আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!

* আট মাস আগে রায় হয়েছে। কেউ জানে না।
* ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মীর সবাই খালাস।
* পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ।
* আপিলের সময়ও পার।

আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো
আবু বকর ছিদ্দিক। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। আট মাস আগে এই মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে জানানো হয়নি। বাদীর পক্ষে সরকারি কৌঁসুলি এই মামলা পরিচালনা করেন।

সব আসামি খালাস পাওয়ায় কে বা কারা আবু বকরকে খুন করেছে, এই বিচারে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হত্যাকারী চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে আপিল করার যে সুযোগ ছিল, তা-ও রাষ্ট্রপক্ষ নেয়নি। এর মধ্যে আপিলের স্বাভাবিক সময়ও পার হয়ে গেছে। ফলে নিহত ব্যক্তির পরিবার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল।

আবু বকর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান। ওই সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। আইন বিভাগের আহত ছাত্র ওমর ফারুক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।

আবু বকর ছিদ্দিকের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামে। তাঁর মৃত্যুতে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। কারণ, আবু বকর তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩.৭৫ পেয়েছিলেন। চতুর্থ সেমিস্টারের ফল বের হওয়ার আগে তিনি খুন হন। ওই বিভাগে তাঁর আগে এমন ভালো ফল কেউ করেননি। আবু বকর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময় গ্রামে গিয়ে কৃষিখেতে কাজ করতেন, প্রতিবেশীদের বাচ্চাকে পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাতেন। তাঁর বাবা রুস্তম আলী দিনমজুর। মা রাবেয়া খাতুন তিন বছর মাথায় তেল না দিয়ে সেই টাকা ছেলের পড়ার খরচ চালানোর জন্য সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

মামলায় অপরাধী শনাক্ত করতে না পারার জন্য পুলিশের দুর্বল তদন্তকে দায়ী করেছেন আদালত। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির গত বছরের ৭ মে দেওয়া রায়ে বলেছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে মাথার পেছনে শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে। কিন্তু আসামিদের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র কিংবা এর আলামত জব্দ করা হয়নি। আবু বকরের রক্তমাখা লুঙ্গিকেই পুলিশ মামলার একমাত্র আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ২২ সাক্ষীর ১১ জন সাক্ষ্য দিলেও কেউই বলেননি যে আবু বকর আসামিদের ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী প্রায় সব সাক্ষী বলেছেন, ছাত্রদের দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের আঘাতে আবু বকর মারা যান। এ তথ্য আবু বকরের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সমর্থন করে বলে রায়ে বলা হয়।

মামলাটি পুলিশের চারজন কর্মকর্তা পর্যায়ক্রমে তদন্ত করেন। অন্যতম তদন্ত কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের জবানবন্দি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ঘটনার সময় শাহবাগ থানার ওসি ২০ থেকে ২৫ জনের দল নিয়ে সেদিন এ এফ রহমান হলে যান। গন্ডগোলের সময় ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেন। মামলার এজাহারে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু বকর মারা যাওয়ার কথা থাকলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে মারা যান তিনি। আদালত বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম ঘটনাস্থল থেকে টিয়ার শেলের খোসা কিংবা ভোঁতা অস্ত্র (হার্ড ব্লান্ট ওয়েপন) জব্দ করেননি কিংবা করার চেষ্টাও করেননি।

প্রসঙ্গত, এই তদন্ত কর্মকর্তাই ওই সময় শাহবাগ থানার ওসি ছিলেন এবং আদালতে দেওয়া তাঁর জাবানবন্দি অনুযায়ী, তাঁর নেতৃত্বেই টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক এমদাদুল হকও আদালতে বলেছিলেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশ বাইরে থেকে রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছুড়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু অগ্রগতি প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, মামলার এক নম্বর আসামি সাইদুজ্জামানের গুলিতেই আবু বকর মারা যান।

মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবদুল হালিম। কিন্তু তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাননি।

মামলার বাদী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওমর ফারুক আদালতে বলেছেন, মামলা করার জন্য তিনি থানায় যাননি। কে এজাহার টাইপ করেছেন, তা-ও তিনি জানেন না। তখন তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে কথা বলেছেন।

আবু বকর হত্যা মামলার রায় পরিবার ও বাদীকে জানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। জানতে চাইলে মামলা পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, তিনি কাউকে রায় সম্পর্কে জানাননি। কারণ, কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আপিল কেন করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাদী কিংবা নিহত ব্যক্তির কোনো আত্মীয়স্বজন আপিল করার জন্য তাঁর কাছে আসেননি। তিনি জানান, এখন আপিল করার সুযোগ নেই, কারণ নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে।

আবু বকর খুনের মামলায় সব আসামি খালাসের রায়ের খবর জানানোর পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিচারিক আদালতের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে কেন আপিল করা হয়নি, তা তিনি খোঁজ নিয়ে জেনে যত দ্রুত সম্ভব আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।

টাঙ্গাইলে অবস্থানরত আবু বকরের বড় ভাই আব্বাস আলীও প্রথম আলোর কাছ থেকে রায়ের তথ্য শোনেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ের খুনের বিচার পাওয়ার আশায় ঢাকায় গিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছি। অথচ আমরা জানতেই পারিনি, রায় হয়েছে; সব আসামি খালাস পেয়েছে। সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, আবু বকরকে তাহলে কারা খুন করল? আমরা জবাব চাই।’

মামলার তদন্তের বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক এমদাদুল হক বলেন, ‘তদন্তে যেটুকু তথ্য পেয়েছি, তা আদালতে তুলে ধরেছি।’

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দও মামলার রায় হওয়ার তথ্য জানেন না। জানানোর পর তিনি বলেন, কেন সব আসামি খালাস পেয়েছেন, রায় না পড়ে বলা যাবে না। তবে তিনি জানান, অনেক পরে সিআইডি মামলার তদন্তভার পায়। শুরুতে তদন্ত করেছে থানা-পুলিশ। তাদেরই দায়িত্ব ছিল আলামত জব্দ করা। কেন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র বা অন্য প্রয়োজনীয় আলামত জব্দ করা হয়নি, তা তিনি বলতে পারবেন না।

মামলায় খালাস পাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হলেন হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুক, মফিদুল আলম খান (তপু), রকিব উদ্দিন (রফিক), মনসুর আহমেদ (রনি), আসাদুজ্জামান (জনি), আলম-ই-জুলহাস, তৌহিদুল ইসলাম খান (তুষার), আবু জাফর মো. সালাম, এনামুল হক (এরশাদ) ও মেহেদী হাসান (লিয়ন)। এঁরা সবাই ঘটনার সময় এ এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।

আসামিদের খালাস পাওয়ার বিষয়ে বাদী ওমর ফারুক বলেন, ‘প্রথম তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আমি নারাজি দিয়েছিলাম। পরে সিআইডি তদন্ত করে। কিন্তু সে তদন্তও ঠিকভাবে হয়নি।’ তিনি বলেন, খালাস পেলেও আবু বকর খুনের দায় ছাত্রলীগের এই নেতারা এড়াতে পারেন না। কারণ, ফারুক ও মেহেদী গ্রুপের ওই সংঘর্ষে আরও ৩০ জন ছাত্র আহত হয়েছিলেন। তাঁদের বিচার কোথায়? তিনি বলেন, ‘আমি বাদী যে আহত হয়েছিলাম, সেই চিকিৎসা সনদও তো পুলিশ আদালতে দেয়নি।’

মামলার প্রধান আসামি সাইদুজ্জামান ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উপস্থিতিতে রায় হয়েছে। আদালত আমাদের খালাস দিয়েছেন।’ তাহলে আবু বকরকে কারা খুন করল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ জানেন কে খুন করেছে।’

আলোচিত এই মামলায় পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষের অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, আবু বকরের খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করার দায়িত্ব পুলিশের। আদালতে তথ্য, প্রমাণসহ অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। বিচারিক আদালতের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে কেন সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তারা আপিল করলেন না, এর জবাব তাঁদের কাছে চাওয়া দরকার। আর রায়ে তদন্তে গাফিলতির কথা বলে থাকলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা দরকার।

আবু বকর খুন হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি আবু বকরের পরিবারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রাখেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের খালাস পাওয়া খুবই দুঃখজনক। আবু বকর তো খুন হয়েছিল, এই খুন কে করল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সবারই। এ বিষয়ে তিনি উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান নিহত আবু বকরের বিভাগে তাঁর সরাসরি শিক্ষক। রায়ের তথ্য শুনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিচার নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ তিনি নেবেন।

আবু বকরের মৃত্যুর ৪২ দিন পর তাঁর চতুর্থ সেমিস্টারের ফল প্রকাশ হয়েছিল। তাতে তিনি যুগ্মভাবে প্রথম হন। ‘এবার প্রথম হয়ে কাঁদালেন বকর’ শিরোনামের সেই খবর তাঁর পরিবারকে তখন আবার শোকের সাগরে ভাসিয়েছিল। শেষ সান্ত্বনার জন্য আদালতের দিকে তাকিয়ে ছিল নিঃস্ব এই পরিবার। কিন্তু গতকাল রায়ের খবরটি জানানো হলে তাদের সব আশা মাটিতে মিশে যায়।

খবর পেয়ে দুপুরে খেত থেকে বাড়ি ফিরে আবু বকরের বাবা রুস্তম আলী নিশ্চুপ বসে ছিলেন ঘরের বারান্দায়। মা রাবেয়া খাতুন ভেতর থেকে কেবল বললেন, ‘আমার নির্দোষ বাবারে যারা হত্যা করল, তাগো বিচার হইলো না! এইডা ক্যামন দেশ!’