ঈদের আগেই পদ্মা সেতুতে চলতে পারে মোটরসাইকেল
পদ্মা সেতুতে বাস-ট্রাকসহ প্রায় সব ধরনের যান চলাচল করছে। তবে বন্ধ আছে মোটরসাইকেল চলাচল। মোটরসাইকেল চালকেরা বিকল্প হিসেবে ট্রাকে করে মোটরসাইকেল পারাপার করছেন। সেতুতে মোটরসাইকেলের নির্ধারিত টোল ১০০ টাকা হলেও ট্রাকে একটি মোটরসাইকেল পার করতে খরচ হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ অবস্থায় রাজস্ব হারাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে মোটরসাইকেলচালকদের আট–দশ গুণ বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেতু কর্তৃপক্ষের এক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ–সংক্রান্ত নথিপত্র প্রস্তুত করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে। অনুমতি পেলে ঈদুল ফিতরের আগেই পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলতে পারে। মোটরসাইকেল সেতুর দুই প্রান্তের আলাদা দুটি লেন দিয়ে চলাচল করবে বলে ওই প্রকৌশলী জানিয়েছেন।
সেতু উদ্বোধনের পর প্রথম দিনে অন্তত ৪৫ হাজার যানবাহন পারাপার হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ২৭ হাজার। ওই দিন রাতে সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই তরুণ নিহত হন। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ।
অবশ্য ৬ মার্চ সচিবালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আপাতত পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলতে দেওয়া নিয়ে কোনো ভাবনা নেই।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের ওই প্রকৌশলী প্রথম আলোকে আরও বলেন, গত সপ্তাহে সেতুর নিরাপত্তা নিয়ে জাজিরার শেখ রাসেল সেনানিবাসে একটি সভা হয়েছে। ওই সভায় সেতু কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সবদিক ভেবে সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের ব্যাপারে লিখিতভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তুলে ধরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। সিদ্ধান্তটি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসবে। তাঁরা এ–সংক্রান্ত নথিপত্র প্রস্তুত করেছেন। অনুমতির জন্য আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস, নির্বাহী প্রকৌশলী, পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন সেতুতে যান চলাচল শুরু হয়। প্রথম দিনে অন্তত ৪৫ হাজার যানবাহন পারাপার হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ২৭ হাজার। ওই দিন রাতে সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই তরুণ নিহত হন। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিপাকে পড়েন মোটরসাইকেলে ঢাকায় যাতায়াত করা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের টোল প্লাজা ও সংযোগ সড়কের (সংরক্ষণ ও সার্ভিস) নির্বাহী প্রকৌশলী লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। সিদ্ধান্তটি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসবে। তাঁরা এ–সংক্রান্ত নথিপত্র প্রস্তুত করেছেন। অনুমতির জন্য আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
স্থানীয় লোকজন ও মোটরসাইকেলচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেতুতে নিষেধাজ্ঞা ও ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ার পর পদ্মা নদী পারাপারের বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন মোটরসাইকেলচালকেরা। এরই মধ্যে জাজিরার নাওডোবা এলাকার নিজাম উদ্দিন ফরাজি ও ফরিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চক্র ট্রাকে করে মোটরসাইকেল পারাপার শুরু করে। জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার এক কিলোমিটার দূরে নাওডোবা এলাকায় সেতুর সার্ভিস সড়ক থেকে ট্রাকে মোটরসাইকেল তোলা হয়। সেতু পার করে নামিয়ে দেওয়া হয় মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার কাছে খানবাড়ি এলাকায়। একইভাবে সেখান থেকে ট্রাকে মোটরসাইকেল নিয়ে নাওডোবার জমাদ্দার মোড়ে নামিয়ে দেওয়া হয়।
Also Read: দক্ষিণের পথে স্বস্তির যাত্রা
মোটরসাইকেলচালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিটি ট্রাকে ছয় থেকে আটটি মোটরসাইকেল তোলা হয়। একেকটি মোটরসাইকেলের জন্য ভাড়া নেওয়া হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। সময় ও গাড়ির আকারভেদে ভাড়ার পার্থক্য থাকে। ট্রাকে মোটরসাইকেল পারাপারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন নিজাম উদ্দিন ফরাজি ও ফরিদ উদ্দিন। তাঁরা ভাড়া বাবদ যে টাকা নেন, সেখান থেকে মোটরসাইকেলপ্রতি ৫০০ টাকা ট্রাকচালক ও মালিককে দেওয়া হয়। বাকি টাকা তাঁরা নিজেরা রাখেন।
নিজাম উদ্দিন ফরাজি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাকে মোটরসাইকেলের পদ্মা সেতু পারাপারের কাজটি তাঁদের জমি ব্যবহার করে করা হয়। ওই কাজের জন্য কয়েকজন শ্রমিক নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মজুরি দিতে হয়। যার কারণে প্রতিটি মোটরসাইকেল থেকে ৩০০ টাকা করে রাখা হয়।
যশোরের জাবেদ কায়সার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাঝেমধ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত করেন। জাবেদ কায়সার বলেন, সেতুতে মোটরসাইকেলের টোল ১০০ টাকা। আর ট্রাকে মোটরসাইকেল পার করতে লাগছে হাজার টাকার ওপরে। সেতুতে বাইক চলাচল বন্ধ রেখে তাঁদের শুধু শুধু ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকায় সংযোগ সড়কের পাশে আটটি ট্রাক রাখা। প্রতিটি ট্রাকে ছয় থেকে আটটি মোটরসাইকেল তোলা হচ্ছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বাসিন্দা সুজন শেখ ঢাকায় আইসিটি-সংক্রান্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে মাসে চারবার গ্রামে যান। সুজন শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেরি পারাপার হয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে যাতায়াত করতাম। তাতে অনেক ভোগান্তি ছিল। সেতু চালু হওয়ার পর ভেবেছিলাম ভোগান্তির দিন শেষ হবে। কিন্তু আমাদের মোটরসাইকেল নিয়ে সেতুতে ওঠা মানা। তাই বাধ্য হয়ে ট্রাকে করে বেশি টাকা খরচ করে পদ্মা সেতু পার হই।’
পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কবে নাগাদ সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি মিলবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে আলোচনা হচ্ছে। সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতুর নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কাজ করছে বলে জেনেছেন। এখন ট্রাক, ট্রলার ও লঞ্চে মোটরসাইকেল পারাপার হচ্ছে। সেখানে তেমন কোনো বিশৃঙ্খলার খবর পাননি বলে জানান।