Thank you for trying Sticky AMP!!

হত্যা না করে হাতি তাড়ানোর যত কৌশল

একটি হাতি সাধারণত ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, সেখানে লোকালয়ে এসে মারা পড়ছে হাতি। সম্প্রতি শেরপুরের শ্রীবরদী থেকে তোলা ছবি।

শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে একটি বন্য হাতির মরদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এবং শেরপুরের শ্রীবরদীতে বৈদ্যুতিক শকে, কক্সবাজারের চকরিয়ায় শিকারিদের গুলিতে একটি করে হাতির মৃত্যু হয়। এ নিয়ে এক সপ্তাহে সারা দেশে চারটি হাতির মৃত্যু হলো।

বন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনে খাদ্যের অভাবে হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। এ কারণে মানুষ ও হাতির মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়েছে। এটা এড়াতে প্রচলিত কৌশল বা পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

Also Read: হাতিই তো মরেছে, এর জন্য আবার এত কিছু?

মহাবিপন্ন হাতি সংরক্ষণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন’ প্রকল্পের আওতায় স্ট্যাটাস সার্ভে অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব এলিফ্যান্ট অ্যাকশন প্ল্যান ফর বাংলাদেশ উপপ্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৬ সালে মানুষ-হাতি সংঘাত নিরসনে বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার জন্য একটি মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপনা সহায়িকা প্রকাশ করা হয়।

বাংলায় সহজ ভাষায় লেখা এ সহায়িকায় বলা হয়, মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে হাতির বাসস্থান, করিডর ও বিচরণভূমি ধ্বংস করছে। ফলে তারা লোকালয়ে চলে আসছে, এতে সংঘাত বেশি হচ্ছে। মানুষের ক্রমাগত বনে প্রবেশের ফলে হাতি তার সহজাত ভীতি বোধটুকু হারিয়ে ফেলে। একসময় বেপরোয়া হয়েই মানুষকে আক্রমণ করে বসে। অপরিকল্পিত বনায়ন, শুকনো মৌসুমে পানি কমে যাওয়া, হাতির খাদ্য নয়, এমন কোনো নির্দিষ্ট উদ্ভিদের একক বন তৈরি করা (সেগুন, রাবার, চা এবং অন্যান্য ফসল চাষ করা), দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণে ব্যবহৃত কাঁটাতারও হাতির জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ত্রুটিপূর্ণ বনায়ন কৌশলের অংশ হিসেবে বাঁশ, বেতগাছ কেঁটে ইউক্যালিপটাসসহ নানা রকমের বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। এ গাছগুলো হাতির খাবারে কোনো কাজে লাগে না। হাতির দিনের প্রায় ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা সময় চলে যায় খাবারের খোঁজে। বনে খাবারের স্বল্পতা, তাই যেসব এলাকায় খাবার পাওয়া যায়, সেসব এলাকায় চলে যাচ্ছে হাতির দল।

হাতি মারতে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি শেরপুরের শ্রীবরদী থেকে তোলা।

একটি হাতি সাধারণত ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এদের ছয়বার পর্যন্ত দাঁত গজায়। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির উচ্চতা সাধারণত ৭-১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং লেজের আগা থেকে শুঁড়ের মাথা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮-২৫ ফুটের মতো হতে পারে। গড়ে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতির ওজন ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

সাধারণত একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতি দিনে প্রায় ১৫০ কেজি খাবার ও ২১০ লিটার পর্যন্ত পানি গ্রহণ করে থাকে। হাতি প্রায় ২২ মাস গর্ভধারণ করার পর বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে। সাধারণত প্রতিবারে হাতি একটি করে বাচ্চা প্রসব করে থাকে। প্রায় সাত বছর বয়সে হাতি শারীরিক পূর্ণতা পায় এবং ১৪-১৫ বছর বয়সে যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। হাতির মল থেকে কাগজ, নোটবুক ইত্যাদি তৈরি করা যায়।

লোকালয় থেকে হাতি তাড়াতে ১৯৭৫ সালে ভারতে হাতির ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে মারা হতো। ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে হাতিকে ভয় দেখাতে বাঘের ডাক রেকর্ড করে বাজানো, বাঘের মূত্র ফসলি জমিতে ছিটানো হয়েছিল। তবে এসব পদ্ধতি তেমন কার্যকর হয়নি। ২০০২-০৩ সালের দিকে ভারতে লোকালয়ে চলে আসা কিছু হাতির গলায় রেডিও কলার পরানো হয়েছিল। তবে এটি ছিল ব্যয়বহুল। ২০০৬-০৭ সালে ভারতে ফসল রক্ষার জন্য শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছুড়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
বাংলাদেশেও মানুষ আর হাতির সংঘাত এড়াতে বিভিন্ন পদ্ধতি বের করা হয়েছে।

সহায়িকাতে সে ধরনের বেশ কিছু পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন দূর থেকেই হাতির চলাচলের ওপর নজর রাখার জন্য উঁচু গাছ বা টাওয়ারের ওপর স্থাপিত পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প ওয়াচ টাওয়ার এগুলোর মধ্যে একটি। কাঁটাযুক্ত এবং ছোট ছোট বীজ আছে এমন গাছ বা উদ্ভিদ হাতি এড়িয়ে চলে। এ ধরনের গাছপালা দিয়ে ফসলের জমি ঘেরাও দিয়ে রাখলে এতে হাতির আক্রমণের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। একইভাবে চাষিরা হাতির অপছন্দের শস্যগুলো চাষ করলে হাতির আক্রমণের হার কমে যাবে।

বিদ্যুৎ–চালিত বেড়া দিয়ে জমির সীমানা ঘেরাও করার পর যদি সেখানে হাতি আসার চেষ্টা করে, তবে হাতিটি ওই তারের অতি নিম্নমাত্রার বৈদ্যুতিক প্রবাহে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে। এতে হাতি ভয়ে আর এ জায়গায় আসবে না।

ট্রিপ অ্যালার্ম স্থাপন পদ্ধতি বা একটি ধাতব তারে ঘণ্টা বা অ্যালার্ম লাগিয়ে বনের সীমানার গাছগুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই সীমানা অতিক্রম করতে গেলেই হাতির সংস্পর্শে এসে তারটিতে টান পড়ে উচ্চ স্বরে ঘণ্টা বেজে ওঠে। চিলি রোপ বা চিলি স্মোক পদ্ধতিতে একটা মোটা দড়িতে আঠালো কিছু জিনিসের সঙ্গে মরিচের গুঁড়া মেখে ফসলের খেতের চারপাশে এমনভাবে রেখে দিতে হবে, যাতে বাতাসের তোড়ে বনের দিকে মরিচের ঝাঁজটি যায়। হাতি যখনই বন থেকে খেতের দিকে আসবে, তখন তার নাকে মরিচের ঝাঁজ গেলে সে আর এই মুখী হবে না।

এ ছাড়া ময়লা-আবর্জনা মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা, হাতির পছন্দের খাবার মজুত না করা, রাতের বেলায় বাইরে বের হতে হলে একটি টর্চলাইট সঙ্গে রাখা, মাতাল অবস্থায় বনে না হাঁটা, সাদা বা উজ্জ্বল রঙের কাপড় না পরা, হাতির খাওয়াদাওয়ার সময় সেটাকে বিরক্ত না করা, বনে ধূমপান না করা, বাড়িতে উজ্জ্বল রং ব্যবহার না করা, হাতি আক্রান্ত হলে কখনো সোজাসুজি না দৌড়ে এঁকেবেঁকে দৌড় দেওয়া, চিৎকার করতে থাকাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এ সহায়িকাতে। হাতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে খুব তাড়াতাড়ি (অনধিক ৩০ দিনের মধ্যে) ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শেরপুরের যে জায়গায় হাতি মারা গেছে, সেখানে ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ। দুই দিন সেখানে ছিলেন তিনি। অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, হাতি বর্তমান পৃথিবীতে স্থলভাগের সবচেয়ে বৃহত্তম প্রাণী। এই হাতিরই যখন এই অবস্থা, তাহলে অন্যান্য বন্য প্রাণীর অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ শ্রীবরদীতে অবস্থান করার সময়ের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি হাতির যে দলটিকে দেখেছি, তাতে কম করে হলেও ১১টি বাচ্চা হাতি ছিল। এদের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচটির জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে আসার পর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারি জায়গায় সবজি, মাছ চাষ, বাড়িঘর কেমনে করছে মানুষ? বনের মধ্যে মানুষের বসতি স্থাপনই হাতি ও মানুষের সংঘাতের বড় কারণ। তাহলে বন বিভাগ কী করছে? হাতি মানুষ মারলে তিন লাখ টাকা পাওয়া যাচ্ছে, আর এতগুলো হাতি মারা গেল বা যাচ্ছে, তার কিছুই হচ্ছে না। বন বিভাগকে আইনের প্রয়োগ তো করতে হবে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ তো হচ্ছে না।’

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বছরে ৫৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মারা গেছে মানুষের হাতে। আর এ সময়ে হাতির আক্রমণে ১৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে হাতি হত্যার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ সাজা পেয়েছে এমন নজিরও নেই।

আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেডের ইনচার্জ আদনান আজাদ দুই বছর ধরে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাতি দিবসে রাজধানী ঢাকায় হাতি রক্ষায় করণীয় নিয়ে সেমিনার হয়।

আলোচনা সভা হয়। এতে শেরপুরের শ্রীবরদী বা চট্টগ্রামের যেসব এলাকায় হাতির অবস্থান, সেখানকার স্থানীয় মানুষের কোনো উপকার হয় না। শ্রীবরদীতে হাতিটি মারা যাওয়ার আগে আদনান আজাদ ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, সাধারণ কৃষক এবং বিশেষ করে কিশোরেরা হাতির দলকে মারতে আগুন ছুড়ে মারাসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করছে। বৈদ্যুতিক তার দিয়ে হাতি মারার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সাধারণ কৃষক বা কিশোরেরা হয়তো জানেই না হাতি মারা আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তাই বন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ঢাকায় সভা, সেমিনার না করে যেসব এলাকায় হাতি ও মানুষের সংঘাত বাড়ছে, সেসব এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগে জনবলস্বল্পতা আছে। হাতি সংরক্ষণে বাজেটেরও স্বল্পতা আছে। এই মুহূর্তে হাতি সংরক্ষণে কোনো চলমান প্রকল্প নেই। তবে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মানুষ ও হাতির সংঘাত নিরসনে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়কে। জনবল বাড়ানোর বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়েছে।

মোল্যা রেজাউল করিম জানালেন, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মানুষ ও হাতির সংঘাত নিরসনে হাতির আবাসস্থল ও করিডর চিহ্নিত করার জন্য একটি গবেষণা চলছে। এটি শেষ হবে আগামী ডিসেম্বর মাসে। গবেষণার ফলাফল হাতে পেলে হাতির আবাসস্থল ও করিডর থেকে মানুষের ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সংঘাত নিরসনে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম বা সংক্ষেপে ইআরটি গঠন করা হয়েছে।

স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে, স্থানীয় পর্যায়ে পরিচালিত, মানুষ-হাতি সংঘাত নিরসন ও হাতি সংরক্ষণে এটি একটি অরাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী দল। স্থানীয় গ্রামবাসীই এ এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্য। এই টিমগুলোকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।