Thank you for trying Sticky AMP!!

সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ, বিপাকে ছয় শতাধিক জেলে

ভোঁদড় দিয়ে নদীতে মাছ শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক জেলে। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীতে

বংশপরম্পরায় ভোঁদড় দিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে নদী-খালে মাছ শিকার করে আসছিলেন ৬৫ বছর বয়সী রবিন বিশ্বাস। তবে পাঁচ বছর আগে বন বিভাগ সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করে দিলে তিনি পড়েন বিপাকে। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো ছয় শতাধিক জেলের জীবিকায় টান পড়েছে, বেকার হয়ে পড়ে তাঁদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাঁরা ভোঁদড়গুলো না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন ভোঁদড়গুলো পর্যাপ্ত খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে।

রবিন বিশ্বাসের বর্তমানে দুটি ভোঁদড় আছে। দুটি ভোঁদড় দিয়ে তিনি কাজলা ও চিত্রা নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন। রবিনের ভাষ্য, সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরে সংসার ভালোই চলত। এখন কাজলা ও চিত্রা নদীতে ভোঁদড় দিয়ে তেমন মাছ পান না। ফলে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

রবিন বিশ্বাসের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীতীরের জেলেপাড়ায়, যা স্থানীয়ভাবে মালোপাড়া হিসেবে পরিচিত। এখানে আড়াই শ জেলে পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় অর্ধশত পরিবারের লোকজন সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করতেন। রবিন বিশ্বাস তাঁদেরই একজন। তিনি বলেন, প্রতিদিন দুটি ভোঁদড়ের মাছ লাগে দেড় থেকে দুই কেজি। নদীতে ভোঁদড় দিয়ে মাছ মেরে আর পেট চলছে না। আবার সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি পেলে বেঁচে যেতেন। ভোঁদড়গুলোও বেঁচে যেত। রবিনের স্ত্রী মিরা বিশ্বাস বলেন, সুন্দরবনে মাছ ধরার সময় সংসার ভালো চলত। এখন সংসার ঠিকমতো চলছে না।

সুন্দরবনে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ভোঁদড় নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলেরা। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীতে
নড়াইল সদর উপজেলায় ১০টি গ্রামের প্রায় ১৫০টি পরিবারের জেলেরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরতেন। প্রত্যেক পরিবারে নৌকা ছিল। মাছ ধরতে একটি নৌকায় চারজন করে মানুষের প্রয়োজন হতো। ছয় শতাধিক জেলে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাঁচ বছর আগে সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা পড়েন জীবিকার সংকটে।

ভোঁদড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্থানীয় নাম ধাইড়া বা ধেড়ে। নৌকার এক প্রান্তে ভোঁদড়ের জন্য আলাদা করে খাঁচা বানানো থাকে। মাছ ধরার সময় খাঁচার ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়। জেলেরা নৌকায় বাঁধা জাল নদীতে ফেলে জালের দুই দিক দিয়ে দুটি, তিনটি বা চারটি ভোঁদড় ছেড়ে দেন। লাঠির সঙ্গে এগুলোর শরীর দড়ি দিয়ে এমনভাবে বাঁধা থাকে, যেন ভোঁদড় ছুটে হারিয়ে না যায়। ভোঁদড় তাড়া করে ধরে মাছ খায়। এ সময় তাড়া খেয়ে মাছ পাতা জালে এসে আটকা পড়ে।

মালোপাড়ার বাসিন্দা ভবেন বিশ্বাসের ভোঁদড় আছে চারটি। চারটি ভোঁদড়কে প্রতিদিন তিন থেকে চার কেজি মাছ খেতে দিতে হয়। অথচ নদীতে তেমন মাছই পাওয়া যায় না। নিজেরা কী খাবেন, আর ভোঁদড়কে কী খেতে দেবেন? ভবেন বিশ্বাস বলেন, ‘খুব সমস্যায় আছি। সুন্দরবনে আবার মাছ ধরার অনুমতি দিলে খেয়েপরে বাঁচতে পারতাম।’

সম্প্রতি মালোপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কাজলা নদীর কাছে ছোট একটি দোকান। দোকানটি ইটের গাঁথুনি, ওপরে টিনের ছাউনি। দোকানের সামনে বসে গল্প করছিলেন জেলেপাড়ার বাসিন্দা কার্তিক বিশ্বাস, শ্রীকান্ত বিশ্বাস, প্রহ্লাদ বিশ্বাস, নিখিল বিশ্বাসসহ বেশ কয়েকজন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নড়াইল সদর উপজেলায় ১০টি গ্রামের প্রায় ১৫০টি পরিবারের জেলেরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরতেন। প্রত্যেক পরিবারে নৌকা ছিল। মাছ ধরতে একটি নৌকায় চারজন করে মানুষের প্রয়োজন হতো। ছয় শতাধিক জেলে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০১৭ সালে সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা পড়েন জীবিকার সংকটে।

Also Read: ৬০ বছর ধরে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা কার্তিক বিশ্বাসদের জীবিকার সংকট

দোকানের পাশে বেঞ্চে বসে অবসর সময় পার করছেন জেলেরা। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীর তীরের জেলেপাড়ায়

ধ্রুব বিশ্বাসের পূর্বপুরুষেরা ভোঁদড় দিয়ে সুন্দরবনের জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। ধ্রুব বিশ্বাসও পৈতৃক পেশায় এসেছেন। ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা তাঁদের শত বছরের পারিবারিক ঐতিহ্য। ধ্রুবর ভাষ্য, সুন্দরবনে মাছ ধরা বন্ধ। এখন নদীতে মাছ কমে গেছে। খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরেন অন্য জেলেরা। সারা রাত মাছ ধরে ২০০–৩০০ টাকার বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। সে জন্য অনেকে ভোঁদড় বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর ভোঁদড় আছে চারটি।

সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করায় নড়াইলের বেশির ভাগ জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন নড়াইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আমরা জেলেদের নানাভাবে সহায়তা করছি। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে গোয়াইলবাড়ি গ্রামের ৬ জেলেকে ছাগল এবং ৬ জনকে জাল দেওয়া হয়েছে।’

খুব সমস্যায় আছি। সুন্দরবনে আবার মাছ ধরার অনুমতি দিলে খেয়েপরে বাঁচতে পারতাম।’
ভবেন বিশ্বাস, জেলে
দুটি ভোঁদড়ের পরিচর্যা করছেন এক জেলে। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামে

স্থানীয় জেলে শ্যাম বিশ্বাস বলেন, তাঁদের কয়েক পুরুষ ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করেছেন। ঠাকুরদা গদাধর বিশ্বাস ও বাবা নিরাপদ বিশ্বাসের মাধ্যমে তিনি এ পেশায় আসেন। দুই শ থেকে তিন শ বছর ধরে চলছিল সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা। সুন্দরবনে মাছ ধরে বেশ টাকা আয় হতো। এখন পাস বন্ধ। নদী-খালে মাছ নেই। সারা রাত জেগে মাছ ধরেও ৩০০-৪০০ টাকার মাছ পাওয়া যায় না। বড় কষ্টে আছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ও খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার ঐতিহ্য ২০০–২৫০ বছরের। সুন্দরবনে জেলেরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরবেন, এতে সমস্যার কিছু নেই। বন বিভাগ সুন্দরবনে জেলেদের ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে, এমন বিষয় তাঁর জানা নেই। জেলেরা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরতে চাইলে তাঁদের সেই সুযোগ করে দেওয়া হবে।