হাতিই তো মরেছে, এর জন্য আবার এত কিছু?

বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে শেরপুরে এই হাতির মৃত্যু হয়সংগৃহীত

গত মঙ্গলবার শেরপুরের শ্রীবরদীর রাণীশিমুল ইউনিয়নের মালাকোচা গ্রামের টিলা থেকে এক বন্য হাতির মরদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। বন বিভাগের লোকজন ওই স্থানেই হাতিটিকে মাটিচাপা দেন। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে সীমান্তের ওপার থেকে একদল বন্য হাতি খাবারের সন্ধানে শ্রীবরদী লোকালয়ে নেমে আসে। তাই সন্ধ্যা হলেই কৃষকেরা হাতির আক্রমণ থেকে তাঁদের সবজিখেত, ফসল রক্ষা করতে বিভিন্ন স্থানে জেনারেটরের মাধ্যমে জিআই তার দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ দেন। সেই বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়েই হাতিটি মারা যায়।

মৃত হাতিটির ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভেটেরিনারি সার্জন মেহেদী হাসান বলেছেন, হাতিটির বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর। এর দৈর্ঘ্য ১৫ ফুট। ময়নাতদন্তে হাতিটির শুঁড়ে বিদ্যুতের ঝলসানো দাগ দেখা গেছে। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয়ের জন্য হাতিটির দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

শ্রীবরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে মৃত হাতি উদ্ধার বিষয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বছরে ৫৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মারা গেছে মানুষের হাতে। আর এ সময়ে হাতির আক্রমণে ১৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে হাতি হত্যা করার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ সাজা পেয়েছে, এমন নজিরও নেই।

শেরপুরে হাতিটি মারা যায় ৯ নভেম্বর। এর আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিলের ধানখেত রক্ষায় কৃষকদের টানানো বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে একইভাবে আরেকটি বন্য হাতির মৃত্যু হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) হাতিকে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা গণনার সর্বশেষ সমীক্ষাটি হয়েছে ২০১৬ সালে। সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে স্থায়ী হাতির সংখ্যা ২১০-৩৩০টি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যবর্তী সীমানা দিয়ে চলাচলকারী অভিবাসী হাতির সংখ্যা ৭৯-১০৭টি। একই সমীক্ষায় সারা দেশে পোষা হাতির মোট সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৯৬টি, যার মধ্যে ৪২টি পুরুষ ও ৫৪টি স্ত্রী। বন অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে হাতির সংখ্যা কমে ২৬০টিতে নেমে এসেছে।

বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বন্য হাতি মারা হলে বা হাতির শরীরের কোনো অংশবিশেষ পাচার করা হলে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। শেরপুরে হাতি মারা যাওয়ার আগে চট্টগ্রামে গত সপ্তাহেই বৈদ্যুতিক তারে লেগে আরেকটি হাতি মারা গেছে। অথচ হাতি ফসলের ক্ষতি করলে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার। হাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেলে পরিবার পাচ্ছে তিন লাখ টাকা। তিনি জানান, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে হাতি হত্যার বিষয়টি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার থেকে শেরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে।

২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বলছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স গ্রহণ না করে কোনো বাঘ বা হাতি হত্যা করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এ অপরাধের জন্য জামিন অযোগ্য হবেন এবং তিনি সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাঘ বা হাতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে এবং এর ফলে জীবনাশঙ্কার সৃষ্টি হলে জীবন রক্ষার্থে আক্রমণকারী বাঘ বা হাতিকে হত্যার ক্ষেত্রে এ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।

বন অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলো শেষ পর্যন্ত তেমন একটা ধোপে টেকে না। ভাবটা এমন থাকে, হাতিই তো মারা গেছে, এর জন্য আবার এত কিছু করতে হবে কেন?

হাতির থেকে ফসল বাঁচাতে বেড়ায় বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করে স্থানীয় লোকজন
ছবি: আদনান আজাদ

শেরপুর বন বিভাগের বালিজুরির রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম তাঁর সাড়ে চার বছরের চাকরিজীবনের কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এলাকাসহ শেরপুরে এ সময়ে প্রায় ১২টি হাতিকে মারার ঘটনা ঘটেছে। আগেরগুলো অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এবারই প্রথম হাতি হত্যা মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।’

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে আজ শুক্রবার সকালে কথা হয়। তিনি চার মাস ধরে বর্তমান কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে আজ বাঁশখালীতে একটিসহ মোট তিনটি হাতি মারা গেছে বলে জানান তিনি।

রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর দেওয়া তথ্য বলছে, গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের ঈদগা উপজেলার পূণ্যগ্রামে একটি মাদি হাতিকে গুলি (স্থানীয়ভাবে তৈরি অস্ত্র দিয়ে) করে হত্যা করা হয়েছে। মামলার পর একজন আসামি বর্তমানে কারাগারে। এর আগে সাতকানিয়ায় বৈদ্যুতিক তারে হত্যা করা হয় একটি হাতিকে। এ ঘটনায় আসামি চিহ্নিত করা হয়েছে ও হত্যার আলামত হিসেবে জিআই তারসহ অন্যান্য আলামত আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। আর আজকে যে হাতিটি মারা গেছে, সেটির বয়স প্রায় ৬০ বছর। হাতিটির শরীরে গুলি বা অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ফসলি জমিতে মারা গেছে, তাই বিষ প্রয়োগ করে মারা হয়েছে, নাকি বয়সের কারণে হাতিটি মারা গেছে, তা জানার জন্য ময়নাতদন্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর অভিজ্ঞতায় জানান, স্থানীয় জনগণ হাতি সংরক্ষণে সচেতন না হলে হাতি রক্ষা করা বেশ কঠিন। বন বিভাগের জনবলের স্বল্পতা তো আছেই। তাঁর মতে, সরকারের তরফ থেকে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যদের আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হলে এ টিমের সদস্যরা মনোযোগ দিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন।

আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেডের ইনচার্জ আদনান আজাদ দুই বছর ধরে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শ্রীবরদীতে হাতিটি মারা যাওয়ার পর আদনান তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বুনো হাতির আবাসস্থল শেরপুরের গারো পাহাড় ও আশপাশের বনাঞ্চল। পাহাড়ি এই বনগুলো বাইরে থেকে দেখলে ঠিক গভীর বনের মতোই লাগে। কিন্তু বনের কিছুটা গভীরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়, বন কেটে সাফ করে সেখানে সবজি চাষ করা হচ্ছে। হাতি যাতে সেই সবজিখেতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সবজিখেত এর চারপাশ দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে বৈদ্যুতিক তারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেনারেটর চালিয়ে তারে বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। সবজিচাষিরা বিশেষ পদ্ধতিতে কিছু অস্ত্রশস্ত্র বানিয়ে রেখেছেন হাতি মারার জন্য। ফলা বা বর্শার মাথায় আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে। হাতি বাগানের কাছাকাছি চলে এলে এই বর্শার মাথায় আগুন লাগিয়ে হাতির দিকে ছুড়ে মারা হয় এবং ফালার সামনের সুচালো অংশটা হাতির দেহে ঢুকে যায় । শরীরে আগুন লাগে।’

প্রথমে আলোচনায় থাকে, পরে একেবারে চুপ

২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট ভারত থেকে বন্যার পানিতে ভেসে আসা বন্য হাতি ‘বঙ্গ বাহাদুর’-এর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আইনি নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। মৎস্য ও পশুসম্পদ সচিব, বন ও পরিবেশসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ ছয়জনের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।

জামালপুরের সরিষাবাড়ীর কয়ড়া গ্রামে বঙ্গ বাহাদুরের মৃত্যু হলে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। ঢাকার বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বক্তব্য ছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করেও হাতিটিকে বাঁচানো যায়নি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামু উপজেলার ধোয়া পালং এলাকায় বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে বন্য মা হাতি মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ। মা হাতিটি মারা যায় ৩১ আগস্ট।

গত বছর কক্সবাজারের টেকনাফের হাতিটি বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। গত বছরের ১৪ জুন প্রথম আলোতে বান্দরবানের লামা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বন্য হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। লামার ফাঁসিয়াখালীতে রাতে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী হাতিটিকে হত্যা করা হয়। আর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে একটি হাতিকে হত্যা করা হয় বিষ প্রয়োগ করে।

সীমান্তের ওপার থেকে একদল বন্য হাতি খাবারের সন্ধানে শ্রীবরদী লোকালয়ে নেমে আসে
ছবি: আদনান আজাদ

২০১৯ সালের নভেম্বরে লামার ফাঁসিয়াখালীতে বৈদ্যুতিক ফাঁদে দুটি বাচ্চাসহ চারটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। বনের সুস্বাস্থ্যের প্রতীক ভাবা হয় হাতিকে। আর হাতি এভাবেই একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে। তা নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্যও হচ্ছে না।

অথচ গত বছর ভারতের কেরালার পালাক্কাড়ে বিস্ফোরক ভরা আনারস মুখে দিলে তা ফেটে গিয়ে গর্ভবতী বুনো হাতিটি মারা গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এর এক মাসের মধ্যে একইভাবে আরেকটি হাতি মারা গিয়েছিল। বিরাট কোহলি, অক্ষয় কুমার, আনুশকা শর্মা, জন আব্রাহাম, শ্রদ্ধা কাপুরসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সামাজিক মাধ্যমে গিয়ে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের শেরপুর বা যেখানেই হাতি মারা যাক, কতিপয় বন্য প্রাণী প্রেমিক ছাড়া আর কারও মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।