার কাছে তাঁর পরিচয় দিলে বরাহ প্রথমে বিশ্বাস করেননি, কারণ গণনায় পুত্রের আয়ু মাত্র এক বছর ছিল। তখন খনা বলে, কিসের তিথি কিসের বার/ জন্ম নক্ষত্র কর আর/ কি কর শ্বশুর মতিহীন/ পলকে জীবন বার দিন। পুত্রবধূর যুক্তিতে বরাহর ভুল ভাঙে। মিহিরের স্থান হয় বিক্রমাদিত্যের সভায়। একদিন তাঁকে আকাশের তারা গুনতে বলা হয়। মিহির একদিন সময় চান। খনা আকাশে তারার সংখ্যা গণনা করে বলে দেন। রাজসভায় খনার ডাক পড়ে। প্রতিষ্ঠা ও সম্মানহানির আশঙ্কায় পিতার আদেশে মিহির খনার জিব ছেদন করেন ও খনার মৃত্যু হয়। বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন হলেন ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, কালিদাস, বরাহমিহির এবং বররুচি। ‘বরাহমিহির’ শব্দটি একবচনান্ত। কাজেই বরাহমিহির বলতে বরাহ এবং মিহিরকে বোঝায় না। তা ছাড়া প্রচলিত খনার বচনের ভাষা লক্ষ্য করলে এমন একটা ধারণা জন্মায় যে ওই ভাষা আনুমানিক দুই শ বছর আগের গ্রামবাংলার ভাষা।২০

আখ্যান: ৭

নওয়াজ (১৯৮৯) তাঁর খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি পুস্তকে খনাসম্পর্কিত উড়িয়া ভাষার নিম্নোক্ত২১ প্রচলিত কিংবদন্তি উল্লেখ করেছেন:

রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত বরাহ স্বীয় নবজাত সন্তানের অকালমৃত্যুর কথা ভুল গণনাবশত জেনে নবজাতককে একটি বাক্সে স্রোতে ভাসিয়ে দেন। এভাবে মৃত্যু থেকে নবজাতক পরিত্রাণ পেতে পারে—এমন একটি ধারণা পণ্ডিতের মনে ছিল। সে সময় অন্য একটি রাজ্যের অনিন্দ্যসুন্দর শিশু রাজকন্যা দ্বীপবাসী তথাকথিত বিদ্রোহী রাক্ষসদের আক্রমণে স্ববংশে পিতৃমাতৃহীনা হয়ে রাক্ষসদের কবলিত হন এবং তাদেরই আশ্রয়ে লালিত-পালিত হতে থাকেন। সেই অভাগী রাজকুমারীর নাম লীলাবতী। ওই দ্বীপবাসী বাক্সটিকে উদ্ধার করে নবজাতককে বড় করেন। লীলাবতী ও নবজাতক স্বর্গমর্ত্যপাতালবিদ্যায় পারদর্শী জ্যোতিষীর কাছে জ্যোতিষবিদ্যা আয়ত্ত করতে থাকেন। লীলাবতী নামগোত্রহীন শিশুটির নাম রেখেছিলেন মিহির। অবশেষে বয়োপ্রাপ্ত সুন্দর শিশুদ্বয় জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে গোপনে পরস্পরের পাণিগ্রহণ করেন। লীলাবতী ও মিহির দ্বীপ থেকে পলায়ন করেন এবং গণনায় জানতে পারেন, মিহির উজ্জয়িনী রাজসভার অন্যতম পণ্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র। তাঁরা বরাহমিহিরকে তাঁদের পরিচয় দেন এবং বরাহমিহির তাঁদের গ্রহণ করেন। ক্রমে জ্যোতিষশাস্ত্রে লীলাবতীর অগাধ জ্ঞানের কথা রটে যায়। রাজসভায় তিনি আমন্ত্রিত হন। লীলাবতীর জ্ঞান-গরিমা সভা পণ্ডিতদের ঈর্ষার বিষয় হয়ে পড়ে। বিশেষত বরাহমিহির তাঁর একাধিপত্য হারাতে থাকেন। বরাহমিহির একদিন পুত্র মিহিরকে পুত্রবধূর জিব কেটে খনা মানে বোবা বানিয়ে দিতে বলেন। নিরুপায় স্বামী লীলাবতীর জিব কর্তন করতে উদ্যত হন। জিব কর্তনের আগে মিহির লীলাবতীকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিলেন। লীলাবতী তখন কৃষি, আবহ-তত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বহুবিধ কথা বলে যান। পরবর্তীকালে সেসব কথা বোবার বচন বা খনার বচন নামে অভিহিত হয়।

আখ্যান: ৮

নওয়াজ (১৯৮৯) তাঁর খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি পুস্তকে খনাসম্পর্কিত নিম্নোক্ত বাংলা কিংবদন্তিটি উল্লেখ করেছেন:

খনা লঙ্কা দ্বীপের রাজকুমারী ছিলেন। শুভক্ষণে জন্ম বলে তাঁর নাম রাখা হয় খনা। লঙ্কা দ্বীপবাসী তথাকথিত রাক্ষসগণ তাঁর পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং শিশু খনাকে হস্তগত করে। একই সময়ে উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার প্রখ্যাত জ্যোতিষ পণ্ডিত বরাহমিহিরের পরিত্যক্ত পুত্র মিহিরকে একটি ভাসমান তাম্রপাত্র থেকে উদ্ধার করেন। রাক্ষসেরা উভয় শিশুকেই লালন-পালন করে। মতান্তরে বয়োজ্যেষ্ঠ খনাই মিহিরকে লালন পালন করেন। খনা ও মিহির জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হন এবং যৌবনে উভয়ে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। খনা খগোল শাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন গণনামতে জেনে তাঁরা রাক্ষসপুরী থেকে এক শুভক্ষণে উজ্জয়িনীতে চলে আসেন। জানতে পারেন, বরাহমিহিরই মিহিরের পিতা। তাঁরা আত্মপরিচয় দান করেন। বরাহমিহির এটি মেনে নিতে পারেন না। তখন খনা বচন দেন, কিসের তিথি কিসের বার/ জন্ম নক্ষত্র কর সার/ কি করো শ্বশুর মতিহীন/ পলকে জীবন বারো দিন। খনা বরাহমিহিরের গণনা ভুল প্রমাণ করেন। খনা জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যার সমাধান দিতে থাকেন। মহারাজ বিক্রমাদিত্য খনাকে রাজসভার দশম পণ্ডিত হিসেবে আসন দান করেন। এতে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পণ্ডিত বরাহমিহির পুত্রকে খনার জিব কর্তন করার আদেশ দেন। মিহির খনাকে এই আদেশের কথা বললে খনা সানন্দে এই শাস্তি মেনে নেন। পিতৃ আদেশে মিহির এক তীক্ষধার ছুরি দ্বারা খনাদেবীর জিব কর্তন করেন। মাত্রাধিক রক্তক্ষরণে অসামান্য বিদুষী খনার জীবন সাঙ্গ হয়। মতান্বরে শ্বশুর বরাহের অভিযোগে স্বামী মিহির খনাকে ভর্ত্সনা করেন। যে জিব বচন প্রচার করে খনার এ দুর্গতি, সে জিবকে খনা রন্ধনশালার ছুরি দিয়ে কেটে ফেলেন। ফলে মৃত্যু ঘটে। খনার কর্তিত জিব ভক্ষণ করে টিকটিকি গুপ্তজ্ঞান লাভ করেছিল।

খনার জীবনী নিয়ে ওপরের আটটি আখ্যান আমাদের জানান দেয়, উপস্থাপনের রাজনীতি ও ক্ষমতার গণিত কীভাবে নিম্নবর্গের আত্মপরিচয়কে আড়াল করে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়। খনার ‘কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি না’ এ নিয়েও দুর্ভাবনার শেষ নেই। মুক্তমনা ব্লগে ‘জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকার’ শিরোনামে রণদীপম বসুর খনাসম্পর্কিত একটি লেখা পাওয়া যায়। ওই ব্লগে লেখাটি ২৪ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে পোস্ট করা। লেখাটিতে রণদীপম উল্লেখ করেছেন, খনা নামে কেউ থাক বা না থাক, খনা নাম বা শব্দটি যে আজ কিংবদন্তি এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না।২২ খনা যদি সিংহলের রাজকুমারী হয়ে থাকেন এবং উজ্জয়িনীতে এসে বসতিস্থাপন করেন, তবে বাংলা এবং উড়িষ্যায় খনার বচনের এত প্রাদুর্ভাব কেন এ প্রশ্নটি খনা ও কৃষি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অধ্যাপক আলী নওয়াজও করেছেন। পাশাপাশি নওয়াজ (১৯৮৯) উল্লেখ করেছেন, মহাবংশ নামক সিংহলি প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে প্রকাশ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জনৈক বাঙালি রাজপুত্র সিংহলে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেন।২৩ একটি প্রাচীন সিংহলি পালি গ্রন্থে পাওয়া যায়, লীলাধিপতি অর্থাত্ রাঢ়াধিপতি সিংহবাহুর পুত্র বিজয়সিংহ পিতৃপরিত্যক্ত হয়ে তত্কালীন বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র সিংহলে বাণিজ্য করতে গিয়ে ক্রমে দারুণ প্রতিপত্তিশালী হয়ে সিংহলের অধিপতি হয়ে বসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ সিংহলে বহু শতাব্দী রাজত্ব করে। অতঃপর গণ-অভ্যুত্থানে এ রাজবংশের অবসান ঘটে। হতে পারে খনা সে বংশেরই দুর্ভাগা রাজকুমারী ছিলেন। এবং সে কারণেই তত্কালীন বাংলাদেশের ভাষা ছিল তার মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার সঙ্গে সিংহলি ভাষার মিলও দেখা যায়। সিংহলে বাঙালি রাজবংশটি কতকাল রাজত্ব করেছিল, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।২৪

‘উত্তর-পশ্চিম ভারতের চেয়ে পূর্ব ভারতের সঙ্গেই মগধের ভাষাগত রাজনৈতিক ও কৃষ্টিগত সম্পর্ক বেশি। ফলে খনা তাঁর বচন পাটলিপুত্রে অথবা বাংলাদেশেই লিখুন ভাষা অভিন্নই হবে। মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় বিবর্তিত রূপই প্রাচীন বাংলা। মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপই ছিল রাঢ়-বরেন্দ্র-সমতট-চট্টলের লোকায়ত ভাষা’।২৫ এ প্রসঙ্গে নওয়াজ (১৯৮৯) জানান, উজ্জয়িনীতেও খনার পক্ষে তত্কালীন বাংলায় বচন রচনা সম্ভবপর। কালিদাসের তালিকানুসারে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার সদস্য প্রায় অর্ধশত ছিল। গুপ্তরা ও কালিদাস বাঙালি হলে উজ্জয়িনীর জ্ঞান চর্চায় বাঙালি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ও উজ্জয়িনীকে জড়িয়ে শুধু খনা-মিহিরের কিংবদন্তি নয়, চণ্ডীকাহিনিও সৃষ্টি। চণ্ডীকাহিনির আদিভূমি বাংলাদেশ অথচ গুরুগোবিন্দের চণ্ডীগীতি অনুসারে চণ্ডী উজ্জয়িনীর রাজকন্যা।২৬ খনার বচনে বরাহের ভণিতাযুক্ত কয়েকটি বচন রয়েছে, আবার রাবণের ভণিতাযুক্ত কয়েকটি বচনও আছে। এ কারণেই হয়তো লঙ্কাকেও খনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। রাবণের ভণিতাযুক্ত বচনগুলো বহু খনার বচনের মতোই বিলুপ্ত।২৭

১৯৫৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত কৃষিকথা নামের একটি পত্রিকায় ডা. আবদুল গফুর সিদ্দিকী ‘খনার বচন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সে লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার বারাসাত মহকুমার দেগঙ্গা থানায় দেউলা নগর অবস্থিত ছিল। রাজা ধূমকেতুর প্রপৌত্র রাজা চন্দ্রকেতুর রাজত্বকালে রাজ্যটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। অতঃপর স্থানীয় লোকেরা স্থানটিকে দেউলে বলে অভিহিত করে। বিধ্বস্ত রাজবাড়ীর অনতিদূরে একখণ্ড জমি বরাহমিহিরের বাস্তু নামে পরিচিতি লাভ করে লোকের মুখে মুখে চলতে থাকে।২৮ ১৯৫৭ সালে কৃষিকথা পত্রিকায় ‘বিদুষী খনা’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন মেরাজ উদ্দিন আহমদ। সেখানে তিনি জানান, দেউলেনগরের আদি নাম ছিল কেতুগ্রাম। দেউলেনগরের রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ আজও পরিলক্ষিত হয়। স্থানীয় লোকদের মাঝে খনার বচন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আগে নাকি এ অঞ্চলে খনার বচনের পুঁথি পাওয়া যেত। আজ বিলুপ্ত। তবে লোকেরা উপজাতীয় জ্যোতিষীদের পুঁথিপত্র থেকে প্রচুর খনার বচন উদ্ধার করেছিল। আজকাল সেসব উপজাতীয় পুঁথিপত্রও নাই।২৯

গুপ্তযুগে বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশে অধুনাবিলুপ্ত বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তদ্রূপ খনার বচনও হতে পারে। এ সময় বাঙালির প্রতিভা ক্ষুরধার হয়ে ওঠে। খনার বচন যে মূলত অপভ্রংশে রচিত হয়েছিল, তা এর আগেই বলা হয়েছে। তা চর্যাপদেরও আগে হতে পারে। প্রতিটি ভাষাতেই সাহিত্য শুরু হয়েছে প্রবাদ ও ছড়া দিয়ে।৩০ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত অসমিয়া সাহিত্যের চানেকী শীর্ষক পুস্তকের প্রথম খণ্ডের ভূমিকা অংশে বলা হয়েছে,

ডাক ষষ্ঠ শতকে রচিত। অনেক পণ্ডিত ডাক ও খনার বচন সমসাময়িক বলে থাকেন।৩১ ১৪ শতক ও ১৫ শতকের দুজন বাঙালি জ্যোতির্বিদের গ্রন্থে খনার বচনের কিছু উদ্ধৃতি আছে, যাতে মনে হয় খনা ১৪ শতকের আগের। খনার বচনে বৈষ্ণব মতবাদের কি ভক্তিবাদের কোনো ছাপ নেই। তাই বলা যায়, এগুলো বৈষ্ণবধর্ম প্রবর্তনেরও আগের। সেন আমলের জ্যোতিষশাস্ত্র ধর্মনির্ভর ছিল। কিন্তু খনার বচনে কোনো দেবদেবী, পূজা অর্চনা, অধ্যাত্মবাদের কোনো উল্লেখ নেই, বরং ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ আছে। খনা সপ্তম শতকের আগের অনুমান করা যেতে পারে।

নিশ্চুপ বচন ও নিরুদ্দেশ পুঁথি

বলে গেছে বরাহের পো।

দশটি মাস বেগুন রো

চৈত্র-বৈশাখ দিবে বাদ

ইথে নাই কোনো বিবাদ

পোকা ধরলে দিবে ছাই।

এর চেয়ে ভালো উপায় নাই

মাটি শুকালে দিবে জল

সকল মাসেই পাবে ফল

পৌষে গরমি বৈশাখে ঝাড়া

পয়লা আষাঢ়ে ভরবে গাড়া

খনা বলে শোন হে স্বামী

শাওন ভাদ্রে নাইকো পানি৩২

ডাক দিয়ে বলে রাবণ

না রুবে কলা আষাঢ় শ্রাবণ

‘খনার বচন’ হিসেবে পরিচিত ওপরের তিনটি বচন খেয়াল করলে দেখা যায়, বচনের ভাষ্য অনুযায়ী একটি বচন খনার, একটি বরাহের পুত্র সম্ভবত মিহিরের এবং আরেকটি রাবণের। হয়তো খনার জন্মের আগে-পরের এ রকম অসংখ্য গ্রামীণ বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা ও নিরীক্ষণ ‘খনার বচন’ হিসেবেই একটি সমষ্টিগত জ্ঞানপ্রবাহ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হয়তো খনার অনেক বচন যেমন অনেকের নামে মিশে গেছে, আবার অনেকের অনেক সূত্র ও বচনও হয়তো খনার বচন নামে বিনির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের বইপুস্তকের দোকানে সচরাচর ‘খনার বচন’বিষয়ক কোনো বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি গ্রন্থাগারগুলোতেও নয়। খনার বচন সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে এমনই নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যদিও খনার বচনের জীবন্ত দলিল গ্রামজীবনের প্রবীণেরা। খনার বচন সংগ্রহের বিঘ্ন ও প্রতিকূলতা আলোচনা করতে গিয়ে নওয়াজ (১৯৮৯) জানান:

বর্তমান সামাজিক টানাপোড়েন, উত্থানপতন, ভাঙা-গড়া, অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও বিবর্তনের যুগে পুরোনো নীতিমালা ও মূল্যবোধকে মানুষ আর ছন্দোবদ্ধ কথায় স্মরণ রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। সে প্রয়াস ও মননশীলতা মানুষের আর নেই। এককালে ছড়া, শ্লোক ইত্যাদি যারা আওড়াতে পারত তাদের একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য ছিল। ক্রমে শ্লোক-ছড়া ইত্যাদির প্রচলন লুপ্ত হতে হতে গৃহিণীদের মাঝেই সীমিত হয়ে পড়েছিল। সে বৈশিষ্ট্যও আজ আর নেই। গ্রামবাংলা আজ প্রায় বিরান। শহরের সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য দেউলিয়া গ্রামগুলোকে প্রভাবিত করছে।৩৩

বিস্তৃত বাংলা অঞ্চলে গ্রামীণ ছড়া, গাথা, ধাঁধা, শ্লোক, পই, ডাক, ডিঠান, হীলুক, পুঁথি, রে-রে, আজিয়া, গীত, রয়্যানি, উভোগীত, পালা, বান্ধা, কিসসা, কাহিনি, ঝাড়া, মন্ত্র বা প্রবাদের মতো নানান রূপ ও ধাপে অস্তিত্বশীল হয়েছে নিম্নবর্গের জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন। চ্যাটার্জি (২০০৭) এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় অঞ্চলে মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্যধারা একসঙ্গেই বহুকাল ধরেই অস্তিত্বশীল।৩৪ মধ্যযুগের পাঁচালি নাট্যের কৃষির প্রসঙ্গ আমরা দেখতে পাই রিপনের (২০১০) বিদ্যায়তনিক গবেষণা অভিসন্দর্ভে।৩৫ এসব নির্মাণের সাথে পুস্তকী ধর্মের তেমন কোনো সংঘর্ষ বা নির্মাণ নেই। এসব নির্মাণশৈলীর একটি বস্তুবাদী চরিত্র আছে। অনেক সময় কিছু পুস্তকী বক্তাকে বলতে শোনা যায়, গ্রামীণ জ্ঞানরীতির আখ্যান ও বিস্তারসমূহ ‘ইসলাম ধর্মের পুস্তকি কায়দার সাথে যায় না’। কিন্তু মুসলমান সমাজের প্রচলিত অনেক প্রবাদ-প্রবচনেও কাককে নিয়ে শুভাশুভ নানা সংস্কার বিদ্যমান রয়েছে।৩৬ সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষার লোকাচারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হিরালি আচার, যা সমানভাবে মুসলিম কি হিন্দু, বাঙালি কি হাজং সব পরিবারেই পালনীয় কৃত্য। এ ক্ষেত্রে ফসল রক্ষাকল্পে কৃষক পেশাদার লোকতন্ত্রবিদকে দিয়ে লৌকিককার্য করে থাকে। চৈত্র মাস বা তার কিছু আগে কৃষকসমাজ মিলে লৌকিকবাদে বিশ্বাসী তন্ত্রগুরুকে নিমন্ত্রণ করে। হিরালি প্রথা প্রাচীনকাল থেকে ফসল রক্ষার হাতিয়ার। হিরালেরা ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে গৃহস্থের আঙিনায় তাঁর পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যানুসারে এমনিতেই চলে আসেন। হিরালি নিয়ে অনেক ছড়াও কৃষকসমাজে প্রচলিত রয়েছে। ভাটিবাংলার সুরমার পাড়ে/ হিরালির ঘর/ গাঁও গেরামে খুঁজে তারে কৃষকের অন্তর/ চৈত্র মাসে ঝড় তুফানে/ শিলাবৃষ্টির ডরে/ কৃষক সমাজ দৌড়ে যায়/ হিরাল বেটার ধারে।৩৭ সংক্ষেপে এই আলাপটি করে নিচ্ছি এজন্য যে এতে করে খনার বচনের রূপ ও নির্মাণশৈলীর ঐতিহাসিকতাটি বুঝতে সুবিধা হবে। এটি হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কোনো ঘটনা নয়। বা এমনও নয়, ১৪০০ বছর আগে এর শুরু হয়েছিল আর এখন এর কোনো চল নেই। খনার বচন নিরন্তর চারপাশের পরিবর্তনশীলতার তত্ত্ব-তালাশের ভেতর দিয়ে গ্রহণ-বর্জনের কারিগরিকে আগলে প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক শরীর ও মন নিয়ে বিরাজিত। কিন্তু অধিপতি ব্যবস্থায় আমরা কখনোই খনার এ বিজ্ঞানধারাকে বিকাশের জন্য কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা কি নাগরিক নজর অবারিত করিনি।

নওয়াজ (১৯৮৯) তাঁর লেখায় মানিকগঞ্জের পারিল গ্রামের এমন একটি তালপাতায় লিখিত খনার বচনের খোঁজ দিয়েছেন। পারিলের আচার্য গোপী ঠাকুরের বাড়িতে তালপাতার এ খনার পুঁথি ছিল। ঝড়বৃষ্টি তাড়াতে গোপী ঠাকুর এ পুঁথি নিয়ে জোরে জোরে পড়তেন।৩৮ তিনি আরও জানান, ময়মনসিংহের কোনো ঐতিহ্যশীল পরিবারের উচ্চশিক্ষিত কোনো ভদ্রলোক তাঁকে বলেছেন, তাঁদের বাড়িতে ৪০ বছর আগে পুঁথির আকারে ৪০০ থেকে ৫০০ পৃষ্ঠার খনার বচনের সংকলন ছিল। করিমগঞ্জ থানার জংগলবাড়ী গ্রামের ছন্দু মিয়া তবলা বাজিয়ে খনার গানের আসর করতেন।৩৯ উড়িয়া খনার বচন সংকলের প্রচ্ছদপটে একটি কল্পিত ছবি দেখা যায়- শিক্ষক টোলের ছাত্রদের খনার বচন পাঠ দিচ্ছেন। এ থেকে নওয়াজ (১৯৮৯) ধারণা করেন, হয়তোবা প্রাচীনকালে এভাবে খনার বচন জ্ঞানের বিষয় হিসেবে শিক্ষা দেওয়া হতো। তালপাতায় লিখিত খনার বচনের কাঠবাধা পুঁথি সেদিও পর্যন্ত দেখা গেছে, এমন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনও প্রমাণ পাওয়া যায়, তত্কালীন গ্রাম্য জমিদারেরা তবলা সংগত করে গীত খনার বচন আসরে গায়কের কণ্ঠে শ্রবণ করতেন। জ্যোতিষ, আবহ, কৃষি ও হোরা শাস্ত্র হিসেবে শিক্ষাদান ও সুরেলা ছন্দের জন্যে খনার বচন সম্ভবত সমাজদেহের রক্তমাংসে মিশে গিয়েছিল।৪০

ডা. আবদুল গফুর সিদ্দিকী খনা সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছিলেন এবং অনেক তথ্য ও বারো শ খনার বচন সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাঁর কলকাতার (২০ মহেন্দ্র রায় লেন) বাসা ভস্মীভূত হলে তাঁর পাণ্ডুলিপিসমূহও বিনষ্ট হয়। ডা. সিদ্দিকীর মতে, খনা পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁর বিবাহ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের দেউলা নগরে। ডা. সিদ্দিকীর মতে:

প্রাচীন দেউলা নগরের স্বাধীন নৃপতি ধূমকেতু রায়ের সভাপণ্ডিত বরাহ ও মিহির যথাক্রমে খনার শ্বশুর ও স্বামী। কিন্তু খনার অগাধ জ্ঞানের সম্যক পরিচয় পেয়ে রাজা খনাকেই প্রধান সভাপণ্ডিত হিসেবে নিয়োজিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পিতাপুত্র খনাকে জিব কেটে হত্যা করেন। তত্পূর্বেই খনা দেড় লাখ কৃষি ও জ্যোতিষসংক্রান্ত বচন লিপিবদ্ধ করেছিলেন কিন্তু তাঁর কোনো পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত প্রাপ্তব্য নয়। শংকরাচার্যের আজ্ঞানুসারে বহু বৌদ্ধগ্রন্থ ধ্বংস হয়েছিল বলে জানা যায়। একই কারণে খনার রচনাও ধ্বংস হতে পারে।৪১

নওয়াজ (১৯৮৯) তাঁর খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি বইতে লিখেছেন, খনা তাঁর কালজয়ী বচনে কৃষিতত্ত্বজ্ঞান সমাজের সম্মুখে বেদবাণীর মতোই উপস্থাপিত করেছেন। এককালে তা অশোক অনুশাসনের মতো কিংবা চাণক্য-শ্লোকের মতো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল কি না কে জানে। নচেত্ ভারতবর্ষের সমগ্র পূর্বার্ধে একটি মহিলার কথা জনসাধারণের নিকট এত ব্যাপক ও সুশৃঙ্খলভাবে জানা হলো কীভাবে? উল্লেখ্য, ডাক ও খনার বচন এককালে গীত হতো এবং জনসমাগমস্থলে খোদাই করে রাখা হতো।৪২ খনার বচনের মতো অসমিয়া ভাষায় ‘ডাক পুরুষের ভণিতাও’ পাওয়া যায়, ‘ডাকের বচন বেদর বাণী, পোলগা তিরী ঘরলৈ নানী’। অর্থাত্ ডাক পুরুষের তত্ত্বজ্ঞানসংবলিত বচনগুলোকেই ‘বেদবাণী’ অর্থাত্ প্রজ্ঞাবাণী বলে অভিহিত করা হয়েছে। তিব্বতি ভাষায় ডাক শব্দটির অর্থই জ্ঞান, ডাকের কথা মানে প্রজ্ঞা-বচন। সুতরাং বেদ এবং ডাক সমার্থক। তিব্বতি গ্রন্থ ডাকার্ণব মানে জ্ঞানসাগর। কারও কারও মতে, খনার বচন মানেও জ্ঞানের কথা এবং ডাকের মতো খনা শব্দটিও তিব্বতি। একই অর্থে তিব্বতি ভাষায় মূল শব্দটি সখম উচ্চারণ খন। উল্লেখ্য, উড়িয়া ভাষায় খনা মানে বোবা।৪৩

জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাসে খনার বিশেষ বিবরণ না পাওয়া গেলেও অনুমিত চতুর্দশ শতকের বাঙালি জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বরা ও ষষ্ঠীদাসের গ্রন্থে খনার বচনের উদ্ধৃতি রয়েছে। সংকলন খণ্ডের ‘জ্যোতিষ ও হোরা শাস্ত্র’ উপাধ্যায় দ্রষ্টব্য।৪৪ খনার অনুসারী জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বরা বা ‘গ্রন্থ সংগ্রহ’ গ্রন্থটি আনুমানিক চৌদ্দ শতকে রচিত হয়েছিল। বইটি রসিক মোহন চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক কলকাতা থেকে ইংরেজ আমলে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে প্রচুর খনার বচন, বিশেষত হোরা শাস্ত্রীয় বচনাদি উদ্ধৃত হয়েছিল। নওয়াজের (১৯৮৯) তথ্যমতে৪৫, খনার বচনের প্রকাশিত সংকলনের ভেতর পিএম ভট্টাচার্যের বৃহত্ খনার বচন সম্ভবত সর্বপ্রথম এবং ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত মধুসূদন ভট্টাচার্যের খনার বচন দ্বিতীয় সংকলন। এর পরেই শ্রী মহেন্দ্রনাথ করের সংগৃহীত সানুবাদ খনার বচন প্রকাশিত হয়। ১৮০৮ সালে বক্রেশ্বর ন্যায়রত্নের ডাক পুরুষের বচন ও ১৯০৪ সালে দুর্গাপতি মুখোপাধ্যায় সংগৃহীত ডাক পুরুষের কথা বর্ধমান থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে শরত্চন্দ্র শীল সংগৃহীত সানুবাদ জ্যোতিষরত্ন খনার বচন, ১৯২৬ সালে কালীমোহন বিদ্যারত্ন সংগৃহীত বরাহমিহির ও খনা এবং ১৯২৯ সালে পণ্ডিত সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যসংকলিত জীবনী ও মমার্থসহ খনার বচন প্রকাশিত হয়। বরাহমিহির ও খনা নামে শ্রীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের আরেকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৩৫২ বাংলায় দেবেন্দ্রনাথ মিত্র কর্তৃক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।

১৯৩১ সালে কলকাতা থেকে প্রাণতোষ কুমার রায় ও মানতা চক্রবর্ত্তীর খনার বচন নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত খনার বচন বইটি বাংলা ১৩৫১ সনে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে খনার বচনের বেশ কিছু পুস্তিকা বাংলা ভাষা ও হরফে প্রকাশিত। খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন (যদিও মলাটে পুস্তকটির নাম লেখা হয়েছে শুধু খনার বচন) নামে ভারতের কলকাতা থেকে পণ্ডিত রামপদ ভট্টাচার্যের (আচার্য) সংকলিত একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটিতে ১৭২টি খনার বচনসহ খনার জীবনী, যাত্রাকালীন শুভাশুভ বিচার, শস্য রোপণ প্রণালি, ঝড়বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বর্ষগণনা, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ ও মড়ক, ধর্মার্থে উপবাসের দিন, অতিবৃষ্টি, অতিবন্যা, শনির অবস্থানভেদে চৈত্র মাসের ফল, স্বামী-স্ত্রীর অগ্র-পশ্চাত্ মৃত্যুগণনা, গর্ভস্থ সন্তান পরীক্ষা, জন্মলগ্নের শুভাশুভ গণনা, পরমায়ু গণনা, প্রশ্ন গণনা, অন্নপ্রাশন, বিদ্যারম্ভ, উপনয়ন, বিবাহের শুভাশুভ কথন, আদ্যঋতুর বারফল, নক্ষত্রফল, গ্রহাদির গোচরফল, জন্মতিথি, ক্ষৌর কর্মাদি ও কর্ণবেধ, হাঁচি, টিকটিকির ফল, তিলতত্ত্ব, যতুকতত্ত্ব ও স্বপ্নতত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে বইটির অধিকাংশ অংশ বাংলাদেশ থেকে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত খনার বচন বইয়ের হুবহু অনুলিপি। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে প্রকাশিত উভয় পুস্তকই শুরু হয়েছে শূন্য কলসী শুকনা না বচনটি দিয়ে এবং শেষ হয়েছে সাত পাঁচ তিন কুশল বাত এই গণনা দিয়ে।৪৬ খনার বচন নিয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক পৃষ্ঠার একটি পুস্তকের নাম বৃহত্ খনার বচন (যদিও বইয়ের মলাটের ভেতরে বইটির নাম লেখা হয়েছে প্রাচীন ও বিশুদ্ধ খনার বচন)। মোট ৬৪ পৃষ্ঠার বইটি খুব সম্প্রতি ১৪১৫ বাংলায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীবাসব বিজয় দাস বইটির সম্পাদনা করেছেন এবং মানসী হালদার বইটি সংশোধন করেছেন। বইটিতে খনার প্রায় ২০০ বচন ও গণনা আছে।৪৭ তুষার কান্তি পাণ্ডের সম্পাদনায় চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী নামে কলকাতা থেকে ১৯৮৯-১৯৯০ সালে একটি বই প্রকাশিত হয়। তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ কান্তি চক্রবর্ত্তী, অর্ঘ্য দাশ ও স্বামী ভূমানন্দ পরমহংস বইটি সংকলন করেন। বইটিতে ১৭৬টি খনার বচন ও শ্লোক উল্লেখ করা হয়েছে।৪৮

বাংলাদেশ থেকে বিজয় রায় খনার বচন নামে ১৯৯০ সালে একটি পুস্তিকা৪৯ প্রকাশ করেন। এটি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন শ্রী বিজয় চন্দ্র রায়। একাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত মোট ৪৮ পৃষ্ঠার এ পুস্তকে ব্যাখ্যাসহ ১৩৭টি খনার বচন আছে। খনার বচনগুলোর পর বিবাহের শুভ কথন, জন্মতিথি প্রকরণ, হাঁচি ও টিকটিকির ফল, গ্রহগণের গোচরফল, স্পন্দন চরিত্র ও তিলতত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।৫০ ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল অধ্যাপক আলি নওয়াজের খনার বচন ও কৃষি বইটি প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গবেষণা প্রকল্পের অধীনে রচিত উক্ত গবেষণা পুস্তকে বাংলা, উড়িয়া, বিহারি, অসমিয়া, তেলেগু, কানাড়া ভাষা থেকে কৃষিপ্রবাদের উদ্ধৃতিসহ মোট ৪৩২টি বচন সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি বইটি প্রকাশ করে। কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সাহেবাবাদ, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীর শিমলা, রুদ্রগ্রাম ও পীরধানীখোলা ও দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জের মাধবপুর ও বোগদাইরহাট এ ছয়টি গ্রামে নির্ধারিত প্রশ্নমালার মাধ্যমে বিধিবদ্ধ নমুনা জরিপ চালিয়ে নওয়াজ (১৯৮৯) জানান, তিনটি জেলার মাত্র ৯% পল্লীবাসী পড়ে খনার বচন জেনেছে, অথচ খনার বচন সম্পর্কে জানে ৯৭% জন। তিনটি জেলার ৮৯% লোক জ্ঞাতসারে কি অজ্ঞাতসারে খনার বচন দ্বারা পরিচালিত। নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা ঢাকা থেকে ১০০টি খনার বচন দিয়ে ‘পকেট-বুক’ আকারের খনার বচন বইটি প্রকাশ করে।৫১ অরূপ রাহীর সম্পাদনায় খনার বিজ্ঞান নামে ২০০৬ সালে একটি বই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

জানা যায়, পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে ঢাকা কৃষি দপ্তর থেকে প্রকাশিত কৃষিকথা পত্রিকায় চাষাবাদে খনার বচনবিষয়ক কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। নওয়াজ (১৯৮৯) ঢাকা থেকে কৃষিকথা পত্রিকায় ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত খনার বচনসম্পর্কিত প্রবন্ধের একটি তালিকা দিয়েছেন।৫২ সে তালিকা অনুযায়ী এম এ মান্নানের ‘কলা চাষের ইতিবৃত্ত’, কলিম উদ্দিন আহমদের ‘প্রাচীন কৃষি সাহিত্য থেকে’, ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত শাহ ইসকান্দারের ‘খনার বচন ও চাষাবাদ’, ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত শাহ ইসকান্দারের ‘বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি খনার বচন’, মোহাম্মদ হানিফ পাঠানের ‘বচনে স্বাস্থ্য প্রসঙ্গ’ (১৯৫৯), জে এল সেনের ‘কৃষি ও পশুপালনের ছড়া-প্রবন্ধ (১৯৫৯)’, জে এল সেনের ‘কৃষিকার্যে খনার বচন (১৯৫৯)’, চৌধুরী গোলাম আকবরের ‘খনার বচন সংগ্রহ (১৯৬৩)’, চৌধুরী গোলাম আকবরের ‘ডাক ও খনা (১৯৬৩)’, হরিপদ পালের ‘খনার বচন’, আবুল কাছিম কেশরীর ‘খনার বচন’, আবুল ওয়াহেদের ‘খনার বচন’, কাশতকারের ‘গ্রাম্য প্রবাদ প্রবচন’, কাশতকারের ‘পান সম্পর্কে খনার বচন (নভেম্বর ১৯৫০)’, কুমুদ বিহারী মোহান্তের ‘কয়েকটি খনার বচন’, ‘কৃষিকথা’ (খনার বচন), এ কে আহমদ খানের ‘খনার বচন’, দেওয়ান গোলাম মর্তুজার ‘কৃষি বাংলার কয়েকটি ছড়া (১৯৬৩)’, দেওয়ান আবদুল হামিদের ‘ফসল ফলাও (১৯৬৭)’, ‘তিলের চাষে খনা’ ইত্যাদি লেখায় খনার বচনের প্রসঙ্গ ও আলোচনা উল্লিখিত হয়েছে। অবিভক্ত বাংলায় কিছু পদস্থ কৃষি কর্মকর্তা খনার বচনের অনুরূপ কৃষি ছড়া রচনা করেন এবং এসব কৃষিকথায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেসবের কোথাও খনার বচনের কোনো উল্লেখ বা সুপারিশ নেই। কোথাও কোথাও এমনও দেখা গেছে, খনার বচনকে মূল সূত্র ও অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে একটি প্রবাদ-কথায় পরিণত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নওয়াজ (১৯৮৯) জানাচ্ছেন, ‘আশুতোষ দেবের বাংলা অভিধানের পরিশিষ্টে প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহে কিছু খনার বচনও স্থান পেয়েছে। কিন্তু এসব বচনের কৃষিমূলক অর্থ বদলে সেখানে একটি প্রবাদমূলক অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন কুয়ো হয় আমের ভয়, তাল-তেঁতুলের কিবা হয়। এই খনার বচনের মানে কুয়াশায় আমের বোল ঝরে পড়ে ও আমের ক্ষতি হয় কিন্তু তাল ও তেঁতুলের ক্ষতি হয় না। এ বচনটির অর্থ করা হয়েছে মহতের বিপদের ভয় বেশি’।৫৩ বাংলাদেশের ঢাকা থেকে প্রকাশিত সুদর্শন ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা ১৪১৮, লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা ১৪১৮, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ১৪১৮, মোহাম্মদী পঞ্জিকার প্রথম ও শেষ অংশে বেশ কিছু খনার বচন ও অর্থ দেওয়া আছে।

খনার বচন এখন কেবল বাংলা পঞ্জিকা, পুস্তিকা কি মুদ্রণেই নেই, ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও তা দৃশ্যমান হচ্ছে। উইকিসংকলন নামের একটি বাংলা ওয়েবসাইটে (bn.wikisource.org) খনার ১৬৮টি বচন সংকলিত আছে।৫৪ বাংলা উইকিপিডিয়ায় (bn.wikipedia.org) ‘মার্চ ২০১০ তারিখ হতে উত্সবিহীন নিবন্ধ’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করে খনার বচন নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অনেকের মতে, খনা নাম্নী জ্যোতিবির্দ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী বাঙালি নারীর রচনা এ ছড়াগুলো’। ওই সাইটেও খনার বচনকে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য হিসেবে বিষয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে নমুনা হিসেবে ১২টি বচন উল্লিখিত হয়েছে।৫৫ রণদীপম বসু ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘...শব্দছেঁড়া কবিতারা’ শিরোনামে তাঁর একটি ব্লগস্পটে ১০০টি খনার বচন সংকলিত করেছেন, সূত্র হিসেবে তিনি নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা থেকে প্রকাশিত খনার বচন পুস্তকের কথা উল্লেখ করেছেন। রণদীপম বসু খনার বচনকে ‘খনার কৃষি ও ফলসংক্রান্ত বচন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।৫৬ ‘খনা’ নামের একটি ব্লগে ৮২টি খনার বচন দেওয়া হয়েছে, ওই ব্লগে মারভিক ও সালাহ উদ্দীন শুভ্র খনা ও খনার বচন নিয়ে কয়েকটি পোস্ট লিখেছেন।৫৭ রথীন্দ্র ভারতী ‘বাঙালি জ্যোতিষী’ নামের একটি ব্লগে খনার বেশ কিছু বচন উল্লেখ করেছেন।৫৮ ডিডব্লিউ-বাংলা (www.dw.de/bengali) নামের একটি ওয়েবসাইটে খনার বচন ও কৃষিসংক্রান্ত ‘বর্তমানকালে খনার বচনের গুরুত্ব’ শিরোনামে জাহিদুল হকের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি। ওই লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালকের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, খনার বচন লোকসাহিত্যের অংশ এবং দর্শন ও বিজ্ঞান আবিষ্কারের আগে থেকেই মানুষ লোকদর্শন আর লোকপ্রযুক্তির ব্যবহার করত। লেখাটিতে আরও জানানো হয়, বর্তমানে প্রায় দুই শ খনার বচনের প্রচলন রয়েছে।৫৯ প্রথম আলো ব্লগে ২৫ আগস্ট ২০০৯ তারিখে পোস্ট করা সালাহ উদ্দীন শুভ্রর ‘খনার বচনের ইতিহাস ও সমকালীন আলোচনা-প্রথম পর্ব’ শিরোনামে একটি লেখা পাওয়া যায়। শুভ্র তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, খনা মানে বোবা।৬০ ওই ব্লগেই ৪ আগস্ট ২০০৯ তারিখে পোস্ট করা শেখ নজরুলের ‘বোবাবিজ্ঞানী’ পোস্টটিও খনাকে নিয়েই লেখা। তিনিও তাঁর পোস্টে উল্লেখ করেছেন, খনা মানে বোবা।৬১ ‘ঝিঁঝিপোকা (zizipoka.com)’ নামের একটি ব্লগে ১০টি খনার বচন দিয়ে সেসবের মানেও উল্লেখ করা হয়েছে।৬২ রূপক রাসেল সামহোয়্যার ইন ব্লগে পাঁচটি খনার বচন নিয়ে ২ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে একটি পোস্ট লিখেন।৬৩

সামহোয়্যার ইন ব্লগে মরুভূমির জলদস্যুর দশটি খনার বচন নিয়ে আরও একটি পোস্ট দেখা যায়, যেটি ১৬ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে পোস্ট করা।৬৪ ‘খনা: এক কিংবদন্তি নারীর দুঃখগাথা’ শিরোনামে ব্লগার চয়ন ‘চতুমার্ত্রিক’ ব্লগে ২৪ নভেম্বর ২০১১ তারিখে পোস্টকৃত তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে জন্ম নেওয়া ইতিহাসের এক কিংবদন্তি খনা বা ক্ষণা। কোনো এক শুভক্ষণে তাঁর জন্ম বলে নাম দেওয়া হয় ক্ষণা। আর ‘ক্ষণা থেকেই ‘খনা’ নামের উত্পত্তি বলে মনে করা হয়।৬৫ ‘মুক্তমনা’ ব্লগে ‘জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকার’ শিরোনামে রণদীপম বসুর খনা-সম্পর্কিত একটি লেখা পাওয়া যায়। উক্ত ব্লগে লেখাটি ২৪ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে পোস্ট করা।৬৬

খনার বচনের সংখ্যাতাত্ত্বিক তর্কে আমরা যাচ্ছি না। কারণ, এটি খনার বিজ্ঞান-দর্শনকে জানা-বোঝার জন্য জরুরি নয়। বিজ্ঞান কোনো গরিষ্ঠতা, সংখ্যার মান কি জনমত দিয়ে নির্মিত হয় না। এটি বস্তুবাদী এক নিরীক্ষিত জীবনধারার বহমানতা। তবে খনার বচনের ক্ষেত্রে সচরাচর ‘হারানো বচন’ কি ‘বিলুপ্ত বচন’ বলে অনেক সময় যে জনক্ষোভগুলো উঠেছে সে জায়গাটিকে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে আমলে নিচ্ছি। কারণ, রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের বিজ্ঞান ও নিরীক্ষার সূত্র ও আওয়াজের ন্যায়বিচার সুরক্ষা করা। সেটি মুদ্রিত দলিলের ভেতর দিয়ে হবে না শ্রুতি আখ্যান হিসেবে বহমান থাকবে তা নির্ধারণ করবে চলমান সামাজিক সম্পর্ক ও জনগণের নথিভুক্তকরণের ব্যাকরণ।

খনার বচনের ‘অবধারিত’ পাঠ

ভাদরে আশ্বিনে না রুয়ে ঝাল

যে চাষা ঘুমিয়ে কাটায় কাল

পরেতে কার্তিক অঘ্রান মাসে

যদি বুড়ো গাছ খেতে পুঁতে আসে

সে গাছ মরিবে ধরিবে ওলা

পাবে না মাল চাষার পোলা৬৭

(ওপরের খনার বচনের অর্থটি এমন যে, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে লঙ্কার চাষ করলে ফল ভালো হয়। তা না করে যদি আলস্যে সময় কাটিয়ে কার্তিক-অঘ্রান মাসে চাষ করা হয়, তাহলে ধসা রোগে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। লঙ্কা পাওয়ার কোনো আশাই থাকে না।)

সচরাচর আমরা দেখি, খনার বচন প্রসঙ্গে আলাপের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ‘কৃষিবৃত্তি’, ‘আবহাওয়া’ ও ‘লোকসংস্কৃতি’। ‘সবার জন্য লোকায়ত জ্ঞান’ শিরোনামে ডি-নেট নামের একটি সংগঠনের ওয়েবসাইটে লোকায়ত জ্ঞানের ছয়টি ক্ষেত্রের ভেতর একটিকে বলা হয়েছে সাহিত্য উপকরণ। আর সাহিত্য উপকরণের অংশ হচ্ছে প্রবাদ, রূপকথা ও প্রথা।৬৮ খনার বচন নিয়ে চৌধুরী (২০০০) যেমন জানান, খনার বচন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এগুলো মূলত লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতিরই এক ভগ্নাংশ। হাজার বছর ধরে এগুলো মানুষ লোকপরম্পরায় ধরে রেখেছে। এটি সম্ভব হয়েছে এগুলোর ছন্দে চমত্কারিত্বের জন্য। প্রকৃতপক্ষে এ বচনগুলো হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের মতোই পুরোনো। অনেকে অনুমান করেন, খনা অন্তত দেড় লাখের মতো বচন রচনা করেছিলেন।৬৯ তার মানে খনার বচনকে অনেকেই ‘সাহিত্য’ বিশেষত লোকসাহিত্যের বিষয় হিসেবেই দেখতে পছন্দ করেন। এসব চিন্তার ভেতর দিয়ে সচরাচর একটি ‘অন্যথা’ তৈরি হয়। কারণ, অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডে গ্রামীণ সমাজের চিন্তাজগত্ কোনো বিজ্ঞান কি দর্শনের কারিগর নয়।

পাশাপাশি সেন (২০০৮) জানান, খনার বচন গ্রামীণ কৃষকদের দ্বারা স্বীকৃত এবং এখনো বর্তমানের ‘আধুনিক কৃষিচর্চার ক্ষেত্রে’ কিছু কিছু বচন অনেক কৃষক মেনে চলেন। হাজার বছর আগের বাংলার জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ, মাটি, আবহাওয়া ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা খনার বচন লোকায়ত কৃষির এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ।৭০ সিং (২০০৮) তাঁর আ হিস্ট্রি অব অ্যানশিয়েন্ট অ্যান্ড আর্লি মেডিয়াভাল ইন্ডিয়া: ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু দ্য ১২ সেঞ্চুরি  বইতে ডাক ও খনার বচনকে ‘প্রাচীন বাংলার জনপ্রিয় কৃষি ভাষ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। খনাকে বরাহমিহিরের পুত্রবধূ হিসেবে পরিচয় দিয়ে লিখেছেন, খনা ও ডাকের বচন বাংলার মাটি ও জলবায়ুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এমনকি তা এখনো বাংলার কৃষকের কৃষির নির্দেশনা দিতে সহযোগিতা করছে।৭১ আমাদের প্রতিষ্ঠিত মনস্তত্ত্বে খনাকে আমরা আমাদের বিন্যাস ও রীতি-প্রক্রিয়া দিয়ে পাঠ করতে চাই। খনার বিজ্ঞান বচনের দর্শনভিত্তি ও তাঁর কাজের লড়াকু ইশতেহার পাঠ কি চর্চা আমাদের খনাপাঠের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না অধিকাংশ সময়। তাই চৌধুরী (২০০০) খনার বচন-সম্পর্কিত একটি লেখায় আশ্চর্যজনকভাবে উল্লেখ করেন, বাংলা বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে খনার খুব বেশি বচন নেই। কেননা এগুলো প্রধানত জলবায়ু, আবহাওয়া, কৃষি, কৃষক, কৃষিকার্যের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি ইত্যাদিনির্ভর। আর যেহেতু বৈশাখ ফল-ফসলের তেমন মাস নয়, রবিশস্যেরও নয়, সে কারণেই বৈশাখকে নিয়ে বচন তৈরি করার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না খনার।৭২ খনা একটি অধিপতিশীল সমাজকাঠামোয় নিম্নবর্গের বিজ্ঞানচৈতন্য ও নিরীক্ষাকে যে কায়দায় জনভাষ্যে পরিণত করার সাহস দেখিয়েছেন, তা কোনোভাবেই স্বীকৃত হয়ে ওঠে না। শেষমেশ খনাকে কেবল ‘গ্রামের লোকদের চাষ-বাস করার কিছু নির্ঘণ্ট ও নির্দেশিকার’ লোক-রচয়িতা হিসেবেই আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

বন্দ্যোপাধ্যায় ও চক্রবর্তী বাংলার কৃষি বিস্তারে খনার বচনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, কৃষিবিজ্ঞান দীর্ঘ সময়ের আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে। খনার বচনও দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীনকালের এক কৃষিবিজ্ঞান।৭৩

ধান, কলা ও গরুকে খনার বচনে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অধিকসংখ্যক বচন রচিত হয়েছে। এ ছাড়া খনা নানা জাতের ধান, সরিষা, বেগুন, মরিচ, লাউ, শসা, পটোল, শিম, আলু, কচু, বাঁশ, তিল, তাল, উচ্ছে, পুঁই, মরিচ, কার্পাস, কুল, বেল, নিম, নিশিন্দা, বাসক, জাম, শাল, মান্দার, চাঁপা, বক, বকুল, মটর, কালাই, মুলা, ধান, মিষ্টিকুমড়া, হলুদ, আম, কলা, তামাক, নারিকেল, খেজুর, আখ, মানকচু, আদা, ওলকচু, পাট, চালকুমড়া, তুলা  এ রকম নানা শস্য ফসল চাষের সময়কাল, বীজ কি চারা বপন-উত্তোলন-কাটার সময়কাল, পরিচর্যা, ব্যবস্থাপনা, চাষপদ্ধতি, নিত্য পর্যবেক্ষণ ও দুর্যোগ আন্দাজ করে ফসল রক্ষা প্রস্তুতি বিষয়ে অনেক ধরনের বচন দিয়েছেন। পাশাপাশি মাটি, আবহাওয়া, ঋতুর অদলবদল, মেঘ-বৃষ্টির শ্রেণীকরণ ও সময় নির্ঘণ্ট, আবহাওয়ার আন্দাজ, দুর্যোগ ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনের আগাম প্রস্তুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুঃসময়ের আগাম হিসাবনিকাশ, প্রাকৃতিক নির্দেশনা, তারাগণনা, জ্যোতিষশাস্ত্র, স্বাস্থ্য ও জীবনপ্রণালি, প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সম্পর্ক এ রকম নানা বিষয় গ্রামীণ গার্হস্থ্যজীবনের নিত্যদিনের কলা ও রীতিকে এক সর্বস্তরের বিজ্ঞানভাবনা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

খনার বিজ্ঞান-দর্শন

কিসের তিথি কিসের বার

জন্মনক্ষত্র কর সার

কি কর শ্বশুর মতিহীন

পলকে জীবন বারো দিন।

(পরমায়ু গণনাবিষয়ক খনার এ বচনটিতে বলা হয়েছে, যে নক্ষত্রে কোনো মানুষের জন্ম, তদবধি বাকি তার যত পরিমাণ, প্রতি পলে বারো দিন ধরে পরমায়ু গণনা করতে হয়।৭৪

ধরা যাক চিত্রা নক্ষত্রে কারও জন্ম হলো। মনে করা যাক ২০ দণ্ড আর বাকি আছে। ৬০ পলে এক দণ্ড। ২০ কে ৬০ দিয়ে গুণ করতে হবে।

গুণফল ১২০০ পল হয়। ১২০০ পলকে বারো দিয়ে গুণ করতে হবে। ১৪৪০০ দিন হয়। একে ৩৬৫ দিন দিয়ে ভাগ করলে পরমায়ু বছর বের হয়।)

৬০ পলে ১ দণ্ড, ২০ দণ্ড = ২০ ঢ ৬০ = ১২০০ পল

১ পল = ১২ দিন, ১২০০ পল ঢ ১২ দিন = ১৪৪০০ দিন

৩৬৫ দিন = ১ বছর, ১৪৪০০ % ৩৬৫ দিন = ৪০ বছর

অতএব জাতকের আয়ু = ৪০ বছর

খনার বচন কি বিজ্ঞান? এ প্রশ্ন দিয়ে আলাপটি শুরু হচ্ছে না। বরং খনার বিজ্ঞান-দর্শনের ভেদটি বোঝার জন্য চারধারের ক্ষমতার রাজনীতির ঐতিহাসিকতাও এখানে টেনে আনা হচ্ছে। খনার বচন ও খনার কাজের বিজ্ঞান-দর্শন নিয়ে আলোচনা একেবারেই আমরা দেখতে পাব না। সেন (২০০৮) খনার বচন ও লোকায়ত কৃষির প্রভাব শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, খনার সব বচনই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত নয়। বিশেষত জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতিবিজ্ঞানের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অনেক বচনকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা কঠিন।৭৫ আবার খনার বচনের বিজ্ঞানভাবনা ও দর্শন নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন চিন্তাও কখনো কখনো প্রকাশ করেছেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে চৌধুরী (২০০০) লিখেছেন, খনাই এ দেশে সর্বপ্রথম কৃষি ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বচনের জাদুকরি স্পর্শে। বলাবাহুল্য, আজও পল্লী বাংলায় খনার বচনই ‘কৃষি দর্শন’ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বাংলার কৃষকেরা এ দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ফসল বোনেন, লাগান ও কাটেন। কৃষি ঐতিহ্য খনারই অবদান।৭৬ ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও দিনাজপুরের কয়েকটি গ্রামে নমুনা জরিপ চালিয়ে নওয়াজ (১৯৮৯) মন্তব্য করেছেন, গ্রাম-বাংলার জীবন-দর্শন আজও খনার বচনের আদর্শেই বাঁধা।৭৭

চৌধুরী (২০০০) খনার বচন নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন, খনার বচনে কোনো সংস্কার বা কুসংস্কার লক্ষ্য করা যায় না। এগুলো মোটামুটি বৈজ্ঞানিক। এবং অভিজ্ঞতা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণসম্মত।৭৮ ২০০৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে ‘খনার বচন কেন বিজ্ঞান’ প্রশ্নটি নিয়ে ‘কবিসভা’ নামের একটি ইয়াহু গ্রুপ সাইটে রহমান নাসির উদ্দীনের একটি লেখাকে ঘিরে কিছুটা আলোচনা উঠেছিল। সেখানে তপন কুমার বাগচী, কন্থৗজাম সুরঞ্জিত, অরূপ রাহী, রহমান নাসির উদ্দীন অংশ নেন।৭৯ রাহী (২০০৬) তাঁর সম্পাদিত পুস্তক খনার বিজ্ঞান- এ  লিখেছেন:

অনেকের মতে খনা কেবল ‘লোকবচন’ বা ‘লোকশাস্ত্র’। খনার কাজকে বিজ্ঞানের চর্চা বলতে অনেকে নারাজ। আমরা খনার কাজকে বিজ্ঞান বলতে চাই। খনা কেন বিজ্ঞান? বিজ্ঞান বিষয়ে লম্বা তর্কে এখানে ঢোকার সুযোগ নেই। আমরা এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই, খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে, তার চর্চার একটা বিকাশশীল পদ্ধতি আছে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ জ্ঞান উত্পাদন করে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ সত্য উত্পাদন করে।৮০ 

কিন্তু আমরা খোদ খনার বচন ও তার নিম্নবর্গীয় চর্চা বাদে ‘বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাণ্ডের’ কোথাও খনার বচনের বিজ্ঞান সূত্র ও বিজ্ঞান-দর্শনের কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখতে পাই না। খনার বচনের ‘আদর্শ’, ‘কৃষিদর্শন’, ‘কৃষিঐতিহ্য’ এসব প্রত্যয় আমরা খনার বচনের আলাপ ঘিরে উঠতে দেখি। যদিও এসবের ভেতর দিয়ে নিম্নবর্গের খনাচর্চা বহমান থাকছে। কিন্তু খনার বিজ্ঞান-দর্শনের সূত্রটিকে আমরা অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডে এখনো মজবুত কায়দায় পাল্টা বিজ্ঞান আওয়াজ হিসেবে তুলতে পারিনি।

বিজ্ঞান প্রসঙ্গে ইসলাম (২০১৩) তাঁর বিজ্ঞানের দর্শন বইতে লিখেছেন:

বিজ্ঞান নির্ভেজাল বস্তুতান্ত্রিক। বস্তুহীন বিজ্ঞান কল্পনার অতীত। বিজ্ঞানে ভাববাদী ও বস্তুবাদী এমন কোনো বিভাজন নেই। বিজ্ঞান এক শ ভাগ বস্তুবাদী। আমরা দেখেছি, গ্রিক সভ্যতার শুরুটা ভালোই ছিল। থেলিস, লিউসিপ্পাস, ডেমোক্রিটাস, অ্যানাক্সিগোরাস, অ্যানাক্সিমিনিস, জেনোফেন প্রমুখ প্রাকৃতিক দার্শনিকের হাতে বিজ্ঞানের আদিরূপের উন্মেষ ঘটতে থাকে। তাঁদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আধিভৌতিক কোনো সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নয়, তাঁদের আগ্রহের প্রধান জায়গা প্রকৃতি, অর্থাত্ বস্তু। যুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির অদৃশ্য রহস্য উদ্ঘাটনে তাঁরা যত্নবান হন এবং অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। রোদ-বৃষ্টি-জল-ঝড়-ভূমিকম্প-অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ তাঁরা প্রকৃতির মাঝেই খোঁজেন। হিপোক্রিটাস (৪৬০-৩৭৭ খ্রি.পূ.) গ্রিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের গুরু ও পাশ্চাত্য চিকিত্সাবিজ্ঞানের জনক। তাই তাঁরা সবাই প্রকৃতি দার্শনিক। তাঁদের সে অনুসন্ধানের প্রধান অস্ত্র ছিল যুক্তি এবং সে যুক্তির প্রয়োগ দেখে আইনস্টাইন বিস্মিত হয়েছিলেন।৮১

খনার বচন সম্পূর্ণতই যাপিতজীবনের বস্তুবাদিতা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। খনার এমন কোনো বচন নেই, যেখানে তা ধর্মের আশ্রয়ে আশ্রিত হয়েছে। বা স্থানীয় কোনো বিমূর্ত রূপ প্রকাশ করেছে। খনার বচন কোনোভাবেই হিন্দু কি মুসলমান, বাাঙলি কি আদিবাসীর আখ্যান হয়ে দাঁড়ায়নি। নওয়াজ (১৯৭৯) তাই বাংলাদেশের তিনটি জেলায় খনার বচন ও কৃষির ওপর এর প্রভাব নিয়ে রচিত বইতে উল্লেখ করেছেন, ডাক ও খনার বচনের সৃষ্ট ঐতিহ্য এ দেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানদের ওপর থেকে ইসলাম বিলুপ্ত করে দিতে সমর্থ হয়নি।৮২ কারণ, খনার বচনের এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি কি দর্শনভিত্তি ছিল না। এটি এ দেশের নিম্নবর্গের বহমান বিজ্ঞানসূত্র, যা বচনের ভেতর দিয়ে এক বস্তুবাদী দার্শনিকতার পাটাতন প্রস্তুত করেছে। অবস্তুবাদী কোনো সূত্র কি প্রত্যয় খনার বিজ্ঞান-দর্শনের বিষয় হতে পারেনি।

ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) সম্পর্কে জে ডি বার্নাল বলেন, ‘মধ্যযুগীয় বিজ্ঞান থেকে আধুনিক বিজ্ঞানে উত্তরণের পথের বাঁক ফেরার সন্ধিলগ্নে বেকন ও দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) আবির্ভাব হয়। এঁরা দুজনেই ছিলেন ভবিষ্যত্দ্রষ্টা এবং বার্তাবহ’।৮৩ বেকন জানিয়েছেন, ‘আমাদের চেতনা এবং উপলব্ধির চেয়ে প্রকৃতি অনেক বেশি সূক্ষ্ম। তাই চটকদার অনুধ্যান, দূরকল্পনা এবং মানুষ সম্পর্কে যেসব তত্ত্ব প্রচলিত আছে, সেগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম ছাড়া কিছু নয়। শুধু প্রকৃতির পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর এবং তাকে পর্যবেক্ষণ করার কেউ নেই’।৮৪ বেকন কি খনা, খনা কি বেকন এরূপ কোনো মাপকাঠি দিয়েই আমরা বিজ্ঞান-দর্শনের আলাপে বসিনি। আমরা কেবল কিছু ঐতিহাসিক সূত্র ও নথিকে আলাপের সাথি করছি আমাদের জানাবোঝার গণ্ডির বিস্তার ঘটাতে। কারণ, নওয়াজের (১৯৮৯) লেখা থেকে পাই, ‘খনার বচন আজ আর কোনো ব্যক্তিসত্তার সাক্ষ্য নয়, বরং বাঙালি জাতি তথা পল্লিবাসীদের নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য’।৮৫ খনা কি খনার বচন তাই আর কোনো ব্যক্তির বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, এটি একটি তত্ত্ব ও দর্শন-প্রক্রিয়াকে সামনে নিয়ে এসেছে। উপস্থিত করেছে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিরীক্ষা ও চর্চার বিজ্ঞানকে। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, কেবল খনা নন, এখনো খনাবাদী৮৬ গ্রামীণ নিম্নবর্গ চারপাশের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে এক বৈজ্ঞানিক কারিগরির ভেতর দিয়েই।

খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শনকে আলাপের কেন্দ্রবিন্দু করে পার্থ (২০১২) ‘জলবায়ু পঞ্জিকার পরিবর্তন’ শীর্ষক তাঁর একটি লেখায় বলেছেন:

চাকমা সমাজের রাধামন-ধনপুদী, মান্দি সমাজের দিগ্গি-বান্দি বা শেরানজিং, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সমাজে রাসপালা, হাজং সমাজের জাখামারা গীত বা সুন্দরবনের গাজীর পট, বিল এলাকার মনসামঙ্গল, হাওর জনপদের ধামাইল বা বান্ধা কি মৈমনসিংহ গীতিকা বা কিসসা-কাহিনি-পই-প্রবাদ-ডাক-ডিঠান-শ্লোক বা খনার বচন চারপাশের পরিবর্তনশীলতাকে ঠাহর করে রচনা করে নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের ইতিহাস। সেই যাপিতজীবনের ঝাঁঝ থেকেই জনগণের ভাবনার ভাষা এবং সূত্রগুলোকে জানাবোঝা করা জরুরি। কারণ, বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোকে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে কখনোই প্রান্তিকজনের ভাবনাকে জানাবোঝার জায়গা তৈরি হয় না। এ জনপদের প্রান্তিক জীবনের নিজস্ব ভাবনার সূত্রসমূহ সব অধিপতি ঝাঁঝকে প্রশ্ন করতে জানে নিজস্ব ভঙ্গিমায়, জানে প্রকৃতির নিরন্তর চলমান অস্তিত্বময়তার সঙ্গে কোনো ধরনের অধিপতি আচরণ না করে এই সম্পর্ক বিরাজমান এবং বিকাশমান করে তুলতে হয়।৮৭

এ পর্যায়ে আমরা ফ্রান্সিস বেকনের আরও একটি আলাপ জুড়ে দিচ্ছি। বেকন জানিয়েছেন, আমাদের কেবল বেশিসংখ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খোঁজ করলেই চলবে না। আমাদের সম্পূর্ণ পৃথক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রবর্তন করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তাকে শক্তিশালী করতে হবে। যেমন আমরা আগেই দেখেছি, অস্পষ্ট ও স্বেচ্ছাচারী পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা তেমন কোনো সুফল অর্জন করা যায় না। কেবল অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোই সার হয়। তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকলেও শিক্ষণীয় কিছু থাকে না। কিন্তু অভিজ্ঞতা যখন যৌক্তিক পথ অনুসরণ করে এবং সুসংবদ্ধ হয়ে ওঠে, তখন বিজ্ঞান সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠতে পারি।৮৮ আমরাও দেখতে পাই খনার বচনের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিকতা। চড়াই-উতরাই। খনা বারবার প্রতিষ্ঠিত অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডকে প্রশ্ন করেছেন। খনা বারবার প্রশ্ন করেছেন, কি কর শ্বশুর মতিহীন, কি কর শ্বশুর লেখাজোখা? খনা তাঁর বিজ্ঞান-দর্শনকে এক নিম্নবর্গীয় ময়দান থেকে একটি সংঘবদ্ধ ডিসকোর্সে রূপ দিয়েছেন। আলাপের এ অংশটিতে আমরা একটি খনার বচন হাজির করছি।

খনার একই বচন দেশের নানান অঞ্চলে নানানভাবে বর্ণিত, ভাষা কি বলার ভঙ্গি ও কায়দায় স্থানীয় আমেজ থাকলেও বচনের অর্থ বদলে যায় না। দেশের নানা অঞ্চলে প্রচলিত নিচের বচনটি৮৯ খেয়াল করুন:

কিতা করঅইন হউর লেখালেখি

মেঘই বুঝঅইন পানির আঁকি।

কোদাল কোপা মেঘের গাও

আড়ি সারি বয় বাও।

কিষান কামলা বান্ধো আইল

আইজ কিংবা অইবো কাইল৯০

(মৌলভীবাজার অঞ্চল)

কি কর শ্বশুর লেখাজোখা

মেঘেই বুঝবে জলের রেখা।

কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা

এধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা।

কৃষককে বলোগে বাঁধতে আল

আজ না হয় হবে কাল৯১

(মৌলভীবাজার অঞ্চল)

কি কর শ্বশুর লেখা জোখা

মেঘেই বুঝব জলের রেখা

মেঘ হয়েছে কোদাল কাটা

বাতাস দিচ্ছে লাটাপাটা।

কি করিস চাষা বাঁধগে আল

আজ না হয় ত হবে কাল।

(রংপুর অঞ্চল)

কোদালে কুড়লে মেঘের গা

এলোমেলো বহে বা।

চাষীকে বলো বাঁধতে আল

আজ না হয় হবে কাল

(চট্টগ্রাম অঞ্চল)

কোদলা কোদলা মেঘের গা

এ্যাঝে মাঝে দিচ্ছে ঘা।

কৃষক ভাই বান্ধো আইল

আইজ না হইলে হইব কাইল

(নেত্রকোনা অঞ্চল)

কোদালে কুড়ালে মেঘের গা

উল্টাপাল্টা বহে বা।

খনা বলে বাঁধ আল

আজ না হয় বৃষ্টি হবেই কাল

(বগুড়া অঞ্চল)

কি কর শ্বশুর লেখাজোখা

মেঘেই বুঝবে জলের রেখা।

কোদালে কুড়লে মেঘের গা

এধ্যি মধ্যি দিচ্ছে ঘা।

বলগে চাষায় বাঁধতি আল

আজ না হয় হবি কাল।

(যশোর অঞ্চল)

গাইবান্ধার যমুনার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের মেঘবিজ্ঞান ভাষ্যমতে, যমুনা চরের আসমানে ছয় ধরনের মেঘ দেখা যেত আগে। বোয়ালি মেঘ, কানা মেঘ, হাঁড়িয়া মেঘ, পাইন্যা মেঘ, ঝাঁপাই মেঘ ও কালবৈশাখী মেঘ। গত চল্লিশ বছরে মেঘের এই বৈচিত্র্য ও বিন্যাস বদলে গেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের তিন দিন থেকে আষাঢ়ের চার দিন টানা সপ্তাহজুড়ে ঝাঁপাই মেঘ জমত আসমানে, আকাশ ধুমা থাকত, ঝিরঝির বৃষ্টি হতো। এখন আর ঝাঁপাই মেঘ দেখাই যায় না। বোয়ালি মেঘ অনেকটাই কোদালি মেঘের মতো। ছোপ ছোপ মেঘ জমে এবং বেশ বৃষ্টি হয়।৯২ উপরোক্ত খনার বচনটি দেশের নানান অঞ্চলে প্রচলিত থাকলেও এর অর্থ কিন্তু বদলে যায়নি। বিজ্ঞান তাই এমনি এক ভূগোল নিরপেক্ষ সত্য, এটি বস্তুকে কেন্দ্র করে বস্তুকে ঘিরে বস্তুর আদ্যপ্রান্ত ব্যাখ্যা করে। এক অঞ্চলের মানুষ এটি বিশ্বাস করছে, আরেক অঞ্চলের মানুষ এটি বিশ্বাস করছে না তাতে বিজ্ঞানের সত্য ও দর্শনের কোনো কিছু যায় আসে না। বিজ্ঞান জনমত কি গণভোটের ওপর নির্ভর করে না। এটি নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু প্রশ্ন আসে, তাহলে কেন প্রান্তর থেকে প্রান্তরে, এক ভূগোল ছাপিয়ে অন্য ভূগোলের মানুষেরা খনার বিজ্ঞানকে যাপিতজীবনের অংশ করেছে? কেন খনার বিজ্ঞানও কাল থেকে কালে গ্রামবাংলার জনভাষ্যে পরিণত হয়েছে? আর এখানটাতেই খনার বিজ্ঞানের দার্শনিকতার প্রশ্ন। খনার বিজ্ঞান চারপাশের সূত্র ও প্রশ্নকে দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু করেছে। সেখান থেকেই উত্তরণ কি সমাধানের আপন উপায় কি নির্দেশনা খুঁজে পেতে চেয়েছে। প্রক্রিয়া হিসেবে এটি অধিপতি জ্ঞানকাণ্ড ও সব ঔপনিবেশিক ধারাবিরোধী। এখানে নিম্নবর্গের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক প্রতিরোধী নিশানা আছে। সেন (২০০৮) তাই ‘বাংলার ঐতিহ্যগত কৃষিতে খনার বচনের গুরুত্ব’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে বলেন, ‘বাংলা অঞ্চলের কৃষিকে খনার বচন অনেক বেশি প্রভাবিত ও প্রসারিত করেছে। খনার বচন এ অঞ্চলের কৃষি জলবায়ু, ভূমি, মাটি, আবহাওয়া ও কৃষকের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার অনেক কাছাকাছি’।৯৩

 অনেকেই বলে থাকেন ‘খনার বচন’ হচ্ছে স্থানীয় বা লোকায়ত জ্ঞান। জ্ঞানপাটাতনের এই রাজনীতি মাথায় রেখেই আমরা আলাপের এ অংশে ঢুকছি। পার্থ (২০১০) বান্দরবানের ম্রো জাতির ‘ইঁদুর বন্যা ও জুমবিজ্ঞান’বিষয়ক এক গবেষণায় অধিপতি ও প্রান্তিক জ্ঞানকাঠামোর এ বিবাদকে আলোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাণ্ডসমূহ স্থানীয় জ্ঞানকে প্রান্তিক করে তোলে আর ‘বিজ্ঞানের সত্য’ হিসেবে তাকে মেনে নিতে ভিন্ন ভিন্নমাত্রার বলপ্রয়োগ তৈরি করে।৯৪ গির্টজ (১৯৯২) যদিও ‘স্থানীয় জ্ঞান’ নিয়ে তাঁর এক বিখ্যাত আলাপে জানান, ‘স্থানীয়’ ধারণাটি আপাদমস্তক একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়। সময় এবং স্থানভেদে এটি বদলে যায়।৯৫ জ্ঞানের সমসাময়িক কালের সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘বিজ্ঞান’ ও ‘স্থানীয় জ্ঞান’ পরস্পর নির্ভরশীল, কারণ উভয়েই বিজ্ঞানের সত্যকে প্রকাশ করে এক বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে। বলা হয়, ঐতিহ্যগত জ্ঞান অনেকখানি স্থানীয় জ্ঞান কি জনবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা কোনো ঐতিহাসিক বা সামাজিক জায়গাকে নির্দেশ করে।৯৬ সাম্প্রতিক প্রাণপ্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, প্রকৃতি-সম্পর্কিত স্থানীয় জ্ঞানই ভবিষ্যতের চিকিত্সা কি ঔষধশাস্ত্রের গবেষণার দ্বার উন্মোচনের পথ। কিন্তু এই চিন্তার সঙ্গে বিশ্বায়িত দুনিয়ার বাণিজ্য রাজনীতি-সম্পর্কিত, যে জায়গা থেকে ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গগুলো বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত। প্রাকৃতিক সম্পদ-সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের জ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।৯৭ বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ জনগণের প্রতিদিনের টিকে থাকার জন্য স্থানীয় জ্ঞান দৃশ্যত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কি কৃষি, কি খাদ্যনিরাপত্তা কি প্রতিদেনের জীবনসংগ্রামে স্থানীয় জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ জীবন কৌশল।৯৮ স্থানীয় জ্ঞানকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ম্যাকিনসন ও নোস্তাদ মত্স্যসম্পদ-সম্পর্কিত একটি গবেষণার ভেতর দিয়ে দেখিয়েছেন, মাছ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয় জ্ঞান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের’ চেয়েও। তারা তাই উভয়জ্ঞানের সম্মিলনকে মত্স্যসম্পদ সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।৯৯ স্থানীয় জ্ঞান রাষ্ট্রীয় রাজনীতির আইন, শাসন ও ক্ষমতার ঘেরাটোপে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতার সীমানায় ঝুলে থাকে। স্থানীয় জ্ঞান কি ব্যক্তিগত না সামষ্টিক এ তর্কও রাষ্ট্রীয় চোখ রাঙানির বাইরে নয়।১০০ স্থানীয় জ্ঞানের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্র কখনোই নিম্নবর্গের পক্ষে দাঁড়ায় না, হাজির করে ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের’ দাপট। ইতিহাস থেকে ইতিহাসে আমরা যেমন দেখতে পাই খনার পক্ষে পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানকাণ্ড দাঁড়াচ্ছে না, কিন্তু বারবার সত্য হয়ে উঠছে খনার বিজ্ঞান।

সংস্কৃতির বিবর্তন ও অন্যান্য রচনা পুস্তকে পিট-রিভার্স (১৯০৬) মানুষের ইতিহাসে সংস্কৃতির বিবর্তনকে আলোচনা করতে গিয়ে বস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদানের আশ্রয় নিয়েছেন। সে সময়কার মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষার ধরন, শ্রেণীবিন্যাস ও তত্কালীন বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাই পিট-রিভার্সের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের আলোচনায় জায়গা পায়।১০১ পিট-রিভার্স (১৯০৬) তাঁর বইতে ‘সংঘবদ্ধ সাধারণ ধারণাকে’ বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিজ্ঞান হিসেবে পরিচয়জ্ঞাপক ‘সাধারণ জ্ঞান’ উন্নয়নের মূলনীতি হলো নিরীক্ষামূলক, শ্রেণীবদ্ধ বা তুলনামূলক ও তাত্ত্বিক- এ তিনটি ধাপ অতিক্রম করা। বর্হিপ্রকৃতির সঙ্গে কর্মসম্বন্ধযুক্ত যে কেউ তাঁর বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে একত্র করে নিরীক্ষামূলক ধাপটি অতিক্রম করতে পারেন।১০২ কোনো জ্ঞান বিজ্ঞানসম্মত কি না তা এ তিনটি ধাপের সঙ্গে সম্পর্কিত, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জ্ঞানের বাস্তবিক রূপ ও প্রয়োগ এবং নির্দিষ্ট চিন্তাধারা ও জনসম্মতি। বিজ্ঞানের এই পুরো ধারাটিই সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাহিত হয় এবং প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান হয়ে ওঠে। খনার ইতিহাস আমাদের সামনে বিজ্ঞানের ধাপগুলো বেশি স্পষ্ট করে তোলে। নিরীক্ষাপ্রবণতা থেকে শুরু করে তাঁর তুলনামূলক কর্মপ্রক্রিয়া এবং একটি তাত্ত্বিক অবস্থান এবং জনসম্মতি আরও এসব ধাপের ভেতর দিয়েই খনার বচনগুলো আবর্তিত হয়েছে এবং উত্পাদন করেছে বিজ্ঞানের সত্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে জীবনঘনিষ্ঠ বিজ্ঞানের এক নিয়ত দর্শন। আর এখান থেকেই খনার বিজ্ঞান দর্শনের ধারাবাহিকতা রক্তাক্ত হয়ে সত্য প্রকাশে নির্ভীক রয়েছে এখনো গ্রামীণ নিম্নবর্গের যাপিতজীবনে, মনস্তত্ত্বে কি স্মৃতিকাতরতায়।

উদ্ধত উপনিবেশ ও সংরক্ষিত প্রবেশাধিকার

চৈতে গিমা তিতা

বৈশাখে নালিতা

জ্যৈষ্ঠে অমৃতফল

আষাঢ়ে খৈ

শাওনে দৈ

কার্তিকে খৈলসার ঝোল

অঘ্রানে ওল

পৌষে কাঞ্জি

মাঘে তেল

ফাল্গুনে পাকা বেল।

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের বাঙালি সমাজে ‘টিকটিকি’ গোয়েন্দা হিসেবে আখ্যায়িত হয়। খনার কাহিনিমতে, খনার জিব কেটে ফেলার পর তা টিকটিকি খেয়ে ফেলে এবং টিকটিকি সেই বচনজ্ঞান লাভ করে। এরপর থেকে এ রকম বিশ্বাসও প্রচলিত যে কেউ কোনো কিছু সম্পর্কে কথা জানার সময় টিকটিকি ‘টিকটিক’ শব্দ করলে তা সত্যে পরিণত হয়। অধিপতি মনোজগতে ‘টিকটিকির প্রবেশাধিকার’ যেমন সংরক্ষিত ও দূরে ঠেলে রাখার বিষয়, ঠিক তেমনি খনার জ্ঞানপ্রক্রিয়া যা টিকটিকিতে স্থানান্তরিত হয়েছে তা-ও তথাকথিত ‘মূলধারায়’ দূরে সরিয়ে রাখার বিষয়। খনার এ আখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, জ্ঞান-প্রক্রিয়া কখনো ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন হয় না। এক রূপ থেকে অন্য রূপে, এক শরীর থেকে অন্য শরীরে বাহিত হয়। বস্তুর এই রূপান্তরধর্মিতা জ্ঞান-প্রক্রিয়ার প্রবাহধারার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় তখন সেখান থেকেও আমাদের খনার বিজ্ঞান-দর্শনের বস্তুবাদী ময়দান আন্দাজ করা জরুরি। জ্ঞান সত্য, অবিনশ্বর। এটি মানুষ থেকে টিকটিকিতে স্থানান্তরিত হতে পারে। আবার টিকটিকি থেকেও মানুষে স্থানান্তরিত হতে পারে। মূল বিষয় হচ্ছে একে কীভাবে কী প্রক্রিয়ায় কেন এবং কাদের জন্য ধারণ ও বহন করা হচ্ছে। কিন্তু কেন খনার বচন এখনো অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডে ‘অচ্ছুত’ এবং প্রান্তিক? কেন খনার বিজ্ঞান-দর্শন রাষ্ট্রের বিজ্ঞান-দর্শন হয়ে ওঠে না? আলাপের এ পর্যায়ে ক্ষমতার রাজনীতি ও অপরত্বের প্রশ্নহীন প্রক্রিয়াগুলো আমাদের যুক্ত করা জরুরি।

সামন্ত (২০০২) তাঁর ‘ইতিহাসের অপরত্ব কিংবা অপরত্বের ইতিহাস’ লেখায় উল্লেখ করেছেন, এ দেশের ইতিহাসে অপরত্বের নানা দিক, নানা দিগন্ত। এত রকমের অপরত্ব মানুষের ইতিহাসে, মানুষের অন্তর্গত গভীরে খেলা করে যে তার হদিস পেতে হয়রান হতে হয়। পাশাপাশি সামন্ত আরও উল্লেখ করেন, উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মঞ্চে নিম্নবর্গ অন্যতম কুশীলব ছিল এ কথা সত্যি কিন্তু আরও বড় সত্যি হলো বহু আন্দোলনে নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের দাসত্ব করেনি। নিম্নবর্গের নিজস্ব চেতনা আছে, নিজস্ব স্বার্থ আছে, আছে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও সংগঠন। তার মানে নিম্নবর্গের একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে।১০৩ নিম্নবর্গের নিজস্ব চেতনাগুলোই খনার ভেতর দিয়ে একটি যৌক্তিক আদল ও রূপ পেয়েছে। খনার যে শ্রেণী ইতিহাস আমরা পাই, সেখানে তাঁর কাছে নিম্নবর্গের এই দীক্ষা ও আওয়াজ আয়ত্ত করা দুরূহ। কারণ, কেউ-ই খনাকে তাঁর বচনভিন্ন তাঁর ‘রাজনৈতিক লড়াইকে’ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেননি। খনা শ্রেণীখারিজের লড়াই করেছেন। তিনি বারবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপদ্ধতি ও বিদ্যায়তনিক বলপ্রয়োগকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি প্রবল পুরুষতন্ত্র ও পরিবারকাঠামোর অন্যায় শাসনকে জ্ঞান-প্রক্রিয়ার সত্য দিয়ে প্রশ্ন করেছেন। খনার রণনীতি ও রণকৌশল দুর্দান্ত। অহিংস। প্রতিষ্ঠিত জ্যোতিষ বরাহমিহির যখন নিজ পুত্রের আয়ু এক বছর গণনা করেন, প্রচলিত নিয়মানুসারে এটিই বিশ্বাস করার কথা। কিন্তু খনা তা বিশ্বাস করেননি। কারণ, মিহিরের বেঁচে থাকার জীবনকালের সত্য তাকে বাধ্য করেছিল প্রতিষ্ঠিত গণনা-প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করতে। খনা তাই বারবার গণনার সত্য ব্যাকরণকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছেন এবং গণনার সত্য উপায়টি খুঁজে বের করেছেন। পুস্তকি গরিমা আর গ্রন্থগিরিকে খনা তুমুলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর বিজ্ঞান-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। তাই খনা বলেছেন, মেঘেই দেখো জলের রেখা। খনা মেঘবিজ্ঞানের সূত্র মেঘের ভেতরেই নিহিত এ উপলব্ধিটি ভেতরে ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত খনা প্রকৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক ও সূত্রকে তাঁর বিজ্ঞান-দর্শন হিসেবে হাজির করেছেন। আর এসব কারণেই খনাকে ইতিহাস থেকে ইতিহাসে অধিপতি চোখ রাঙানি ‘অপর’ ও প্রান্তিক করে রেখেছে। তাই এখন পর্যন্ত খনার বচনের কোনো পূর্ণাঙ্গ দলিল আমাদের নাগালে নেই। কেবল গ্রামীণ নিম্নবর্গের মৌখিক সংরক্ষণ-প্রক্রিয়ার ওপর যাবতীয় দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমরা ‘খনার বচন’ আমাদের ইতিহাস কি আমাদের ঐতিহ্য বলে পাশ কাটিয়ে যাই। খনার বচনকে ঘিরে এই ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বটি থেকেই আমরা অধিপতি জ্ঞানকাণ্ড ও নিম্নবর্গের বিজ্ঞানের সত্যকে প্রান্তিকীকরণের ইতিহাসকে বুঝতে পারি।

জানা যায়, ১৮৭২ সালে তিন হাজার বাংলা প্রবাদ প্রবচনের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে তত্কালীন ইংরেজ শাসক ও পণ্ডিতেরা বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহে এত আগ্রহী হলেও খনার বচন ও ডাকের কথা সংগ্রহের প্রতি তাঁদের তেমন উত্সাহ দেখা যায় নি।১০৪ ১৮৭০-এর দিকে জমিদারি শাসনের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের রেশ ধরে প্রশাসনিক প্রয়োজনে সরকার এ দেশের লোকদের গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য দেশের কিংবদন্তি ও প্রবাদ-প্রবচনাদি সংগ্রহ করায় উদ্বুদ্ধ হয়। ১৮৭২ সালে গণজীবনে প্রচলিত কাহিনি নিয়ে সরকারিভাবে প্রকাশিত হয় ডেসক্রিপটিভ এথনোলজি অব বেঙ্গল। হাজার খানেক বাংলা প্রবাদ সংকলন প্রকাশ করেন উইলিয়াম মর্টন ১৮৩২ সালে। ১৮৯৩ সালে দ্বারকানাথ বসুর প্রবাদ পুস্তক এবং ১৮৯৮ সালে মধুমাধব চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাদ পদ্মিনী প্রকাশিত হয়। ১৮৮৬ থেকে বামাবোধিনী, বঙ্গবাসী, সৌরভ পত্রপত্রিকায় বহু প্রবাদ প্রবচন প্রকাশিত হয়। রাজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৮৯৩ সালে নিম্নবর্গের কৃষি প্রবচনের একটি বই প্রকাশ করেন। নওয়াজ (১৯৮৯)-এর লেখা থেকে জানা যায়, ইংরেজ প্রশাসক ও পণ্ডিতেরা যেভাবে এ দেশের লোকসাহিত্য সংগ্রহে আগ্রহী হয়েছিলেন, তেমনি যদি তাঁরা লোকসাহিত্যের খনার বচনের শাখাটির প্রতিও নজর দিতেন তবে হয়তো আরও অধিক খনার বচন, ডাকের কথা, তথা কৃষি প্রবাদ-প্রবচনাদি রক্ষিত কিংবা অবিকৃতভাবে রক্ষিত হতে পারত। এ দেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের ঐতিহ্যশীল কৃষির গুরুত্ব দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে এবং সমাজকাঠামোও দ্রুত বদলাতে থাকে। কৃষিই ছিল এ দেশের মেরুদণ্ড, আজও। একে চূর্ণ করাই শাসকদের নীতি ছিল। ফলে মানুষ খনার বচন ইত্যাদি থেকে দ্রুত বিস্মৃত হতে থাকে। একটি জাতিকে আত্মবিস্মৃত করাই সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।১০৫

সচরাচর আমরা গ্রামীণ নিম্নবর্গের সৃষ্টি দুনিয়াকে বিজ্ঞান ও দর্শনের ময়দান থেকে তাড়িয়ে দিই। তাকে ইতিহাসের এক পরাজিত ও নিষ্ক্রিয় অনিবার্য দর্শকে পরিণত করি। এ প্রসঙ্গে ভদ্র (১৯৯৪) তাঁর ইমান ও নিশান গ্রন্থে বলেন, “কৃষকদের পিছিয়ে থাকা মানসিকতা” বেশ চালু তত্ত্ব। বাইরে থেকে আসা যোজকেরাই কৃষক আন্দোলনের প্রকৃত রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে কার্যকর করে। তবু খটকা থেকেই যায়। প্রথমত, এই এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্রোহগুলো সমাজের নানা ক্ষেত্রে আধিপত্য ও পরাবশ্যতার সংঘাতকে চিহ্নিত করে। ওইসব বিন্দুকে না চিনলে আমরা ক্ষমতার পুরো ইতিহাস ধরতেই পারব না।১০৬ কিন্তু খনা আমাদের ইতিহাসের এক সক্রিয় নির্মাতা। খনার সময়কার এবং পরবর্তী সময়ে খনার বচনের প্রান্তিকরণের ঐতিহাসিকতা বুঝতে আমাদের সামাজিক ক্ষমতা সম্পর্ক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক দেনদরবারগুলোও আলাপে টেনে আনা জরুরি।

খনার বচনপাঠে এটি স্পষ্ট হয়, খনা এক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভেতরেই নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। প্রতিবেশীয় সম্পর্ককে যাপিতজীবনের নানান সমস্যা ও উত্তরণের নিরিখে বারবার বিজ্ঞান সত্যে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডে আমরা দেখতে পাই বারবার কারিগরি কি বাণিজ্যিক প্রযুক্তিকে আমাদের সামনে বিজ্ঞান হিসেবে হাজির করা হয়। সেই বৈষম্যের গণিতই শিশুবেলায় আমাদের রচনা পাঠ করায় ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?’ বিজ্ঞান কোনোভাবেই অভিশাপ কি আশীর্বাদ সেই প্রশ্নের কাছাকাছি নয়। বিজ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক, বিজ্ঞান সত্য, বিজ্ঞান প্রমাণিত। নিম্নবর্গের এই জ্ঞানধারা ও দর্শনের সঙ্গে অধিপতি পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের প্রবল তফাত্। কারণ, অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডে মূলত টিকে আছে বিভাজন, চোখ রাঙানি আর নিয়ন্ত্রণের শর্তকে জিইয়ে রেখে। ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানবিষয়ক একটি লেখায় মাজ্জোচ্চি (২০০৬) জানান, মানুষ ও প্রকৃতির মিথোজীবী সম্পর্ককে বিবৃত করেই ঐতিহ্যগত জ্ঞানের উন্নয়নধারা বহমান। কিন্তু পশ্চিমা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অধিকাংশ সময়ই স্থানীয় ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে মূল্যায়ন করে না এবং এর জায়গাকে প্রান্তিক করে তোলে।১০৭ কালভেট-মির ও অন্যান্যরা (২০০৮) পশ্চিমা চিকিত্সাজ্ঞান ও ঐতিহ্যগত চিকিত্সাজ্ঞানের ভেতর দূরত্ব ও সম্পর্কবিষয়ক এক লেখায় জানান, ‘ঐতিহ্যগত চিকিত্সাজ্ঞানকে ‘সাংস্কৃতিকভাবে উপযোগী’ কিন্তু পশ্চিমা চিকিত্সাজ্ঞানের সঙ্গে বিস্তর পার্থক্যপূর্ণ মনে করেন পশ্চিমা চিকিত্সকেরা। পশ্চিমা চিকিত্সাজ্ঞানের ক্ষমতার জায়গায় ঐতিহ্যগত চিকিত্সাজ্ঞানের প্রান্তিকতা স্পষ্ট, কিন্তু একটি সফল চিকিত্সাধারার জন্য উভয়জ্ঞানের ভেতর সমন্বয় প্রয়োজন’।১০৮ পশ্চিমা এই মনস্তত্ত্বই খনার বচন সংগ্রহ ও বিকাশে উপনিবেশকাল থেকে নিয়ে আজকের এই নয়া করপোরেট ঔপনিবেশিক দুনিয়ায় কোনো সাড়া কি তত্পরতা দেখায় না।

প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণের নানান মাত্রাকে আমরা হরহামেশা আড়াল করে ফেলি। সমাজে উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ কি যৌনবাদের মতো বিভাজন ও কর্তৃত্বগুলো অনেক সময়ই মানুষের শরীর ও মনকে ঘিরে আবর্তিত, যার বৈষম্যের গণ্ডি তৈরি হয় ক্ষমতার সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে।১০৯ প্রকৃতির ওপর অধিপতি পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণ, দখল ও কর্তৃত্বকে ব্যাখা করে প্লামউড (১৯৯৩) তাঁর আলোচিত পুস্তক ফেমিনিজম অ্যান্ড দ্য মাস্টারি অব নেচার -এর ভেতর দিয়ে পশ্চিমা বলপ্রয়োগকে খারিজ করতে সকলকে সত্যিকারের নতুন গল্প, নয়া পাণ্ডুলিপি ও নয়া মঞ্চ নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন।১১০ পশ্চিমা দুনিয়ায় আধিপত্যের এই ধরন সুযোগের ফলাফল ও সুনির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিছুটা আবার প্রয়োজনের তাগিদে পরম্পরা হিসেবে চলমান এবং বহুপাক্ষিক। আবার কখনো তা ‘আত্ম’ ও ‘অপর’ এবং ‘কারণ’ ও ‘প্রকৃতির’ ভেতর নিয়ন্ত্রণের দর্শনের সঙ্গেও সম্পর্কিত। পশ্চিমা এই বৈষম্যের চিন্তাধারায় তাই দেখা যায়, প্রকৃতি চিহ্নিত হয় এক ‘নিষ্ক্রিয়’, ‘অপ্রভাবক’ ও ‘বিষয়হীন’ চিন্তা হিসেবে। অপরদিকে ‘পরিবেশকে’ দেখা হয় মূলত পশ্চিমা ধলা চামড়ার বিশেষজ্ঞ পুরুষ কি উদ্যোক্তাদের অর্জন, ফলাফল, কারণ ও সংস্কৃতি হিসেবে।১১১ মিলস (১৯৯১) প্রকৃতির ওপর আধিপত্যবিষয়ক তাঁর এক তাত্ত্বিক আলাপে উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি’ এ চিন্তাধারা প্রকৃতি ও ইতিহাসের চলমান সম্পর্ককে বুঝতে একধরনের ‘মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’। এভাবে বুঝতে গেলে আমরা প্রকৃতি ও ইতিহাসের বস্তুবাদী সম্পর্ক এবং মানুষ প্রকৃতির অংশ এ বিবেচনাকে হরহামেশাই হারিয়ে ফেলতে থাকি’।১১২ খনার বচন কি খনার আখ্যানে আমরা এই প্রকৃতি-বিবর্জিত মানুষকেন্দ্রিকতার কোনো প্রবল প্রতাপ কি দোর্দণ্ড দেখতে পাই না। কারণ, খনার বচন উত্সারিত হয়েছে বস্তুবাদী ঐতিহাসিকতা থেকে, কোনো বিভাজনের নিয়ন্ত্রণ থেকে নয়। খনার বচন তাই প্রতিবেশঘনিষ্ঠ জ্ঞান-প্রক্রিয়া।

প্রশ্ন আসে, তাহলে খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শনকে কেন আমরা প্রবলভাবে গ্রহণ করলাম না? ইতিহাস থেকে ইতিহাসে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞানমনস্কতার জন্য পুড়িয়ে মারা হয়েছে, খুন করা হয়েছে। তার পরও সত্য উল্টে যায়নি। আমরা হয়তো খনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি, কিন্তু খনার বিজ্ঞানের সত্যকেও আমরা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একেবারে নিরুদ্দেশ করে দিতে পারছি না। কারণ, বিজ্ঞানের সত্যকে রুখে দেওয়া অসম্ভব। খনার বচনকে দাবিয়ে রাখার ঔপনিবেশিক স্বার্থ ছিল বাংলার গ্রামীণ জগত্ থেকে কৃষির আপন রীতি ও দার্শনিক ভিত্তি গায়েব করে দেওয়া, যাতে ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতাগিরি আরও সক্রিয় ও বৈধ হতে পারে। পরবর্তী সময়গুলোতে খনার বচনের রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতি এবং সংরক্ষিত প্রবেশাধিকারও নিম্নবর্গের আপন কৃষি দুনিয়াকে গায়েব করার তাগিদেই। অধিপতি বিদ্যায়তনিক জ্ঞানকাণ্ডে যা তথাকথিত ‘আধুনিক কৃষির উন্নয়ন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। খনা লাউ মাচায় ছাই ও মাছ ধোয়ার পানি এবং বাঁশঝাড়ে ধানের তুষ ছিটাতে বলেছেন। কিন্তু আমাদের চলমান তথাকথিত আধুনিক কৃষি১১৩ আমাদের জমিন থেকে খাবারের থালা কি বিছানা পর্যন্ত মারাত্মক রাসায়নিক বিষে ভরিয়ে রেখেছে আর বাস্তুসংস্থান ফালি ফালি করে চালু রেখেছে ‘খাদ্য উত্পাদনের এক অমীমাংসিত কারবার’। এসব বিবেচনায় খনার বচন আমাদের সামনে তাই প্রতিবেশ-রাজনীতির এক লড়াকু ডিসকোর্সকেও হাজির করে আপন কায়দায়।

গ্রিনবার্গ ও পার্কের (১৯৯৪) একটি যৌথ লেখায় ‘প্রতিবেশ রাজনীতি’ প্রত্যয়টি প্রথম চোখে পড়ে।১১৪ মানুষ তাঁর সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে কীভাবে প্রতিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাই ‘সাংস্কৃতিক প্রতিবেশবিজ্ঞানের’ অধ্যয়নসূত্র।১১৫ খনার জন্ম কি বেড়ে ওঠা সিংহল কি উজ্জয়িনী কি চন্দ্রকেতুর গড় যেখানেই হোক না কেন, খনা প্রতিবেশের সঙ্গে জীবনসংস্কৃতির সম্পর্ককে তাঁর অধ্যয়নের বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। খনা কিন্তু স্ট্রবেরি কি ড্রাগনফ্রুট চাষ বা একাশিয়া কি ইউক্যালিপটাস গাছের উন্নয়ন কি তেলাপিয়া কি সিলভারকার্পের বৃদ্ধিবিষয়ক কোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত দেননি। কারণ, খনার বেড়ে ওঠা ও শিখন সীমানার চারধারজুড়ে এসবের কোনো উপস্থিতি ছিল না। মানে খনার বচন দাঁড়িয়েছে অস্তিত্বময় বস্তুকে কেন্দ্র করেই। কোনো অনস্তিত্বশীল অচিন যুক্তিহীনতার ভেতর দিয়ে নয়। বলা হয়ে থাকে, দুনিয়াব্যাপী নারীরা প্রতিবেশীয় সমস্যা মোকাবিলায় পুরুষের চাইতেও বেশি জড়িত ও ঘনিষ্ঠ।১১৬ প্রকৃতির ওপর এলাপাতাড়ি নিয়ন্ত্রণ ও অবিচারকে পুরুষতান্ত্রিক অন্যায় হিসেবেই দেখা হয়। প্রতিবেশ ও নারীর সম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করে যেসব বৈশ্বিক বাহাস চলছে, তা যেন খনার আখ্যান ও অনিবার্য পরিণতিরই তাত্ত্বিক ময়দান। মেলর (১৯৯৭) নারীবাদ ও প্রতিবেশের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এক দীর্ঘ তাত্ত্বিক আলাপে প্রতিবেশ নারীবাদের প্রধান দুটি ধারাকে ব্যাখ্যা করেছেন। একটি ধারা, যা প্রকৃতির সঙ্গে নারীর র্যাডিকেল, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে এবং নারী ও প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতাকে তুলে ধরে। অপর ধারাটি অনেকটাই কাঠামোবাদী এবং মার্ক্সীয়, যা সমস্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ও সমাধানের ইশারা দেয়। মেলর বিশুদ্ধ র্যাডিকেল প্রতিবেশবাদীদের মতো চিন্তা না করে বিষয়ের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ও সংঘাতকে বুঝতে চেয়েছেন এবং সমস্যাকে ধারণ করার জন্য নিজস্ব ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনীয় মনে করেছেন, যা বিদ্যমান সমস্যা মোকাবিলায় মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককেই মজবুত করে।১১৭ প্রতিবেশ-নারীবাদী লেখক কারেন (১৯৯৩) তাঁর লেখায় নারী ও প্রকৃতির আট ধরনের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন। এসব সম্পর্ক কখনো প্রতিযোগিতামূলক, কখনো সহযোগিতামূলক কি আন্তরিক কখনোবা সম্মতিমূলক।১১৮ খনার বচনকে খনার বচন করে তোলার ক্ষেত্রে খনার দুর্বিনীত লড়াইয়ের কথা স্মরণ করি আসুন। রাক্ষসপুরী থেকে রাজপুরী। কোনোখানেই খনার স্বাধীন উপস্থিতি ছিল না। প্রতিটি পদক্ষেপই তাঁকে শরীর ও মগজ দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। জিব কাটার আগে খনা তাঁর বচনসমূহ উচ্চারণ করেন। খনা-আখ্যানের এ জায়গাটি হয়তো প্রতীকী কিন্তু জ্ঞান-প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার ব্যাকরণ জিইয়ে রাখতে জরুরি। খনা তাঁর শারীরিক মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞান-দর্শনের মৃত্যুকে মেনে নেননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই তিনি প্রকৃতি ও যাপিতজীবন থেকে আহরিত জ্ঞানপ্রবাহ বাঁচাতে তাঁর বচনসমূহের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন আসমান থেকে পাতালে, মানুষ থেকে টিকটিকিতে, প্রকৃতির মাঝে, বস্তুর অবিনশ্বরতায়। কিন্তু খনার মৃত্যুর পর আমরা দেখতে পাই অধিপতি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের গণিত বদলেছে, এক উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশকালে প্রবেশ করতে হয়েছে।

নিম্নবর্গের জ্ঞানপ্রবাহের বিজ্ঞান ও দর্শনকে পাত্তা না দিয়ে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লবের নামে’ ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘বহুজাতিক কোম্পানিনিয়ন্ত্রিত এক আধুনিক কৃষি প্রকল্প’। দক্ষিণ এশিয়ায় সবুজ বিপ্লবের বিপদ ও ভয়াবহতাকে তুলে ধরে শিবা (২০০১) কৃষির অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবকে এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।১১৯ পরিবেশবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ক্যারোলন মার্চেন্ট ১৯৮০ সালে প্রকাশ করেন তাঁর যুগান্তকারী বই দ্য ডেথ অব নেচার: উইমেন, ইকোলজি অ্যান্ড দ্য সায়েন্টিফিক রেভুল্যুশন । যেখানে তিনি প্রকৃতি ও মাতৃদুনিয়ার মৃত্যুর জন্য যন্ত্রনির্ভর বৈজ্ঞানিক-বিপ্লবকে দায়ী করেন। পরবর্তীতে মার্চেন্ট (২০০৬) তাঁর আরও একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, যন্ত্রনির্ভর বিজ্ঞান রাসায়নিকের দূষণের মাধ্যমে মাটির মৃত্যু ঘটিয়েছে। বৈশ্বিক আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হলো প্রকৃতির ওপর নির্বিচার শোষণ, অবিরত বাণিজ্যিক বিস্তার এবং সামাজিক-অর্থনীতির উন্নয়ন মানে নারী-অধঃস্তনতা। প্রকৃতির মতো এক জীবন্ত সত্তা ও রূপকল্পকে কোনো ধরনের গ্রাহ্য না করেই এই প্রশ্নহীন যন্ত্রনির্ভর বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে।১২০ খনা এই ধরনের উন্নয়ন নীতি ও দর্শনের চূড়ান্ত বিরোধী ছিলেন, খনার বচনসমূহই তার প্রমাণ। ঔপনিবেশিককালে কেন খনার বচন সংগ্রহ ঔপনিবেশিক শাসকদের মাথাব্যথার কারণ ছিল না এবং কেন পরবর্তী একটি বড় সময়জুড়ে খনার বচনকে প্রায় নিরুদ্দেশ করার প্রক্রিয়া চালু আছে তা নিশ্চয়ই স্পষ্ট।

নির্ঘুম টিকটিকি

থোড় তিরিশে, ফুলো বিশে

ঘোড়ামুখো তেরো জেনো,

বুঝে সুঝে কাটো ধান্য।১২১

(থোড় জন্মানোর তিরিশ দিন পরে, ফুল বার হওয়ার কুড়ি দিন পরে, শিষ নত হওয়ার তেরো দিন পরে ধান কাটতে হবে। অন্যথায় লাভের আশা থাকে না।)

পার্থ (২০১২) বাংলাদেশের বন্যাপ্লাবন সমভূমি অঞ্চলের গ্রামীণ শস্যফসলপঞ্জিকার সাম্প্রতিক পরিবর্তনশীলতা বিষয়ে একটি প্রতিবেশীয় সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, পঞ্জিকাকেন্দ্রিক জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্নতা, গ্রামীণ ক্ষমতা সম্পর্ক, লিঙ্গীয় অসমতা, সাংস্কৃতিক রূপান্তর, বাজার নির্ভরশীলতা, বহিরাগত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, জাতের বিশুদ্ধতা, তথাকথিত আধুনিক রাসায়নিক কৃষির বিস্তার, গ্রামীণ আচাররীতির পরিবর্তন, কৃষকের নিজস্ব পছন্দ, জমির ভূবৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত বিপর্যয়, লোকায়ত বিজ্ঞান ও গ্রামীণ জীবনের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা, বেসরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি, আলোকগ্রহণশীলতার পরিবর্তন ও ঋতুভিত্তিক কৃষিজমির রঙের পরিবর্তন গ্রামীণ শস্যপঞ্জিকার রূপান্তরকে প্রভাবিত করে।১২২ তার পরও গ্রামীণ নিম্নবর্গ এখনো এই পরিতর্বনশীলতার ভেতরও খনার বিজ্ঞান-দর্শনকে তাদের যাপিতজীবনের উত্পাদনের মৌলিক দর্শন হিসেবে মান্য করে। এটি এমন নয় যে, প্রতিটি পদক্ষেপেই খনার বচন মেনে চলছে সবাই। আসুন একটি ‘জনপ্রিয়’ খনার বচন এবং এর প্রতিবেশ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে চলতি আলাপকে শেষের দিকে টেনে নিয়ে যাই। 

ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন

শীঘ্র হবে বৃষ্টি যেন১২৩

(খনার বচনে বলে যে, ব্যাঙের ডাক বৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ।)

আমাদের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঙের উপস্থিতি এবং ব্যাঙের ডাক প্রকৃতির এক প্রতিবেশীয় সূচক এবং আবহাওয়ার এক অনন্য নির্দেশক। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনে অবস্থিত লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির পানজুমিয়াদের কাছে বনের নানা প্রজাতির ব্যাঙ হচ্ছে পরিবেশের নানা তারতম্যের নির্দেশক। লাউয়াছড়া বনে একটি সবুজ ব্যাঙ প্রজাতি, যা বনের আর্দ্রতা ঠিক থাকার নির্দেশক ছিল বর্তমানে বিলুপ্ত হয়েছে। ব্যাঙ বিলুপ্তির ফলে পানজুমিয়া খাসিয়ারা এখন অনেক ক্ষেত্রেই ঠাহর করতে পারেন না বনের আর্দ্রতার পরিমাপ, কিন্তু পানজুমের জন্য একটি স্থিতিশীল আর্দ্রতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং হবিগঞ্জের হাওর জনপদের বাঙালিদের ভেতর বৃষ্টির প্রার্থনায় ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়। অনাবৃষ্টি এবং খরার সময় গ্রামের কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা মিলে গ্রাম ঘুরে ঘূরে এই পর্ব পালন করে বৃষ্টির প্রার্থনায়। টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবনের মান্দি জনগোষ্ঠীর ভেতর জুম চাষের সময় বীজ লাগানোর পর বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা হয়, এই ধরনের প্রার্থনা খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ভেতরও আছে। হাওর জনপদের মানুষেরা জানালেন, ব্যাঙ যদি ডাকে তবে বোঝা যায় বৃষ্টি হবে। কিন্তু বর্তমানে ব্যাঙ যেমন নেই সেটিও সত্য, আবার বৃষ্টি কখন না কখন হয় সেটিরও ঠিক নেই। এই যে প্রতিবেশের একটি প্রাণীর অনুপস্থিতি, একেই হাওর জনপদের মানুষেরা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ভেতর জলবায়ুগত পরিবর্তনশীলতার একটি ঘটনা হিসেবে পাঠ করেন। এই ঘটনাটি স্থানীয় জনগণের আবহাওয়াপঞ্জিকাতে নির্দেশ করে বৃষ্টিপাতের আগমন এবং পরিমাণ।

ব্যাঙ এবং বৃষ্টিপাতের এই যে পারস্পরিক সম্পর্ক দেখার জায়গা এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবেশকেন্দ্রিক ধারণা ও চিন্তাজগতের পাটাতন। খনা যে বিজ্ঞান-দর্শনের কথা আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্থানীয় জনগণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংলগ্ন থাকলেও করপোরেট মুনাফা বাজার কিন্তু ব্যাঙদের আর ভারসাম্যের বাস্তুসংস্থানে থাকতে দেয়নি। ব্যাঙ নেই বলে যে বৃষ্টিপাতের ধরন এবং আগমনকেই কেবল পাঠ করা যাচ্ছে না তা নয়, ব্যাঙের অনুপস্থিতি প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বিপন্ন করেছে। দেশে অনেক জনগণের খাদ্যের উত্স ছিল এই ব্যাঙ, ব্যাঙের বিলুপ্তি অনেক জনগণের খাদ্যাভাস এবং খাদ্যসংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ব্যাঙ কৃষি ও জুমের অনেক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের শস্য ফসলকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যাঙের পা বাণিজ্যের ফলে এই ব্যাঙ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর আমাদের কৃষকের ধানখেতে পোকামাকড় মারতে সমানে দোকান খুলেছে মনসান্টো, সিনজেন্টা, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, বিএএসএফের মতো বড় দশাসই করপোরেট বিষ কোম্পানিরা। বাংলাদেশের গ্রাম জনপদ থেকে একটা সময় ব্যাঙ হত্যা করে ব্যাঙের পা দেশের বাইরে উত্তরের ধনী দেশগুলোর জন্য রপ্তানি করা হয়েছে। সেসব ব্যাঙ কারবারি দেশগুলোর জন্যই আজ পৃথিবীর জলবায়ু বদলে গিয়ে অনেক বেশি উষ্ণ হয়ে পড়ছে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ১২ বছরের একটি গড় হিসাবে দেখা যায়, ভারত থেকে প্রতিবছর ২৭৭০ মেট্রিক টন সোনা ব্যাঙের পা আমেরিকা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জার্মানিতে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য রপ্তানি হয়েছে। ৬০টি ব্যাঙের পা একত্র করলে ওজন হয় মাত্র এক কেজি। ২৭৭০ মেট্রিক টন ব্যাঙের মাংসের জন্য প্রতিবছর ভারতে হত্যা করা হয়েছে চার কোটি ১০ লাখ ব্যাঙ।১২৪ একটি ব্যাঙ গড়ে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পোকামাকড় খায়, ব্যাঙ না থাকায় কৃষিজমির পোকামাকড়দের মারার জন্য কি ব্যাপক পরিমাণ করপোরেট বিষ ঢালতে হয়েছে, তা কি ভাবা যায়? কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগণ বরাবরই নির্বিচারে ব্যাঙ হত্যা এবং করপোরেট ব্যাঙ বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছেন। ১৯৭৯ সালের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে দেশে প্রচণ্ড খরা হয়। পুকুর, খাল, বিল শুকিয়ে যায়। বোরো ধান হয়নি, আউশ বপন করা যায়নি। বোনা পাট মরে যেতে থাকে। কাপ্তাই হ্রদে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুত্ উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায়। তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত ওঠে। গরমে ও পানির অভাবে মানুষ ও জন্তু-জানোয়ার মরতে থাকে। এ অবস্থায় গাইবান্ধায় গ্রামবাসীরা ব্যাঙশিকারিদের আক্রমণ করেন। তাঁদের ধারণা, শিকারিরা ব্যাঙ ধরে ফেলছে, সে জন্য দল বেঁধে ব্যাঙ ডাকতে পারছে না, ফলে বৃষ্টিও হচ্ছে না।১২৫ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা বলছেন ‘খনার বচন এ যুগে অচল’ তাঁরা কি এ যুগে ‘বহুজাতিক রাসায়নিক বিষ বাণিজ্য আর নির্মম ব্যাঙ বাণিজ্যকেই’ একমাত্র সচল ও যুগোপযোগী মনে করছেন? খনার এ বচন বস্তুকে ঘিরে, এটি তখনো সত্য ছিল, এখনো সত্য। প্রতিবেশে ব্যাঙ থাকা না থাকা কি উত্তরের ভোগবাদী দুনিয়ার নির্মমতায় জলবায়ু বদলে যাওয়া মেঘের পরিবর্তন কি কোনোভাবেই এই বচনের ‘সত্যের’ সঙ্গে তুলনামূলক তর্কে জায়গা পেতে পারে? খনার বচনসমূহ এমনই চারধারের সূত্র থেকে উদ্ভাবিত, চারধারকে অন্যায়ভাবে বদলে ফেলে ‘খনার বচনের’ অসারত্ব প্রমাণের চেষ্টা কেবল অধিপতি ঔপনিবেশিক পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রকেই হাজির করে। খনার বচনের আখ্যানের বরাহমিহির থেকে শুরু করে আজকের বিদ্যায়তনিক গরিমা কি আধুনিক কৃষি প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান বাহাদুরি সবখানেই এই একই রকম বৈষম্যের ধারাবাহিকতা। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শন বদলে যায় না বা এর উপযোগিতা হারিয়ে যায় না। খনার জিব কেটে ফেললেও টিকটিকিরা এখনো নির্ঘুম। জ্ঞানজাগতিক দুনিয়ার বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক সত্যের মতোই।

তথ্যসূত্র ও টীকা

১ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পীরগাছা বর্মণ পাড়া থেকে বাইদ জমিন দিয়ে চুনিয়া মান্দি গ্রামে যাচ্ছি। হঠাত্ দেখি পূব আকাশে রংধনু। সঙ্গী মান্দি দার্শনিক জনিক নকরেক (১০২) তখন উপরোক্ত খনার বচনটি বলেন। রঙধনুটি দেখা যায় ৪ জুলাই ২০১০ তারিখে বিকাল ৪.২০ মিনিটে। সেদিনই সন্ধ্যা ৬.৩০ থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। এভাবে ৭ জুলাই ২০১০ তারিখ পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। জনিক নকরেকের মতে, মধুপুর গড়ে সচরাচর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পশ্চিম আকাশে রঙধনু দেখা যায় না। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি ও তীব্র খরাও তেমন একটা দেখা যায় না। তবে সমসাময়িককালে ইকোপার্কের বছর মানে ২০০৪ সালে আষাঢ় মাসে পশ্চিম আকাশে দুই বার পরপর রঙধনু দেখা যায় এবং খরা দেখা দেয়। বৃষ্টি কম  হয়। আনারস ও কলার ফলন কমে যায়। ‘মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প’ স্থানীয়ভাবে ‘ইকোপার্ক’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাকৃতিক বন ও বনভূমির আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে সরকার এই বাণিজ্যিক বিনোদন প্রকল্প করতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে এটি স্থগিত হয়ে যায়।

২ এ ধরণের অধিপতি চিন্তা রাষ্ট্রের প্রবল বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে জোড়ালো করে। এটি ‘আত্ম’ ও ‘অপরের’ রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত। অধিপতি ও নিম্নবর্গের বোঝাপড়ার বিষয়। এ দৃষ্টিভঙ্গিই ‘শহরের মানুষ আধুনিক’ আর ‘গাইয়া বা গ্রাম্য’ হচ্ছে অনাধুনিকতা এ ধরণের বৈষম্য জিইয়ে রাখে। এ দৃষ্টিভঙ্গিই নিম্নবর্গের জগতসংসার তছনছ কি গায়েব করে আবার ‘হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার লোকসংস্কৃতি’ বলে মায়াকান্না ছড়ায়। বৈষম্যের এই মনস্তত্ব ‘যাদুঘর-মার্কা’ ধারণাকে বৈধ করে, বিষয়টি হচ্ছে কৃষি কি জুম কেড়ে নিয়ে শহরের মঞ্চে আদিবাসী নারীদের দিয়ে জুমনৃত্য আয়োজন করা কি বাঙালি মেয়েদের ধান কাটার গান পরিবেশন। জীবন থেকে, যাপন থেকে, প্রশ্ন কি পাটাতন থেকে সূত্র ও সম্পর্ককে আলাদা করে বারবার এসবকে ‘ড্রইং রুমে’ সাজিয়ে রাখার ‘জিনিস’ করে তোলা হয়। এ বিষয়ে বাংলায় আরো দেখুন : অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ২০০২ সনে প্রকাশিত ‘অপর সংখ্যা’, সমাজমনস্ক পোস্টমডার্ন সাহিত্যপত্র হাওয়া ৪৯, হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, কলকাতা-৭০

৩ চলতি লেখাটি খনা ও খনার বচনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও বিকাশের জোর দাবি জানায়। খনার বচন ও বিজ্ঞানসূত্রসমূহের মালিকানা দেশের নিম্নবর্গের। খনার বচনের কোনো একতরফা বাণিজ্যিক ব্যবহার বুদ্ধিজাত সম্পদ কি জ্ঞানের অধিকার লংঘন হিসেবে বিবেচনা করে দৃষ্টান্তমূলক ন্যায়বিচার দাবি করে চলতি আলাপ।

৪ পরিবেশ এবং প্রতিবেশ সম্পর্কিত বিদ্যমান দর্শন এবং চিন্তাকে ঘেঁটে নারীবাদীরা দেখিয়েছেন পরিবেশ সম্পর্কিত কোনো মতবাদেই পরিবেশ বিষয়টির নিশ্চিত সুরাহা হয় না। কারণ এইসব মতবাদ গড়ে ওঠেছে একটি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং বলপ্রয়োগকারী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গি এসব ধারণা অটুট রাখে, যে পুরুষ নারীর চেয়ে  প্রধান, মন শরীরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সংস্কৃতি প্রকৃতির চেয়ে উচ্চ। বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে কর্তৃত্ব এবং বলপ্রয়োগের জায়গায় নারীবাদীরা নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং প্রকৃতিকে নিকট সম্পর্কিত এবং পারস্পরিক আহাজারির ভেতর দিয়ে ঐক্যবদ্ধ মনে করেন। পরিবেশ ডিসকোর্সে নারীবাদীদের এই চিন্তা সমপ্রতি প্রতিবেশনারীবাদ (Ecofeminism) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রতিবেশনারীবাদীরা সকল ধরনের কর্তৃত্ব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এবং শ্রেণীহীন দুনিয়াতে বিশ্বাসী এই মতবাদ কোনো ধরনের কর্তৃত্ব ছাড়া মানুষকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত হওয়ার আহবান জানায়। যেখানে অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কর্তৃত্ব এবং বলপ্রয়োগসমূহকে জিইয়ে রাখে। কারেন ওয়ারেন, বন্দনা শিবা, ক্যারোলিন মারচেন্ট, রুজমেরী র্যুথার, য়্যনেস্ত্রা কিং প্রতিবেশনারীবাদী ধারণার ভিন্নতা  দিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীবনযাপনের জটিল সম্পর্কের চিন্তাকাঠামোর শরীরকে অন্যান্য মতবাদের চাইতে অনেক বেশী সংগঠিত, স্পষ্ট এবং মূর্ত করে তুলেছেন।

৫  শ্রী বিজয় চন্দ্র রায়ের (সংগ্রহ ও সম্পাদনা) খনার বচন, শ্রীবাসব বিজয় দাস সম্পাদিত বৃহত্ খনার বচন (যদিও বইয়ের মলাটের ভেতরে বইটির নাম লেখা হয়েছে ‘প্রাচীন ও বিশুদ্ধ খনার বচন’) এবং পন্ডিত রামপদ ভট্টাচার্য (আচার্য) সংকলিত খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন এই তিনটি পুস্তকের কথা বলা হচ্ছে। মৌখিক জ্ঞানবিনিময়ের বাইরে, উল্লিখিত ধরণের পুস্তক এবং বাংলা পঞ্জিকা থেকেই এখনও গ্রামীণ সমাজে খনার বচনের চর্চা চলে। ‘বাংলার প্রবাদ প্রবচন সমগ্র বা প্রবাদ প্রবচনে বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট মার্কা’ কোনো শহুরে মধ্যবিত্তীয় প্রকাশনা থেকে এখনও খনার বচন চর্চার চল শুরু হয়নি।

৬ হোসেন, সেলিনা। ২০১২, ‘খনা ও খনার বচন’, সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত জেন্ডার বিশ্বকোষ থেকে এই অংশটুকু উল্লেখ করা হয়েছে। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃ.৪২৭-৪২৮।

৭ দেখুন: http://en.wikipedia.org/wiki/Khana_%28poet%29। ১৫ মার্চ ২০১৩ এখানে প্রবেশ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

৮  দেখুন:  http://www.scribd.com/doc/89654073/khonar-bochon। ১৫ মার্চ ২০১৩ এখানে প্রবেশ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

৯ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ধানমন্ডি, ঢাকা, পৃ. ১৫৩।

১০ Singh, Upinder. 2008, A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century. Pearson Education India, p.581.

১১ চৌধুরী, তিতাশ। ২০০০, ‘খনার বচনে বোশেখের চিত্রলতা’, নিবন্ধটি লেখকের বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্যচেতনা শীর্ষক পুস্তক সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ৯৫-৯৯।

১২ প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫-৯৬।

১৩ দেখুন htpp://choturmatrik.net/blogs। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

১৪ Sen, Dhiman. 2008, Impact of Khana’s Vachan on Traditional Agriculture in Bengal, Asian Agri-History, Vol. 12, No. 3, P. 211.

১৫ ভট্টাচার্য, পন্ডিত রামপদ (আচার্য)। মোট ৪৭ পৃষ্ঠার বইটির কোথাও প্রকাশকাল উল্লেখ নেই। খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন। রাজেন্দ্র লাইব্রেরী, ১৩২ বিপ্লবী রাসবিহারী বসু রোড, কলিকাতা-৭০০০০১, সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশকের। মূল্য ১২ টাকা। বইটির মলাটের ছবিটি রঙিন এবং হাতে আঁঁকা, প্রচ্ছদশিল্পীর নাম নেই কোথাও। বইটি ১৮ মে ২০০৪ তারিখে কলকাতার ফুটপাত থেকে সংগ্রহ করি। পৃ.২।

১৬ দাস, শ্রীবাসব বিজয় (সম্পাদিত)। ১৪১৫, বৃহত্ খনার বচন (যদিও বইয়ের মলাটের ভেতরে বইটির নাম লেখা হয়েছে ‘প্রাচীন ও বিশুদ্ধ খনার বচন’), মানসী হালদার বইটি সংশোধন করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে সজল পুস্তকালয়, ৩৫ দর্পনারায়ণ ঠাকুর ষ্ট্রীট, কলকাতা-৭০০০০৬। সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত। খনার বচনের অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এর আকার একটু লম্বাটে এবং ছাপা ঝকঝকে। মলাট রঙিন এবং লেমিনেট করা। তবে প্রচ্ছদশিল্পীর কোনো নাম নেই। বইটি আমি শিয়ালদহ রেলষ্টেশন থেকে ক্যানিং যাওয়ার পথে রেলষ্টেশনের ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি ২০১২ সনে। বিক্রয়কেন্দ্র-সজল পুস্তকালয়, ৯৯ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা-৭০০০০৭, মূল্য ২৫ টাকা, পৃ.২-৪।

১৭ রায়, শ্রী বিজয় চন্দ্র (সংগ্রহ ও সম্পাদনা)। ১৯৯৮ (দ্বিতীয় সংস্করণ), খনার বচন, ২/২ জয় চন্দ্র ঘোষ লেন, ঢাকা-১১০০ থেকে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন বিজয় রায়। গ্রন্থস্বত্ত্ব প্রকাশক। বর্ণবিন্যাস-ফাইন টাইপ কম্পিউটারস এন্ড প্রিন্টার্স, শাঁখারী বাজার, ঢাকা। মূদ্রণ-ডি.সি. রায়, অনু প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ২/২ জয়চন্দ্র ঘোষ লেন, ঢাকা-১১০০। প্রাপ্তিস্থান-নিউ এজ পালিকেসন্স, ৬৫ প্যারী দাস রোড, ঢাকা-১১০০, পৃ.৩।

১৮ দেখুন: http://issuu.com/saptarishisastrologyvol7/docs/48-khannarvachan-1/1?mode=a_p। ১৫ মার্চ ২০১৩ তারিখে এটি নেয়া হয়েছে। এই সাইটে ইংরেজীতে বরাহমিহিরের পুত্রের নাম চত্রঃযুঁধংধং লেখা হয়েছে।

১৯ এই অংশটুকু লিখতে হাসনাত শাহীনের ‘কিংবদন্তির খনা’ লেখাটির সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ২৯ মার্চ ২০১৩ তারিখে এটি প্রকাশিত হয়। পৃ.২৭।

২০ পান্ডে, তুষার কান্তি (সম্পাদনা)। ১৯৯০, চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী, গ্রন্থনা, কলিকাতা-৯, পৃ. ১-৬৪।

২১ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ধানমন্ডি, ঢাকা, পৃ. ৪৮-৫০।

২২ দেখুন http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=4725। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

২৩ এই অংশটুকু অধ্যাপক আলী নওয়াজ ১৩৪৭ বাংলায় পুনমূদ্রিত বঙ্গদর্শনের ‘বংগে ব্রাহ্মণাধিকার’ অংশ থেকে উল্লেখ করেছেন।

২৪ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি । পৃ. ৫২।

২৫ এটি নীহার রঞ্জন রায়ের বাংগালীর ইতিহাস আদি পর্ব থেকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকাশকাল ১৩৫৬।

২৬ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। পৃ. ৬১।

২৭ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬।

২৮ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।

২৯ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।

৩০ প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১-৯২।

৩১ প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২।

৩২ চৌধুরী, তিতাশ। ২০০০, খনার বচনে বোশেখের চিত্রলতা, পৃ. ৯৫-৯৬।

৩৩ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬।

৩৪ Chatterji, Roma. 2007, ‘Orality, Inscription and the Creation of a New Lore’, Cultural Analysis 6 (2007): 71-90, The University of California. 

৩৫ রিপন, জাহারাবী। ২০১০, মধ্যযুগের পাঁচালি নাট্যে বাংলার কৃষি-প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৩৬ জলিল, মুহম্মদ আবদুল। ১৯৯৫, ‘বাঙালী মুসলমানের সংস্কৃতি ও ফোকলোর’, এই নিবন্ধটি লেখকের লোকসংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ বই থেকে নেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ৪১।

৩৭ সুবাস উদ্দিন, মুহম্মদ। ২০০৭, সুনামগঞ্জের লোকসংস্কৃতি : কৃষি ও কৃষক সমাজ, বারসিক, ঢাকা, পৃ. ২১। (বিমল চন্দ্র পাল, কৃষক, লালারচর, সুনামগঞ্জ থেকে নেয়া তথ্য এখানে ব্যবহার করা হয়েছে)।

৩৮ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। পৃ. ১৪১।

৩৯ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪২।

৪০ প্রাগুক্ত, পৃৃ.১১৪-১১৫।

৪১ ওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। পৃ. ৭৬-৭৭।

৪২ প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪। (কাজী দীন মোহাম্মদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস  দ্বিতীয় খন্ড থেকে এই অংশটুকু নেয়া হয়েছে। ১৯৬৮ সনে এটি প্রকাশিত হয়।

৪৩ কলকাতা থেকে প্রকাশিত শশীভূষণ দাশগুপ্তের ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ  গ্রন্থ থেকে এ তথ্য দিয়েছেন অধ্যাপক আলি নওয়াজ। দেখুন: নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি, পৃ. ৪৫।

৪৪ প্রাগুক্তা, পৃ. ৪৭-৪৮।

৪৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪-১৫৫।

৪৬ ভট্টাচার্য, পন্ডিত রামপদ (আচার্য)। খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন।

৪৭ দাস, শ্রীবাসব বিজয় (সম্পাদিত)। ১৪১৫। বৃহত্ খনার বচন (যদিও বইয়ের মলাটের ভেতরে বইটির নাম লেখা হয়েছে ‘প্রাচীন ও বিশুদ্ধ খনার বচন’), মানসী হালদার বইটি সংশোধন করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে সজল পুস্তকালয়, ৩৫ দর্পনারায়ণ ঠাকুর ষ্ট্রীট, কলকাতা-৭০০০০৬। সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত। খনার বচনের অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এর আকার একটু লম্বাটে এবং ছাপা ঝকঝকে। মলাট রঙিন এবং লেমিনেট করা। তবে প্রচ্ছদশিল্পীর কোনো নাম নেই। বইটি আমি শিয়ালদহ রেলষ্টেশন থেকে ক্যানিং যাওয়ার পথে রেলষ্টেশনের ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি ২০১২ সনে। বিক্রয়কেন্দ্র-সজল পুস্তকালয়, ৯৯ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা-৭০০০০৭, মূল্য ২৫ টাকা।

৪৮ দেখুন: পান্ডে, তুষার কান্তি (সম্পাদনা)। ১৯৯০, চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী, গ্রন্থনা, কলিকাতা-৯, পৃ. ১-৬৪।

৪৯ উল্লিখিত পুস্তিকাটি আমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের রাসলীলানুসরণ উপলক্ষে আয়োজিত ‘পূর্ণিমারাস মেলা’ থেকে কিনি ১৪০৮ বাংলায়। পুস্তকের গায়ে ৯ টাকা দাম লেখা থাকলেও আমার কাছে যাদব চন্দ্র সূত্রধর (৬৫) বইটি ৬ টাকায় বিক্রি করেন। তিনি প্রায় ৪০ বছর যাবত এ কাজের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের নানান অঞ্চলে বছরব্যাপি মেলা ও উত্সবে এরকম দোকান দেওয়াই তাঁর কাজ। যাদব চন্দ্র সূত্রধরের মূল বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে। পেশাগত জীবনে তিনি উল্লিখিত খনার বচন পুস্তকটি ছাড়াও আরো দুই রকমের খনার বচন বই বিক্রি করেছেন। প্রায় বিশ বছর আগে একটি বই ছিল, বইটির মলাটে শাড়ি পড়া খনার ছবি ছিল। বইটির কোনো কপি নেই। পরবর্তীতে আমি শিবপুরে খোঁজ করি, তাঁর দিদিমার কাছেও বইটি ছিল না। তবে তাঁর দিদিমা বিন্দুবালা সূত্রধর (৯৯) সেই খনার বচন পুস্তকটি পড়েছেন। অনেক বচন তখনও তাঁর স্পষ্ট মনে ছিল, সেখান থেকে প্রায় বাহাত্তরটি বচন আমি তিন দিনে লিখে আনি। আলাপে উল্লিখিত এসব পুস্তিকা সাধারণত অভিজাত বিপণিবিতান হিসেবে পরিচিত কোনো বইপুস্তকের দোকানে বিক্রি হতে দেখা যায় না। এসব বই সাধারনত সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনো উত্সব উপলক্ষে মেলা, বারুণী স্নান, পৌষমেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, কোনো আঞ্চলিক মেলাতে মাটিতে দোকান পেতে দোকানদারেরা বিক্রি করেন। এসব পুস্তক বিক্রেতারা ‘পুস্তক পরিবেশক বা বিক্রয়কারী হিসেবে’ কখনোই স্বীকৃত নন। উল্লিখিত খনার বচনের মতো পুস্তিকাকে অনেক সময়ই ‘চটি বই’ বলতে শোনা যায়। খেয়াল রাখা জরুরী ‘চটি বই’ বলতে শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের ভেতর পর্ণো পত্রিকাকেও বোঝানো হয়। কেউ কেউ এসব প্রকাশনাকে ‘বটতলার প্রকাশনাও’ বলেন। ব্যাক্তিগতভাবে গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মেলায় সহযাত্রী বাঙালি পুরুষ বন্ধুদের ‘এসব প্রকাশনাকে’ ‘হিন্দুদের বই’ বলতে শুনেছি। লক্ষীব্রতের পাঁচালী, শনির পাঁচালী, শ্রী শ্রী অষ্টোত্তর শতনাম, গোরক্ষনাথের পাঁচালী, বাংলার ব্রতকথা, মেয়েদের ব্রতকথা, ত্রিনাথের পাঁচালীর সাথে খনার বচনের মতো পুস্তিকাগুলো এসব মেলায় পাওয়া যায়। এসব দোকানে চলতি সময়ে বাংলা সিনেমার গান, মাতাল রাজ্জাকের গান, জনপ্রিয় সিনেমার গান, যৌনরোগের মহৌষধ, স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য মিলন, সুখের বাসর, জানার আছে অনেক কিছু, কি করিলে কি হইবে, মোবাইলের গান, মোবাইল সম্পর্কে জানুন এসব পুস্তিকাও বিক্রি হতে দেখা যায়। পাশাপাশি সিঁদূর, আবীর, নীল, চন্দন কাঠ, তিলকমাটি, তুলসীর মালা, সনাতন হিন্দুদের নানান দেবী-দেবতার পোস্টার, ফুল-শিশু-রাজনৈতিক নেতৃত্ব-সিনেমার নায়িকা-নায়কদের পোস্টারও বিক্রি হয়। এসব দোকানের ব্রতকথা ও খনার বচনের মতো পুস্তকের মূল ক্রেতা গ্রামের কৃষক পরিবারের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাাঙলি মধ্যবয়স্ক ও কখনো কখনো প্রবীণ নারী। উল্লিখিত অন্যান্য পুস্তক কমবয়স্ক বাঙালি মুসলিম কি হিন্দু ছেলে-মেয়েদেরও কিনতে দেখা যায়। এসব পুস্তক ছাপা হয় নিউজপ্রিন্ট কাগজে এবং উপরের প্রচ্ছদ থাকে হাতে আঁঁকা, যদিও কোথাও প্রচ্ছদশিল্পী কি লেখক বা সংগ্রাহকের কোনো পরিচয় থাকে না। এসব পুস্তকের মূল্য নিতান্তই কম, এখনও একটি জাতীয় দৈনিকের দামে এরকম একটি পুস্তক কিনতে পাওয়া যায়। বাঙালি সনাতন হিন্দু পরিবারের গ্রামীণ নারীরা এই পুস্তকগুলো খুব যত্ন করে, ঘরের ভেতর দেবতার জন্য সংরক্ষিত আসনের কাছে রাখে। ব্রতকথা ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তক ‘পবিত্র’ হিসেবে যে স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায় পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত ‘খনার বচন’ পুস্তকও সেইসব পরিবারে ‘পবিত্র পুস্তকের’ মর্যাদা পায়। খনার বচন কি খনা সম্পর্কিত কোনো লেখা কি আলাপে আজ পর্যন্ত এসব পুস্তকের কোনো হদিস দিতে কখনো কাউকে দেখা যায় না। এসব প্রকাশনা সম্পর্কে অধ্যাপক আলি নওয়াজ (১৯৮৯) বলেছেন, কলকাতায় বটতলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এ জাতীয় সংকলন অহরহই পাওয়া যেত এবং এখনও যায়। বাংলাদেশ হতেও এরূপ কিছু চটি সংকলন মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন, খনার বচনের পুরাতন সংকলনের মধ্যে মধুসূদন ভট্টাচার্যের ক্ষুদ্রাকৃতি সংকলনটিই শুধু বাংলা একাডেমীর মুক্তাগাছা গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়।

৫০ রায়, শ্রী বিজয় চন্দ্র (সংগ্রহ ও সম্পাদনা)। ১৯৯৮ (দ্বিতীয় সংস্করণ), খনার বচন।

৫১ নারীগ্রন্থ প্রর্বতনা। ২০০৭, খনার বচন, পঞ্চম সংস্করণ, ঢাকা।

৫২ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি। পৃ. ১৫২-১৫৩।

৫৩ প্রাগুক্ত পৃ. ১৪৮।

৫৪ দেখুন http://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8। ১৫ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি দেওয়া হয়েছে।

৫৫  দেখুন http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8। ১৫ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি দেওয়া হয়েছে।

৫৬ দেখুন http://chorakobita.blogspot.com/2009/12/blog-post_30.html। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি দেওয়া হয়েছে।

৫৭ দেখুন http://khona.blog.com/khonas-speech/। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি দেওয়া হয়েছে।

৫৮ দেখুন http://rathindrabharati.wordpress.com/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8/। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৫৯ দেখুন http://www.dw.de। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬০ দেখুন http://prothom-aloblog.com/posts/16/58775। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬১ দেখুন http://zizipoka.com/known-unknown/263। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬২ দেখুন http://zizipoka.com/known-unknown/263। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৩ দেখুন http://www.somewhereinblog.net/blog/rupokrasel31/29721043। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৪ দেখুন http://www.somewhereinblog.net/blog/qshohenq/29308834। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৫ দেখুন http://choturmatrik.net/blogs। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৬ দেখুন http://choturmatrik.net/blogs। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৭ এই খনার বচনটি নেওয়া হয়েছে: পান্ডে, তুষার কান্তি (সম্পাদনা)। ১৯৯০, চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী, পৃ. ৭-৮।

৬৮ দেখুন http://www.ik.org.bd/?page_id=22। ১০ মার্চ ২০১৩ তারিখে এই লিংকে প্রবেশ করে এই তথ্যটি নেওয়া হয়েছে।

৬৯ চৌধুরী, তিতাশ। ২০০০, ‘খনার বচনে বোশেখের চিত্রলতা’, নিবন্ধটি লেখকের বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্যচেতনা  শীর্ষক সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ৯৯।

৭০ Sen, Dhiman. 2008, Impact of Khana’s Vachan on traditional agriculture in Bengal, P. 212.

৭১ Singh, Upinder. 2008, A History of Ancient and Early Medieval India, p.581.

৭২ চৌধুরী, তিতাশ, ২০০০। পৃ. ৯৫-৯৯।

৭৩ Bandyopadhyay, Monanjali and Chakraborti, Kalyan. Folk Poetry as a Media of Agriculture Extension in Bengal. Available in http://www.academia.edu/16 04047/Full_length_paper_Folk_poetry_as_a_media_of_agricultural_extension_in_Bengal.

৭৪ ভট্টাচার্য, পন্ডিত রামপদ (আচার্য) ।খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন, পৃ.২৯।

৭৫ Sen, Dhiman. 2008. P. 213.

৭৬ চৌধুরী, তিতাশ, ২০০০। পৃ. ৯৫-৯৯।

৭৭ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি, ১৯৮৯। পৃ. ১৫৭।

৭৮ চৌধুরী, তিতাশ, ২০০০। পৃ. ৯৫-৯৯।

৭৯ দেখুন : http://groups.yahoo.com/group/kabishabha/message/3788.

৮০ রাহী, অরূপ। ২০০৬। খনার বিজ্ঞান (সম্পাদিত), শ্রাবণ প্রকাশণী, ঢাকা।

৮১ পড়ুন: ইসলাম, শহীদুল। ২০১৩, বিজ্ঞানের দর্শন, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, পৃ. ১৮-১৯।

৮২ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি, ১৯৭৯। পৃ.২৬০।

৮৩ এটি নেয়া হয়েছে শহিদুল ইসলামের বিজ্ঞানের দর্শন  পুস্তক থেকে। শহিদুল ইসলাম তথ্যটি নিয়েছেন, J.D. Bernal, Science in history, অনুবাদ-আশিষ লাহিড়ী, প্রথম খন্ড, বিজ্ঞান চেতনা, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ-২৮৭ থেকে।

৮৪ মানুষের রাজত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে শহীদুল ইসলাম তাঁর বিজ্ঞানের দর্শন (দ্বিতীয় খন্ড) পুস্তকে ‘ফ্রান্সিস বেকনের নোভাম অর্গানাম আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারোদঘাটন’ নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন। সেখান থেকেই উক্ত অংশটি নেয়া হয়েছে। পড়ুন: ইসলাম, শহীদুল, ২০১৩। বিজ্ঞানের দর্শন, পৃ. ৩১৯।

৮৫ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি, ১৯৮৯। পৃ. ১১৪।

৮৬ ‘খনাবাদী’ মানে খনার বচন ও বিজ্ঞান-দর্শনের অনুসারী। বা যারা মিলে নিরন্তর এক অখন্ড খনার বচন নির্মাণ বিনির্মাণ করে চলেছেন। এই প্রত্যয়টি চলতি আলাপের লেখক প্রথম ব্যবহার করেন ১৯৯৬ সনে ‘বাংলাদেশে হাইব্রিড বীজের আগ্রাসন ও বীজের রাজনীতি’ বিষয়ক একটি লেখায়। লেখাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্তবাতায়ন পাঠচক্রে’ পঠিত হয়েছিল।

৮৭ বিস্তারিত জানতে পড়ুন: Partha, Pavel. 2012, ‘Climate Calendar: Changes and Challenges’ (an eco-feminist analysis on climate change and the local knowledge of rural Bangladesh), this paper was presented in the ``SAARC Festival of Literature 2012’’, 16-19 March 2012, Lucknow, India. This festival was organized by SAARC, ICCR and Arpana Caur, p.1-15.

৮৮ উদ্ধৃত হয়েছে ইসলাম, শহীদুল, ২০১৩। বিজ্ঞানের দর্শন, পৃ. ৩৬৬।

৮৯ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে বচনটি সংগ্রহ করেছিলেন শ্রীমঙ্গলের প্রণতি রায়। এছাড়া অন্যান্য বচনগুলি নওয়াজ, অধ্যাপক আলি, ১৯৮৯, পৃ. ১০-১১ এবং রায়, শ্রী, ১৯৯৮ (দ্বিতীয় সংস্করণ) থেকে নেয়া।

৯০ সংগ্রহের অঞ্চল: হাকালুকি হাওর অঞ্চল, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।

৯১ মহামতি খনা বলেছেন, মেঘের মধ্যেই বৃষ্টির প্রকৃতি বোঝা যায়। যদি মেঘের মধ্যে কোদাল-কোদাল ছোপ ছোপ হয় এবং বাতাস বয়ে যায় তবে বোঝা যায় আজকালের ভেতর বৃষ্টি হবে। এই খনার বচনটি সংগ্রহ করা হয়েছে শ্রী শান্তি রায় (৮০), সবুজবাগ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, এর কাছ থেকে।

৯২ যমুনার চরাঞ্চলের মেঘবিজ্ঞান সম্পর্কে শিখিয়েছেন প্রবীণ আজিজুল হক। আজিজুল হক (৯৫), কৃষক, মা- ওছিয়ন ও বাবা- হাজী নওশের উদ্দীন। বুলবুলিচরে জন্ম, নদীভাঙ্গনের ফলে রহমতপুর, সেখান থেকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের কাওয়াবাধা চরে বসবাস করছেন। আজিজুল হকের দাদা বানু শেখ অনেক খনার বচন জানতেন। যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের অনেকরই জীবনে আসামের নিম্নাঞ্চলে বসবাস কি উচ্ছেদ বা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। আসামের গোয়ালপাড়া থেকে হয়তো আগের মানুষেরা অনেকেই খনার বচন জেনেছেন, কিন্তু এখন দিনে দিনে চর্চার অভাবের ফলে নতুন শিশুরা এসব ভুলে যাচ্ছে বলে আজিজুলের পর্যবেক্ষণ। ১৭-২৩ জুলাই ২০১২।

৯৩ Sen, D. (2008): Impact of Khana’s Vachan on Traditional Agriculture in Bengal, p 211-224.

৯৪ দেখুন: পার্থ, পাভেল। ২০১০। ‘ইঁদুর-বন্যা’ এবং বান্দরবানের ম্রোদের জুমবিজ্ঞান: অধিপতি ও প্রান্তিক জ্ঞান কাঠামোর ঐতিহাসিক বিরোধ’ বিষয়ে একটি সাম্প্রতিক আলাপ, সুকান্ত সেন সম্পাদিত লোকায়ত জ্ঞান ও উন্নয়ন বিষয়ক ষান্মাসিক জার্নাল তৃণমূল উদ্যোগ থেকে লেখাটি নেয়া হয়েছে, ৭মবর্ষ: ১মসংখ্যা: জুন ২০১০, বারসিক, ঢাকা, পৃ. ৯-৬২ (লেখাটির শেষে লেখক জানিয়েছেন, ‘এই মূল লেখাটির রচনাকাল মার্চ ২০০৮। অবশ্য এর আগে মানে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের ভেতর ইঁদুর-বন্যা বিষয়ে ‘দৈনিক সমকাল’ এবং ‘দৈনিক প্রথম আলো’ পত্রিকায় আমি কলাম লিখেছিলাম। লেখাটি শেষ করার পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ অনেককেই আমি ই-মেইলে লেখাটি পাঠাই। পরবর্তীতে লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় রাঙমাটির জুম ঈসথেটিক কাউন্সিলের (জাক) বাত্সরিক সংকলন ত্যৈঠায়। ত্যৈঠায় লেখাটি প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের এপ্রিলে, বৈসুক-বিজু-সাংগ্রাই উপলক্ষ্যে বিশেষ এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দীপায়ন খীসা সম্পাদিত এবং হিল লিটারেচার প্রটেকশন ফোরাম- ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাওরুম পত্রিকার ২০০৮ সালের সংখ্যায় লেখাটি পুর্নমূদ্রিত হয়।’)

৯৫ Geertz, Clifford. 1992, ‘Local Knowledge and its Limits’, The Yale Journal of Criticism, Volume-5, Number-2, Yale University, p.129.

৯৬ Philip, K.S. 2001, ‘Indigenous Knowledge: Science and Technology Studies’, In : Indigenous Knowledge and Technology, International Encyclopedia of the Social & Behavioral Sciences, ISBN: 0-08-043076-7, p.7292-7297.

৯৭ Warburton, H. and Martin, A. 1999, ‘Local People’s Knowledge in Natural Resources Research’, Socio-economic Methodologies for Natural Resources Research, Chatham, UK: Natural Resources Institute.

৯৮ Beckford, Clinton and Barker, David. 2007, ‘The Role and Value of Local Knowledge in Jamaican Agriculture: Adaptation and Change in Small-scale Farming’, The Geographical Journal, Vol.173, No. 2, June 2007, p. 118–128.

৯৯ Mackinson, Steven and Nøttestad, Leif. ‘Combining Local and Scientific Knowledge’, Reviews in Fish Biology and Fisheries, 8(4):481-490.

১০০ স্থানীয় জ্ঞান ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতির দ্বন্দ্বকে বুঝতে একটি ঐতিহাসিক আইনী লড়াই সম্পর্কে জানতে দেখুন: ঝঃবত্হ, ঝরসড়হ. ২০০১-২০০২, Stern, Simon. 2001-2002, ‘Note on Between Local Knowledge and National Politics: Debating Rationales for Jury Nullification after Bushell’s Case’, Yale Law Journal, Volume-111, p. 1815-1854

১০১ আরো জানতে দেখতে পারেন: Pitt-Rivers, Lt. Gen A. Lane. 1906, The Evolution of Culture and Other Essays, edited by J. L. Myres, M.A., Oxford at the Clarendon Press.

১০২ This lecture delivered at the Royal Institution of Great Britain on Friday, May 28, 1875, and published in Proc. Boy. Inst., vol. vii. pp. 496-520, PI. i-iv. (Pitt-Rivers, Lt. Gen A. Lane. 1906, The Evolution of Culture and Other Essays, edited by J. L. Myres, M.A., Oxford at the Clarendon Press এই বই থেকে এটি উল্লেখ করা হয়েছে)।

১০৩ সামন্ত, অরবিন্দ। ২০০২, ‘ইতিহাসের অপরত্ব কিংবা অপরত্বের ইতিহাস, নিবন্ধটি নেয়া হয়েছে সমাজমনস্ক পোস্টমডার্ন সাহিত্যপত্র হাওয়া ৪৯- এর ‘অপর’ সংখ্যা থেকে, এটি সম্পাদনা করেছেন অরবিন্দ প্রধান, হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, কলকাতা-৭০, পৃ. ৮৬-৯০।

১০৪ নওয়াজ, অধ্যাপক আলি, ১৯৮৯। ঢাকা, পৃ. ১৪৮।

১০৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০।

১০৬ দেখুন: ভদ্র, গৌতম। ১৯৯৪, ইমান ও নিশান, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, পৃ. ১৪।

১০৭ Mazzocchi, Fulvio. 2006, ‘Western Science and Traditional Knowledge’, EMBO reports, V-7, N-5, European Molecular Biology Organization, p. 463-466.

১০৮ 

Calvet-Mir, Laura; Reyes-García, Victoria , and Tanner, Susan. 2008, ‘Is There a Divide between Local Medicinal Knowledge and Western Medicine? A Case Study Among Native Amazonians in Bolivia’, J Ethnobiol Ethnomed. 2008; 4: 18. Published online 2008 August 18. doi: 10.1186/1746-4269-4-18.

১০৯ এ বিষয়টি আরো জানতে দেখতে পারেন: Plumwood, Val. 1993, Feminism and the Mastery of Nature, Routledge, London and NY.

১১০ Plumwood, Val. 1993. p.195-196.

১১১ এ বিষয়ে আরো জানতে দেখুন: Plumwood, Val. 1993. p.4.

১১২ Mills, Patricia Jagentowicz. 1991, ‘Feminism and Ecology: On the Domination of Nature’, In : Hypatia vol. 6, no. 1 (Spring 1991), p-162.

১১৩ এ ক্ষেত্রে অবশ্য রাষ্ট্রের ‘সবুজ বিপ্লব’ মানসিকতা কাজ করে বেশি। ১৯৬০ এর দশকে অধিক ফসল ফলানোর নাম করে তৃতীয় দুনিয়ার দেশে মাটির তলার জল যন্ত্র দিয়ে টেনে তুলে, রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করে এক তথাকথিত উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত প্রবর্তন করার ভেতর দিয়ে যে রাসায়নিক কৃষি বাণিজ্যের সূচনা হয় তাই সবুজ বিপ্লব। যে ‘বিপ্লবের মাধ্যমে’ বহুজাতিক কোম্পানির কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্র্রসারিত হয়েছে আর নিশ্চিহ্ন হয়েছে কৃষক-জুমিয়ার ঐতিহাসিক কৃষি ও জুমপ্রাণবৈচিত্র্যের অধিকার। আর এটিই এখন ‘আধুনিক কৃষি’। ‘আধুনিকতার রাজনীতি’ বিষয়ে দক্ষিণের গরিব দেশের নিম্নবর্গ হিসেবে গভীর যাতনা উপনিবেশিক ক্ষত নিয়ে আমরা এখনও চলতে ফিরতে বাধ্য হচ্ছি। ‘আধুনিকতার’ নামে ক্ষমতার বলপ্রয়োগকে এভাবে মেনে নেয়াকেই হয়তো আন্তোনিও গ্রামসি ‘হেজিমনি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

১১৪ প্রতিবেশের সাথে সম্পর্কিত রাজনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, ক্ষমতার সম্পর্ক ও ধরণকে ব্যাখ্যা করে তাঁরা এই প্রত্যয়টি প্রস্তাব করেন। কিভাবে ‘ডিপ-ইকোলজি’ ও ‘ইকো সোশালিজম’ থেকে এই চিন্তাপদ্ধতির জায়গা আলাদা সেটিও তারা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। আরো জানতে দেখুন : Greenberg, James B. and Park, Thomas K. 1994, ‘Political Ecology’, Journal of Political Ecology, Volume-1.

১১৫ বিষয়টি আরো জানতে হলে পড়ুন: Mark Q. Sutton and E . N . Anderson. 2010, Introduction to Cultural Ecology, Second Edition, Altamira Press.

১১৬ d’Eaubonne, Frangoise. 2000, ‘Feminism - Ecology: Revolution or Mutation?’, In: Ethics and the Environment, 4(2):1 75-1 77, Copyright © 2000 Elsevier Science Inc.

১১৭ দেখুন: Mellor, Mary. 1997, Feminism & Ecology, New York University Press, New York, p. 221.

১১৮ Michael E. Zimmerman et al., (Eds.), Environmental Philosophy: From Animal Rights to Radical Ecology. Englewood Cliffs, NJ: Prentice-Hall, 1993, p. 253-267.

১১৯ দেখুন: Shiva, Vandana. 2001 (3rd impression), The Violence of Green Revolution, Other India Press in association with RFSTE, India.

১২০ দেখুন: Merchant, Carolyn. 2006, ‘The Scientific Revolution and The Death of Nature’, In : Isis, 2006, 97:513–533, 2006 by The History of Science Society.

১২১ পান্ডে, তুষার কান্তি (সম্পাদনা)। ১৯৯০, চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী, পৃ. ৪।

১২২ পার্থ, পাভেল। ২০১২। ‘গ্রামীণ শস্যপঞ্জিকা: রূপ ও রূপান্তর’ (বাংলাদেশের বন্যাপ্লাবন সমভূমি অঞ্চলের গ্রামীণ শস্যফসলপঞ্জিকার সামপ্রতিক পরিবর্তনশীলতা বিষয়ে একটি প্রতিবেশীয় সমীক্ষা)। লেখাটি সুকান্ত সেন ও সিলভানুস লামিন সম্পাদিত ও সংকলিত বাংলাদেশের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে, বারসিক, ঢাকা, পৃ. ৪৩-৭৯।

১২৩ আলাপের এই অংশটুকুর জন্য বিস্তারিত পড়ুন: পার্থ, পাভেল। ‘বাংলাদেশের লোকায়ত জলবায়ু বিজ্ঞান: একটি প্রতিবেশ-নারীবাদী আলাপ’, লেখাটির রচনাকাল ২০০৮। এটি দেশের বিভিন্ন পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয় ও অঞ্চলে আয়োজিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়ক সেমিনারে পঠিত এবং শিক্ষবার্তাসহ অনেক প্রকাশনায় প্রকাশিত।

১২৪ দাঁ, দীপক কুমার। ১৯৯৯। পরিবেশ সংকটে বিপন্ন পাখি, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী, আগরতলা, ভারত। পৃ. ১০১।

১২৫ নওয়াজ, ড. আলি, ১৯৮৯। পৃ.১২৮।

ঋণস্বীকার

বাংলাদেশের নানা প্রান্তের গ্রামীণ নিম্নবর্গের জ্ঞান ও খনাপাঠ আমার খনার বিজ্ঞান-দর্শনকে জানা-বোঝার ভিত্তি তৈরি ও মজবুত করেছে। তাঁদের সবার কাছে এই নিতান্তই ছোট্ট এক ‘খনালাপ’ আপাদমস্তক ঋণ স্বীকার করছে।

হোসেন, সেলিনা। ২০১২। জেন্ডার বিশ্বকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৮৯, খনার বচন, কৃষি ও বাঙালি সংস্কৃতি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ধানমন্ডি, ঢাকা।

Singh, Upinder. 2008, A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th Century, Pearson Education India, p.581.

চৌধুরী, তিতাশ। ২০০০, বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্যচেতনা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

Sen, Dhiman. 2008, ‘Impact of Kahan’s Vachan on traditional agriculture in Bengal’, Asian Agri-History, Vol. 12, No. 3, p. 211.

ভট্টাচার্য, পণ্ডিত রামপদ (আচার্য)। মোট ৪৭ পৃষ্ঠার বইটির কোথাও প্রকাশকাল উল্লেখ নেই। খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন। রাজেন্দ্র লাইব্রেরি, ১৩২ বিপ্লবী রাসবিহারী বসু রোড, কলকাতা-৭০০০০১।

দাস, শ্রীবাসব বিজয় (সম্পাদিত)। ১৪১৫। বৃহত্ খনার বচন (যদিও বইয়ের মলাটের ভেতরে বইটির নাম লেখা হয়েছে ‘প্রাচীন ও বিশুদ্ধ খনার বচন’), মানসী হালদার বইটি সংশোধন করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে সজল পুস্তকালয়, ৩৫ দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৬।

রায়, শ্রী বিজয় চন্দ্র (সংগ্রহ ও সম্পাদনা)। ১৯৯৮ (দ্বিতীয় সংস্করণ), খনার বচন, ২/২ জয় চন্দ্র ঘোষ লেন, ঢাকা-১১০০ থেকে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন বিজয় রায়। গ্রন্থস্বত্ব প্রকাশক। বর্ণবিন্যাস-ফাইন টাইপ কম্পিউটারস অ্যান্ড প্রিন্টার্স, শাঁখারীবাজার, ঢাকা। মুদ্রণ-ডিসি রায়, অনু প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ২/২ জয়চন্দ্র ঘোষ লেন, ঢাকা-১১০০।

পাণ্ডে, তুষার কান্তি (সম্পাদনা)। ১৯৯০, চাণক্য শ্লোক, ৭০০ প্রবাদ ও খনার বচন, কবীরের দোহা ও মীরার পদাবলী, গ্রন্থনা, কলকাতা-৯।

Chatterji, Roma. 2007, ‘Orality, Inscription and the Creation of a New Lore’, Cultural Analysis 6 (2007): 71-90, The University of California.

রিপন, জাহারাবী। ২০১০। মধ্যযুগের পাঁচালি নাট্যে বাংলার কৃষি-প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

জলিল, মুহম্মদ আবদুল। ১৯৯৫, লোকসংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

সুবাস উদ্দিন, মুহম্মদ। ২০০৭, সুনামগঞ্জের লোকসংস্কৃতি: কৃষি ও কৃষক সমাজ, বারসিক, ঢাকা।

নারীগ্রন্থ প্রর্বতনা। ২০০৭, খনার বচন, পঞ্চম সংস্করণ, ঢাকা।

Bandyopadhyay, Monanjali and Chakraborti, Kalyan. ‘Folk poetry as a Media of Agriculture Extension in Bengal’, available in


http://www.academia.edu/1604047/Full_length_paper_Folk_poetry_as_a_media_of_agricultural_extension_in_Bengal

রাহী, অরূপ। ২০০৬। খনার বিজ্ঞান (সম্পাদিত), শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।

ইসলাম, শহীদুল। ২০১৩, বিজ্ঞানের দর্শন, কথাপ্রকাশ, ঢাকা।

নওয়াজ, অধ্যাপক আলি। ১৯৭৯, খনার বচন ও কৃষি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ধানমন্ডি, ঢাকা।

Partha, Pavel. 2012, ‘Climate Calendar: Changes and Challenges’ (an eco-feminist analysis on climate change and the local knowledge of rural Bangladesh), this paper was presented in the ``SAARC festival of literature 2012’’, 16-19 March 2012, Lucknow, India. This festival was organized by SAARC, ICCR and Arpana Caur.

Geertz, Clifford. 1992, ‘Local knowledge and its limits’, The Yale Journal of criticism, Volume-5, Number-2, Yale University.

Philip, K.S. 2001, ‘Indigenous Knowledge: Science and Technology Studies’, In: Indigenous Knowledge and Technology, International Encyclopedia of the Social & Behavioral Sciences, ISBN: 0-08-043076-7.

Warburton, H. and Martin, A. 1999, Local People’s Knowledge in Natural Resources Research. Socio-Economic Methodologies for Natural Resources Research, Chatham, UK: Natural Resources Institute.

Beckford, Clinton and Barker, David. 2007, ‘The Role and Value of Local Knowledge in Jamaican Agriculture: Adaptation and Change in Small-scale Farming’, The Geographical Journal, Vol.173, No. 2, June 2007.

Mackinson, Steven and Nøttestad, Leif. ‘Combining Local and Scientific Knowledge’, Reviews in Fish Biology and Fisheries, 8(4):481-490.

Stern, Simon. 2001-2002, ‘Note on Between Local Knowledge and National Politics: Debating Rationales for Jury Nullification After Bushell’s Case’, Yale Law Journal, Volume-111, p. 1815-1854.

Pitt-Rivers, Lt. Gen A. Lane. 1906, The Evolution of Culture and Other Essays, edited by J. L. Myres, M.A., Oxford at the Clarendon Press.

সমাজমনস্ক পোস্টমডার্ন সাহিত্যপত্র হাওয়া ৪৯ এর ‘অপর’ সংখ্যা থেকে, এটি সম্পাদনা করেছেন অরবিন্দ প্রধান, হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, কলকাতা-৭০।

ভদ্র, গৌতম। ১৯৯৪, ইমান ও নিশান, সুবর্ণরেখা, কলকাতা।

Mazzocchi, Fulvio. 2006, ‘Western science and traditional knowledge’, EMBO Reports, V-7, N-5, European Molecular Biology Organization, p. 463-466.

Calvet-Mir, Laura; Reyes-García, Victoria , and Tanner, Susan. 2008, ‘Is There a Divide between Local Medicinal Knowledge and Western Medicine? A Case Study among Native Amazonians in Bolivia, J Ethnobiol Ethnomed. 2008; 4: 18. Published online 2008 August 18. doi: 10.1186/1746-4269-4-18.
Plumwood, Val. 1993, Feminism and the Mastery of Nature, Routledge, London and NY, p.195-196.
Mills, Patricia Jagentowicz. 1991, ‘Feminism and Ecology: On the Domination of Nature’, In: Hypatia vol. 6, no. 1 (Spring 1991).
Greenberg, James B. and Park, Thomas K. 1994, ‘Political Ecology’, In: Journal of Political Ecology, Volume-1.
Mark Q. Sutton and E . N. Anderson. 2010, Introduction to Cultural Ecology, Second Edition, Altamira Press.
d’Eaubonne, Frangoise. 2000, ‘Feminism- Ecology: Revolution or Mutation?’, In: Ethics and the Environment, 4(2):1 75-1 77, Copyright © 2000 Elsevier Science Inc.
Mellor, Mary. 1997, Feminism & Ecology, New York University Press, New York , pp 221.
From Michael E. Zimmerman, J. Baird Callicott, George Sessions, Karen J. Warren, and John Clark (Eds.), Environmental Philosophy: From Animal Rights to Radical Ecology, Englewood Cliffs, NJ: Prentice-Hall, 1993, pp. 253-267.
Shiva, Vandana. 2001 (3rd impression), The Violence of Green Revolution, Other India Press in association with RFSTE, India.
Merchant, Carolyn. 2006, ‘The Scientific Revolution and The Death of Nature’, In : Isis, 2006, 97:513–533, 2006 by The History of Science Society.

পার্থ, পাভেল। ২০১২। ‘গ্রামীণ শস্যপঞ্জিকা: রূপ ও রূপান্তর’ (বাংলাদেশের বন্যাপ্লাবন সমভূমি অঞ্চলের গ্রামীণ শস্যফসলপঞ্জিকার সাম্প্রতিক পরিবর্তনশীলতা বিষয়ে একটি প্রতিবেশীয় সমীক্ষা), লেখাটি সুকান্ত সেন ও সিলভানুস লামিন সম্পাদিত ও সংকলিত বাংলাদেশের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে, বারসিক, ঢাকা।

পার্থ, পাভেল। ‘বাংলাদেশের লোকায়ত জলবায়ু বিজ্ঞান: একটি প্রতিবেশ-নারীবাদী আলাপ’, লেখাটির রচনাকাল ২০০৮। এটি দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অঞ্চলে আয়োজিত ‘জলবায়ু পরিবর্তন’বিষয়ক সেমিনারে পঠিত এবং শিক্ষাবার্তাসহ অনেক প্রকাশনায় প্রকাশিত।

ব্যবহূত ওয়েব লিংকসমূহ:

http://en.wikipedia.org/wiki/Khana_%28poet%29| 
http://www.scribd.com/doc/89654073/khonar-bochon| 
http://choturmatrik.net/blogs| 
http://issuu.com/saptarishisastrologyvol7/docs/48-khannarvachan-1/1?mode=a_p
http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=4725|
http://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8| 
http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8| 
http://chorakobita.blogspot.com/2009/12/blog-post_30.html| 
http://khona.blog.com/khonas-speech/| 
http://rathindrabharati.wordpress.com/%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%9A%E0%A6%A8/
http://www.dw.de| 
http://prothom-aloblog.com/posts/16/58775|
http://prothom-aloblog.com/posts/16/53422| 
http://zizipoka.com/known-unknown/263|
http://www.somewhereinblog.net/blog/rupokrasel31/29721043| 
http://www.somewhereinblog.net/blog/qshohenq/29308834| 
http://choturmatrik.net/blogs|
http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=4725| 
http://www.ik.org.bd/?page_id=22| 
http://groups.yahoo.com/group/kabishabha/message/3788|