Thank you for trying Sticky AMP!!

'আমার ভাই বকরের খুনি কে?'

আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো

খবরের কাগজে পাসপোর্ট আকারের কোনো ছবি দেখলে খুব কষ্ট লাগে। কারণ, এই আকারের ছবিগুলোয় ছাপিয়ে থাকে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষটার মুখ। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ার বাইরে থেকেও ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আজকের এই দিনে (২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি) না–ফেরার দেশে চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ও আমার ভাই আবু বকর।

তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই থমকে যাই। চাপা কষ্ট অনুভূত হয়। আবু বকর শুধু আমার মেজ ভাই নন, আমার বন্ধুও বটে। রাজনৈতিক মত আর আদর্শের বাইরে অবস্থান থাকলেও ‘বাঁধন’ তাঁকে ছেড়ে দেয়নি, তিনিও ছাড়েননি ‘বাঁধন’কে। ‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন’—এই বাণীটার প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। বহুবার রক্তও দিয়েছেন আমার ভাই।

আমার ভাই থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষ। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম, সঙ্গে ছিলেন আমার বাবা। আমি ভাইয়ের কক্ষে গেলাম। দরজায় কড়া নাড়লাম। কেউ একজন দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢোকার সময় জুতা খুলতে বলল। পেছন থেকে আরেকজন বলল, জুতার সঙ্গে রক্ত লেগে যাবে। তাই করলাম। বাবা আগে গেলেন, এরপর আমি। কক্ষের মাঝখান বরাবর রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার দাগ। শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। যতটুকু তাজা আছে, তা কিছু পিঁপড়া চুষে খাচ্ছে, মশা আর মাছিরাও অংশ নিয়েছে তাতে। সবখানে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভাবলাম, কিছু মানুষের রক্তে শুধু জোঁক নয়, মশা–মাছিরও হয়তো অধিকার আছে।

বাবা টেবিলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। বাবা পাঞ্জাবি দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। এরপর গেলাম বেলকনিতে।

ভাইয়ের বন্ধুদের দাবি, ‘ওই যে ৫০৩ নম্বর কক্ষ। ওখান থেকে গুলি করা হয়েছিল। এরপর সেই গুলি বকরের মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বাবা বলে চিৎকার করে এখানে পড়ে যায়, এরপর আর কোনো কথা বলেনি।’ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোঁতা কোনো বস্তু, হাতুড়ি অথবা রডের আঘাতে আবু বকরের মৃত্যু হয়েছে।

১০ বছর পর আজ মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মৃত্যুর পর তাঁর বাবার দোয়া করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র স্থান, যেখানে কোনো ছাত্র হত্যার বিচার ঠিকমতো হয়নি। এ দেশে গরিব মারা গেলে তিন দিনে কবরে ঘাস জন্মায়।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গেলাম। সঙ্গে ছিলেন আমার বাবা। সেখানে একজন স্যার আমাকে বললেন, ‘তোমার ভাই আবু বকর সম্পর্কে দু-এক মিনিটে আমাদের কিছু বলো।’ আমি মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, দু–এক মিনিটে কী আর বলব। তখন মনে পড়ল আমার ভাইয়ের একটি কথা। একদিন আমরা দুই ভাই মিলে একসঙ্গে ধান কাটছিলাম। তখন বকর ভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘দোয়া করিস, এবার যদি প্রথম হতে পারি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারব।’ আমার ভাই আমাকে বলেছিলেন, ‘জীবনে মা-বাবা আর শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবি না। প্রতিটি সেকেন্ডের মূল্য দিবি, সময় কারও পাওনা বাকি রাখে না।’

আপনমনে ভেবে চলি। কেবল বকর ভাইয়ের ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। তখন একজন স্যার আমাকে বললেন, ‘কিছু বলো, কিছু বলো।’

আমি ছিলাম বাক্‌রুদ্ধ। কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। কেবল চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।

ওমর ফারুক। ছবি: সংগৃহীত

আমি বলেছিলাম, ‘অনেক কথা বুকে জমাট বেঁধে আছে, কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। তবু আমি বলেছিলাম, শহীদ আবু বকর শুধু আমার ভাই না, আপনাদেরও ভাই, আপনাদের বন্ধু। তাঁর জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন। হত্যাকারীর জীবনে যেন হয় এটাই শেষ হত্যা। আবু বকরের মতো কফিনে করে নয়, সার্টিফিকেট আর মিষ্টি হাতে মায়ের কাছে ফেরা হোক সবার, এই প্রত্যাশাই করি।’

আমরা যারা বহু যুদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধূলিকণা পবিত্র মনে হয়।

আজ ভাইয়ের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। গভীরভাবে মনে পড়ছে একসঙ্গে কাটানো শৈশবের দিনগুলো।

ভাই, তুমি চির ভাস্বর, চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তুমি আছ সর্বত্র, শান্তিতে ঘুমাও তুমি, ভাই।

আমার ভাই আবু বকর হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাইনি। আমরা জানতে চাই, আমার ভাই আবু বকরের খুনি কে?

লেখক: স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


আরও পড়ুন:

আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!
ঘামঝরা জীবন, রক্তে ভিজে শেষ
রক্ত যখন জেলি হয়ে যায়...