Thank you for trying Sticky AMP!!

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনাকে ভিত্তি করে পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ শিরোনামে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত মতামতের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, বর্তমান সরকারের বিগত এক দশকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার সামান্যতম প্রতিফলন পত্রিকায় প্রকাশিত মতামতে কিংবা গোলটেবিল বৈঠকে আলোকপাত হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (বহিঃপ্রচার বিভাগ) মাসুদুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে পররাষ্ট্রনীতি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন, প্রকারান্তরে বাংলাদেশের সব সরকারই তা অনুসরণ করেছে। সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুশাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, কার্যকরীকরণ এবং শক্তিশালীকরণে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যা উন্নয়ন-সহযোগী এবং বন্ধুরাষ্ট্রগুলো স্বীকার করে নিয়েছে। বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরঙ্কুশ বিজয়ে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়াটি কিছুটা সংক্ষেপ করে তুলে ধরা হলো।

ভারসাম্যের কূটনীতি

ভারসাম্যের কূটনীতির প্রশ্নেও বাংলাদেশ কোনো দেশের পক্ষ না নিয়ে জাতীয় স্বার্থ এবং ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। সরকার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে ভারসাম্যের কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করে এবং এর সুফলও পায়। এ বিষয়টির সঠিক মূল্যায়ন হলেও মতামতে তিস্তার পানি চুক্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টিকে অহেতুক আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের রাজনীতির খোলনলচে দেখার সুযোগ নেই।

সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক সই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের ভারসাম্যের কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এই দাবি অমূলক। বাংলাদেশের সঙ্গে কাতার এবং তুরস্কের সাম্প্রতিক সময়ের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় আরও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী এবং তাঁদের পাঠানো মোট ৯ বিলিয়ন ডলার মূলত সৌদি আরব এবং অন্যান্য জিসিসি দেশসমূহ থেকেই এসে থাকে।

উপমহাদেশীয় নীতি

দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক, বিমসটেক, বিবিআইএন, বিসিআইএমসহ এই অঞ্চলের আঞ্চলিক সংস্থা ও উদ্যোগগুলোকে কার্যকর করে এ অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে, আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং সর্বোপরি বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উদার প্রতিবেশী নীতির আওতায় বর্তমানে সরকার ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখে চলেছে, সেটি মিয়ানমারের সঙ্গে অনুসরণের নীতি গ্রহণ করেছে। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ায় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এ মুহূর্তে স্থবির হয়ে আছে। এ দায় বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তান সরকারের।

রোহিঙ্গা সমস্যা

গোলটেবিল বৈঠকের দাবি অনুযায়ী সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি আন্তর্জাতিকীকরণ করতে পারেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ সক্রিয় কূটনীতির কারণে সমস্যাটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটি, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের জোরালো সমর্থন আদায় করতে পেরেছে। জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রেখেছে।

ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিশ্বের সব শান্তিকামী দেশ রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত মিয়ানমারের সব অমানবিক কার্যক্রমে এবং এর ফলে উদ্ভূত মানবিক, আঞ্চলিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। সম্প্রতি ভারত ও চীন সরকার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে একযোগে কাজ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। চীন ও ভারত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। উপরন্তু এ দুই দেশ রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মানবাধিকার সংরক্ষণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ দেশে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে সরকার এক বিরাট মানবিক বিপর্যয় ওই সময় রোধ করতে পেরেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী প্রজ্ঞায় এবং মানবিক অনুধাবনে অনুসৃত বাংলাদেশের ওই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে সারা বিশ্ব অকুণ্ঠে সাধুবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসনের চুক্তির আওতায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ এবং সম্মানজনক একটি প্রত্যাবাসনের জন্য নিয়মিত বিরতিতে কাজ করে চলেছে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব

গোলটেবিল বৈঠকে পররাষ্ট্রনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নে পররাষ্ট্রনীতিতে লুকোছাপার প্রসঙ্গটি এসেছে। জাতীয় সংসদ, বিআইআইএসএস, এনডিসি, ফরেন সার্ভিস একাডেমিসহ একাধিক সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের আলোকে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সর্বদা সচেষ্ট থেকেছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, সাবেক কূটনীতিক এবং ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বৈঠক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত তিন মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনটি প্রভাবশালী দেশ যথাক্রমে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সফর করেছেন। গত ৩০ ডিসেম্বরের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত, রাশিয়া ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় আসেনি। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনাই করেননি, বরং বাংলাদেশের নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সামগ্রিক অগ্রগতিতে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ তিনটি দেশেরই সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘ভয়ংকর টাইমবোমার’ সঙ্গে তুলনা করার মন্তব্যটি যথাযথ নয় বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবাসনে একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করে চলেছে, সেখানে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিসমূহ ‘মিয়ানমারের শর্ত পূরণ করে চলেছে’, এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই।