৬০ বছর ধরে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা কার্তিক বিশ্বাসদের জীবিকার সংকট

বেঞ্চে বসে জেলেরা জীবন–জীবিকার সংকট নিয়ে কথা বলছিলেন। শনিবার দুপুরে নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীর তীরের জেলেপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ন। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুরসংলগ্ন জেলেপাড়ার মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন এভাবে। প্রায় একই রকম চিত্র নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীর তীরের জেলেপাড়ার, যা স্থানীয়ভাবে মালোপাড়া হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় আড়াই শ জেলে পরিবারের বসবাস।

নড়াইলের এই মালোপাড়ায় গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘর, একচিলতে পায়ে চলার পথ, কালবৈশাখীর নির্মম ছোবল, শীতের নির্দয় কামড়, রোগ–শোক আর সর্বগ্রাসী দারিদ্র্যই জেলেপাড়াবাসীর অমোচনীয় বিধিলিপি।

কাজলা নদীর একটু দূরে ছোট একটি দোকান। ইটের গাঁথুনি, ওপরে টিনের ছাউনি। দোকানের পেছনের দিকে একটি টিনের ছাপরা। ছাপরার নিচে তিনটি লম্বা কাঠের বেঞ্চ, একটি ভাঙাচোরা টেবিল। বেঞ্চ দুটির অবস্থা নড়বড়ে। গত শনিবার দুপুরে সেখানে বসে গল্প করছিলেন জেলেপাড়ার বাসিন্দা কার্তিক বিশ্বাস (৭৫), শ্রীকান্ত বিশ্বাস (৬৪), প্রহ্লাদ বিশ্বাস (৬৪), নিখিল বিশ্বাস (৬৫) ও সুনীল বিশ্বাস (৫৮)। পাশে বসে তাঁদের গল্প শুনছিলেন জেলেপাড়ার আরও ১০-১৫ তরুণ। তাঁদের গল্পে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা, সুন্দরবনে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার অনুমতি বন্ধ করে দেওয়ার পর বেকার হয়ে পড়া এবং জেলেদের জীবনযাপনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংকটের চিত্র উঠে এসেছে।

কাজলা নদীর একটু দূরে ছোট একটি দোকান। ইটের গাঁথুনি, ওপরে টিনের ছাউনি। দোকানের পেছনের দিকে একটি টিনের ছাপরা। ছাপরার নিচে তিনটি লম্বা কাঠের বেঞ্চ, একটি ভাঙাচোরা টেবিল। বেঞ্চ দুটির অবস্থা নড়বড়ে।
ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এক জেলে। শনিবার দুপুরে নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীতে
ছবি: প্রথম আলো

ভোঁদড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্থানীয় নাম ধাইড়া বা ধেড়ে। নৌকার একপ্রান্তে ভোঁদড়ের জন্য আলাদা করে খাঁচা বানানো থাকে। মাছ ধরার সময় খাঁচার ঢাকনা খুলে দেওয়া হয়। জেলেরা নৌকায় বাঁধা জাল নদীতে ফেলে জালের দুই দিক দিয়ে দুটি, তিনটি বা চারটি ভোঁদড় ছেড়ে দেন। লাঠির সঙ্গে এগুলোর শরীর দড়ি দিয়ে এমনভাবে বাঁধা থাকে, যেন ভোঁদড় ছুটে হারিয়ে না যায়। ভোঁদড় তাড়া করে ধরে মাছ খায়। এ সময় তাড়া খেয়ে মাছ পাতা জালে এসে আটকা পড়ে।

৬০ বছর ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেছেন কার্তিক বিশ্বাস। জাল বাইতে বাইতে তিনি সুন্দরবনে চলে যেতেন। প্রচুর মাছ পেতেন। ছয় মাস পর বাড়িতে ফিরতেন। ছয় মাস মাছ ধরে যা রোজগার হতো, তা দিয়ে সারা বছর ভালোই চলত। বন বিভাগ সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নদী বা খালে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় গত পাঁচ বছর তিনি আর ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেন না। তিনি ভোঁদড় বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পাশের কাজলা ও চিত্রা নদীতে সারা রাত জেগে মাছ ধরেন। কিন্তু নদীতে মাছ তেমন মেলে না। কোনো রাতে ১৫০ টাকা আবার কোনো রাতে ২০০ টাকার মাছ হয়। বয়সের ভারে এখন আর তাঁর শরীর ঠিকমতো চলে না। স্ত্রী, চার মেয়ে এবং দুই ছেলে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। চার মেয়ে ও এক ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। জমিজিরাত বলতে তিন শতক ভিটেবাড়ি। বাঁশের তৈরি ছোট একটি ঘর। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া। ছাউনি টিনের। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেখানেই তিনি থাকেন।

১০০ বছরের বেশি সময় ধরে দিয়ে আসা মাছ ধরার পাস বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এখন তাঁদের সংসার ঠিকমতো চলে না। বন বিভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মাছ ধরে অনেক জেলে পরিবার বেঁচে যাবে।
কার্তিক বিশ্বাস, জেলে
দোকানের পাশে বেঞ্চে বসে অবসর সময় পার করছেন জেলেরা। শনিবার দুপুরে নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামের কাজলা নদীর তীরের জেলেপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

কার্তিক বিশ্বাস বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ভোঁদড় দিয়ে পাশের কাজলা ও চিত্রা নদীতে মাছ ধরতাম। বড় হয়ে সুন্দরবনের ভেতরের নদী ও খালে মাছ ধরতাম। এই মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চলত। আমরা কোনো অবৈধ কাজ করিনি। সুন্দরবনের ভেতরে খালের মুখে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন কিছু মানুষ। তাঁরা বন বিভাগের কাছে অভিযোগ দেন, আমরা নাকি ভোঁদড় ধরে বিক্রি করি। এ কারণে পাঁচ বছর আগে বন বিভাগ আমাদের মাছ ধরার পাস বন্ধ করে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে দিয়ে আসা মাছ ধরার পাস বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এখন তাঁদের সংসার ঠিকমতো চলে না। বন বিভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে মাছ ধরে অনেক জেলে পরিবার বেঁচে যাবে।

মালোপাড়ার শ্রীকান্ত বিশ্বাস ৩৫ বছর ভোঁদড় দিয়ে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরেছেন। এখন তিনি ভ্যান চালিয়ে কোনো দিন ২০০ টাকা, আবার কোনো দিন ৪০০ টাকা রোজগার করেন। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। তিন শতক জমির ওপর টিনের একটি ছাপরা তুলে সেখানেই তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাস করেন। শ্রীকান্ত বিশ্বাস বলেন, ‘এখন ভ্যান চালাই। প্রতিদিন ভ্যান চালিয়ে যা পাই, তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চলে। বেশির ভাগ সময় ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে।’

দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মতো থাকে। এই সামান্য আয় দিয়ে এখন আর ঠিকমতো তাঁর সংসার চলছে না।
সুনীল বিশ্বাস, জেলে

প্রহ্লাদ বিশ্বাসের সংসারে লোকসংখ্যা পাঁচজন। ৯ শতক ভিটেবাড়ি তাঁর। সেই ভিটায় বাঁশ দিয়ে ঘর তুলেছেন। ঘরের বেড়া ও ছাউনি টিনের। একসময় বছরের প্রায় ছয় মাস ভোঁদড় দিয়ে সুন্দরবনের মধ্যের নদী ও খালে মাছ ধরতেন প্রহ্লাদ। এখন তাঁর জীবিকার সংকট। প্রহ্লাদ বিশ্বাস বাজার থেকে মাছ কিনে সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘সব দিন বাজারে মাছ কেনা যায় না। মাসে ২০ থেকে ২২ দিন মাছ কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করি। কোনো দিন ৩০০ টাকা আবার কোনো দিন ৫০০ টাকা থাকে। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। যা আয় করছি, তা দিয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। খুব কষ্টে আছি।’

সুনীল বিশ্বাসের পরিবারের সদস্য ছিল আটজন। তিনি পাঁচ মেয়ের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর জমি আছে দুই শতক। ওই জমিতে বাঁশ দিয়ে ছোট একটি ঘর করেছেন। ঘরের বেড়া ও ছাউনি টিনের। ২০ বছর তিনি সুন্দরবনের খাল ও নদীতে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেছেন। ১৫ বছর আগে তিনি মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তিনি বাজার থেকে মাছ কিনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করেন। সুনীল বলেন, কোনো দিন ১০ কেজি আবার কোনো দিন ১৫ কেজি মাছ বাজার থেকে কেনেন। এরপর মাছ পাত্রে নিয়ে সাইকেলে বেঁধে সারা দিন ধরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করেন। এতে দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মতো থাকে। এই সামান্য আয় দিয়ে এখন আর ঠিকমতো তাঁর সংসার চলছে না।

ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারে যাচ্ছেন এক জেলে। শনিবার দুপুরে নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়াইলবাড়ি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মালোপাড়ার নিখিল বিশ্বাস ২৫ বছর ধরে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরেছেন। তিন বছর ধরে তিনি বাজার থেকে মাছ কিনে সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করেন। তিন মাস ধরে অসুস্থ তিনি। টাকার অভাবে চিকিৎসক দেখাতে পারছেন না। মাছ কেনাবেচাও বন্ধ। পৌনে তিন শতক জমির ওপর ইটের দেয়ালের ঘর। টিনের ছাউনি। স্ত্রী, দুই ছেলে, তাঁদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে নয়জনের সংসার নিখিলের। তিনি বলেন, ‘যা আয়রোজগার করি, তা দিয়ে এখন আর সংসার চলছে না। শরীরও খারাপ। অসুস্থ হয়ে দেড় মাস ধরে বাড়িতে পড়ে আছি। কী খাব, আর কী দিয়ে ডাক্তার দেখাব, খুব বিপদে আছি।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন