অদম্য মেধাবী, অব্যাহত সহযোগিতা

২০১৯ সালে বৃত্তিপ্রাপ্ত অদম্যদের সঙ্গে অতিথিরা
২০১৯ সালে বৃত্তিপ্রাপ্ত অদম্যদের সঙ্গে অতিথিরা

সংবাদপত্রে দিনের ঘটনা বলতে যা বোঝায়, তা খুব কমই পাওয়া যায় উত্তরের জেলা রংপুরের সবচেয়ে ছোট্ট উপজেলা তারাগঞ্জে। তাই দিনের ঘটনার বাইরের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সংবাদকর্মীদের ছুটতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামে। ২০০৮ সালের ২৮ জুন একটি বিশেষ প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাদের সহকর্মী রহিদুল ইসলাম মিয়া গিয়েছিলেন উপজেলার সয়ার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে। চেয়ারম্যানের কক্ষে ঢুকে দেখেন, চেয়ারম্যানের চেয়ারের সামনে বসে আছেন এক নারী। হাতে একটা পুঁটলি। কুশল বিনিময়ের পর আলাপ জমে উঠল। আলাপ করতে করতে ওই নারী জানালেন, জয় বাংলা গ্রামের খগেন্দ্র রায়ের ছেলে জয়ন্ত রায়ের সঙ্গে তাঁর ছেলে বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। জয়ন্তর বাবা অসুস্থ। তাঁদের জমিজমা নেই। জয়ন্তর মা আরতি রানী অন্যের বাসায় কাজ করেন। পুরোনো বই, অন্যের জামায় স্কুলে যেত জয়ন্ত। সেই জয়ন্ত এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু ভালো সুযোগ–সুবিধা থাকলেও তাঁর ছেলে জয়ন্তর মতো ফল করতে পারেনি। এ জন্য স্বামী তাঁর ও তাঁর ছেলের খাবার বন্ধ করে দিয়েছেন। মারপিট করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

 বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অলিয়ার রহমানকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হন রহিদুল। ওই দিন দুপুরে জয়ন্তদের বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেশী, মা–বাবা ও জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলেন। পরদিন প্রতিবেদন পাঠালেন। জয়ন্তের জিপিএ-৫ পাওয়ার কষ্টের কাহিনি ছাপা হলো। প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে জয়ন্তকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হলো। বৃত্তির টাকায় এইচএসসি, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পরে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে।

২০০৯ সালের এপ্রিলের কোনো একদিন যশোরের কেশবপুর উপজেলার বায়সা গ্রামের এক ব্যক্তি আমাদের সহকর্মী দিলীপ মোদকের সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘শুনলাম, আপনারা লিখলে ছেলেমেয়েরা বৃত্তি পায়। আমার ভাইপো আবু হোসেন অনেক কষ্ট করে এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে।’ তাদের পারিবারিক অবস্থা শুনে পরদিন বাড়িতে গেলেন তিনি। আবু হোসেন তখন মাঠে, তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করছিলেন। বাবা মারা গেছেন আগেই। প্রতিবেশীদের কাছে খবর পেয়ে একটু পর তাঁরা এলেন। আবু হোসেনের মা শোনালেন ছেলের সংগ্রামের কাহিনি। দুই দিন পর আবু হোসেনকে নিয়ে সংবাদ ছাপা হলো। প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি পেল। এইচএসসি শেষ করে আবু হোসেন ভর্তি হলেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে। এমবিবিএস পাস করে এখন সাতক্ষীরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা কর্মকর্তার পদে কাজ করছেন তিনি। আবু হোসেনের ইচ্ছা মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার।

 জয়ন্ত রায় ও আবু হোসেনদের জীবনকাহিনি মোটামুটি একই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে দুবেলা খাবার জোটাতেই তাঁদের নাভিশ্বাস উঠত। বিদ্যাচর্চা ছিল তাঁদের কাছে বিলাসিতার অপর নাম। তবু হাল ছাড়েননি। আত্মশক্তিকে হাতিয়ার করে লেখাপড়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম চালিয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁদের অনেকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। আবু হোসেনের মতো চিকিৎসা দিয়ে কেউ মানবসেবা করছেন। জয়ন্তর মতো পুলিশ বাহিনীতে কেউ বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।

 জয়ন্ত রায় ও আবু হোসেনদের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সুবিধাবঞ্চিত যেসব শিক্ষার্থী জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন, তাঁদের সাফল্যের কাহিনি নিয়ে জেলা–উপজেলায় কর্মরত আমাদের সংবাদকর্মীরা ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত সংবাদ পাঠাতে থাকেন। প্রথম আলো তাদের বলেছে অদম্য মেধাবী। সংবাদ প্রকাশেই সীমাবদ্ধ না থেকে আরও কিছু করার ভাবনা থেকেই নেওয়া হয় অদম্য মেধাবীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির উদ্যোগ। শুরুর দিকে প্রথম আলোর নিজস্ব তহবিল, সামিট গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ, আমেরিকা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা দেয়। পরে প্রথম আলো ট্রাস্ট ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অদম্যদের শিক্ষাবৃত্তি চালু করে। ২০১০ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংক এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। ব্র্যাক ব্যাংক যুক্ত হওয়ার পরে উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ৯৪২ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছেন। বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ৪০৮ জন। ট্রাস্টের মাধ্যমে তাঁদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অদম্যদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন সময়ে অদম্যদের জীবনসংগ্রাম প্রথম আলোয় উঠে এলে তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে অর্থাভাবে ভর্তি হতে না পারার সংবাদ প্রথম আলোয় ছাপা হলেই তাঁদের একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। চলতি বছরের অক্টোবরে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া ছয় মেধাবীর সংবাদ প্রথম আলোয় ছাপা হওয়ার পর থেকে তাঁদের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রথম আলোয় যোগাযোগ করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে অর্থাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা তিন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও। এর কারণ প্রথম আলোর সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। আর বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হয় সুসাংবাদিকতা থেকে। ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা–উপজেলা পর্যায়ে প্রথম আলোর সংবাদকর্মীরা সেই সুসাংবাদিকতার চর্চাই করেন।

প্রথম আলোর ২১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় প্রকাশিত। ৩ নভেম্বর ২০১৯।