ভাইবোনের দিনরাত্রি

সাভারের রানা প্লাজা ধসের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৪ এপ্রিল। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন সহস্রাধিক মানুষ। তাঁদেরই একজন রমিছা বেগম। তিনি মোহাম্মদ আলী ও তাসলিমা আক্তারের মা। মাকে হারিয়ে নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়েছেন দুই ভাইবোন। তবুও সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, স্বপ্ন দেখছেন সুন্দর ভবিষ্যতের। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেই আমরা গিয়েছিলাম সাভারে।

তাসলিমা আক্তারকে পড়াশোনায় সব সময় অনুপ্রেরণা জোগান বড় ভাই মোহাম্মদ আলী। ছবি: খালেদ সরকার
তাসলিমা আক্তারকে পড়াশোনায় সব সময় অনুপ্রেরণা জোগান বড় ভাই মোহাম্মদ আলী। ছবি: খালেদ সরকার

‘পাঁচ-পাঁচটা বছর গেল, মায়ের মতো করে একবারও কেউ কইল না, ‘বাবা, খাইছ?’

এই কথা বলতে গিয়ে জগদ্দল পাথর যেন আটকাল মোহাম্মদ আলীর গলায়। মায়ের ছায়াহীন জীবনের কথা বলতে বলতে চোখজোড়া এমনিতেই ছলছল করছিল, কথাটা বলতেই গাল বেয়ে অশ্রু গড়াল, অশ্রু ঝরল তাসলিমা আক্তারের চোখেও।

বিছানার এক কোনায় বসা মোহাম্মদ আলী। তাঁর পাশেই ছোট একটা পড়ার টেবিল। সে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাসলিমা। আলীর দশম শ্রেণি পড়ুয়া বোন। অজানায় দৃষ্টি তার, ভাইয়ের কথা শুনছিল আনমনে।

দুই ভাইবোন সাভারের সিআরপি রোডের ডগরমোড়া এলাকার ভাড়া বাসায় থাকেন। সাভারের রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একমাত্র আশ্রয় মাকে হারিয়েছেন তাঁরা। এই কয়টি বছরে শোকের জীবনে নানা প্রতিকূলতা পেরোতে হয়েছে তাঁদের। ১৭ এপ্রিল গিয়েছিলাম তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে, ভাইবোনের দিবারাত্রির কথা শুনতে।

তাঁদের কথায় ঘুরেফিরে এলেন মা, মোহাম্মদ আলী ও তাসলিমার মা রমিছা বেগম। ২০১০ সালে বাবাকে হারানোর পর মা-ই তো ছিলেন সব। তিনি নিজে কষ্ট করেছেন, কিন্তু দুই সন্তানকে কোনো দিন বুঝতে দেননি। তবে মায়ের কষ্ট একসময় বুঝেছিলেন ২৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী। তাই বাড়তি কিছু রোজগারের আশায় চাকরি নিয়েছিলেন, ছেড়ে দিয়েছিলেন পড়াশোনা।

ভালোই চলছিল সব। সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছিল। মোহাম্মদ আলী চেয়েছিলেন নিজে কিছু করবেন। মাকে বলেছিলেন দোকান দেবেন। কিন্তু মা চেয়েছিলেন আলী পড়াশোনা শুরু করুক। মায়ের কথায় ফের অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন আলী।

 ‘কিন্তু সবার কপালে সুখ সয় না’, বললেন আলী। তাঁর সুখ ভঙ্গ হওয়া দুঃখদিনের কথা আমরা জানি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সে দিনটি। সকাল পৌনে নয়টায় সাভার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন নয়তলা রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে পড়ে। এতে ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তাঁদেরই একজন মোহাম্মদ আলী-তাসলিমা আক্তারের মা রমিছা বেগম। তিনি কাজ করতেন নিউ ওয়েভ বটম লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানায়। দুর্ঘটনার দিনই মায়ের মৃতদেহ পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী।

তাসলিমা-আলীর মা রমিছা বেগম।
তাসলিমা-আলীর মা রমিছা বেগম।

মাকে শেষবারের মতো রেখে আসার পর থমকে গিয়েছিল তাঁদের জীবন। আলীর ভাষায়, ‘আমার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল। চেনা ঘর অচেনা মনে হতো তখন।’

সময়ের নিয়মে তাঁদের জীবন চলতে শুরু করেছে ফের, কিন্তু সেই ক্ষত, মাকে হারানোর শোক, এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন, বয়ে বেড়াচ্ছেন মায়ের সঙ্গে অজস্র স্মৃতি। সেসব স্মৃতিই যেন অনুপ্রেরণা দুই ভাইবোনের।

 আলী চান তাসলিমা পড়ুক

মোহম্মদ আলী শিমুলতলা মোড়ে একটি দোকান চালান। দোকান বলতে ইন্টারনেটে বিভিন্ন সেবা দেন, কাজ করেন একটি ট্রাভেল এজেন্সির হয়েও। তাসলিমা আক্তার এবার সাভারের চাপাইন নিউ মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ে। মাকে হারানোর সময় তাসলিমা নিতান্তই ছোট ছিল। তাই সাভারে তাদের ফুফুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছে। একসময় মোহাম্মদ আলী ব্যস্ততার কারণে বোনের দিকে খেয়াল রাখতে পারতেন না। তাই তাকে রেখে আসেন সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় নানাবাড়িতে। সেখানেই স্কুলে পড়ছিল। গত বছর হঠাৎ খবর আসে, বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন অনেকে। কিন্তু ছোট একটা মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতেই পারেন না মোহম্মদ আলী, ‘কতই আর বয়স ওর। আমি চেয়েছি বোনটা পড়াশোনা করুক।’ তাসলিমাও চায় পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে। একদিন ভাইকে বলল, সে সাভারে আসতে চায়। মোহাম্মদ আলী নিয়ে এলেন সাভারে। ভর্তি করালেন স্কুলে।

 স্বপ্ন আছে মনে মনে

তাসলিমা ভীষণ চাপা স্বভাবের মেয়ে। কথা বলে মেপে মেপে। তাই নিজের স্বপ্নের কথা বলতেও শব্দ খরচ করতে চাইল না। শুধু মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘আছে, স্বপ্ন আছে।’ তাসলিমার স্বপ্ন মনে মনেই থাক। বাড়ন্ত হোক। কোনো একদিন হয়তো জানব তার একলা দেখা স্বপ্নের কথা।

এমন দীপ্ত পায়েই এগিয়ে যেতে চান দুই ভাইবোন।
এমন দীপ্ত পায়েই এগিয়ে যেতে চান দুই ভাইবোন।

তবে সেদিন জানা গেল, তার রোজকার জীবন প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিলে বসা, দুই কক্ষের ঘরটা নিজে কীভাবে সামলায় সে কথা। স্কুল-কোচিং শেষে বিকেলে বাসায় ফিরে রান্নার কাজটা সেরে নিতে কোনো সমস্যাই হয় না সে কথাও বলল তাসলিমা, দিনে দিনে এসব কিছুতেই অভ্যস্ত। কিন্তু কোনো কাজ করতে গেলেই শুধু মায়ের কথা মনে হয় তার। মনে হয়, মুরগির মাংসের জন্য মায়ের কাছে তার শেষ বায়নাটার কথাও।

 কেউ তাঁদের খোঁজ নিক

‘অনেকে আছে, কিন্তু কেউ নেই।’ আলী বলেন, ‘প্রথম আলোর মানুষ আর দুজন ভাইয়া-আপু ছাড়া আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না। আমাদের খবর নিতে মাঝেমধ্যে কেউ ফোন দিলে কী যে ভালো লাগে।’

আমাদের সঙ্গে দেখা হতেই সেদিন কথাটা বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার কথা। নির্ভরতার ছায়াহীন এক জীবনযাপনের কথা। শুধু অভিভাবকহীন বলে বাসা ভাড়া নিতেও কী ধকল পোহাতে হয়েছে, সে কথাও।

তাঁদের মায়ের মৃত্যুর পর মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলসহ সরকারি তহবিল ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু সহায়তা পেয়েছিলেন। সেসব অর্থের বেশির ভাগ খরচ হয়েছে। তিনটি স্থায়ী হিসেবে কিছু অর্থ জমা আছে। আলী বলেন, ‘এসব সহায়তা ছাড়া তাঁদের জীবন অনেক কঠিন হতো।’ কিন্তু তিনি চান নিজের ভালো একটা কিছু হোক।

আমরাও চাই তাঁর ভালো কিছু হোক, তাদের ভালো কিছু হোক।