পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে—এই জিজ্ঞাসা নিয়ে সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন রাজনীতিক, কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। আলোচনায় উঠে আসে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভেতর-বাহির, জাতীয় নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা দিক। আয়োজক ছিল বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)।

আলোচনায় প্রায় সব বক্তা অভিমত প্রকাশ করেন, যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হলো সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্য সুদৃঢ় না হলে সেটি অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘সার্বভৌমত্ব’ বিকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে থাকে, যা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে ক্ষমতার পালাবদল হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিও অনেকটা বদলে যায় বলে জনমনে ধারণা আছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক আলোচক। ২০০৯ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছিল, পরবর্তী সময়ে সেই ধারা সব ক্ষেত্রে বজায় রাখা যায়নি। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

ভারসাম্যের কূটনীতি

আওয়ামী লীগ সরকার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব রেখে ভারসাম্যের কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করে এবং এর সুফলও পায়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, চীন-জাপান এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব আর লুকোছাপার বিষয় নয়। বাংলাদেশ এই পাঁচ প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সংহত অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে কৌশলগত সামরিক সহযোগিতারও সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীর। আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এই দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে যেন আমরা জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি ভুলে না যাই, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হয়নি, যদিও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তাঁর এবং শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই চুক্তি সই হবে। এমনকি গত সাত-আট বছর যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসির) বৈঠকও হয়নি। এটি কূটনৈতিক ব্যর্থতাও বটে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো সম্পর্ক থাকার দাবি করলেও জিএসপি সুবিধা আদায় করতে পারেননি। আবার সুযোগ পেলে সরকারি দলের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দ করতেও দ্বিধা করেন না।

কূটনীতিকদের মতে, সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক সই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের ভারসাম্যের কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কেননা সেখানে সৌদি আরব একতরফাভাবে ইয়েমেনে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও সাবধানে পা ফেলা উচিত।

উপমহাদেশীয় নীতি

আলোচনায় আসে উপমহাদেশীয় রাজনীতির ভারসাম্যহীনতার বিষয়টিও। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় এসে উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছিল, এখন আর তা নেই। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি ও ইসলামাবাদ ছুটে গিয়েছিলেন ‘শান্তির বার্তা’ নিয়ে। দিল্লির ইচ্ছায় এখন সার্ক পুরোপুরি অকার্যকর। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সার্কের প্রয়োজন আছে। সম্প্রতি ভারতের প্রবীণ কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবেও প্রথম আলোকে বলেছেন, সার্ককে দাফন করার প্রয়োজন নেই। ফের জেগে উঠতে পারে। সার্কের বিকল্প হিসেবে বিবিআইএন ও বিসিআইএম নামে যেসব আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাও সফল হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক কোন পর্যায়ে আছে—জানতে চাইলে একজন কূটনীতিক বলেন, ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ে।’ তবে এর জন্য উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইসলামাবাদের নাক গলানোও দায়ী।

রোহিঙ্গা সমস্যা

কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭১ সালে ভারতে বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি ইন্দিরা গান্ধীর সরকার যেভাবে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে পেরেছিল, আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। যদিও মিয়ানমার দুই সপ্তাহের মধ্যে ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে তিনটি দেশ (রাশিয়া, ভারত ও চীন) মিয়ানমারকে অধিক চাপ সৃষ্টি করতে পারত, সেই তিনটি দেশের কূটনৈতিক সমর্থন পেতেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। অন্যদিকে মিয়ানমার দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সমর্থন আদায় করতে পেরেছে। কূটনীতিকদের মতে, মিয়ানমার সরকার যে এত বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে, তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ধারণাই করতে পারেননি। আগে থেকে যে সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছিল, তাদের বিষয় অধিক সোচ্চার হলে হয়তো ২০১৭ সালের বিপর্যয় এড়ানো যেত।

 এ ছাড়া ২০১৭ সালে সমস্যার শুরুতে যেভাবে ‘সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছিল’ তাও ঠিক হয়নি বলে মনে করেন বৈঠকে উপস্থিত নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। পরবর্তী সময়ে সরকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করলেও খুব লাভ হয়নি। সেনাসদস্যদের ওপর হামলার পর মিয়ানমার সরকার প্রচার চালিয়েছে যে তারা নিরীহ মানুষ নয়, সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে দিয়েছে। মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের জায়গা দিলেও তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, তা ইয়াঙ্গুন সরকার কখনো স্বীকার করেনি। এমনকি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। মিয়ানমার শুধু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির দুঃসাহস দেখাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করব না। কিন্তু আক্রান্ত হলে যে বাংলাদেশ পাল্টা আঘাত হানতে প্রস্তুত আছে, তাদের এই বার্তাটি দেওয়া উচিত। বর্তমান যুগে শুধু সেনাবাহিনীর আকার এবং সমরাস্ত্রের পরিসর দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয় না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তির যে বিন্যাস, সেটাই দেশের নিরাপত্তাকে সংহত করে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব

আলোচনায় একাধিক কূটনীতিক বলেছেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে সবকিছু গোপন রাখার যে প্রবণতা, সেটি পররাষ্ট্রনীতিতেও বহাল আছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পার্লামেন্টে ও সংসদীয় কমিটিতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কূটনীতিকদের মতামত নেওয়া হয়। সাবেক কূটনীতিকদের নিয়ে ‘থিংক ট্যাংক’ গঠিত হয়ে থাকে। সবার মতামতের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল নির্ধারিত হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সবকিছু চলে লুকোছাপার ভেতর দিয়ে। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে, তা নিয়েও জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি বা সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে। যখন কোনো সমস্যা আসে, সেটি নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু সমস্যা মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি বা টেকসই কোনো পরিকল্পনা থাকে না বলেও অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ। অনেক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানে না, এসব নীতি কীভাবে নির্ধারিত হয়। কেউ কেউ বিশেষ সংস্থাগুলোর প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বৈঠক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত তিন মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনটি প্রভাবশালী দেশ যথাক্রমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সফর করেছেন। সম্প্রতি মস্কো সফরকালে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে রাশিয়া মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। তবে প্রায় একই সময়ে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসে বলেছেন, মিয়ানমার সরকার রাখাইনে এমন কিছু করেনি, যাতে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেই মনে করেন দেশের সাবেক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আলোচনায় তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করতে না পারা বাংলাদেশের অন্যতম কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন সফরকালে তাঁর প্রতিপক্ষ যথাক্রমে সুষমা স্বরাজ ও মাইক পম্পেওর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নয়াদিল্লিতে না হলেও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাম্প্রতিক নির্বাচন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একই রকম অভিযোগ এসেছে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও।

অস্বীকার করা যাবে না যে রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার সহায়তা ছাড়া কাউকে পাশে পাইনি। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার সেই চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

পররাষ্ট্রনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বরের পর পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও রোহিঙ্গা সমস্যাটি যেভাবে বাংলাদেশে চেপে বসেছে, তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি।’ রোহিঙ্গা সমস্যাকে তিনি ‘ভয়ংকর টাইম বোমা’র সঙ্গে তুলনা করে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যেভাবে এগোচ্ছেন এবং একের পর এক মিয়ানমারের শর্ত পূরণ করে চলেছেন, তাতে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও শক্ত অবস্থানে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই কূটনীতিক।