Thank you for trying Sticky AMP!!

চীনের বিশেষ দূত আবারও নীরবে ঢাকায়

তিন মাস আগে চীনের এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত দেং সিজুন নীরবে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে যুক্ত করে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন।

চীনের এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত দেং সিজুন

এবারও অনেকটা নীরবে ঢাকায় এসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেছেন চীনের এশিয়াবিষয়ক বিশেষ দূত দেং সিজুন। আলোচনায় পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

চীনের বিশেষ দূত গতকাল সোমবার আলাদাভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

ঢাকা ও বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলো চীনের বিশেষ দূত দেং সিজুনের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে নিশ্চিত করেছে। দেং সিজুন গত রোববার তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, চীনের দূত গতকাল সোমবার প্রথমে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠক করেন। এরপর তিনি দুপুরের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। দুই আলোচনাতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রসঙ্গগুলো এলেও গুরুত্ব ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি।

মিয়ানমারের সরকারি মুখপত্র নিউ গ্লোবাল লাইট মিয়ানমার জানিয়েছে, গত শুক্রবার চীনের বিশেষ দূত দেং সিজুন মিয়ানমারের সেনাশাসক জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। ওই আলোচনায় মিয়ানমারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনের সহযোগিতার পাশাপাশি রাখাইন থেকে চলে যাওয়া ‘প্রবাসীদের’ ফেরতের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

মিয়ানমারের সরকারি এক ওয়েবসাইটের খবরে বলা হয়েছে, চীনের দূত দেং সিজুন গত শুক্রবার মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহায়তামন্ত্রী কো কো হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় তিনি মিয়ানমারের মন্ত্রীকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি রাখাইনের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে ফেরানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তার প্রসঙ্গটি তুলেছেন।

ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৯ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৯ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে

জানতে চাইলে গতকালের আলোচনায় উপস্থিত একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানান, চীনের বিশেষ দূত মিয়ানমার সফরের সময় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রসঙ্গটি তুলেছেন। মিয়ানমারও প্রত্যাবাসনে আগ্রহী বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে আগ্রহী—এমন প্রসঙ্গ টেনে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় রাখাইন পাঠানোর নীতি থেকে বাংলাদেশ সরে আসেনি। এই অবস্থান বজায় রেখে প্রত্যাবাসন হোক, এটাই বাংলাদেশের প্রত্যাশা। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছামূলক, নিরাপদ এবং টেকসই করতে হলে মিয়ানমারকে রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ ফেরাতে হবে।

গতকালের আলোচনায় চীনের বিশেষ দূতও স্বীকার করেছেন যে প্রত্যাবাসন অনুকূল এবং স্বেচ্ছামূলক হতে হবে। এখন বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার পর সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো না কোনো একটা সময়ে প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করতে হবে। বছরের পর বছর তো প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাবে না। এবার ছয় বছর পর রোহিঙ্গারা সরেজমিন রাখাইন ঘুরে এসেছে। শুরুতে রাখাইন সফরকারী দলটি প্রত্যাবাসনে আগ্রহী থাকলেও পরে তারা ফিরে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছে। আবার পশ্চিমারাও চীনের উদ্যোগে প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে আসছে। এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দেখেশুনে এ বছরের কোনো এক সময়ে প্রত্যাবাসন শুরুতে নজর দিচ্ছে।

২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল নেমেছিল, তাকে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থীর ঢল হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘ।

তিন মাস আগে চীনের এই বিশেষ দূত নীরবে ঢাকায় এসেছিলেন। গত এপ্রিলের শুরুতে তিনি পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে যুক্ত করে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি কুনমিংয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর তাগিদও দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে চীনের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।

চীনের মধ্যস্থতায় গত ১৮ এপ্রিল কুনমিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলেও বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন আলাদা করে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে। পরে তিন দেশ একসঙ্গে আলোচনায় বসে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, চলতি বছর আরও পাঁচ ধাপে প্রতিবারে ১ হাজার ২০০ জন করে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের মধ্যে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ওই বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা পর্যালোচনার জন্য আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩০০ জন করে রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা। কিন্তু মিয়ানমার এখন বলছে, তাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিন ৩০ জন করে রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে।

তবে কুনমিংয়ের বৈঠকে ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে ফেরানোর পাশাপাশি আরও ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও মৌলিক কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মতপার্থক্য দূর হয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩০০ জন করে সপ্তাহের পাঁচ দিনে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে পাঠানোর কথা। কিন্তু মিয়ানমার এখন বলছে, তাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিন ৩০ জন করে সপ্তাহের পাঁচ দিনে ১৫০ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। আর বাংলাদেশ বলছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে।

কুনমিংয়ের ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল ৫ মে রাখাইনে গিয়েছিল। কক্সবাজারে ফিরে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানান। তাঁরা বলেন, রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনোটাই নেই।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের একটি অংশের থাকার ব্যবস্থা গড়ে দেওয়া হয়েছে

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা–ঢলের মাত্র তিন মাসের মাথায় অনেকটা চীনের চাপে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছিল। ওই সময় একাধিকবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছিলেন চীনের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। নেপথ্যে চীন থাকলেও তখন বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সমঝোতা স্মারক সইয়ের সময় ওয়াং ই নেপিডোতে অবস্থান করছিলেন।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মুহূর্তে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৯ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৯ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এদের মধ্যে পুরোনো নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৬৬।

Also Read: মংডুর পরিবেশ দেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল

Also Read: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য চীনের বিশেষ মনোযোগ

Also Read: এ বছরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই: পররাষ্ট্রমন্ত্রী